তারাচরিত/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়া, ও, টোডায় কোন নূতন উপদ্রব নাই অবগত হইয়া, এবং, হইবারও সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া, পৃথ্বীরাজ তারাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, চলুন, আপনার প্রস্তাবানুসারে গিয়া আমরা স্বয়ং সুরতন্ মহাশয়কে যবন পরাজয়ের শুভ সংবাদ দি। তারা সম্মত হইলেন এবং পৃথ্বীরাজের সমভিব্যাহারে বেডনোরে যাত্রা করিলেন। যাইতে যাইতে পথি মধ্যে কতই কি শোভা সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। অটবী সকল কি সুন্দর শোভাই ধারণ করিয়াছে দেখিলেন। নানা প্রকার বনপুষ্প বিকসিত হইয়া সৌরভে চতুর্দ্দিক আমোদিত করিতেছে। আর বৃক্ষে বৃক্ষে কত রকমের সুদৃশ্য পক্ষী সকল কলরব করিতেছে। তাহাদের মধুর সঙ্গীত সকল কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়া শরীর জুড়াইতেছে। এইরূপ অপূর্ব্ব মনোহর পদার্থ সকল দেখিতে দেখিতে তাঁহারা বেডনোরে আসিয়া পৌঁছিলেন। তারা আসিতেছেন শুনিয়া নগরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই তাঁহাকে দেখিতে লোলুপ হইল। তারা সকলকে যথা বিহিত অভিবাদন করিয়া পৃথ্বীরাজের সহিত যাইয়া রাও সুরতনকে করযোড়ে প্রণাম করিলেন এবং যথাযথ সমর বৃত্তান্ত জয় লাভ পর্য্যন্ত সকল বর্ণন করিলেন। শুনিয়া রাজা সস্নেহে উঠিয়া উভয়ের চিবুক ধারণ করিয়া শিরঃঘ্রাণ করিলেন। পৃথ্বীরাজ গদগদ কায় হইয়া স্বীয় শিবিরে প্রতিগমন করিলেন। এদিকে মালতী শুনিলেন যে তার প্রাণ সখী রণজয়ী হইয়া আসিয়াছেন। শুনিয়া তিনি যেমন তাড়াতাড়ি আসিতেছিলেন অমনি সম্মুখে তারাকে দেখিতে পাইলেন। তারা অমনি মালতীকে প্রিয় সম্বোধন করিয়া বলিলেন সখি কোথায় যাইতেছ? এই বলিয়া দুইজনে দুইজনকে কোমল মৃণাল ভুজযুগল দ্বারা বেষ্টন করিলেন। মালতী বলিলেন অদ্য কি সুপ্রভাত হইয়াছিল যে, তোমার বদন কমল নিরীক্ষণ করিলাম। সজনি তোমার গমনাবধি আমি মৃত প্রায় ছিলাম। অদ্য মর দেহে জীবন দান পাইলাম। অদ্য জলদ জাল হইতে পূর্ণ শশধর উদয় হইল। অদ্য চাতকিনীর প্রয়াস পরিতৃপ্ত হইল। ঘন দরশনে যেমন সর্ব্বলোক আহলাদিত হয় আমি তাহার অপেক্ষা ও আহলাদিত হইলাম। সখি বলিতে কি এখন কেবল আমার মন তোমার পরিণয় প্রতীক্ষা করিতেছে। এই বলিতে বলিতে দুইজনে শয়ন গৃহাভিমুখে গমন করিলেন।
রাজাজ্ঞায় তারার বিবাহের উদ্যোগ হইতে লাগিল। নগরী উৎসবময় হইল। চতুর্দ্দিকের লোক সকল রাজকুমারী তারার পরিণয় হইবেক শুনিয়া আহলাদে ভাসমান হইয়া আসিতে লাগিল। কি ছোট কি বড়, কি ধনী কি নির্ধন, সকলেরই মুখ প্রফুল্ল কমলবৎ ভাসিতেছে। নগর এইরূপে সাজান হইল যে, দেখিয়া সকল লোক চমৎকৃত হইল, এবং, বলিতে লাগিল যে, নাই বা হইবে কেন, তারার বিবাহ। এই সকল সন্দর্শন করিতে করিতে পৃথ্বীরাজ রাজপথে পদচারণ করিতেছেন। কতই কি সুখচিন্তা বিশাল তরঙ্গমালার ন্যায় তাঁহার হৃদয়কে আপ্লুত করিতেছে। কোথাও দেখিতেছেন যে লোক সকল আমোদে উন্মত্ত হইয় গ্রাম্য সঙ্গীত দ্বারা মনকে চরিতার্থ করিতেছে। কোথাও দেখিতেছেন যে অসংখ্য শ্রুতিমধুর মনোহর বাজনা সকল বাজিয়া লোকদিগকে আমোদিত করিতেছে। কোথাও নাচ কোথাও তামাসা হইতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে পৃথ্বীরাজ ক্রমে ক্রমে রাজবাটীর সম্মুখীন হইলেন। দেখিলেন যে তারাবাই বসিয়া আছেন এবং মালতীর সহিত কি কথোপকথোন হইতেছে। মালতী বলিতেছেন সখি আপনিই এই ধরাতলে ধন্য। নারী কুল পবিত্র করিবার জন্যই বিধাতা আপনাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। আমি আপনার মধুর রূপে বা প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া বলিতেছিনা। রাজকুমারি যাহার অন্তঃকরণে এত অধিক পরিমাণে স্বদেশের রক্ষার যত্ন তিনি কি প্রশংসার পাত্রী হইতে পারেন না। সজনি আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিতেছি যে সুরতন মহাশয় তোমার উপর প্রসন্ন হইয়া তোমার মনোভীষ্ট সিদ্ধ করুন্। তারা বলিলেন সখি তুমি আমাকে ভালবাস বলিয়া কি আমাকে এত বলিতে হয়? সখি আমি তোমাকে বলিতেছি আমি এত প্রশংসার কাজ কি করিয়াছি যে আমার এত সুখ্যাতি করিতেছ? দেখ সখি এই অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ড মণ্ডলে জন্ম গ্রহণ করিয়া যাঁহারা স্ব স্ব কার্য্যের যথার্থ রূপে অনুষ্ঠান করিতে পারিয়াছেন তাঁহারই কেবল প্রশংসার পাত্র হন। দেখ দেখি সতী দাক্ষায়ণী ও সীতাদেবী যেমন নারীকুল চিরউজ্জ্বল করিয়াছেন ইতিহাসে আরও আমন কত উপমা দেখিতে পাওয়া যায়। তবে বল দেখি আমি কেমন করিয়। প্রশংসার যোগ্য পাত্রী হইলাম! এই সকল কথা পৃথ্বীরাঙ্গ অন্তরালে দণ্ডায়মান থাকিয়া শ্রবণ করিলেন। শ্রবণ করিয়া মনে মনে বলিলেন যে আহা এমন মিষ্ট শ্রুতিসুখকর বাক্য ত কখন শ্রবণ গোচর করি নাই। প্রিয়া আমার যেমন মিষ্ট ভাষিণী তেমনি বিচক্ষণ। এমন সকল কথা কি কখন অন্য রমণীতে সম্ভবে। আহা তান লয় বিশুদ্ধ কোকিলের রব আমার এমন মিষ্ট ও স্নিগ্ধকারী বলিয়া বোধ হয় না! অনেক অনেক বার চন্দ্রের জ্যোতি শরীরে লাগিয়াছে বটে কিন্তু তাহাতে আমার তেমন শরীর জুড়ায় নাই, অদ্য এই লোক ললামভূতার সর্বলোক প্রিয় বীরতাপূর্ণ বিশুদ্ধ ভাবযুক্ত মধুময় বচন শ্রবণ করিয়া, বীরকুলোচিত ও সাধুতাসঙ্গত ভঙ্গি সন্দর্শন করিয়া আমি যেমন তৃপ্তিলাভ করিলাম। তিনি হৃদয়কে বলিতে লাগিলেন, হে হৃদয় আশ্বস্ত হও; তোমার আর ব্যাকুল হইবার প্রয়োজন নাই; ঐ মনোমোহিনী তোমার আনন্দদায়িনী হইবেন সন্দেহ নাই; চক্ষু স্থির হও পলকে প্রলয় জ্ঞান করিও না, ইহার পর আর তুমি মুদ্রিত হইতে পারিবে না, সর্ব্বগুণসম্পন্না রমণী তোমার নিকটবর্ত্তিনী হইবেন। এই বলিতে বলিতে তিনি নিজ শিবিরে প্রত্যাগমন করিলেন। এদিকে নগরী উৎসবান্বিত হইতে লাগিল। অসংখ্য লোক ক্রমে ক্রমে দিগদিগন্তর হইতে আসিল। সকলেই তারার বিবাহের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। কেহ বলিতেছে যেমন উপযুক্ত পাত্র তেমনি আমাদের রাজকুমারী; আহা বিধাতা কি অপূর্ব্ব নয়ন রঞ্জনই মিলন করিয়াছিলেন; এমন না হইলে কি শোভা পাইত। আর কেহ বলিতেছে যে ওহে ভাই এমন অযুক্ত কথা গুলা কেন প্রয়োগ করিতেছ, করি মস্তকেই গজমুক্তার শোভা হইয়া থাকে, মুক্তার মালা কখন ক্রীড়াশীল বানরের গলায় শোভা পায় না; আর দেখ প্রফুল্প শতদল কথন শুষ্ক সরোবরের শোভা সম্পাদন করে না; নক্ষত্র বেষ্টিত না হইলে কি চন্দ্রমার শোভা হয়, তাহা আবার বলিতেছ কি। এইরূপে কোথাও হাস্য, কোথাও পরিহাস, কোথাও বাকবিতণ্ডা হইতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে রাজকুমারীর বিবাহের দিন নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। রাও সুরতন একবারে অপত্য মায়ায় বশীভূত হইতে লাগিলেন। ভাবিলেন কেমন করিয়া আমি তারাকে শ্বশুরগৃহে প্রেরণ করিব; আহা তারা যে আমার হৃদয়ালোক, কেমন করিয়া আমি অন্ধকারে থাকিব; আমার প্রফুল্ল কমলিনী কোথায় পাঠাইব; আমি তারাধনে না দেখিতে পাইয়া কেমন করিয়া নয়নতারা মুদ্রিত করিব। এই রকমে মহারাজ মায়ায় মুগ্ধ হইয়া অপত্য স্নেহে কতই কি হৃদয় মধ্যে আন্দোলন করিতে লাগিলেন। এদিকে তারার বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নগরী আলোকাকীর্ণ হইল। পথ ঘাট সকল পরি স্কৃত হইল। সভা রচনা হইতে লাগিল। নানা দেশীয় রাজা সকল সভায় উপস্থিত হইলেন। দেখিয়া রাও সুরতন্ মহাবীর পৃথ্বীরাজকে সভায় আনয়ন করিলেন। যখন সূর্য্যকুল প্রদীপ পৃথ্বীরাজ আসিয়া সভায় অধিবেশন করিলেন তখন সভা কি জনমনোহারিণী রূপই ধারণ করিয়াছিল। এদিকে সভাস্থ সকলেই রাজকুমারী তারার বাহিরে আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
মালতী বলিলেন সখি এস এস একবার তোমাকে মনের সাধ মিটাইয়া সাজাইয়া দিব। এই বলিয়া মালতী তাহার হস্ত ধারণ করিয়া তথা হইতে উত্তোলন করিলেন এবং মনের সাধে তারাকে সাজাইতে লাগিলেন। প্রথমে মস্তকের বীর বেশোচিত কিরীটি খুলিয়া অপূর্ব্ব বেণী বিনাইয়া দিলেন। তাহার পর যেখানে যাহা সাজিল তাহা পরাইয়া দিলেন। পরিশেষে এক মহামূল্য পট্ট বস্ত্র পরিধান করাইয়া সজল লোচনে বলিতে লাগিলেন, দেখ দেখ পুরবাসিনীগণ অদ্য আমাদের কি সুখের দিন; এরূপ জগজ্জন মনোহারিণী রাজকুমারীর অদ্য বিবাহ হইবে, আমাদের কি আনন্দের দিন উপস্থিত হইল; বলিতে পারি না সখী আজ কি নয়ন রঞ্জন রূপই ধারণ করিয়াছেন, দেখিলে মনে হয়, যেন নীল নভোমণ্ডলে সৌদামিনী খেলিতেছে। এই বলিয়া তিনি তারার হস্ত ধারণ করিয়া সভ্যস্থলে দণ্ডায়মান হইলেন। দেখিয়া সকলে একবাক্য হইয়া বলিতে লাগিল এ রূপ কল্পিত না প্রকৃত। এমন অলৌকিক রূপ রাশি আমরা কখন দর্শন করি নাই। শারদীয় চন্দ্র শোভা, বাসন্তি কুসুম বিলাস, ও মকরন্দ পূর্ণ প্রস্ফুটিত শতদলের সুস্নিগ্ধ মধুর ভাব এই রমণী রত্নে শোো পাইতেছে। এইরূপ নানা কথা সভাস্থলে সকলে আন্দোলন করিতে লাগিলেন। তাহার পর যখন রাও সুরতন কনা সম্প্রদান করেন তখন সকলে জয় জয় শব্দ কবিয়া উঠিল। মঙ্গলবাদ্য বাজিতে লাগিল। তখন সুরতন পৃথ্বীরাজের করে তারার কর সংলগ্ন করিয়া বললেন, বাবা পৃথ্বী আমি তোমাকে স্বরাজ্যের সহিত আমার নয়নতারা দান করিলাম এবং পরম দেবতাদিগের নিকট এই প্রার্থনা করি তুমি রজঃপূত কুল তিলক হইয়া বংশোচিত কীর্ত্তি লাভ কর এবং তোমরা উভয়ে দীর্ঘজীবী হইয়া পরম দাম্পত্য প্রণয়ে পরস্পর সুখী হও; আর নির্ম্মল যশের আলয় জন্মভূমি ভারতবর্ষ উজ্জ্বলকর। এই বলিবামাত্র তারা ও পৃথ্বীরাজ উভয়ে ভূতলে লুটিয়া সুরতনকে প্রণাম করিলেন।