তারাচরিত/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এদিকে যুদ্ধ যাত্রার সমুদায় অনুষ্ঠান হইলে আর কালের মধ্যেই তাঁহারা সকলেই যুদ্ধের নিমিত্ত বাহির হইলেন। আর এই পরামর্শ হইল যে মুসলমান ধর্ম্মের আদি গুরু ও প্রবর্তক মহম্মদের দৌহিত্রদিগের নিধন প্রাপ্তি দিবসীয় তিথি প্রস্তাবিত সংগ্রামের দিবস অবধারিত হউক। পাঁচশত অশ্বারোহী মহাবীর সমভিব্যাহারী হইলেন। বীর কুলচূড়ামণি পৃথ্বীরাজ যুদ্ধ যাত্রা করিলেন। শুনিয়া সকলে জয় জয় ধ্বনি করিতে লাগিল। তার রাজকুমারকে গিয়া বলিলেন যে আমিও আপনার সহকারিণী হইব। পৃথ্বীরাজ বলিলেন সুন্দরি তোমার গমনে প্রয়োজন নাই, আপনি রাজকুমারী হইয়া যুদ্ধ কষ্ট সহিতে পারিবেন না। আপনি যুদ্ধ স্থান ভয়ঙ্কর দেখিয়া ভয় পাইবেন, তাহা হইলে আর আমরা দিক্ রক্ষা করিতে সাহসী ও সমর্থ হইব না। আপনি নিশ্চিন্ত হইয়া গৃহে প্রতি গমন করুন, আমি অতি সত্বরই যুদ্ধ জয় করিয়া সেই উৎপীড়কদিগের মাথা রাও সুরতনকে উপটৌকন দিব। আপনার কোমল অঙ্গ পথের কষ্টের যোগ্য নহে। দুগ্ধ-ফেণনিভ শয্যা আপনার বাস স্থান। কেমন করিয়া সমর শয্যায় অভিলাষিণী হইতেছেন। আমি বলিতেছি আপনি কোমল কমল তুল্য স্ত্রীজাতি, কি জানি যদি রণ তুফান দীর্ঘ কাল আন্দোলিত হইতে থাকে তাহা হইলে আপনাকে রক্ষণ করা ভার হইবে। এই সকল কথা শুনিয়া তারা বাই বলিলেন, হে মহাত্মন, আমাকে নিষেধ করিবেন না, আমার মন রণ তরঙ্গে নৃত্য করিবে, আমি তাহাই ভাল বাসিব; আর যদি আমার এই ছার প্রাণ পিতার রাজ্য উদ্ধারের জন্য যায় তাহাতে আমি কিছুমাত্র ভীত নহি, কারণ যদি পিতার রাজ্যের আমা হইতে কোন কার্য্য না হইল তবে এ জীবনে আর কাজ কি? হে সদাশয়! আমাকে নিষেধ করিবেন না। যদি আমা হইতে আপনার কোন উপকার হয় তাহ হইলে আমি আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিব। এই রূপ অনেক বাক বিতণ্ডার পর তারার যাওয়াই স্থির হইল। যাত্রা কালে তারার মনে পড়িল যে প্রিয় সহচরী মালতীর নিকট বিদায় গ্রহণ করা হয় নাই। তিনি তখন তাড়া তাড়ি মালতীরে বলিতে লাগিলেন সজনি জন্মের মতন বিদায় দাও, এই দেখা শেষ দেখা আর দেখা দুর্ল্লভ হইবে, সখি এস একবার গাঢ় আলিঙ্গন করি, তোমার সুধারূপ প্রণয় পীযূষ পান করিয়া এত দিন জীবন রূপ তরু সিঞ্চাইয় রাখিয়া ছিলাম। অদ্য সেই সলিল ছাড়িয়া আমি যাইতেছি। সজনি একবার আমাকে প্রণয় সম্বোধনে আহ্বান কর, সেই সুধা পান করিয়া আমি সমরে জীবনাহুতি দিতে যাইতেছি। এই বলিয়া তারা নিস্তব্ধ হইলে, মালতী বলিলেন কেন আজ এরূপ নিষ্ঠুর বাকাবাণ হানিয়া আমার হৃদয় বিদ্ধ করিতেছ। তোমার এই হৃদয় ভেদী কথা সকল প্রয়োগ করা উচিত হয় না। তখন তারা যুদ্ধের বন্দোবস্ত আনুপূর্ব্বিক সকল বলিলেন। শুনিয়া মালতী ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলশায়িনী হইয়া মূর্চ্ছিত প্রায় হইলেন। দেখিয়া তার বলিলেন সখি এ অমন করিবার সময় নয়, এখন আমাকে সান্তনা করিতে চেষ্টা কর। তুমি অমন করিলে আমি ভগ্নোৎসাহ হইব। সজনি উঠ উঠ আমাকে আলিঙ্গন কর। তারা এই বলিলা অনেক প্রবোধ দিলে পর, মালতী নয়ন উন্মীলন করিয়া বলিলেন, আর উঠিবার শক্তি নাই, কোন শক্তিতে উঠিব বল। এই বলিয়া মালতী উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। তখন তারা আর রোদন সম্বরণ করিতে না পারিয়া মালতীর গলদেশে বাহুলতা বেষ্টন করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। পরে তারা উঠিয়া মালতীকে আলিঙ্গন করিয়া রণোন্মখে ধাবিত হইলেন। এ দিকে পৃথ্বীরাজ তারার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, দুই জনে মিলিত হইয়া টোডায় উপস্থিত হইলেন। যাইয়া দেখিলেন যে, চকে তাজিয়া অর্থাৎ মহম্মদ দৌহিত্রদিগের মৃতদেহের স্বরূপ স্থাপিত হইতেছে। দেখিয়া অশ্বারোহী সৈন্যদিগকে পশ্চাৎ রাখিয়া পৃথ্বীরাজ ও তার এবং পৃথ্বীরাজের চিরবন্ধু সেন গড়াধিপতি এই তিন জনে মছরমের তাজিয়ার সমভিব্যাহারী লোকদিগের সঙ্গী হইলেন। যে সময়ে তাহারা সেই সঙ্গে মিলিলেন তখন তাজিয়া আফগান লীল্লারাজের প্রাসাদ সন্নিহিত হইয়াছিল। অজিয়ার সমভিব্যাহারী হইবার জন্য তিনি পরিচ্ছদ পরিধান করিতেছিলেন। পরদেশী আরোহী তিনটী কে? এই প্রশ্নটা মাত্র তিনি স্বীয় পারিষদকে জিজ্ঞাসা করিলেন এমন সময় পৃথ্বীরাজ ও তারা বাইর ধনুনিঃসৃত দুই প্রবল বাণ তাঁহার বক্ষস্থল ভেদ করিয়া অবশেষে তাহাকে ধরাতলশায়ী করিল। এই আকস্মিক ঘটনা অবলোকন করিয়া আফগান দলের সকলে হা হতোস্মি বলিয়া গোলমাল করিয়া উঠিল, এবং তাহারা ইতিকর্ত্তব্য নিৰ্দ্ধারণ করিবার পূর্ব্বেই ইহাঁরা তিন জনে নগরের ধারে উপস্থিত হইলেন। হইয়া দেখিলেন যে এক প্রকাও হস্তী নগরের দ্বার রোধ করিয়া দণ্ডায়মান আছে। দেখিবামাত্রই তারা হস্তস্থিত তরবারি দ্বারা করিবরের শুণ্ড চ্ছেদন করিলেন। গজরাজ যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া পলায়ন করিল। এই অবসরে তাঁহারা সসৈন্যে নগর আক্রমণ করিলেন। দেখিয়া অধিবাসী সকলে জয় ধ্বনি করিতে লাগিল।
এইরূপ তাঁহারা নগর দখল করিলেন বটে কিন্তু তাহাতে তাহাদের সংশয়াপনোদন হইল না। কারণ অচিরকালের মধ্যে আফগান সেনা সকল সজ্জীভূত ও দল বদ্ধ হইয়া যুদ্ধাকাঙক্ষায় অগ্রসর হইল। তখন পৃথ্বীরাজ প্রভৃতি সকলে যুদ্ধ সজ্জা করিতে লাগিলেন। এই রূপে উভয় দল ক্রমে ক্রমে সন্নিহিত হইতে লাগিল। এক দিন ঊষার প্রাক্কালে দিন মণি পূর্ব্ব দিক হইতে অলক্তাক্তের ন্যায় উদয় হইতেছেন দেখিয়া কুমুদিনী নায়ক স্বীয় সকলঙ্ক কর নিকর সংযত করিয়া অস্তাচলাভিমুখী হয়েন, যখন নলিনী কুল ঈষদ্বিকাশিত হইল, কহ্লার সমূহ দলাবগুণ্ঠন অবলম্বন করিল, মৃগগণ মৃগধরের অদর্শনে আনন্দাতিশয় সহকারে বন হইতে বনান্তরে গমন করিতে লাগিল, পেচকাদির দৃষ্টি পথ অবরুদ্ধ বিলোকনে নিরীহ বিহঙ্গম সকল আপনআপন শাবক সমূহকে স্ব স্ব রবে আহার প্রদান করিয়া ভোজনানুসন্ধানে গমনোদ্যত হইল, প্রভাতানিল মন্দ মন্দ সঞ্চরণ দ্বারা জীব লোকের আনন্দ সম্পাদন করিতে লাগিল, এমন সময়ে উহাদের উভয় দলে সংগ্রাম আরম্ভ হইল। সংগ্রামের কথা কি বলিব! এমন সংগ্রাম কখন কাহারও নয়নাদর্শে দর্শিত হইয়াছে কি না সন্দেহ। যুদ্ধ স্থল কি অপূর্ব্ব ভয়ঙ্কর রূপই ধারণ করিয়াছে! দেখিলে হৃদয়ের রক্ত শুকাইয়া যায়। গজে গজে, অশ্বে অশ্বে, তীরে তীরে, ধনুতে ধনুতে, পদাতিতে পদাতিতে, যুদ্ধ হইতে লাগিল। এমনি ভয়ঙ্কর শব্দ হইতে লাগিল যে দূরবর্তী লোক সকল শুনিয়া একটা মহাভাবী বিপদ আশঙ্কা করিতে লাগিল। এক জন মহাবলশালী সৈন্যের সহিত তারার যুদ্ধের উপক্রম হইতে লাগিল। সেই বীর পুরুষ সগর্ব্ব বচনে বলিতে লাগিল, সুন্দরি আর বড় বিলম্ব নাই, এখনি পৃথ্বীরাজকে সমন ভবনে প্রেরণ করিয়া, তোমাকে লইয়া আমাদের রাজার হৃদয়ের ঈশ্বরী করিব। এই আস্ফালন বাক্য যখন তারার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল তখন তিনি বলিলেন, রে দুরাত্মন! তোর এত স্পৰ্দ্ধা যে আমাকে এমন কথা বলিস? এখনি তাহার প্রতিফল পাইবি। এই বলিয়া তারা ঘন ঘন তরবারি চালন করিতে লাগিলেন এবং এমনি নৈপুণ্য সহকারে আপনাকে শত্রু হস্ত হইতে রক্ষা করিতে লাগিলেন যে দেখিয়া সকল লোক চমৎকৃত হইল। তরবারি সন্ সন্ চালিত হইতে লাগিল। অশ্ববর তালে তালে ঘুরিতে লাগিল। এইরূপ তাহার সহিত তারার তুমুল সংগ্রাম হইল। কে যে কাহার উপর তীর নিক্ষেপ করিতেছে তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এইরূপে দুই জনের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে হইতে বীর্য্যশালিনী তারা স্বীয় হস্তস্থিত তীক্ষ্ণ তরবারি দ্বারা তাহার মস্তক ভূতলে পাতিত করিলেন। দেখিয়া সকল লোকে তারাকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল।
হেথায় তারা বাই সমরান্তে পৃথ্বীরাজের কোন সংবাদ ন। পাইয়া অতিশয় উৎকণ্ঠ সহকারে তাহাকে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শুনিলেন যে তিনি শত্রু মধ্যে বেষ্টিত হইয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতেছেন। শুনিয়া তাহার হৃদয় আল্লাদে নৃত্য করিতে লাগিল। পরিশেষে তারার কোমল হৃদয় মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ মালার ন্যায়, ঘন ঘন এই চিন্তা-উর্ম্মি উদয় হইতে লাগিল, যে কেমন করিয়া পৃথ্বীরাজ সেই অসংখ্য সৈন্য জয় করিয়া আসিবেন। এই রকম ভাবিতেছেন এমন সময়ে পৃথ্বীরাজ স্বয়ং বীরবেশে জয় পতাকা উড্ডীন করিতে করিতে আসিয়া তারাকে সম্বর্দ্ধন করিলেন এবং বলিলেন রাজকুমারি অদ্য আমার দুঃখের নিশি প্রভাত ও সুখের দিন উপস্থিত হইল। এই বলিয়া তিনি নিরস্ত হইলেন। তারা মনে মনে মহা আনন্দিত হইয়া প্রফুল্ল চিত্তে বলিলেন, বীর বর তবে আর এখানে ক্ষণ বিলম্বেব আবশ্যক হইতেছে না, চলুন যাইয়া পিতৃদেবের নিকট টোডা জয়ের সংবাদ আমরা দিইগে।
এইরূপ কথোপকথন হইতেছে এমন সময়ে তাঁহারা শুনিলেন যে লিল্লার সহোদর যুদ্ধার্থে অগ্রসর হইতেছেন। শুনিবামাত্র তাঁহারা বিদ্যুতবেগে আফগানীয় সৈন্যের সম্মুখীন হইলেন। তাঁহাদের সহকারী বীরপুরুষ সকল তাহদের পাশ্ববর্ত্তী হইল। পুনর্ব্বার ঘোরতর সংগ্রাম হইল। টোডা রাজ্য আফগাণীয় অধিকারে থাকে এই আশায় লিল্লার সহোদর যত শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ করিলেন সকলই বিফল হইল। পরিশেষে তিনিও রণভূমিতে মানবলীলা সম্বরণ করিলেন।
পৃথ্বীরাজ ও তারার যুদ্ধ জয়ের বৃত্তান্ত লিল্লার পরম বন্ধু আজমীরাধিপতি নবাব মল্লুুখাঁ, অচিরকাল মধ্যেই শুনিতে পাইলেন। শ্রবণমাত্রই অতিশয় রোষ পরবশ হইয়া বলিলেন কাফর হিন্দু বংশোদ্ভব এই ক্ষত্রিয় যুবক যুবতীকে এখনি ইহার প্রতিফল দিতে হইবে। এই বলিয়া তিনি যুদ্ধার্থ সসৈন্যে রাজধানী হইতে বহির্গত হইয়া টোডাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
এদিকে সূর্য্য সম তেজস্পুঞ্জ সূর্য্যবংশাবতংস পৃথ্বীরাজ এই সংবাদ শুনিয়া স্থির করিলেন যে, মুসলমানদিগকে আর চড়াও হইতে দেওয়া হইবে না, আজমীর রাজেই নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে। মনে মনে ইহাই স্থির করিয়া পৃথ্বীরাজ যুদ্ধসজ্জা করিতে লাগিলেন। তারার শিবিরে ঐ সংবাদ পৌঁছিল। তিনিও সজ্জিত হইয়া বীরমণ্ডলীর সমভিব্যাহারিণী হইলেন। রণ তুরঙ্গ সকল তীরবেগে গমন করিতে লাগিল। পৃথ্বীরাজ ও তারা সসৈন্যে যবন রাজ্যের সন্নিহিত হইলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে যবন শিবির আক্রমণ করিলেন। তাহাদের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম হইল। যুদ্ধে বিস্তর যবন সেনা মরিল। অবশিষ্ট দিগকে বন্দী হইতে হইল। পৃথ্বীরাজ ঐ বন্দীদিগকে সঙ্গে লইয়া, সেনা পরিবৃত হইয়া তারা সমভিব্যাহারে আজমীরের সম্মুখস্থিত গড় বিঠ্ ঠলী নামক কেল্লায় প্রবেশ করিলেন। আজমীর সম্পূর্ণ রূপে তাঁহার করতলগত হইল।