তারাচরিত/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সুরতন রায়মল দত্ত উপহার প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ ক্ষণকাল অবাক হইয়া রহিলেন। পরে সমাগত দূতকে সবিশেষ জিজ্ঞাসা করিলে দূতবর আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বর্ণন করিলেন। তাহা শুনিয়া সুরতন মনে মনে মহারাজা রায়মলকে বহুবিধ প্রশংসা করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, তাহা না হইলেই বা কেন তিনি সূর্য্যবংশের প্রদীপ হইবেন। তাঁহার ন্যায় উদারচেতা মহৎ গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি আর কুত্রাপি নয়নগোচর হয় না। আর আমি যে ক্ষত্রকুলোচিত কাজ করিয়াছি ইহা জানিতে পারিয়া যে তিনি আমাকে বেডনোরের স্বামীত্ব প্রদান করিলেন ইহাতে তাঁহার পরিণামে ভালই হইবে সন্দেহ নাই। এইরূপ নগরের সকল লোকেও তাহাকে শত শত ধন্যবাদ দিতে লাগিল এবং এই মহৎ গুণের ভূয়সী প্রশংসাধ্বনি সকল ঘরেই হইতে লাগিল।
মহারাজ রায়মলের তিন পুত্র ছিল। জ্যেষ্ঠের নাম সংগ্রামসিংহ। তিনি প্রভূত ক্ষমতাশালী ছিলেন। তাহার শৌর্য্য বীর্য্যের কথা এস্থলে লেখা বাহুল্য হইবে। দ্বিতীয়ের নাম পৃথ্বীরাজ। তৃতীয়ের নাম জয়মল। অসীম শৌর্য্যশালী পৃথ্বীরাজের সহিত সর্ব্বজ্যেষ্ঠ মহাবীর সংগ্রামসিংহের বিবাদ বিতণ্ডা ও সংগ্রাম হয়। সেই অনৈসর্গিক দ্বন্দ যুদ্ধে সংগ্রামসিংহ বিকলাঙ্গ হইয়া স্বদেশ পরিত্যাগপূর্বক কিছুকাল অজ্ঞাতবাস অবলম্বন করেন। মহারাজ রায়মল এই সকল বৃত্তান্ত অবগত হইয়া যারপর নাই অসন্তুষ্ট হন। তিনি পৃথ্বীকে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাপু হে তোমার বিস্তর বাহুবল আছে, যুবরাজ তোমার অসীম বীরত্ব প্রভাবে মাতৃভূমি পরিত্যাগ করিয়া অজ্ঞাতবাস স্বীকার করিয়াছেন। অধিক আর কি বলিব তোমার যথায় ইচ্ছা গমন কর। এখানে কষ্ট সহিয়া থাকিবার কোন প্রয়োজন নাই। স্বীয় বীরত্ব ও বাহুবল প্রভাবে অনায়াসে কালাতিপাত করিতে পারিবে”। কুমার পৃথ্বীরাজ মহারাজের এই হৃদয়ভেদী মর্ম্মপীড়ক বচনাবলি শ্রবণ করিয়া ক্ষণেক অচল প্রায় হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, যেমন অনুচিত কাজ করিয়াছি তাহার উপযুক্ত প্রতিফল অদ্য বিধাতা আমাকে দিলেন। যাহা হউক পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য্য। গমন করাই উচিত হইতেছে। রাজআজ্ঞাও অবশ্য পালনীয়া। এই ভাবিয়া পৃথ্বীরাজ রাজবাটী পরিত্যাগ করিলেন। সেই অবধি জয়মল কনিষ্ঠ পুত্র হইয়াও যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। এক্ষণে তাহার মৃত্যুর পর বৃদ্ধ বিচক্ষণ সদ্বিবেচক সচিবগণের সুপরামর্শে মহারাজ পৃথ্বীরাজকে দেশে আনাইলেন। তিনি যে সকল বীরপুরুষোচিত কীর্ত্তিকলাপ দ্বারা দিগন্তব্যাপিনী প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন তাহা মহারাজের অবিদিত ছিল না। সম্প্রতি তিনি মিনাজাতিকে পরাস্ত করিয়া গোড়ওয়ারে মিওয়ারের আধিপত্য পুনর্ব্বার সংস্থাপিত করাতে মহারাজ তাহার উপর অত্যন্ত প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছিলেন এবং তাহার পূর্ব্বকৃত সমুদায় অপরাধ মনে মনে মার্জ্জনা করিয়ছিলেন। সুতরাং তিনি মন্ত্রীরা পরামর্শ দিবা মাত্রই প্রসন্ন মনে স্নেহপূর্ণ বচন পরম্পরাপূরিত পত্র প্রেরণ করেন। পৃথ্বীরাজ পিতার সেই স্নেহময়ী মধুর কর্ণসুখদায়িনী পত্রিকা পাইয়া যেন আহলাদ সাগরে সন্তরণ করিতে লাগিলেন। তিনি মনে করিলেন পিতা যে আমাকে মনে করিয়া পত্র লিখিয়াছেন ইহাতেই আমার যথেষ্ট হইয়াছে। আমি যে দেশত্যাগী হইয়াছি, ইহাতে কি পিতার অন্তরে বজ্রের ন্যায় আঘাত লাগে নাই। তিনি কি করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ। আমি পিতৃস্নেহে এতদিন বঞ্চিত ছিলাম। উঃ পিতা মাতার স্নেহ কি অপূর্ব্ব মধুময় পদার্থ! আমি কি কঠিন! সেই স্নেহে এতদিন বঞ্চিত ছিলাম! এখন যে বিধাতা অনুগ্রহ করিয়া আমাকে সেই অসীম রত্নভাণ্ডার মিলাইয়াছেন ইহাতে তাহাকে আমার উপর প্রসন্ন বলিতে হইবে। যাহা হউক এখন পরমারাধ্য পরম দেবতা পিতার চরণ-কমল দর্শন করিয়া মন পরিতৃপ্ত করি। এই বলিয়া তিনি এক দ্রুতগামী তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া তথা হইতে বাহির হইলেন। এবং অতি শীঘ্র মিওয়ারের রাজধানীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। পৃথ্বীরাজ পিতৃসমীপে সমাগত হইবার পরেই মহারাজ জয়মলের অকীর্ত্তির কথা সকল ব্যক্ত করিলেন। করিয়া বলিলেন সেই কুলাঙ্গার পিতৃনাম কলঙ্কিত ও সূর্য্যবংশের অপ্রতিহত গৌরব স্বীয় দুশ্চরিত্র দ্বারা হীনপ্রভ করিতে উদ্যত হইয়াছিল। তাহাকে যে রাও সুরতন, এইরূপ দণ্ড দিয়াছেন তাহা তিনি যুক্তিযুক্ত কাজ করিয়াছেন সন্দেহ নাই। বৎস এখন আর তাহার অনুশোচনা করা বৃথা। তোমাকে বলিতেছি তুমি বেডনোরে গমন করিয়া বীরবংশের মর্য্যাদা রক্ষণ কর। টোডার উদ্ধার সাধন করিয়া তারার পাণিগ্রহণের অধিকারী হও। পৃথ্বীরাজ পিতার বাক্য শ্রবণ করিয়া এবং উহার অপ্রতিহত আদেশ প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে পুলকিত হইলেন। বীরত্ব প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইবেন ইহা অপেক্ষা প্রীতিকর বিষয় আর কি হইতে পারে! অতএব তিনি পিতাকে ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া তাহার অনুমতি লইয়া তথা হইতে বাহির হইলেন। বাহির হইয়া অতি শীঘ্র বেডনোরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন যে কিছুই চেনা যাইতেছে না, এবং সুরতন, যে কোথায় আছেন তাহারও কোন সন্ধান পাইতেছেন না। পরে তিনি ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতে করিতে সম্মুখে এক মনোহর পুষ্পোদ্যান দেখিতে পাইলেন। দেখিয়া ভাবিলেন যে দেখি ইহার ভিতর কোন মনুষ্য থাকে ত তাহাকে জিজ্ঞাসা করি রাও সুরতন কোথায় আছেন। এই মনে করিয়া সেই উদ্যানোন্মুখ হইলেন। আহা উদ্যানটা কি মনোহর! এমন কখন নয়ন গোচর হয় নাই। উদ্যান মধ্যে একটী মনোহর অট্টালিকা আছে। তাহাতে উদ্যান যে কি সুন্দর সাজিয়াছে তাহা বলিতে পারি না। কোথাও কলনাদী বিহঙ্গমগণ কলকল ধ্বনি করিতেছে, কোথাও কমলিনী.প্রস্ফুটিত হইয়া স্বীয় প্রিয়তম দিবাকরকে আলিঙ্গন করিতেছে ও তরুলতা সকল ফলভরে অবনত হইয়া উদ্যানের অপূর্ব্ব শোভা সম্পাদন করি তেছে, তমাল তরু শাখার উপরি কোকিল কুহু কুহু করিয়া চতুর্দি্দক আমোদিত করিতেছে, ভ্রমরগণ গুণ গুণ ধ্বনি করিতে করিতে ফুল হইতে ফুলান্তরে পরিভ্রমণ করিতেছে, গৃহপালিত জন্তু সকল শান্তভাবে চরিতেছে, দেখিতে দেখিতে পৃথ্বীরাজ সেই উদ্যান মধ্যস্থিত অট্টালিকার নিকট আসিয়া পৌঁছিলেন। শব্দ পাইয়া মালতী বলিতেছেন রাজকুমারি কোন অশ্বারূঢ় এই পথে আসিতেছেন। অশ্বের পদধ্বনি শুনা যাইতেছে। তারা বলিলেন সখি এ বিজন প্রদেশে কেন অশ্বারূঢ় আসিবেন? তবে কি আবার দুর্বৃত্ত যবন আমাদের এই অবস্থাতে উৎপীড়ন করিতে আসিতেছে? তবে চল সখি আর এস্থানে আমাদের ন্যায় সহায়হীন নারীদ্বয়ের থাকা উচিত হইতেছে না। এই বলিয়া তাঁরা তথা হইতে যেমন বাহিরে আসিবেন অমনি সেই বীরবেশধারী পৃথ্বীরাজকে সম্মুখে দেখিতে পাইলেন। পাইয়া অমনি চমকিয়া উঠিলেন। তখন পৃথ্বীরাজ বলিলেন, ভদ্রে ভয় নাই, আমি শত্রু নহি, আপনারা কেবল দয়ার বশবর্ত্তিনী হইয়া আমাকে বলিয়া দিউন যে, রাও সুরতন, এখন কোথায় আছেন। বলিয়া দিয়া আমাকে বাধিত করুন। এই কথা শুনিয়া মালতী বলিলেম হে ভগবন, আপনি কে? রাজকুমার উত্তর করিলেন ভদ্রে আমি মহারাজ রায়মলের পুত্র। মহারাজ সুরতনের রাজ্যচুতি হইবার কথা শুনিয়া আমি পিতৃ আদেশে তাঁহার সাহায্য করিতে আসিয়াছি। এই কথা বলিবামাত্র মালতী বলিলেন মহাশয় আপনি অশ্বারোহণ করুন, আমি লইয়া যাইতেছি। পৃথ্বীরাজ সুরতন সমীপে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কীর্ত্তি দেবী তাঁহার নাম পূর্ব হইতে বেডনোরে প্রচারিত করিয়া দিয়া তাঁহাকে পূর্ব্ব হইতেই পরিচিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। যাহা অবশিষ্ট ছিল তাহা ভট্টগণ ও কবিগণ পূরণ করিয়াছিলেন। পূর্ব্বে দিল্লীতে পৃথ্বীরাজ নামে এক অদ্বিতীয় শৌর্যবীর্য্যশালী রাজা রাজত্ব করিয়াছিলেন। সুতরাং ঐ নামটী ক্ষত্রিয়বংশীয় সুন্দরীদিগের নিকট এতই আদরণীয় হইয়াছিল যে, মিওয়ারের রাজপুত্র পৃথ্বীরাজ বেডনোরে আগমন করিবামাত্র তারার মন সেইদিকে পক্ষপাতী হইতে লাগিল। এদিকে সুরতন, এবং পৃথ্বীরাজের রাজ্যবিষয়ক নানা কপোপকথনের পর তাহারা স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন।
পৃথ্বীরাজের বাসস্থানের অনতিদূরেই তারার গৃহ ছিল। এক দিন পৃথ্বীরাজ কথোপকথন চ্ছলে তারার সহিত তাঁহার পরিণয়ের কথা বলিলেন। শুনিয়া তারা পিতার আদেশানুসারে পৃথ্বীরাজকে বলিলেন যদি আপনি এই প্রতিজ্ঞা করেন যে “টোডা জয় করিয়া সুরতন্ মহাশয়কে দিব নতুবা বৃথা রাজপুত নাম ধারণ করি” তাহা হইলে আমি আপনার সহধর্ম্মিণী হইতে অঙ্গীকার করিব। পৃথ্বীরাজ প্রতিজ্ঞা করিলেন। এই রূপ কথোপকথনের পর তারা আপনার আবাস গৃহে আগমন করিলেন। তারার মুখকমল অধিকতর প্রফুল্ল দেখিয়া মালতী বলিলেন সখি অদ্য আপনাকে এত আনন্দিত দেখিতেছি কেন? মেঘ চাহিতেই জল। আর যে দেখিতেছি ত্বর সহিতেছে না। আপনি যে যুবরাজের মোহন রূপরাশিতে মুগ্ধ হইয়াছেন। তারা বলিলেন সখি কি বলিলে আমি রূপে মুগ্ধ হইয়াছি! মালতী বলিলেন, আমি ত কোন অনিষ্টের কথা বলি নাই। রাজকুমারি আপনি যৌবন পদবীতে পদার্পণ করিয়াছেন, আপনার বিবাহের সময় হইয়াছে। শুনিয়া তারা বলিলেন, সখি এ পরিহাসের সময় নয়, আমি কাহারও রূপ কি মিষ্ট আলাপে পাগলিনী হই না, যাহারা শুদ্ধ তাহাতে ভুলিয়া যায় তাহারা রমণী কুলের অধম। মালতী বলিলেন সখি তোমার কথা আমার ভাল বোধ হইতেছে না। আচ্ছা বলুন দেখি সিংহের ভক্ষ্য বস্তু করি-মস্তক হইয়া থাকে, সে ছাগ মুণ্ড কখন আহার করে না। যুবরাজ যেমনি সুপাত্র আপনিও তদনুরূপ। যদি বিধাতার অনুগ্রহে আপনাদের উভয়ের মিলন হয় তবে কি অকৃত্রিম শোভাই সম্পাদন হইবে। জগতে রূপ আর মিষ্ট আলাপের চেয়ে রমণীর মন মুগ্ধকারী উপকরণ আর কি আছে। তারা বলিলেন, হাঁ তাহা সামান্য নারীতে সম্ভবে বটে। মিষ্টভাষী রূপবান পুরুষকে দেখিলে তাহারা একবারে অধৈর্য্য হইয়া পড়ে। কিন্তু সজনি যাহারা কামিনী কুলের প্রধান বলিয়া গণ্য হইয়া থাকেন তাহারা পুরুষের রূপের আদর বেশী করেন না। তাঁহারা শৌর্য্য বীর্য্য পুরুষার্থ প্রভৃতিরই বিশেষ আদর করিয়া থাকেন। তুমি কি ইতিহাসের কথা শুন নাই? অর্জ্জুন লক্ষ্য ভেদ করিয়া পাঞ্চালী রত্ন লাভ করিয়াছিলেন। পাঞ্চালী কেবল তাঁর রূপ দেখিয়া মুগ্ধ হন নাই। আর দেখ হেড়ম্বা রাক্ষসী বটে, কিন্তু তাঁর বীরত্বের উপর কত আদর ছিল। তিনি ভীমের বীরত্বের কথা শুনিয়া তাহাকে বরমালা দিয়া নিজ মহত্ত্বের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। দেখ দেখি সখি কৈ কেহইত কাহারও রূপের পক্ষপাতী হইলেন না, সকলেই শূরত্বের ও বীরত্বের গুণে বশীভূত হইয়াছেন, আমিও প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, যদি যুবরাজ এই যুদ্ধে জয়ী হইতে পারেন তাঁহাকে বরমালা প্রদান করিব। তাঁহাদের এই রূপ কথোপকথন হইতে লাগিল।