তিতাস একটি নদীর নাম/দুই/নয়া বসত

 দুই 

নয়া বসত

 চার বছর পরের কথা।

 শীতের সকালে একটা মরানদীতে অল্প জলটুকু যাই-যাই করিতেছিল। রাতের জোয়ার যে-টুকু জল ভরিয়া দিয়াছিল, ভোরের ভাঁটা তাহা টানিয়া খসাইয়া নিতেছে। স্রোত চলিয়াছে শিকারীর তীরের মতো। একটু পরেই শুখাইয়া ঠন্‌ঠনে হইয়া যাইবে। দুই বুড়ার ব্যস্ততার শেষ নাই। ডিঙ্গি নৌকায় বাঁশের মাচান পাতিতে পাতিতে একজন রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘অ গৌরা!’

 গৌরার হাতের মোটামোটা আঙ্গুলগুলি শীতে কুঁকড়াইয়া আসিতেছিল। একরাশ এলোমেলো দড়াদড়ি। তার গিট খুলিয়া ওঠা এ আঙ্গুলের সাধ্যের বাইরে। তবু খুলিতে হইবে। বারবার চেষ্টা করে, পারে না; মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠে। রোদ উঠিতে এখনো ঢের দেরি, মালসার আগুনে হাতদুটি তাতাইয়া নেওয়া দরকার। কিন্তু মালসা কোথায়।

 ‘তুই একবার যা গৌরা, বরুণ-গাছের তলাত গিয়া ডাক দে।’

 স্রোত থাকিতে নৌকা খুলিতে না পারিলে, নদীর জল নিঃশেষ হইয়া যাইবে। তখন কোমরে দড়ি বাঁধিয়া কাদার উপর দিয়া টানিয়া নিতে হইবে, আর নৌকায় কাঁধ ঠেকাইয়া ঠেলিতে হইবে।

 ওদিকের ঘাটে আরেকখানা ডিঙ্গি খুলিতেছে। সেখান হইতে ডাক আসে, ‘অ, নিত্যানন্দ দাদা, অ গৌরাঙ্গ দাদা!’

 কান পর্যন্ত ঢাকিয়া মাথায় জড়ানো নেকড়ার রাশ। দুই বুড়া শুনিতে পায় না। কাছে আসিয়া ডাকিতে দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল! কিন্তু সে নৌকাতেও মালসা নাই দেখিয়া গৌরাঙ্গ বিমর্ষ মুখে দড়ির গিঁট খোলাতে মন দিল। যত খোলে, আবার জট লাগে। মাচান পাতা শেষ করিয়া দড়ির গেরোয় দাঁড় ঢুকাইতে গিয়া নিত্যানন্দ মুখ তুলিয়া চাহিল, ‘কি রে ছিনিবাস, বেপারে যাইবি?’

 ‘হ দাদা। গাঙে মাছ পড়ছে। অখন কি না গিয়া পারি? তোমরা যাইবা না?’

 ‘যামু। আইজ না, কাইল। আইজ রাজার ঝিরে লইয়া গোকনঘাট যামু কিনা।’

 দড়ি-খোলা ও বৈঠা-বাঁধা শেষ করিয়া গৌরাঙ্গ কাঁপিতে কাঁপিতে বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। তার মুখে রাগে ও বিরক্তিতে কথা ফুটিতেছিল না। সে শুধু বিড় বিড় করিয়া ‘রাজার ঝি,’ ‘রাজার ঝি’ করিতে লাগিল। উঠানে পা দিয়া গৌরাঙ্গের যত রাগ জল হইয়া গেল।

 রাজার ঝি পা মেলিয়া বসিয়া বিলাপ করিতেছে।

 বুড়ার চোখে জল আসিয়া পড়িল। সত্যি এই দুঃখী মেয়েটাকে দুই ভাই বড় স্নেহ করে। কিন্তু তার বুকভরা কান্না জুড়াইতে তাদের বুড়া হৃদয়ের স্নেহই যথেষ্ট নয়। ছেলেটা ঘরের এক কোণে মলাটের বাক্সে তার রূপকথার রাজ্য সাজাইতেছে। কয়েকটি ছবির টুকরা, দেশলাইর খালি-বাক্স, জাল বুনিবার দুই একটা ভাঙা উপকরণ, কিছু সূতা, ছেঁড়া একখানা ভক্তিতত্ত্বসার, একটুকরা পেন্সিল। মলাটের বাক্সে সযত্নে সাজানো হইলে মাকে হাত ধরিয়া উঠাইল। রোগা, একটুকরা ছেলেটার ইচ্ছার নিকট পরাজয় মানিয়াই যেন যুবতী মা কান্না থামাইয়া উঠিয়া পড়িল। এবার যাত্রা করিবার পালা।

 ধরা গলায় গৌরাঙ্গ বলিল, ‘আর কিছু বাকি নাই ত?’

 আর একটি কাজ বাকি আছে। তারা তুলসীতলায় প্রণাম করিতে গেল।


 নৌকা কতক্ষণ স্রোতের টানে বেশ চলিল। গ্রাম্য নদী। খাল বলিলেও চলে। দুই পারে যেন ছবি আঁকা। রোদ উঠিয়াছে। দুই পারে গ্রামের পর মাঠ, তার পর গ্রাম। গ্রাম ছাড়াইয়া নৌকা চলিয়াছে।

 অনন্ত মার কোল ঘেঁসিয়া বসিয়াছিল। নৌকাতে এই প্রথম উঠিয়াছে। আজ তার আনন্দের সীমা নাই। দুই চোখে এক রাজ্যের বিস্ময়। নদীর দুইটি তীরই এত কাছে! দুইদিকেই যখন গ্রাম থাকে তখন দুইটি গ্রামই কত কাছে। গ্রাম ছাড়াইয়া যখন মাঠে পড়ে,—জমির আলের উপর ক্ষেতের লোকে তামাক টানে, লাঙ্গলে-বাঁধা গরু দুটি তার দিকে তাকায়।

 নৌকাটা এক সময়ে আটকাইয়া গেল। ভাঁটার তখন শেষ টান। সবটুকু জল শুষিয়া নিয়া স্রোতের বেগ মন্দা হইয়া পড়িয়াছে। অনেক পিছনে, নদীর মরিবার পালা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। রোগীর যেমন পা হইতে মরিতে মরিতে সবশেষে মাথায় আসিয়া শেষ মৃত্যু হয়, তাদের এ পোড়া গাঙেরও সেই দশা। যে-নৌকা যেখানে থাকে সেইখানেই আটকাইয়া থাকে।

 গৌরাঙ্গ তখন হতাশ হইয়া হালের দাঁড় খুলিয়া ফেলিল। ইহার পর যে-কাজ করিতে হইবে, শীতের দিনে তাহা একান্ত বিরক্তিকর।

 অনন্তর মা আগেই কল্‌কেতে তামাক দিয়াছিল। মালসা হইতে এইবার জ্বলন্ত টিকাটি তুলিয়া গৌরাঙ্গের দিকে হাত বাড়াইয়া দিল। হুকা হাতে করিয়া সামনের দিকে চাহিতে গৌরাঙ্গ দেখে তিতাসে পড়িতে আর বেশি দেরি নাই। এবার অনন্তর দিকে চাহিয়া তার মনে মমতা উছলিয়া উঠে। অনন্তর বড় গাঙ দেখার অত সাধ। বড় গাঙের কথা, তার বুকে মাছধরার কথা, রাত জাগার কথা, ভাসিয়া থাকার কথা, শুনিতে শুনিতে তার চোখ দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এ ছেলে বড় হইলে খুব বড় জেলে না হইয়া যায় না। তখন কি সে এই গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দের মত এই মরা নদীর হাঁটুজলে টেংড়া-পুঁটির জাল ফেলিবে! সে তখন তিতাসের অগাধ জলে ভেসাল জাল, ভৈরব জাল, ছান্দি জাল পাতিয়া বসিবে। কে জানে আরো বা’র গাঙে, মেঘনার বুকে গিয়া জগৎ-বেড়ই হয়ত ফেলিবে। তখন কি এই গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দর কথা তার মনে থাকিবে! কুড়াইয়া-পাওয়া তার মা হয়ত হইবে বড় নদীর বড় জেলের মা, সেও কি তখন অনন্তকে মনে করাইয়া দিবে যে, অনন্ত, তোর মা ডাকাতের নৌকা হইতে জলে ঝাঁপ দিয়া এক দুর্দিনের রাতে বড় নদীতে পড়িয়াছিল, তুই তখন পেটে। তোর মা মরি-বাঁচি করিয়া একটা বালুচরে উঠিয়াছিল মাত্র। আর কিছু মনে নাই। তারপর এই দুই বুড়া, তোর দুই দাদা, কোথা থেকে কোথায় নিয়া আসিল। কোথায় ভবানীপুর গ্রাম, কোথায় কি। দেখ্ অনন্ত, আ-ঘাটাতে ঘাট হয়, আ-পথে পথ হয়, আ-কুটুমে কুটুম হয়। এই দুই বুড়া যদিও কেউ না, তবু এরা সব-কিছু। এরা দুজন আমার বাপ আর খুড়া। এ দুইজনকে তুই কোনোদিন ভুলিস না।

 শীত ছাড়িয়া যাওয়ায় নিত্যানন্দ তাজা হইয়া উঠিয়াছে। প্রসন্ন মুখে বলে, ‘অনন্তরে ভাই, তুই না বড় গাঙের পাগল, ঐ দেখ্ বড় গাঙ্।’

 অনন্তর ছোট শরীর। তারপক্ষে এত দূরে থাকিতে বড় নদী দেখা সম্ভব নয়। বুড়োর বুকে-পিঠে কাপড় জড়ানো। তার উপর দিয়া টানিয়া তুলিয়া সে অনন্তকে বড় নদী দেখাইল।

 এইখান হইতে বৈঠা আচল। গৌরাঙ্গ কোমরে দড়ি বাঁধিয়া জলে নামিল। সে টানিবে। নিত্যানন্দ নামিল পিছনের দিকে। সে কাঁধ ঠেকাইয়া ঠেলিবে। নৌকা হাল্কা করিবার জন্য অনন্তকে লইয়া তার মাও তীরে নামিল। তারা বাঁক ঘুরিয়া বড় গাঙে নামাইবে।


 এইবার বড় নদী।

 অনন্ত কোল হইতে নামিয়া পড়িল। একটা নেংটি ইঁদুর বুঝি ধানক্ষেতের প্যাঁচ হইতে বাহির হইয়া রূপকথার দেশের এক নদীর পারে গিয়া দেখিল সামনে রূপার নদী। গলানো উপছানো রূপার নদী। সে তো নদী নয়, হাজার বছরের না শোনা গল্প দুই তীরের বাঁধনে পড়িয়া একদিকে বহিয়া চলিয়াছে।

 অনন্তর মুখে কথা নাই। সে নীরবে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে জলে নমস্কার করিল। তারপর মায়ের দেখাদেখি হাত পা মুখ ধুইয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল।

 মা হুঁকা জ্বালাইয়া নিত্যানন্দ বুড়ার দিকে হাত বাড়ায়। বুড়ার দিকে সে চাহিতে পারে না। চোখ ফাটিয়া জল বাহির হয়। অসহায় দুই বুড়া। দুজনেরই বৌ কোন্ যৌবন কালেই মরিয়া গিয়াছে।

 স্ফটিকস্বচ্ছ জলের দিকে অনন্ত একবার মুখ বাড়াইয়া দেখিল। জলে তার ছোট মুখের ছায়া পড়িয়াছে। তারই ভিতর দিয়া দেখা যায় জলের স্বচ্ছতা ভেদ করিয়া জাগিয়া আছে বালিময় তলদেশ। দুই একটা শামুক হাঁটিয়াছে, তার রেখা বালির বুকে আঁচড় কাটিয়াছে। ছোট ছোট বেলেমাছ সে বালিতে বুক লাগাইয়া চুপ করিয়া আছে, যেন হাত বাড়াইলেই ধরা যাইবে। একটুও নড়িবে না। আর সেই শামুক চলার দাগ, কম জল হইতে ক্রমে বেশি জলের দিকে চলিয়া গিয়াছে। জলের নীচে বালিমাটি ক্রমে ঢালু হইয়া চলিয়াছে—এখানটা স্পষ্ট দেখা যায়, ওখানটা একটু একটু করিয়া অস্পষ্ট হইয়াছে, তারপর ওখানটাতে কিছুই আর দেখা যায় না। জল ওখানে বেশি কিনা। শামুকগুলি ওখানটাতেই গিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের পায়ে চলার দাগগুলিও অদৃশ্য হইয়াছে। ওখানটাতে কি রহস্য! নামিলে পায়ে মাটি ঠেকিবে না। আরও একটু দূরে বুঝি ঐ দাঁড় দিয়াও মাটি ছোঁয়া যাইবে না। সেখানটাতে আরও কত রহস্য! কত কি যে আছে সেখানে, হাজার চেষ্টা করিলেও অনন্ত কোনোদিন দেখিতে পাইবে না। তার চোখ আবার নিকটে ফিরিয়া আসিল। বেলে বাচ্চাগুলি এখনো শুইয়া আছে। হাত দিয়া জল নাড়িতেই মাছ ক’টা চড় চড় করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। জলের উপর ভাসিয়া উঠিল না। বালিমাটিতে বুক লাগাইয়াই ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া মিলাইয়া গেল, কোথায় জলের গভীরতার দিকে, যেখানে অনন্ত অনেক কিছুর মতই তাহাদিগকেও দেখিতে পাইবে না সেখানে।

 শামুকের দাগগুলি দৃষ্টিসীমার যেখান থেকে উধাও হইয়াছে, সেখানটাতে অনন্ত আরো অনেক্ষণ চাহিয়া থাকিত, মা তাকে টানিয়া কোলের কাছে বসাইল, চুলের ভিতর আঙ্গুল চালাইবার জন্য।

 মাতাপুত্রের দিকে স্নেহদৃষ্টিতে চাহিয়া নিত্যানন্দ বলে, ‘তিতাসের জল এত ফরসা! মাছ ত এই জলে মারা পড়ে না, মারা পড়ে ঘোলা জলে। এই সংকটকালে কি খাইয়া বাঁচ্‌বি মা, আমি তাই ভাবি।’

 মাছের জো সামনে। তারজন্যে জেলেরা এখন থেকেই শক্ত জাল বোনে। তার জন্য চাই শণসূতা। সে-গাঁয় গিয়া বসিতে পারিলে এখন থেকেই সে মিহি ও মোটা দুই রকমের সূতা কাটিবে। বেচিবে। তাতে মা ছেলেতে দুর্দিন কাটাইবে।

 ‘খাই না-খাই দিন আমার যাইব, রাইত্ আমার পোহাইব। কিন্তু তোম্‌রা ত জন্মের লাগি পর হইয়া গেলা।’

 তারাও যদি এ-নদীর পারে ঘর বাঁধিত! কিন্তু জন্ম-ভিটার এমনি তাদের মায়া, বুড়া হইয়াছে, সব ছাড়িবে, তবু জন্ম-ভিটা ছাড়িবে না।

 তিতাসের জলের মতই অনন্তর মার চোখের ফরসা জল হু হু করিয়া ছুটিয়া আসিতে চায়।

 হালে দড়ি পরাইয়া নিত্যানন্দ যৌবন-বেগে দুই-তিন টান দিয়া বলিল, ‘গৌরাঙ্গসুন্দর!’

 ‘কি দাদা।’

 ‘আমার গাতিটা খুইল্যা দে। শীত পলাইছে।’

 গৌরাঙ্গসুন্দর নৌকার গলুই ধুইতেছিল। দাদার আদেশ পাইয়া তার পিঠের বড় গেরো খুলিয়া পরতে পরতে পেঁচানো কাপড়ের নিবিড় বন্ধন হইতে দাদাকে মুক্ত করিল। গাতি তাদের শীতের পোষাক।

 এবার গৌরাঙ্গসুন্দর গঙ্গামার নাম স্মরণ করিয়া লগি ঠেলিয়া নৌকা ভাসাইল।

 অনন্তকে মা আরো কাছে টানিয়া নিল। সে নীরবে মার বাহুর বেড়ায় বাঁধা পড়িল, কিন্তু তখন তার মন না ছিল মার দিকে না ছিল দাদাদের দিকে। নৌকাখানার অস্তিত্ব পর্যন্ত সে ভুলিয়া গেল। তার চোখের সামনে জাগিয়া রহিল শুধু একটা নদী। সে নদী তার সকল সত্তাকে, সারা অনুভূতিকে, লূতাতন্তুর মত টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। ভূত-ভবিষ্যত বিস্মৃত হইয়া সে এই সদাজাগ্রত মুখর বর্তমানের স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। তার প্রকৃত যাত্রা শুরু যেন হইয়াছে এইখান থেকে।


 দুপুর গড়াইয়া গেল। একটু পরেই বিকাল হইবে। অনন্তর মা সে গাঁ কোনো দিন চোখে দেখে নাই। শুধু জানে গাঁ খানা তিতাস নদীর তীরে। নদী সোজা উত্তর দিকে আসিয়া এ গায়ের গাঁ ঘেঁসিয়া পশ্চিম দিকে মোড় ঘুরিয়াছে। এক একটা গ্রামের ছায়ায় নৌকা আসিলে চমকাইয়া উঠিয়াছে, বিহ্বলের মত চাহিয়াছে, এই বুঝি সেই গাঁ। গাঁ খানা তার মনকে টানিয়াছে শুধু আজ নয়, অনন্ত যখন পেটে, তখন থেকে। অত বিস্মৃতির মাঝেও, বিপদের অত ঝড়তুফানের মাঝেও, গাঁ খানার নাম সে মনে রাখিয়াছে। আর কিছু তার মনে নাই। এই গাঁ হইতেই সে প্রবাসে গিয়াছিল। তার নামও মনে নাই, দেখিতে যেন কি রকম ছিল তাও তার মনে নাই। কতবারই বা দেখিয়াছে। সেই প্রথম দিনের দেখা! সারা অন্তর তাকে চাহিয়াছিল, কিন্তু ভাল করিয়া কি তার দিকে চাহিতে পারিয়াছে। অত লোকের সামনে গানবাজনা, হৈ চৈ, মারামারি সব কিছু মিলিয়া সেদিন তাকে মূৰ্ছিত করিয়াছিল না? সেইত তখন আমাকে তুলিয়া ধরিয়াছিল, না হইলে মাটিতে গড়াইয়া পড়িতাম, যার মারামারি করিতেছিল তাদের পায়ের তলায় পড়িয়া মরিয়া যাইতাম। মনে পড়ে যেদিন তাকে একান্তভাবে পাইলাম। আমার বড় ভয় করিতেছিল। দুরু দুরু বুকে তার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। সে আসিয়া বাহুর বাঁধনে বাঁধিয়া ভয় দূর করিল। এ যেন একটা পুতুলখেলার মত খেলা হইয়া গেল। আরো দুই একবার দেখিয়াছি; কিন্তু লোকের সামনে তার দিকে চাহিতে কেমন লজ্জা করিত, এজন্য পরিপূর্ণভাবে কি তাকে দেখিতে পারিয়াছি যে, চেহারা মনে থাকিবে! মনে পড়ে নৌকাতে যখন মাচানের তলে ছিলাম বন্দী, তার বন্ধু আসিয়া খাওয়াইত, কিন্তু সে থাকিত দূরে দূরে। বন্ধুকে সে বলিয়াছিল, আমি দেখিতে কেমন সে তা ভুলিয়াই গিয়াছে। আমার না হয় চাহিতে বাধা, তার চাহিতে বাধাটা ছিল কোথায়। এত ভোলা যার মন, সে কি এখনো দেখিলে চিনিতে পারিবে? চিনিতে পারা না পারা আমার কাছে দুইই সমান। চিনিতে পারিলে বলিবে, ডাকাতে যাকে ছুঁইয়াছে, তার সঙ্গে আমার কি সম্বন্ধ। আর চিনিতে পারিলে বলিবে, অনাথা বিধবা, তাই সম্বন্ধ জড়াইয়া ঠাঁই করিয়া লইতে চায়। সামনে পতি নাই; হাতে নোয়া কপালে সিঁদুর পরণে শাড়ি মানায় না। বাপ জোর করিয়া বিধবার বেশ পরাইয়াছে। আপত্তি করিলে বলিয়াছে, ডাকাতে যখন ধরিয়াছিল, নিশ্চয়ই কাটিয়া ফেলিয়াছে, তা না হইলে, মোহানার স্রোতের পাকে যখন পড়িয়াছিল, নৌকা কি আর ছিল, নিশ্চয়ই ডুবিয়া গিয়াছিল। আমার সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া চিরদিন আমাকে মেয়ের মত কাছে রাখিবে বুড়ার মতলব ছিল এই। প্রতিবেশীদের কাছে তখন পরিচয় দিয়াছে, এর স্বামীকে ডাকাতে মারিয়া ফেলিয়াছে; একেও মারিয়া ফেলিত, জলে ঝাঁপ দিয়া বাঁচিয়াছে। সেই থেকে বিধবার বেশ। কিন্তু সে তো বাহিরের। মনে মনে জানি সে আছে। সে ঐ গাঁয়েই আছে। কিন্তু না জানি তার নাম, না জানি তার বন্ধুর নাম।


 রোদ কড়া হইয়া উঠিয়াছে। নৌকাখানা তাতিয়া উঠিয়াছে। দুই বুড়ার শক্ত চামড়াও তাতিয়া উঠিয়াছে। অনন্তর মার স্নেহ উথলিয়া উঠিল। বার বার ইচ্ছা করিল তার শাদা কাপড়ের আঁচল দিয়া তাদের গায়ে ছায়া দেয়। কিন্তু সে অসম্ভব। একটা বালিকাবয়সী নারীর আঁচলে গা ঢাকা দেওয়ার বয়স তাদের নাই। সে-আঁচলে সে অনন্তর রোদে-তাতা ছোট শরীরখানা সূর্যের আড়াল করিল। কড়া রোদে, মায়ের মিষ্টি ছায়ার আড়ালে থাকিয়া অনন্ত কোনো এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অনেক কিছু দেখিতে পারিত, ঘুমাইয়া পড়াতে দেখিতে পারে নাই। হয়ত স্বপ্নে তাহার সবই দেখিতে পাইয়াছে।


 ঘাটে গিয়া নৌকাখানা শব্দ করিয়া ঠেকিল। চলতি নৌকা। গৌরাঙ্গ দাঁড় ঠেকাইয়া গতিরোধ করিল, কিন্তু সবটুকু গতি রুদ্ধ হইল না। মাটিতে ঠেকিয়া অবশিষ্ট গতিটুকু রুদ্ধ হইতেই নৌকাটা ঝাঁকুনি খাইল। সেই ঝাঁকুনিতে অনন্তর মার চমক ভাঙ্গিল। এতক্ষণ সেও বুঝি স্বপ্ন রাজ্যেই ছিল। এখন ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া, কাপড় চোপড় সামলাইল, অনন্তকে ডাকিয়া উঠাইল। অনন্ত জাগিয়া চোখ কচলাইয়া ঘাটখানা একবার দেখিয়া লইল। তারপর নদীর দিকে ঘাটের লোকজনের দিকে আর ঘাটের অদূরবর্তী ছায়াঢাকা গ্রামখানার দিকে চাহিয়া দেখিল। ছোট চোখের দৃষ্টি যতদূর যায়, দেখিল, একটির পর একটি করিয়া বাঁধা নৌকা। সব নৌকা একই আকারের, একই গড়নের। সারি সারি বাঁশের খুঁটি পোঁতা আছে। তারই একটির সঙ্গে একটি করিয়া নৌকা বাঁধা। নৌকার পেছনের দিকে এক একটা ছই। ছইয়ের দুই দিকই খোলা।

 দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। বেলা করিয়া যারা স্নান করিতে আসিয়াছে, ঘাটে নূতন নৌকাতে নূতন মানুষ দেখিয়া তারা কৌতূহলী চোখে চাহিয়া দেখিতেছে। অনন্তর মা এদের কাউকে চিনে না। কোনো দিন দেখে নাই। কিন্তু এরাই হইবে তার পড়শী। এদের বাড়ির পাশ দিয়াই উঠিবে তার কুটির। এদেরই সঙ্গে কাটাইতে হইবে তার সুখ দুঃখের দিনগুলি। পারে উঠিয়া দৈনন্দিন কাজেকর্মে এদেরই সঙ্গে সে মিশিয়া যাইবে। তার খুব আনন্দ হইল, এরা যেন কত আপন। তিতাসের ছোট ঢেউ তীরে আসিয়া মাথা রাখিতেছে। আমার বুকের ঢেউ বুঝি ঐ নারীদের বুকে মাথা রাখিবার জন্য উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে।

 একটা পাগলকে দুই বুড়াবুড়ি টানিতে টানিতে ঘাটের দিকে লইয়া আসিতেছে। পাগল একটা যুবক। হয়ত সুন্দরই ছিল। এখন কদাকার হইয়া গিয়াছে। হাড় দেখা দিয়াছে, চামড়ায় খড়ি উঠিতেছে। বিড়বিড় করিয়া কত কি যে বকিতেছে। বুড়াবুড়ির হাত ছাড়াইবার জন্য হুমড়ি খাইয়া পড়িতেছে। বুড়া তার শীর্ণ হাতখানা তুলিয়া গায়ের সব জোর একত্র করিয়া ঠাস-ঠাস পাগলটাকে মারিতেছে। মার খাইয়া পাগলটা ককাইয়া উঠিতেছে। কিছুতেই জলে নামিবে না। তারাও জলে না নামাইয়া ছাড়িবেনা। স্নান তাকে করাইবেই। পাগলের গায়ে এবার যেন হাতীর জোর আসিল। এক ঝট্‌কায় বুড়ার হাত ছাড়াইয়া দৌড় দিতে যাইতেছিল সে। হাতের কাছে একখণ্ড কঞ্চি পাইয়া বুড়ি সপাং সপাং করিয়া পাগলটাকে মারিল। পাগল এবার গলা ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। বুড়ার চোখেও জল আসিয়া পড়িয়াছে। বুক জোড়া নিশ্বাস ফেলিয়া সে আক্ষেপ করিতে লাগিল, ‘হায়রে বিধাতা, হায়রে উপরোল্লা, এ কি করলে, কোন্ পাপে তুই আমারে এ শাস্তি দিলে। সাধ করছিলাম জোয়ান পুতের কামাই খামু, তারে বিয়া-শাদি করামু, বউ ঘরে আনুম, নাতি কোলে নেমু। হায়রে আমার কপাল।’

 বুড়া ছেলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আর ছেলেও বাপের গলা জড়াইয়া একটানা বিলাপ করিতে করিতে জলে নামিল। কাঁদিতেছে না কেবল বুড়িটা। হয়ত তার মা। কিন্তু কি পাষাণ। সব কান্না তার শুখাইয়া গিয়া বুঝি বা জমাট বাঁধিয়াছে। সে কেবল দুই হাতে জল তুলিয়া গামছা দিয়া পাগলের দেহটা ঘসিয়া দিতেছে। ঘাটের নারীরা স্তব্ধ হইয়া দেখিতেছে। তাদের দৃষ্টিতে দরদ ঝরিয়া পড়িতেছে। কারো কারো চোখ সজল হইয়া উঠিতেছে। অনন্তর মার মনে হইল এই সকল নারীর সবাই তার আপন। এদের বুকের মধ্যে মাথা রাখিয়া সেও পাগলটার দিকে দরদভরা দৃষ্টিতে তাকায়, সেও ঘরে যাওয়ার কথা ভুলিয়া পাগলটার দিকে জলভরা চোখে চাহিয়া থাকে। ইচ্ছা হইল পাগলটার গলা জড়াইয়া ধরিয়া সেও খানিক গলা ছাড়িয়া কাঁদে।

 অনন্তর মা অনন্তকে শক্ত করিয়া বুকে চাপিয়া ধরিল।


 এ গাঁয়ে একজন নূতন বাসিন্দা আসিয়াছে, খবরটা যারাই পাইল তারাই খুশি হইল। মালোপাড়ার সবচেয়ে যে ধনী ছিল, তারই গিন্নি কালোর মা ছেলেদের বলিয়া একখানা পোড়ো ভিটি কম দামে ছাড়িয়া দিল; ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ করিয়া তার আগাছা সাফ করিল, তারপর পাড়ার পাঁচজনে মিলিয়া তার উপর একখানা ঘর তুলিয়া দিল।

 নূতন ঘরে অনন্তদিগকে রাখিয়া একদিন দুই বুড়া বিদায় হইল। বিদায় দিতে ঘাটে আসিয়া অনন্তর মা অনেকক্ষণ আত্মসম্বরণ করিয়া ছিল। ঘাটের মেয়েরা কাজ ফেলিয়া এই বিদায়দৃশ্য দেখিতেছে।

 তাদের নৌকাখানা মাঝ-নদীতে পড়িয়া আগাইয়া চলিয়াছে। এতটুকু পথ গিয়াই বুঝি দুই বুড়া শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। দাঁড় বাহিতে বাহিতে হাতের কব্জিতে তারা কি কপালের ঘাম মুছিতেছে। অনন্তর মার মনে হইল তারা ঘাম মুছিবার ছল করিয়া দুইজনেই চোখের জল মুছিতেছে।

 নৌকা আরো দূরে সরিয়া যাইতেছে। আরো আরো দূরে। অনেক ছোট দেখাইতেছে নৌকাখানাকে। মানুষ দুজনকেও এবার দেখাইতেছে অনেক অনেক ছোট। যেন দুটি শিশু—যেন চাঁদের দেশের দুটি শিশু যাত্রাগানের বুড়ার পোষাক পরিয়া নাও বাহিয়া চলিয়াছে। এ জগতের নয় তারা। কেন আসিয়াছিল—আর থাকিবে না; ক্রমেই উপরে উঠিয়া ছোট হইয়া যাইতেছে—এখনই মিলাইয়া যাইবে।

 অনন্তর মা এবার কাঁদিয়া উঠিল।

 হয়ত মাটিতে পড়িয়া লুটাইয়া কাঁদিত। এই সময়ে একজন কে আগাইয়া আসিয়া তাকে ধরিয়া ফেলিল।

 অশ্রুভরা চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখে, সে তারই সমবয়সী। তারই মত সে-জনারও বিধবার বেশ।

 পাড়ার কৌতূহলী নারীরা বলাবলি করে সে কে, কোন্ দেশে বিয়া হইয়াছিল। ছেলের বাপ কবে মরিয়াছে—ছেলে তখন পেটে, না কোলে, না হাঁটিতে শিখিয়াছে।

 কালোর মা মেজাজী মানুষ। স্বামী অনেক টাকা রাখিয়া মারা গিয়াছে। ছেলেরাও রোজগারী। পাড়ার সবাই মান্য করে। বছরে তার ঘরে পাঁচ ছ মণ শণ সূতা কাটা হয়। তাতে বড় বড় জাল বোনে, সে-জালে বড় বড় মাছ ধরে। অনেক টাকা ঘরে আসে।

 সেই কালোর মারও কৌতূহল হয়। সকালে একবার দেখিয়া গিয়াছে। বিকালেও দেখিতে আসিল। কথাটা কি করিয়া তোলা যায় ভাবিয়া না পাইয়া শুধু বলিল, ‘কি লা মা, তোর মা-আবাগি কি আমার মত?’

 ‘হ মা, ঠিক তোমার মত।’

 ‘আছে?’

 ‘জানি না ত মা।’

 ‘আ কপাল!’

 ঘর বানাইতে হাতের সম্বল ফুরাইয়া গিয়াছে। বাকি দিন কি ভাবে কাটিবে, কালোর মা চলিয়া গেলে সে তাই ভাবিতে বসে।

 কিন্তু লোকে তাকে ভাবিবার অবসর দেয় না। একটু পরেই একদল বর্ষীয়সী নারী আসিল। কালোবরণের বাড়িকে বড়বাড়ি বলে। তার বাড়ি আর এ-বাড়ির মাঝখানে একটি বাঁশের বেড়া। সেই বেড়াতে কাপড় শুখাইতে দিয়াছিল। সেখানা আনিয়া বিছাইয়া দিবে কিনা ভাবিতেছে। তারা ভাবিবার অবসর না দিয়া মাটিতেই বসিয়া পড়িল।

 একজন বলিল, ‘পান আছে মা?’

 আরেকজন বলিল, ‘তামুক খাওয়া। আছে নি হুক্কা-কল্‌কি? তামুক আছে নি?’ অনন্তর মা মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে থাকে। তার ঘরে এসবের কিছুই নাই।

 একজন কোমর হইতে সুচারু কাজ-করা একটি ছোট রঙিন থলে বাহির করিয়া হাতে হাতে পান বাটিয়া দিল। অনন্তর মাকেও একটা পান লইতে হইল। সে-নারীর দাঁতগুলি পানে কালোবর্ণ। দুই তিনটা পান গালে পুরিয়া আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা চুন লাগাইল। চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে তারই খানিকটা দাঁতে লাগাইতেছে। মুখখানা হইয়াছে টকটকে লাল। অনন্তর মা অবাক হইয়া তার দিকে চাহিয়া রহিল।

 ‘কি দেখছ্ মা, অপাক হইয়া? আমি খুব বেশি বটপাতা খাই না। আমি আর কত খাই! আমার শাশুড়িএ যা বটপাতা খাইত!’

 ‘বটপাতা?’ অনন্তর মা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল।

 সে-নারী সঙ্গিনীর দিকে ইঙ্গিত করাতে কথাটা সে বুঝাইয়া দিল, ‘তাইনের শ্বশুরের নাম পাণ্ডব। পান কইতে পারে না, পানেরে কয় বটপাতা।’

 —‘আর তামুক খাইত আমার শ্বশুর। মাথায় এক ঝাঁকড়া বাবরি চুল। যমদূতের মত চোউখ। আম্‌রা ডরাইতাম। সারিন্দা বাজাইত আর তামুক খাইত।’

 —“আর আমার নন্‌দের শাশুড়ি। জামাই আইলে তারে ঠকান চাই। পান সাজাইয়া কইত, ‘পান খাও রসিক জামাই কথা কও ঠারে, পানের জন্ম অইল কোন্ অবতারে। যদি না কইতে পার পানের জন্মকথা, ছাগল হইয়া খাও শাওড়াগাছের পাতা!’ —খাইত কোনো জামাই পান তার সামনে?”

 এসব হাসিঠাট্টার কথাতে অনন্তর মার মন বসে না। বর্ষিয়সী রঙ্গিণীরা তার মন পায় না। মনে করে এ নারী অনেক দূরের। এইত একমুঠা মেয়ে। তাকেও দলে পাইবে না! অত দেমাক!

 কিন্তু অনন্ত উহাদের মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। এরা বুঝি রূপকথার দেশের। এদের মনেমনে অনেক গল্প জমা আছে, বলিলে কোনোদিন ফুরাইবে না।

 —একজন গল্পের ঝাঁপি খুলিল, ‘আমার শ্বশুরের অনেক কিচ্ছা আছে। তুম্‌রি খেলা জানত। উঠানের দুই দিকে দুই উস্তাদ খাড়াইত। একজন মন্ত্র পইড়া সাপ চালান দিত, আরেকজন ময়ূর চালাইয়া সেই সপ্প সংহার করত। সেই মন্ত্র না জানা থাকলে মরণ। সেইজন আবার ফির্‌তি আগুন চালান দিত, অন্যজন বরুণ মন্ত্রে মেঘ নামাইয়া আগুন নিভাইত। একবার কামরূপ কামিখ্যা হইতে এক উস্তাদ বাদ্যানী আইল আমার শ্বশুরের লগে তুম্‌রি খেলতে। পর্‌থম খেলা হইল গাঁওয়ের আর এক উস্তাদের লগে। বাদ্যানী সরষার মধ্যে মন্ত্র পইড়া উস্তাদের পরাণ টিপ্যা ধর্‌ল— বাদ্যানী সরষাবান্ধা গিরোর মধ্যে টিপা দেয়, আর উস্তাদের নাক দিয়া গল্‌গল্ কইরা রক্ত পড়ে। উস্তাদ এর পাল্‌টা মন্ত্র জানত না। আমার শ্বশুর আছিল কাছেই। বাদ্যানীরে এক ধাক্কায় মাটিতে ফালাইয়া সরষা-বন্ধন খুইল্যা উস্তাদরে বাঁচাইল। বাদ্যানী রাইগ্যা আগুন। কইল, বাপের বেটা হওত, এই মারলাম ভীমরুল বাণ, বাঁচাও নিজেরে। আমার শ্বশুর ধূলাবৃষ্টি বাণে সব ভীমরুলরে কানা কইরা দিল, আর পাল্টা এমন এক বাণ মারল—বাদ্যানীর পিন্ধনের শাড়ি কেবল উপ্‌রের দিকে ওঠে, কেবল উপ্‌রের দিকে ওঠে। দুই হাতে যতই নিচের দিকে টাইন্যা রাখ্‌তে চায়, শাড়ি ততই ফরাত্ কইরা গিয়া উপ্‌রে উঠে। শেষে বাদ্যানী এক দৌড়ে তার নাওএর ভিতরে গিয়া লাজ বাঁচাইল।—’

 আর বলা হইল না। কালোর মা আসিয়া আসর ভাঙিয়া দিল। সূর্যের উদয়ে যেমন আঁধার সরিয়া যায়, কালোর মার আবির্ভাবে তেমনি গল্পবাজ নারীরা, বেলা বেশি নাই এই অজুহাতে সরিয়া পড়িল।


 বেলা কালোর মারও বেশি নাই। তিন বৌ সারারাত সূতা কাটিয়া শেষরাতে শুইয়াছিল। অল্প একটু ঘুমাইতেই কালোবরণের জালে যাওয়ার সময় হইল। ভোররাতে রোজ এরা জাল লইয়া নদীতে যায়। বেচারী বৌরা কি আর করে। স্বামীরা পাশ হইতে উঠিয়া কেউ তামাক-টিকার ডিবা, কেউ মালসা খলুই জালের পুঁটলি হাতে নিয়া বাহির হইয়া পড়ে। ততক্ষণে ফরসা হইতে থাকে। পাখ্‌পাখালির ডাক শুরু হয়। কালোর মা যতদিন বাঁচিয়া আছে এই সময়ে বৌদের উঠিতেই হইবে। সকল বাড়ির বৌদের আগে কালোর বাড়ির বৌদের স্নান করিয়া আসা চাই।

 তারপর পূবের আকাশ রাঙা করিয়া সূর্য উঠিলে তিনচারিটা পড়ো ভিটাতে জালের ঘের দিয়া আগের দিনের মাছ শুখাইতে দেওয়া চাই। কালোর মা ততক্ষণ তরুণ রোদ গায়ে লাগাইতে লাগাইতে তিতাসের পাড়ে গিয়া বাজারের ঘাটের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়ায়। রাতের জেলেদের মাছেভরা নৌকাগুলিতে বাজারের ঘাট ছাইয়া ফেলে। তার উপর শত শত বেপারি ওঠা নামা করে। সোরগোলের অন্ত থাকে না। তাদেরই একজন কালোবরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলে, তোমার মা দাঁড়াইয়া আছে। মার দাঁড়াইবার ভঙ্গিটিও রাজসিক। অল্পেতেই চেখে পড়ে। কালোবরণের ভাই এক দৌড়ে একঝাঁকা মাছ মার হাতে দিয়া যায়। বাড়িতে আনিলে পড়ে কোটার ধূম। দুই বেলার রান্নার মাছ রাখিয়া বাকি মাছ সেই জালের তলাতে রাখিয়া আসে। সারা গাঁয়ের কাক তখন মালোপাড়ায় ভিড় করে। এ পাড়ায় আসিলে কাকেদেরও বেহায়াপনা বাড়ে। মানুষের চোখে ধূলা দিয়া কি করিয়া এক ফাঁকে জালের ঘেরের ভিতর থেকেই শোয়ানো মাছ টানিয়া নেয়। কিন্তু কালোর মা সজাগ। চৌকি পাতিয়া কঞ্চি হাতে নিয়া বসে। কাকের কয়েকটা ছেঁড়াপালক দড়িতে বাঁধিয়া কঞ্চির আগাতে ঝোলায়। সেই কঞ্চি নাড়িলে কাক কাছে আসে না, কেবল দূরে থেকে কা কা করে। কয়েকটি নাতি, নাতনি আছে। ছোট ছোট টুকরিতে মুড়ি লইয়া বুড়ির কোল ঘেঁসিয়া কেউ বসে, কেউ দাঁড়ায়। যেটি হাঁটিতে পারে না, শুধু দাঁড়াইতে পারে, তার হাত ধরিয়া, অন্য হাতে কঞ্চি দোলাইয়া বুড়ি ছড়া কাটে, ‘কাউয়ার দাদী মরল, কুলা দিয়া ঢাকল, দূর হ কাউয়া দূর!’

 এই কালোর মার কাছে সময়ের দাম আছে। তার কাছে অনন্তর মা তো দুগ্ধপোষ্য। যারা বিনা কাজে সময় কাটাইতে আসিয়াছিল, তারা চলিয়া গেলে বলিল, ‘কামকাজ নাই কোনো?’

 কাজের মধ্যে ঘাটে গিয়া এক কলসি জল আনিতে হইবে। এ ছাড়া আর কি যে করিতে হইবে ভাবিয়া পায় না অনন্তর মা। অথচ করিতে হইবে অনেক কিছু। কাজ সে করিবে। কে তাকে হাতে ধরিয়া কাজ করার সন্ধান দেখাইয়া দিবে। কালোর মা কেবল কাজের তাড়া দিতে জানে, কাজের পথ দেখাইতে জানে না।


 কাজের পথ যে-জন দেখাইয়া গেল সে সুব্‌লার বৌ।

 অল্প বয়সে বিধবা। সেদিন ঘাটে সেই তাকে ধরিয়াছিল। তার সেই সমবেদনার নিঃশ্বাস এখনো অনন্তর মার চোখে মুখে বুকে লাগিয়া আছে।

সুবলার বৌ এ কয়দিন কেবল উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। একা থাকিলে দেখে মুখখানা ভার; গোমরা মুখের সঙ্গে ভাব করিতে যাওয়া নিরর্থক। যখন কাছে মানুষ থাকে, তখন মানুষ বলিতে ঐ কালোর মা। সুবলার বউ এই কালোর মাকেই সহিতে পারে না।

 হরিণী যেমন নিজের কস্তুরীর গন্ধ অনুভব করে, সুবলার বউয়ের আবির্ভাবও অনন্তর মা তেমনি করিয়া অনুভব করিল। জেলে রমণীর ঘরে থাকিবে কাটা আ-কাটা সূতা, এক আধখানা অসমাপ্ত জাল, আর সূতাকাটার জালবোনার নানা কিসিমের সরঞ্জাম। এই যদি না রহিল তো জেলেনীর ঘরে আর কায়স্থানীর ঘরে তফাৎ রহিল কোথায়। ঘটিবাটিগুলিও দুই দিন মাজা হয় নাই, তাও তার দৃষ্টি এড়াইল না। মনেমনে সুবলার বউ বলিল, এর আলসেমি দুইদিনেই ভাঙ্গিতে হইবে। তার মাথার চুলে দেবদুর্লভ অজস্রতা। সাধ হয় খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। মুখখানা মলিন। তবু সুন্দর। চিবুক ধরিয়া নাড়িয়া দিলে বেশ হইত। সুন্দর চোখ দুইটি শুভদৃষ্টির সময় কার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল! কেমন না জানি ছিল সে জন। কিন্তু সে তো আর নাই। এও তো আমারি মত বিধবা।

 ‘ছাওয়ালের বাপ কবে স্বগ্‌গে গেল দিদি!’

 ‘জানি না।’

 ‘বলি, মারা গেছে ত?’

 ‘জানি না।’

 ‘বিয়া হইছিল কোন্ গাঁয়ে?’

 ‘জানি না।’

 ‘আমি কই, বিয়া একটা হইছিল ত?’

 ‘জানি না দিদি।’

 সুবলার বউ না চটিয়া পারিল না, ‘পোড়া কপাল! কই, এই ছাওয়ালটা হইছে বিয়া হইয়া ত?’

 মনে মনে খানিক ভাবিয়া নিয়া এবারও আগের মতই জবাব দিল, ‘জানি না ত দিদি।’

 খালি জানি না, জানি না, জানি না। তুমি কি দিদি কিছুই জান না!—না কি জিভে কামড় শিরে হাত, কেম্‌নে আইল জগন্নাথ? আস্‌মান থাইক্যা হইছে বুঝি।’

 অনন্তর মা অপমানে মরিয়া যাইতে থাকে।

 ‘ঘরখান যেন শূদ্রাণীর মন্দির। না আছে এক বোন্দা সূতা, না আছে একখান তক্‌লি। নিজে যেমন ফুল-বামনি,—’

 ‘সূতা পাওয়া যাইব আইজ দুপুরে। ঐ বাড়ির বউঠাক্‌রাইনে দিবে।’

 ‘ও, কালোর মা? দর কত?’

 ‘জানি না। ধারে দিবে।’

 সুবলার বউ গম্ভীর হইয়া গেল। এইত জগৎবেড় ফেলিয়াছে। এ দিকে রাঘব-বোয়াল আছে মনের আনন্দে।

 ‘ভাল মানুষের হাতেই পড়ছ দিদি!’

 ‘দিদি তুমি কি যে কও। কি সোনার মানুষ গো দিদি। কত আদর করে আমারে আর অনন্তরে।’

 সুবলার বউ মনে মনে হাসে।

 ‘তুমি তারে সন্দে কর কেনে?’

 ‘সন্দে করি কেনে? আমার অন্তরে বড় জ্বালা দিয়া রাখ্‌ছে। এমন জ্বালা, যা কইবার উপায় নাই, দেখাইবার সাধ্য নাই।’

 ‘বুঝলাম।’

 বাপের ঘরে এক নাল সূতা কাটিতে হয় নাই। শিখিবারও সুযোগ পায় নাই কোনোদিন। দশ শের সূতা লইয়া সে অথৈ জলে পড়িল।

 দুপুরের পরে সুবলার বউ কতকগুলি সূতা কাটার হাতিয়ার লইয়া হাজির হইল। সেগুলি মাটিতে নামাইয়া বলিল, ‘এই নেও বড় টাকু, মোটা সূতার লাগি, এই নেও ছোট টাকু, চিকন সূতার। আর এই একখানা পিঁড়ি দিলাম, ঘাটে গিয়া শণের লাছি এর উপরে আছড়াইয়া ধুইয়া আনবা। তার পর রইদে শুখাইবা। রাইতে আইয়া সব শিখাইয়া দিমু।’

 অনন্তর মা’র প্রথম চেষ্টার ফল দেখিয়া সুবলার বউ হাসিয়া খুন। বলে, ‘আমার দিদি কাটুনি সূতা কাটতে পারে, একনাল সূতায় হস্তী বান্ধা পড়ে।’

 দ্বিতীয় দিনের ফল দেখিয়া খুশি হইয়া বলিল, ‘এইবার কাট চিকন সূতা ছোট টাকু লইয়া।’

 সাত দিনে চৌদ্দ ‘নিড়ি’ সূতা হইল। সাতটা মোটা সূতার, সাতটা সরু সূতার। মোটা এক টাকা ও সরু দুই টাকা সের দরে একদিন কৈবর্ত পাড়ার লোক আসিয়া পরমাদরে কিনিয়া নিল।

 সূতা বিক্রির পর কালোর মা আসিয়া বসিল, বলিল, ‘পোড়া চৌখের জ্বালায় বাঁচি না। বাওচণ্ডীর মত বাইর হইয়া গেল মানুষটা কে গ মা, কে?’

 ‘নাম ত জানি না মা। খালি মুখ চিনা। ঐ যে সূতা আনতে গেছলাম—’

 ‘ও, চিন্‌ছি। সুবলার বউ। সুবলা নাই, তার বউ আছে। আগে ডাকত বাসন্তী। আমি ডাকতাম রামদাস্যার ভাগ্‌নি। আমার ছোট পুতের সাথে বিয়ার কথা হইছিল, সেই বিয়া হইল গগনের পুত সুবলার সাথে। সেই সুবলা মরল। ছেমড়ি তার নামের জয়ঢাক হইয়া রইল। অখন ছোট বড় সগলেই ডাকে সুবলার-বউ।’

 ‘আপ্‌নের ছোট ছাওয়ালের সাথে কথাবার্তা ঠিক হইয়া গেছল বুঝি?’

 ‘হমা। তারও আগে হওনের কথা আছিল, রামকেশবের ঘরের কিশোরের সাথে। যে কিশোর অখন পাগল হইয়া বনে বনে ফিরে।’


 দুপুরে মঙ্গলার বউ বাসন লইয়া ঘাটে যাইবার সময়, পাশের রাস্ত দিয়া না গিয়া, অনন্তর মার উঠান দিয়া গেল এবং ঘরের দিকে উঁকি মারিয়া দেখিল। ফিরিবার সময়েও তেমনিভাবে ঘরের দিকে চাহিতে, ঘর হইতে সুবলার বউ ডাকিয়া বলিল, ‘অ মহনের মা, আজ যে দেখি আ-ঘাটাতে চন্দ্র উদয়।’

 মঙ্গলার বৌ বিরক্ত হইল। সুবলার বউ যে উহাকে দিন-রাত আগলাইয়া রাখে ইহা ভাল লাগে না। একদণ্ড একা পাইবার যো নাই।

 বিরক্তি মানুষকে অনেক সময় নির্মম করিয়া তোলে। মঙ্গলার বউ একটু আগাইয়া ছাঁইচের তলায় আসিয়া এক-পা বারান্দার উপরে আর এক-পা নিচে রাখিয়া ঝুঁকিয়া পড়িল। তারপর হাতের তালুতে গাল ঠেকাইয়া বলার কথাটাকে গুরুত্বপূর্ণ করিয়া তুলিল, ‘কি লা সুবলার বৌ, আজ নগরে বাজারে কি সমস্ত কথাবার্তা শুনা যাইতাছে।’

 ‘কি সমস্ত কথাবার্তা?’

 ‘দশের বিচারের মধ্যে নাকি তার কথাখান ‘উদার্‌চন’ হইব।’

 ‘কার কথা গো, আ মহনের মা, কার কথা!’

 ‘ছাওয়ালের মার।’ মঙ্গলার বৌর কণ্ঠে শ্লেষ।

 সুবলার বউ কথা না বাড়াইয়া তার ভুল শোধরাইয়া দিল, ‘দশজনের বিচারে তার কথা উঠব কেনে গো! সে কি কে’উর ‘বাপেন ধন সাপরে’ দিয়া খাওয়াইছে, না পথের মানুষ ডাইক্যা আন্‌ছে যে দশজন তার বিচার করব! ভাল কইরা না শুইন্যা তোম্‌রার মত উপর-ভাসা আমি কোনো কথা কই না, মহনের মা।’

 সুবলার বউ সত্যই এত সহজে থামিল না, রাত্রের বৈঠকের সকল কথাই সে বলিয়া রাখিল—মাতব্বরেরা সকলে এতদিন বাড়িতে ছিল না। কেউ গিয়াছিল উত্তরে, বেপার করিতে; কেউ গিয়াছিল উজানে ধান কিনিতে, কারো হইয়াছিল জ্বর। এখন সব লোক গাঁয়ে আসিয়াছে। যার শরীর ভাল ছিল না তার শরীর ভাল হইয়াছে। গাঁখানা লোকজনে থমথম করিতেছে। সামাজিক বৈঠক হওয়ার এইত সময়। কত কথা জমিয়া আছে। কত লোকের নামে আচার-বিচার বাকি আছে। কালীপূজা সম্বন্ধে, গাঙের মাথট সম্বন্ধে, কথা তুলিবার আছে। সব কথার শেষে অনন্তর মারও একখান কথা উঠিতে পারে—সে সমাজ করিবে কার সঙ্গে,—তোমার সঙ্গে, না আমার সঙ্গে, না কালোর মার সঙ্গে।

 সুবলার বৌয়ের কথার তোড়ে মঙ্গলার বৌ ভাসিয়া গেল।

 কিন্তু অনন্তর মার ভয় করিতে লাগিল। দশজনের মধ্যে কথা উঠিবে ভাবিতে বুক দুরদুর করে। নূতন গাঁয়ে নূতন মানুষ হইয়া আসার এমন ঝক্‌মারি।

 সন্ধ্যার অল্প আগে দুইটি ছেলে বাড়িবাড়ি নিমন্ত্রণ করিতে আসিল। ছেলে দুটি পাড়ার এক প্রান্ত হইতে শুরু করিয়া প্রত্যেক বাড়িতে বলিয়া গেল, ‘ঠাকুর সকল, ঘরে নি আছ, আমার একখান কথা। ভারতের বাড়িতে আজ দশজনের সভা। তোম্‌রার নিমন্ত্রণ। পান তামুক খাইবা, দশজনের দশ কথা শুনবা।’

 বাঁধা কথা। অনন্তর মাও বাদ পড়িল না। বিশেষত বৈঠকের সঙ্গে যার মামলা জড়ানো থাকে, ঘোষক জনগণের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে জানাইবে ইহাই নিয়ম।


 অনন্তর মা এক কিছুতেই যাইত না। সুবলার বউ তাকে টানিয়া বাহির করিল।

 তারা যখন ভারতের বাড়ি উপস্থিত হইল, বৈঠক তখন পুরাপুরি জমিয়া গিয়াছে।

 ভারতের বাড়ির উঠান খুব প্রশস্ত। চারদিকের ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর। মাঝখানে উঠান উঁচু। কিছুদিন আগে এ উঠান অত প্রশস্ত ছিল না। ভারতের শুঁটকির কারবার। উঠানের মাঝখানে গভীর গর্ত খুঁড়িয়া নয় মাস আগে শুঁটকির খাদ দিয়াছিল। এখন চড়াবাজারে সেই শুঁটকি তুলিয়া পাইকারী দরে বেচিয়া ফেলিয়াছে। খাদ ভাঙ্গিয়া উঠান সমান করিয়াছে, কিন্তু গর্ত বুজানোর পরও উদ্বৃত্ত মাটি থাকিয়া যাওয়াতে উঠানটা গরবিনীর মত বুক টান করিয়া রাখিয়াছে।

 মেয়েরা যেখানে রাঁধে, ধান সিদ্ধ করে, মুড়ি-চিড়া করে, মাথায় তেল দেয়, উকুন বাছিয়া দেয় পরস্পরের, সেখানটাতে একটা আবদ্ধ বেড়া। তার ভিতর থেকে তারা উঠানের সবাইকে দেখিতে পায়, উঠান হইতে কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পায় না। সেখানে বসিয়াছে মেয়েরা।

 উঠান জুড়িয়া পাল খাটানো। মাঝখানে উত্তম বিছানায় বসিয়াছে পাড়ার গণ্যমান্য লোক কয়জনা। তাদের সবাই বড়—কেউ টাকার জোরে, কেউ গায়ের জোরে ভাইয়ের জোরে, কেউ বুদ্ধির জোরে। তবে যাদের বিচারবুদ্ধি বা উপস্থিত বুদ্ধি কিংবা কথার প্যাঁচ খাটানোর প্রতিভা আছে, সকল বৈঠকেই তাদের প্রাধান্য। এই শ্রেণীর কেউ যদি ভ্রাতৃ ও অর্থবলে বলীয়ান হয়, তার কথার উপর কথা বলার সাহস কম লোকেরই হইয়া থাকে। এমনই যে ব্যক্তিটি মাঝখানে বসিয়া আছে, তার চোখমুখের চেহারা ও বসিবার ভঙ্গি অনন্তর মা’র দৃষ্টি প্রথমেই আকর্ষণ করিল।

 সুবলার বউ বুঝাইয়া দিল, ‘এইজনেরেই কয় বড়-মাতব্বর।’ কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, ‘নাম রামপস্‌সাদ।’

 শিবের মতন চোখ, মণিগোঁসাইর মতন দাড়ি, এ-জনেরে দেইখ্যা, আমার জেঠার কথা মনে পড়ে ভইন। কোন্ দিক দিয়া বাড়ি।’

 ‘এ গাওয়ে থাকে না। কালোর বাপের সাথে বিবাদ কইরা দশবচ্ছর আগে ঘরদুয়ার লইয়া যাত্রাবাড়ি গেছে। ঘাটে গেলে তিতাসের বাঁকে যে মঠ দেখা যায় তারই পরে কুড়ুলিয়া খাল। খালের ঐ পারের গাওয়ের নাম যাত্রাবাড়ি। সেই গাওয়ে আর মালো নাই, খালি কৈবর্তরা থাকে।’

 তাঁর পরেই যিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাঁর চোখমুখ দুর্বাসার মত ক্রোধারক্ত। বয়স হইলেও যুবকের মত সটান।

 —বড় মাতব্বরের পরেই এজনের কথা গ্রাহ্য হয়। কায়েত পাড়ায় যাত্রার দল হয়, তাতে তিনি মুনি-ঋষির পাঠ করেন। কৌপীন পরিয়া নামাবলি গায়ে দিয়া খড়ম পায়ে তিনি যখন আসরে ঢোকেন, ভয়ে তখন কারো মুখ দিয়া কথা ফোটে না। পৈতা ধরিয়া যখন রাজাকে অভিশাপ দিবার জন্য গর্জন করিতে করিতে সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন, তখন আসরের চারিপাশের গরীব লোকগুলি তো দূরের কথা, অমন যে রাজা, হাতে তলোয়ার গায়ে ঝক্‌মক্ করা পোষাক, সেও থর-থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁর পায়ের কাছে নত হয়। এমন তেজ এই জনের। নাম দয়ালচাঁদ।

 জানিবার ও বুঝিবার মত আরো কয়েকজন এই দলে ছিল। সময় অল্প। দুই-এক কথাতে সুবলার বৌ দুইএকজনের পরিচয় দিল। এই জনের নাম নিতাইকিশোর। ঘুষ খাইয়া পেট মোটা করিয়াছে, কিন্তু চালে এক মুঠা ছন নাই। আর এই যে কানামানুষ, তিনি লোকের বিচার করিতে গিয়া ‘শ্বশুরের বিছানায় বউ শোয়ায়, জামাইর বিছানায় শাশুড়ী শোয়ায়’, তার নাম কৃষ্ণচন্দ্র। এই ‘দেড় নিয়তির’ জন্য চক্ষুধন খাইয়াছে।

 আসরের চারিধারের আর যত সব নর-নারায়ণ, তারা কেবল কথা শোনার লোক, তামাক টানার লোক। কয়েকটি ছেলে হুকাকল্কি মালসা ডিবা লইয়া বসিয়া গিয়াছে। অনবরত ছিলিম ধরাইয়া হাতে হাতে চালাইয়া দিতেছে, আর সে সব হুকা পুরানো হইয়া পর পর তাদের হাতে ফিরিয়া আসিতেছে।

 একটা পরিষ্কার ঝক্‌ঝকে বড় কাঁসার থালাতে কয়েক বিড়া ধোয়ামোছা পান, সুচিক্কণ সুপারি, মাজাঘষা কয়েকখানি বাটিতে চুন ও অন্যান্য মসলা। থালাখানা হাতে করিয়া মধ্য বিছানায় নমস্কার করল ভারত, ‘দশজন পরমেশ্বর, আমার একখান কথা। পান নি দেওয়ার সময় অইছে?’

 সকলেই সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে তাকাইল। পরে রামপ্রসাদের দৃষ্টির ইঙ্গিত পাইয়া ভারত নিজে মাতবরদিগকে পান বাটিয়া দিল। পরে পাড়ার একটি ছেলের হাতে থালাখানা তুলিয়া দিল। সে ক্ষিপ্রহস্তে এই জনারণ্যে পান বাটা শুরু করিল। কিন্তু শেষ না করিতেই বৈঠকের ‘কথা’ আরম্ভ হইয়া গেল।

 দয়ালচাঁদ দুর্বাসাসুলভ ভঙ্গিতে চারিদিকে তাকাইয়া লইল। তারপর রামপ্রসাদের মুখের উপর চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসু হইল।

 রামপ্রসাদের বয়স হইয়াছে। রঙ্ ইষৎ তাম্রবর্ণ। যৌবনে এর সোনার কান্তি ছিল। চামড়ার বার্ধক্য ঠেলিয়া নিজেকে জাহির করিয়াছে যে মোটা হাড়গুলি তারাই প্রমাণ দেয়, যৌবনে এর শরীরে অসুরের শক্তি ছিল। চোখ দুটিতে দেবসুলভ আবেশ। তার মধ্যে থেকেই দৃঢ়তার ক্ষাত্রতেজ ফুটিয়া বাহির হইতেছে। সৃষ্টিশীল প্রতিভা যেন এখনো তাঁর মধ্যে আত্মপ্রকাশ খুঁজিয়া ফিরিতেছে। কোন্ এক সত্যবস্তুর সন্ধানে সুদূরে মেলিয়া রাখিয়াছে তাহার অনন্ত প্রশ্নের জবাব-না-পাওয়া বড় বড় দুটি চোখ।

 দয়ালের নীরব জিজ্ঞাসায় সে চোখ প্রথমেই পড়িল কৃষ্ণচন্দ্রের উপর, ‘কই নগরের বাপ, কথা তোল।’

 অন্ধের চোখ তুলিয়া চাওয়া না চাওয়া সমান। সে চোখ নিচের দিকেই নিবিষ্ট রাখিয়া খানিক পিট পিট করিয়া লইল, তারপর ভদ্র গলায় বলিল, ‘ভারত কই রে।’

 ‘কাকা, এইত আমি ইখানে।’

 ‘ইখানে থাক্‌লেই সার্‌ব? ত’র বাড়িতে দশজনেরে কি জন্য ডাকাইলে ক’।’

 বক্তব্য সকলেরই জানা। ঘরের মালিক তার বাসিন্দা। কিন্তু মাটির মালিক জমিদার। জমিদারের সঙ্গে সে-বাড়ির কোনো যোগ নাই। সে থাকে তার রাজসিক ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবিয়া। তহসিলদার রাখে। সেই আদায়পত্র করে, আদায় না হইলে নালিশ করিয়া প্রজা উচ্ছেদ করে জমিদারের সই লইয়া, সে-ই। প্রজা উচ্ছেদ হয়, সে জায়গাতে আরেক প্রজা আসিয়া বসে। জমিদার নিজে আসিয়া সেখানে বাড়ি বাঁধে না। বাঁধিলে অনেক জমিদারের প্রয়োজন হইত। তারা সত্য নয় বলিয়াই সংখ্যায় তারা কম। মানুষের মধ্যে তারা ব্যতিক্রম। রায়তেরাই সত্য। তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মাটির মালিক হয় তারাই। কাগজপত্রের মালিক নয়, বাসকরার মালিক। সেইরূপ তিতাসের মালিক জেলেরা। কাগজ-পত্রের মালিক আগরতলার রাজা। মাছ ধরার মালিক মালোরা।

 প্রাচীনকালে নিয়ম ছিল মালোরা রাজবাড়িতে বছরে একবার দশ ভার করিয়া মাছ দিবে। নির্দিষ্ট দিনে তারা দশ জনে ভারি-ভারি দশটি ভার কাঁধে তুলিয়া বাতাসে ঢেউ তুলিয়া দৌড় দিত। কৃষ্ণচন্দ্র যৌবন কালে ইহা দেখিয়াছে। কিন্তু নদীর মাছ অনিশ্চিত বস্তু। কোনো নির্দিষ্ট দিনে দশ ভার পূর্ণ করিবার মত এত মাছ ধরা নাও দিতে পারে। কৃষ্ণচন্দ্র তখন যুবক। কর্তাদের মেজাজ ঠাণ্ডা থাকা কালে সে-ই গিয়া তাঁদের পায়ে ধরাধরি করিয়া গ্রামের পক্ষ হইতে বড় রকমের একটা বন্দোবস্ত পাকাপাকি করিয়া আসিল। আর মাছ দিতে হইবে না। বছরে একবার করিয়া মাছের বদলে, মাথট তুলিয়া রাজ-সরকারে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিলেই চলিবে। পৌঁছাইয়া দিবার ভারও পড়িল তারই উপরে। গত তিন বৎসরের কথা। সকলেই যার যার মাথট তার হাতে দিয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি রাজ-পিয়াদা জানাইয়া গিয়াছে, তিন বৎসরের খাজনা বাকি পড়িয়াছে, অতঃপর আর বাকি পড়া উচিত হইবে না। এবং অবিলম্বে সেই বাকি পড়া খাজনা লইয়া রাজসরকারে এ-গাঁয়ের মালোদের উপস্থিত হওয়া উচিত।

 আজিকার সভাতে রাজদূতের সেই ভীতিপ্রদর্শনের বিষয় প্রধান আলোচ্য হইলেও সামাজিক ব্যাপারের এবং কারো কারো ব্যক্তিগত বিষয়ের অনেক কথাই আলোচনার জন্য অপেক্ষমান। কিন্তু তাহার নিজের কৃতকর্মের কথাই সকলের আগে উঠিয়া পড়ে, এই ভয়ে কৃষ্ণচন্দ্র জোর করিয়া মুখে একটু হাসি টানিয়া নত মুখেই বলিল, ‘কি আর কইব! ভারতের মাইয়ারে বিয়া দিতে লাগব, তারই কথা উদার্‌চন করবার জন্য বৈঠক ডাকাইছে, কথা কি আর আমরা বুঝতে পারি না। হাঁ করতে আলজিহ্বার টের পাই।’

 ভারত তার আড়াই বছরের নগ্না নন্দিনীকে রোরুদ্যমান অবস্থায় একটু আগে কোল হইতে নামাইয়া আসিয়াছে। তাহারই সম্পর্কে রসিকতা উঠিয়াছে দেখিয়া সেও চটপট উত্তর দিল, ‘মাত্‌বর কাকা থাকতে আমার মাইয়ার আবার বিয়ার ভাব্‌না। কাকা রাজি হইলে এই বৈঠকেই সাতপাক ঘুরাইয়া দিতে পারি।’

 কথাটা খুব হাসির। কৃষ্ণচন্দ্র মুখনিচু করিয়াই হাসিল। কেউ কেউ সে-হাসিতে যোগ দিল; অনেকেই দিল না। যারা যোগ দিল না, একটু পরে ভারত যখন মূল কথা উত্থাপন করিল, তাদের মধ্যে তখন একটা অসন্তোষের গুঞ্জন উঠিয়া মিলিয়া গেল।

 আসরের চারিপাশে সর্বসাধারণের স্তরের যারা বসিয়া ছিল, তাদের মধ্যে অনবরত হুকা চলিতে লাগিল এবং কাসির মাত্রাটাও এই সময়ে চারিদিকেই একটু বাড়িল। মনের অসন্তোষ বাহিরে প্রকাশের ভাষা হয়ত ইহাদের আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাহীন জীবনে সহাসের স্বভাব-সুলভ অভাবই ইহাদিগকে যুগে যুগে দাবাইয়া রাখে। তাই ইহারা আগাইয়া আসিয়া সরবে মনের আলোড়নকে ভাষা দিয়া প্রকাশ করিতে পারে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস হারাইলেও অন্যায়কে এরা কোনো যুগেই হজম করিয়া নেয় না। তাই কালে কালে দেশে দেশে এরা আগাইয়া সামনে আসিতে না পারিলেও এই অব্যক্তের দল প্রতিবাদ ঠিক জানায়। কোথাও হাসিয়া, কোথাও কাঁদিয়া, কোথাও শিষ্ দিয়া। আবার কোথাও তৈজসপত্র ভাঙ্গিয়া বা দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া ও কেরোসিন-সিক্ত বস্ত্রাঞ্চলে দেশলাইর কাঠি ধরাইয়া। গোকনঘাট গ্রামের মালোদের সাধারণ স্তরের লোকেরা মাতব্বরের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইল সেদিন হুকা টানিবার ছলে অনেকে এক সঙ্গে কাসিয়া।

 দয়ালচাঁদের মুখ দিয়া অনুচ্চ স্বরে বাহির হইল, ‘আমি হইলে তিতাসের জলে তলাইয়া গিয়া মান বাঁচাইতাম।’

 ‘দশের বৈঠকে লক্ষ্মণ-বর্জনের পালাখান তুমি কইর না দয়ালবেপারি। ব্রজলীলার দিনে কুরুক্ষেত্তর ঘটাইয়া লাভ নাই।’

 ‘কোন্ ত্রেতাযুগে কি কইয়া রাখ্‌ছ অখন তারে ধইয়া জল খাও।’

 নিজেদের মধ্যে ব্যাপার। তাই মাতব্বররা ওর বেশি কথা বাড়াইল না। কেবল রামপ্রসাদ তিরস্কার করিল, ‘কৃষ্ণচন্দ্র, মাত্‌বরগিরির মানমজ্জাদা তুমি বুঝি আর রাখ্‌তে চাও না।’

 কৃষ্ণচন্দ্র খুব লজ্জা পাইল, বলিল, ‘আর কটা দিন ক্ষেমা কর।’


 ‘ঠাকুর-সকল, আমার একখান কথা।’

 রামপ্রসাদ ফিরিয়া দেখে তার ঠিক পিঠের কাছেই রেশমি চাদর গায়ে একজন কথা কহিয়া উঠিয়াছে।

 ‘কি কইতে চাও কও না।’

 যারা এখান হইতে মাছ কিনিয়া শহরে গিয়া বিক্রি করে তাদের সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দিয়াছে। সে সমস্যার সে একজন ভুক্তভোগী। মোড়লের আশ্বাস পাইয়া জানাইল আনন্দবাজারের মাছ বিক্রেতাদের কাছে এখন জমিদারের লোকে মাশুল চাহিতে শুরু করিয়াছে। মাছের ভার পিছু দুই আনা করিয়া মাশুল না দিলে বলিয়া দিয়াছে মালোদিগকে বাজারে বসিতে দিবে না।

 রামপ্রসাদের চোখে মুখে একটা কঠোরতার ছায়া পড়িল। সে বাজারের ইতিহাসখানা চকিতে তার মনের পরদায় ছায়া ফেলিল। জগৎবাবু আর আনন্দবাবু শহরের এই দুজন গণ্যমান্য জমিদার একই সময়ে নিজ নিজ নামে দুইটি বাজার বসায়। দুইজনেই চায় নিজেরটা জমুক, অন্যেরটা না জমুক। দুইজনেরই লোকে মালোদের ধরিয়া পড়িল। মালোরা কার কথা মান্য করিবে ভাবিয়া পায় না। রামপ্রসাদের কাছে সকালে আসিল জগৎবাবুর লোক, বিকালে আসিল আনন্দবাবুর লোক। সে যার পক্ষে টলিবে, মালোরা তারই বাজার জমাইবে। সকালে যারা আসিল, গোপনে জানাইল, বাবু তোমাকে তিনশ টাকা দিবে, তুমি কথা কও। সে কথা কহিল না। বিকালে যারা আসিল, তারা জানাইল, বাবু মালোদের প্রত্যেককে পঁচিশ টাকা নগদ দিবে, আর একখানা করিয়া ধুতি দিবে। রামপ্রসাদ তাহাদিগকে পানতামাক খাওয়াইল।

 পরের দিন মালোরা দলে দলে মাছের ভার লইয়া আনন্দবাজারে পশরা সাজাইল। যারা বেপারী তারা ত গেলই, যারা বেপারী নয়, তারাও নৌকা ঘাটে বাঁধিয়া এক এক ভার মাছ লইয়া বাজার আলো করিল। কি জমাটাই না জমিয়াছিল সেদিনকার বাজার। সেদিন হইতে জগৎবাজার কানা। আনন্দবাবুর সেদিন মুখে হাসি ধরিতেছিল না। সে আনন্দবাবু আজ নাই। তাঁর লোকেরা আজ গোকর্ণঘাটের মালোদের কাছে খাজনা চায়।

 ‘শুন বেপারি, বাবুরে সাফ্ কথা কইয়া দিও, মালোরা মাছ বেচ্‌তে কোনো সময় মাশুল দেয় নাই, দিবেও না। জায়গা দেউক আর নাই দেউক। মালোরা বাজার জমাইতে যেমুন জানে, ভাঙ্‌তেও জানে। তারা যেখানে যায়, আ-পথে পথ হয়, আ-বাজারে বাজার হয়।’

 তামসীর বাপের কানে এসকল কথা ঢুকিতেছিল না। সে নিজের কথা ভাবিতেছিল। এই বৈঠকে তার কথাও উঠিবে। মনে মনে সে নিজেকে অপরাধী স্থির করিয়া রাখিল। সত্যই ত, পাড়ার মধ্যে ঐক্য রাখা এবং পাড়ার স্বার্থ দেখাই সর্বাগ্রে কর্তব্য। তারা আমার কে? তারা মালোদের ঘরে নেয় না, মালোরা কোনো জিনিস ছুঁইলে সে জিনিস তারা অপবিত্র মনে করে। পূজাপার্বণে মালোরা তাদের বাড়ির প্রসাদ খাইলে এঁটো পাতা নিজে ফেলিয়া আসিতে হয়। সে-পাতা ওরা ছোঁয় না, জাত যাইবে। এরা মালোদের কত ঘৃণা করে। মালোর লেখাপড়া জানে না, তাদের মত ধুতি-চাদর পরিয়া জুতা পায়ে দিয়া বেড়ায় না। কিন্তু তাই বলিয়া কি তারা ছোঁওয়ারও অযোগ্য? মালোরা মালো বলিয়া কি মানুষ নহে।

 এমন সময় তার ডাক পড়িল।

 ডাকিল দয়ালচাঁদ, ‘তামসীর বাপ্ শুনছ নি?’

 ‘হ কাকা, শুনছি, কও।’

 দয়ালচাঁদ বলিয়া চলিল, বাজারের কাছে তোমার বাড়ি। বাজারের কায়েতরা তোমার বাড়ি আসিয়া নাকি তবলা বাজায় আর মেয়েদের দিকে নজর দেয়। ভাবিয়া দেখ, কায়েতের সঙ্গে মিশিতেছ বলিয়া তারা তোমাকে কায়েত বানাইবেনা। তুমি মালোই থাকিবে। তারা তোমার বাড়ি আসিলে যদি সিংহাসনও দেও, তুমি তাদের বাড়ি গেলে বসিতে দিবে ভাঙ্গা তক্তা। তুমি রূপার হুকাতে তামাক দিলেও, তোমাকে দিবে শুধু কল্‌কেখানা। না না, কাজখানা তুমি ভাল করিতেছ না।

 অনুতপ্ত তামসীর বাপ শুধু এই কথা কয়টি বলিতে পারিল, ‘দশজন পরমেশ্বর, অনেক কাঁদছি, আর আমারে কাঁদাইও না।’


 সব শেষে উঠিল অনন্তর-মার কথা। তার বুক দুরদুর করিতে লাগিল।

 একথাটাও ভারতকেই তুলিতে হইল, নতুন যে লোক আসিয়াছে, আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন। তারে নিয়া কিভাবে সমাজ করিতে হইবে আপনারা বলিয়া যান। তারে কার সমাজে ভিড়াইবেন, কিষ্টকাকার, না দয়ালকাকার, না বসন্তর বাপকাকার—

 কৃষ্ণচন্দ্র বলিল, ‘কোন্ গুষ্টির মানুষ আগে জিগাইয়া দেখ্, কোন্ কোন্ জাগায় জ্ঞেয়াতি আছে জান্।’

 আদেশমত সুবলার বৌ তাকে জিজ্ঞাসা করিল।

 অনন্তর মা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘ভইনসকল গুষ্টিজ্ঞিয়াতির কথা আমি কিছু জানি না।’

 শুনিয়া সকলেই নিরুৎসাহ হইল। কেহই তাহাকে নিজের সমাজে লইতে আগ্রহ দেখাইল না।

 কৃষ্ণচন্দ্র বলিল, ‘আমার সমাজ বিশ ঘরের। ঘর আর বাড়াইতে চাই না।’

 দয়ালচাঁদের সমাজও দশ ঘরের। প্রত্যেকটাই বড় ঘর। তার সমাজেও ঠাঁই হওয়া অসম্ভব।

 মঙ্গলা বসিয়াছিল সকলের পশ্চাতে। ঠেলিয়াঠুলিয়া আগাইয়া আসিয়া সে বলিল, ‘আমার সমাজ মোটে তিন ঘরের।’

 রামপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কারে কারে লইয়া তোর সমাজ?’

 ‘সুবলার শ্বশুর আর কিশোরের বাপেরে লইয়া।’

 ‘তা হইলে নতুন মানুষ লইয়া তোর সমাজ হইল চাইর ঘর।’

 ‘হ কাকা।’


 কৃষ্ণপক্ষের রাত। দশমী কি একাদশী হইবে। কালিঢালা আঁধারের ভিতর দিয়া রামপ্রসাদ চলিয়াছে।

 তার সারা দেহে বার্ধক্য যেন জোর করিয়া ছাপ মারিয়াছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গ্রন্থিবন্ধন যেন অনেক কষ্টে শিথিল হইতে পারিয়াছে। আবেশায়ত চোখদুটি হইতে কিঞ্চিৎ দৃষ্টিশক্তি যেন সবলে অপসৃত হইয়াছে। রামপ্রসাদের আজ যেন কি হইয়াছে। রামপ্রসাদ পথ হারাইয়া ফেলিল।

 যে পথ চিনিয়া চলে তার পথ একটি, আর যে দিশাহারা হইয়া চলে তার পথ শত শত। মালীবাড়ির পথের পর আরেকটা পথে পা দিয়া তার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার স্তব্ধতায় সহসা ঢেউ জাগাইল এই মালিনী। অনেক সময় এক একটা চিন্তা মানুষের মনে আসিয়া ঢোকে আকস্মিকভাবে, আগে একটুও খবর না দিয়া। তার অবচেতন মনের চিন্তার সঙ্গে সে-চিন্তা যোগ রাখিয়া আসেনা, একেবারে আকাশ ফাঁড়িয়া আবির্ভূত হয়,—সে মীমাংসা মনস্তাত্ত্বিকের কাজ। আমরা দেখিতে পাই, সে-চিন্তা আকস্মিক আসিলেও আগের চিন্তাগুলির তাহা অনুপূরক। তাই মালিনী তার মনে আকস্মিক হইলেও, সঙ্গে সঙ্গেই জানা গেল সে একটা প্রসঙ্গের আবছা তরীতে ভর করিয়াই আসিয়া নামিয়াছে তার চিন্তার জোয়ারে। হয়ত রামগতির উঠানে জড়ানো জাল দেখিয়া মনে হইয়াছিল বিভ্রান্ত রামপ্রসাদের, যে এটা মালিনীর বাঁশের ঝাড়। হয়ত পথ চলিতে চলিতে এও মনে হইয়াছিল, আমার পথের একটু ডানদিকেই একটা বাড়ি আছে, সেটাকে বলে মালীবাড়ি। সে বাড়ি এখন পোড়ো। তার পাশ দিয়া যে পথ গিয়াছে রাতে সেপথে কেউ হাঁটে না। বেঘোরে মরা মালিনীর প্রেতাত্মা এখানে মূর্তি ধরিয়া পথিককে ভেংচায়। আর নানারকমের সাপ এপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ব্যাঙ্ ধরে।

 কিন্তু এবাড়ি আগেত এমন ছিল না। এর চারিদিকে মালঞ্চঘেরা ছিল। একদিকে ফুলবাগান, একদিকে বেগুন ক্ষেত, একদিকে বাঁশঝাড়, আমগাছ, আর পূবদিকে পুষ্করিণী। ফুলগুলিতে মৌমাছি গুন্‌গুন করিত। আমগাছে বসন্তের কোকিল ডাকিত। বাঁশঝাড়ে রাতদিন পাখ্‌পাখালিতে কলরব করিত। মালিনীর যখন বয়ঃসন্ধি সে তখন কলাপাতা লইয়া এই পথ দিয়া পাঠশালায় গিয়াছে। ভরা যৌবনেও মালিনীকে দেখিয়াছে। এখনো মনে পড়ে, দাওয়ায় বসিয়া মালী ও মালিনীতে ধুচনি বুনিতেছে, শেষে একদিন মালী মরিয়া গেল। তখনও মালিনীর ভরা যৌবন। সেই অবারণ যৌবনভার আগলাইয়া বহুদিন সে কাটাইয়া দিল। বাড়ির চারিদিকে মালঞ্চের বেড়া তখনো ছিল। তার মনের বাঁধন যতই আলগা হইতেছিল, মালঞ্চের বাঁধনকে ততই সে শক্ত করিয়া তুলিতেছিল। সেখানে ঢুকিয়া কিন্তু ফুলে হাত দিবার সাধ্য কারো ছিল না। মুখে প্রণয়ের মধুভাণ্ড ধারণ করিয়াও সে-বাড়িতে পা ফেলিতে অনেকের বুক শঙ্কায় সঙ্কুচিত হইত। আজ মুখে কালকূটের বোঝা লইয়া জাতকেউটেরা অসঙ্কোচে ঘুরিয়া বেড়ায়।

 এরকম হইল কেন? কেন মালিনীর যৌবনের ছেলেপুলেগুলি, বার্ধক্যের নাতি-নাতনিগুলি এবাড়ির আঙ্গিনায় খেলাইতে নামিল না। তার থেকে কেন আরো দশটা জোয়ান পুরুষ-নারী ঘর্মক্লান্ত দেহে এই বাড়ির ফলফুলের ভার সাজাইতে আজ এখানে কর্মব্যস্ত নয়। সংখ্যায় বাড়িয়া, এই বাড়িতে স্থানের অকুলান দেখিয়া, আরো জঙ্গল কাটিয়া, খানায় মাটি ফেলিয়া তারা কেন আরো দুই চারিটা মালীবাড়ির গোড়াপত্তন করিল না? ইহাতে বাধা জন্মাইল কিসে? এসকল সহজপন্থার বিরাট সম্ভাবনা কেন এক মালিনীর বুকের কানাচে শুখাইয়া মিলাইয়া গেল। এমন করিয়া কেন বাড়ি খালি হইয়া পড়ে। একদা যারা বাস করে, পরে তারা কোথায় চলিয়া যায়। কেন আবার নতুন মানুষ আসে না। মালিনী অনেকবার বাঁশের মাচাতে লাউকুমড়ের গাছ লতাইয়া দিয়াছে। তাতে ধরিয়াছে অজস্র লাউকুমড়া। সে নিজে কেন একটা শক্ত মাচাকে আশ্রয় করিয়া ফলবতী হইয়া উঠিতে পারিল না। তবেত এ বাড়ির চেহারা আগের মতই অম্লান থাকিয়া যাইত। নূতন যুগের সম্ভাবনা লইয়া নূতন মানুষ এর আঙ্গিনায় খেলিয়া বেড়াইত। নূতন শিল্পীরা যুগের চাহিদা পূরণ করিয়া, নূতন চাহিদা জাগাইয়া নূতন রকমের শিল্পরচনা করিয়া যাইত। কেউটে সাপ এ-বাড়ির ত্রিসীমায় ঘেঁসিত না।


 শরীয়তুল্লা বাহারুল্লা দুই ভাই শহরে গিয়াছিল। ফিরিতে রাত হইয়া গিয়াছে। গ্রামের অন্ধকার পথগুলি একসঙ্গে অতিক্রম করিয়া বাড়ির কোণে আসিয়া ছাড়াছাড়ি হইল। পাশাপাশি দুই বাড়ি। মাঝখানে বেড়া। তারা যার যার পরিবার নিয়া আলাদা থাকে। ছোটভাই শরীয়তুল্লা ঘরে না ঢোকা পর্যন্ত বাহারুল্লা দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ঘুরিয়া কয়েক পা হাঁটিয়া নিজের হিস্যায় পা দিল। দিয়া, চমকাইয়া উঠিল। উঠানের কোণে ধানসিদ্ধ করার যে দু-মুখো উনান আছে সেখানে একটা ছায়ামূর্তি নত হইয়া কি যেন হাতড়াইতেছে। কাঁধের লাঠি হইতে আস্ত গজার মাছটা খুলিয়া লাঠিখানা বাগাইয়া একেবারে তার মুখোমুখি হইয়া দাঁড়াইল। তখন তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে।

 ‘মাত্‌বর তুমি। অত রাইতের পর ইখানে।’

 ‘বাহারুল্লা ভাই, আমি পথ বিস্মরণ হইয়া গেছি। গেছলাম সমাজের বৈঠকে। এমন ভুল ত হয় না আমার।’

 বাহারুল্লা তাহাকে হাত ধরিয়া বারান্দায় উঠাইল।

 তার পরিবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিতেই উঠিয়া লণ্ঠন জ্বালিয়া দরজা খুলিল। সে ঘরে ঢুকিয়া গামছা-বাঁধা পুঁটলিটা মাটিতে রাখিল। একটা পিঁড়ি হাতে বারান্দায় আসিতে আসিতে পরিবারকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, ‘একটু তামুক নি খাওয়াইতে পারে।’

 পরিবার বৌ নয়, গিন্নি। তার তিন ছেলের তিন বৌ স্বামী লইয়া তিনি ঘরে তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। গিন্নি ক্ষিপ্রহাতে হুকা ধরাইয়া কপাটের কোণে ঠেকাইয়া, বাহারুল্লার ভাতের জন্য পাকঘরে গেল। মাঝঘরের বিছানাটা বারান্দা হইতে দেখা যায়। এই বাড়ির গৃহিণী একটু আগে এখান হইতেই উঠিয়া গিয়াছে। অনেকগুলি ছেলেপুলে বুকে পিঠে লইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। রামপ্রসাদ তামাক টানিতে টানিতে একবার সেদিকে আর একবার বাহারুল্লার দিকে চাহিল। বাহারুল্লার বয়স তারই কাছাকাছি। তার ভরপুর সংসার। জমিগুলি সব নিজের। তিন ছেলেকে লইয়া চারজোড়া বলদ দিয়া চারখানা হাল চালায়। যত ধান ঘরে ওঠে, গিন্নি বৌদের নিয়া ভানিয়া ডোল ভরতি করে। এবার অনেক ধান উঠিয়াছে। কাটার বাকিও রহিয়াছে অনেক। ভোর হইলেই ছেলেদের ডাকিয়া মাঠে পাঠাইয়া দিবে, বৌদের ডাকিয়া তুলিবে আর চারজনে মিলিয়া ধান সিদ্ধ করিতে বসিবে। রাঁধে দুমুখো উনানে, কিন্তু ধানসিদ্ধ করে চারমুখো ছ’মুখো উনানে। একসঙ্গে চার-ছ হাঁড়ি সিদ্ধ হইয়া যায়। মোরগডাকার আগে সিদ্ধ শুরু করিয়া রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে-ধান উঠানময় ছড়াইয়া দিবে। সারাদিন রোদ লাগিবে ধানে।

 লণ্ঠনের আলোতে সাদা মাটির উঠানটা চক্‌চক্ করিয়া উঠিল। হুকাটা ফিরাইয়া দিতে দিতে রামপ্রসাদ বলিল, ‘ধান ত এইবার খুব ফলছে।’

 ‘হ মাত্‌বর।’

 ‘জারি গাইবা না?’

 ‘না, এইবার ক্ষেমা দিলাম। ধান যেরকম গম্‌গমাইয়া পাক্‌তে লাগছে, জারির উস্তাদের খোঁজে ঘোরার সময় কই?’

 একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া রামপ্রসাদ উঠানের দিকে একবার চাহিল। এ উঠানে কত জারিগান হইয়াছে। মুল্লুকের সেরা ওস্তাদ আনা হইত। একমাস ধরিয়া সে-ওস্তাদ পাড়ার ছেলেদের শিখাইত। তারপর নিমন্ত্রণ করিয়া পাল্টা দল আনা হইত। দুই দলে হইত প্রতিযোগিতা। ছেলে ও যুবার দল কাঁধে-কাঁধে কোমরে-কোমরে ধরিয়া বীরের নাচ নাচিত। সারা উঠান কাঁপিয়া উঠিত। গান যা জমিত!

 ‘বাহারুল্লা ভাই, গানগুলি কি ভাল লাগত! এই দুইটা গানের সুর অখনো মরমে গাঁথা হইয়া আছে—‘মনে লয় উড়িয়া যাই কারবালার ময়দানে,’ আর ‘জয়নালের কান্দনে, মনে কি আর মানে রে, বিরিক্ষের পত্র ঝরে।’

 ‘হ মাত্‌বর, এই সগল গানই খুব জমত। আরেকটা গানও বেশি জমত, মনে পড়ে নি মাত্‌বর,—‘বাছা তুমি রণে যাইওনা, চৌদিকে কাফিরের দেশ, জহর মিলে ত পানি মিলে না।’ এই সগল গান ক বছর শুনি না। আমার এই উঠানে জারিগান কতবার হইছে।’

 সে গানে মালোরাও নিমন্ত্রণ পাইত। রামপ্রসাদ কতদিন এই উঠানেই বসিয়া শুনিয়াছে। বীররস করুণরসের এসকল গান শুনিতে বসিলে ওঠা যায় না। কয়েক বৎসর ভাল ফসল হয় না। চাষীরা কেবলই দেনায় জড়াইয়া যাইতেছে। লোন-কোম্পানীর টাকা আনিয়া কত চাষী আর শোধ করিতে পারে নাই বলিয়া প্রতি কিস্তিতে কত শাসানি কত ধমক খাইয়া মরিতেছে। জারি গাহিবে তারা কোন্ আনন্দে? এবার ভাল ধান হইয়াছে। সে ধান তুলিয়াই সারা হইতেছে। জারিগান গাহিবার সময় কই?

 ‘মালোগুষ্টির কালীপূজার দেরি কি, মাত্‌বর?’

 ‘বেশি দেরি নাই। সামনের আমাবস্যায়।’

 ‘এইবার গান দিবা না?’

 ‘হ, আট পালা। চাইর পালা যাত্রা আর চাইর পালা কবি।’

 ‘আ—ট পালা? এই টেকা দিয়া তারা মলোপাড়ায় যদি একটা ইস্কুল দিত।’

 ‘আর ইস্কুল। মালোরা পুলকে বাঁচে না, তারা দিব ইস্কুল!’

 ‘দেখ মাত্‌বর, নিজেত আঞ্জি ক খ শিখলাম না। কিন্তু ‘কালা আখর’ যে কি চিজ অখন কিছুকিছু টের পাই। মজিদের কিনারে এজমালির যে মক্তব জমাইছি, বেহানে তার কাছ দিয়া যাইতে যাইতে খাড়া হইয়া থাকি, তারা পড়া করে, আমার কানে মধু বরিষণ করে।’

 ‘বাহারুল্লা ভাই, উচিত কথা কইলে মালোরা লাঠি মার্‌তে চায়। এই দুঃখেইত গাঁও ছাইড়া দেশান্তরী হইলাম।’

 জোরে একটা টান দিয়া হুকাটা রাখিতে রাখিতে বাহারুল্লা বলিল, ‘মালোগুষ্টি সুখে আছে। মরছি আম্‌রা চাষীরা। ঘরে ধান থাক্‌লে কি, কমরে একখান গামছা জুটেনি? পাট বেচবার সময় কিছু টেকা হয়। কিন্তু খাজনা আর মাহাজন সাম্‌লাইতে সব শেষ। কত চাষায় তখন জমি বেচে। তোম্‌রা-তারার দোয়ায় অখন অব্‌ধি আমার জমিতে হাত পড়ছে না। পরে কি হইব কওন যায় না।’

 ‘এই কামও কইর না বাহারুল্লা ভাই। জান্ থাকতে জমি ছাইড় না। মালোগুষ্টির কথা আল্‌গা। তারা জলের উপ্‌রে জলটুঙ্গি বাইন্ধা আছে। জোয়ারে বাড়ে ভাটায় কমে, জলের আবার একটা বিশ্বাস। মাটির সাথে সম্বন্ধ-ছাড়া মানুষের জীবনের কোন বিশ্বাস নাই, বাহারুল্লা ভাই।’

 ‘চল মাত্‌বর, তোমারে আগাইয়া দেই।’

 রামপ্রসাদ উঠানে নামিয়া দেখে, চাঁদ উঠিয়াছে। বড় তেজালো চাঁদ। সামনের দিকে যেন রথ ছুটাইয়া আসিতেছে।

 ‘জোছনা উঠ্‌ছে বাহারুল্লা ভাই, তুমি ঘরে যাও, খাও গিয়া। অখন আমি একলাই যাইতে পারমু।’


 যে-শিশু আকাশ-কোণে হামাগুড়ি দিয়া উঠিয়াছিল, সে এখন ধাপে ধাপে আগাইয়া আসিতেছে। সুনীল স্বচ্ছ আকাশখানা দূরের না-দেখা-জগৎ হইতে অনেকখানি নিচে যেন নামিয়া আসিয়া ঘুমন্ত মালোপাড়ার উপর চাঁদোয়া ধরিয়াছে। গায়ে-গায়ে লাগানো ছনের ঘরগুলি বিমল আলোর ধারায় স্নান করিয়া এককালে মাথা তুলিয়া আছে। কানাচে কানাচে পড়িয়াছে ছোট ছোট ছায়া। তাই মাড়াইয়া চলিতে লাগিল রামপ্রসাদ। মালোপাড়ায় জোৎস্নার এমন অজস্রতা। এর প্রতিঘরের উপর গলিয়া-পড়া রূপলোকের এমন পরিপূর্ণ হাসি। নির্মল আকাশের স্বচ্ছতার সঙ্গে মাথা-উঁচুকরা ঘরবাড়িগুলির এমন আবেগময় আলিঙ্গন। এ দৃশ্য পাড়ার আর কেউ দেখিল না, দেখিল কেবল রামপ্রসাদ।

 আরো একজন দেখিতেছিল। কিন্তু সে দেখা অর্থহীন, অনুভূতিহীন। রামপ্রসাদ গিয়া রামকেশবের উঠানে পা দিতেই দেখে, সে ধাঁ করিয়া উঠানের একধার হইতে অন্যধারে চলিয়া যাইতেছে।

 রামকেশবের উঠানে আলোর তেজ কম। সারা উঠান ঢাকিয়া বাঁশের আগায় জাল ছড়াইয়া রাখিয়াছে। মাটির উপর তার ছায়া পড়িয়াছে। জালের খোপের ভিতর দিয়া মাছেরা মাথা গলাইতে পারে না, কিন্তু চাঁদের আলোরে আটকায় কার সাধ্য। প্রতি খোপের ফাঁক দিয়া সে আলো উঠানের স্বচ্ছ মাটিতে পড়িয়াছে। কোন্ সুচতুরা মালোর মেয়ে বুঝি অপার্থিব ক্ষমতায় আলোর জাল বুনিয়া রামকেশবের উঠানের মাটিতে বিছাইয়া দিয়াছে।

 উত্তরের ভিটির ঘর রামকেশবের। দুইচালের ঘর। সামনে একফালি বারান্দা। অনুচ্চ ভিটির কিনারাগুলি স্থানে স্থানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। ঘরের পূবের অংশ অন্দরমহল। এককালে আবরু-বেড়া ছিল। ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে অনেক দিন। আগে ছেঁড়া জাল দিয়া ভাঙ্গা জায়গাগুলি ঢাকিবার চেষ্টা হইত। এখন আর সেরূপ চেষ্টা নাই, দেখিলেই মনে হইবে এ বাড়ির আবরুরক্ষার প্রয়োজন ফুরাইয়া গিয়াছে।

 বারান্দার উপরে একপাশে চালের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি এলোমেলো দড়াদড়ি। তার পাশে কয়েকটা ছেঁড়াজালের পুঁটুলি উপরি-উপরি মাটিতে ফেলিয়া রাখিয়াছে। তারই উপরে কুকুর-কুণ্ডলী দিয়া বোধ হয় লোকটা শুইয়াছিল। ধাঁ করিয়া উঠানে নামিয়া রামপ্রসাদের সামনা দিয়া ভৌতিক ক্ষিপ্রতায় তিন লাফে উঠান পার হইয়া গেল। খালি গা। পরনে একখানি গামছা। মাথায় এক বোঝা আলুথালু চুল। মুখ ভরতি দাড়ি। যাইবার সময় জালের নিচেকার বুনানো আলোছায়ায় তার মাটিমাখা কালো শরীরটা চিক্‌চিক্‌ করিয়া উঠিল। একটু অস্বাভাবিক ফোলা শরীর।

 রামপ্রসাদ দেখিয়া চিনিল!

 সে ঝুলানো হাত দুটি ঘনঘন নাড়িতে নাড়িতে মুখ বাড়াইয়া আক্রমণের ভঙ্গিতে আগাইয়া আসিল। রামপ্রসাদের মুখের কাছে মুখ আনিয়া বিকৃতমুখে ম্লান একটু হাসিয়া বিজ্ঞের মত আস্তে বলিল, ‘অ, মাত্‌বর, অতদিন পরে। আচ্ছা বারিন্দায় উঠ, দেখ কি কাণ্ডখান হইয়া আছে।’

 ‘কি কাণ্ড হইয়া আছে। আরে শালা কি কাণ্ড।’

 ‘দেখ না গিয়া।’

 হাত ধরিয়া বারান্দায় তুলিয়া নিয়া দেখাইল। দা দিয়া মাটিতে তিন চারটা গর্ত খুঁড়িয়াছে। লম্বা গর্ত। একটার মুখ খুঁড়িতে খুঁড়িতে আরেকটার গায়ের উপর তুলিয়া দিয়াছে। সেইখানে আঙ্গুল ঠেকাইয়া বলিল, ‘দেখ চাইয়া, কি হইতাছে। মাইয়া চুরি হইতাছে! এই তোমার মেঘনা গাঙ্, অইখানে খাড়ি। খাড়িতে আছিল নাও, বড় গাঙে কি কইরা গেল। জাইগ্যা দেখি মাইয়াচুরি হইতাছে। বাইরে জোছনা ফট্‌ফট্‌ করে, ভিতরে আন্ধাইরে মাইয়া চুরি হয়। তুমি কি কও মাত্‌বর।’

 রামপ্রসাদ কিছুই কহিল না। তিতাসের শুশুক মাছগুলি যেমন সন্ধ্যার ছায়া পাইয়া ভাসিয়া নিঃশ্বাস ছাড়ে, জালের পুঁটুলিগুলির উপর বসিতে বসিতে তেমনি ফোস্ করিয়া একটা নিঃশ্বাসের শব্দ তার নাক দিয়া বাহির হইল।

 ঘরের ভিতর রামকেশব অকাতরে ঘুমাইতেছে। নাকডাকার শব্দ শোনা যায়। শেষরাতে জালে যাইবে। এখন তাকে ডাকিয়া জাগান মর্মান্তিক। ঘুমভাঙা মানুষ মাথা ঠিক রাখিয়া জাল ফেলিতে পারে না। তার রোজগারটাই মাটি হইবে। শেষরাতের আর দেরি কত।

 রামপ্রসাদ অধিক ভাবিতে পারিল না। চিন্তাতে বিমনা, ক্লান্তিতে অবশ রামপ্রসাদকে জালের উষ্ণতাটুকুর মাঝে ঘুম একেবারে কাত করিয়া ফেলিয়া দিল।

 রাত শেষ হইবার আগেই একবার ঘুম ভাঙিয়াছিল। পাগল তাহার একান্ত কাছে। হাতের কাছে মাটি খুঁড়িবার একটা দা রাখিয়াছে। একটা কিছু করিয়া ফেলা স্বাভাবিক। চোখ মেলিবার সঙ্গে সঙ্গে এ-ভয়ই সে করিতেছিল। চোখ খুলিয়া দেখে, একজন তার অতি কাছে বসিয়া, মুখখানা তারই মুখের কাছাকাছি। ভয় পাইবার আগে জড়তাগ্রস্ত চোখ কচলাইয়া আবার দেখিল—রামকেশব। তাকে আগলাইয়া রাখিয়াছে। বুড়ার দাড়িগুলি তার দাড়িগুলির একান্ত কাছে। প্রশস্ত লোমশ বুকখানাও তার বুকের অতি নিকটে। তার লোমশ বুকের উষ্ণতা রামপ্রসাদের বুকেও লাগিতেছে।

 রামকেশবের বয়স তার চাইতে আরো বেশি। শরীর তার মতই শক্তির পরিচয় দিলেও, তার চাইতে বেশি ভাঙিয়া পড়িয়াছে। চুল দাড়ি চোখের ভ্রূ কানের লোম এখনো কাঁচাপাকা। রামপ্রসাদের শণের মত শাদা চুলদাড়ির নিকট তাকে আকাশের পথে কাত-হইয়া-দৌড়-দেওয়া চাঁদের বারান্দায়-ঢুকিয়া-পড়া আলোতে নাবালকের মত দেখাইতেছে। যেন দুইটি প্রাগৈতিহাসিক শিশুর অপার্থিব সমন্বয় ঘটিয়াছে, যার ইতিহাস স্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর একজন যে জানে, তার কোনো অনুভূতি নাই।

 দুইজনের মধ্যে এই রকম কথাবার্তা হইল—

 —মাতবরের ছেলে, ডাক দিলে না, কোন্ সময়ে আসিয়াছ জানিলাম না। শীতে কষ্ট পাইলে।

 —না মালোর ছেলে, শীতে কষ্ট বেশি পাই নাই। ঘুমাইয়া পড়িলে আবার কষ্ট কি। ভাবিলাম তুমি যখন শেষরাতে নদীতে যাইবে, তোমার নৌকায় আমি যাইব। তুমি আমাকে যাত্রাবাড়িতে নামাইয়া দিবে।

 —সারা রাতে একবার বাহির হইয়াছিলাম। বাহির হইয়া দেখি একটা মানুষ। কাছে আসিয়া দেখি তুমি। জাগাইলাম না। পাগলটা কাছে। তাই বসিয়া গেলাম শিয়রে। রাতের জালে যাওয়া আর বাবা আমারে দিয়া কুলাইবে না। খেউ তুলিয়া জালে হাত দিলে হাত ঠক ঠক করিয়া কাঁপে। গাঙের বাতাসে কান-কপাল ভাঙ্গিয়া নামায়। বুক যেন ভোঁতা ছুরি দিয়া কাটে। আমার কি আর বাবা মাছ ধরার সময় আছে। আমার এখন গুফার মধ্যে বসিয়া বসিয়া তামাক টানিয়া কাটাইবার দিন। বিধি তারে কোন্ পাগল বানাইল। কত পাগল ভাল হয়, আমার পাগল আর ভাল হইল না। ঘরে আসিয়া বস, আমি তামাক জ্বালাই।

 মাটির গাছাতে কেরোসিনের আলো মিটমিট করিতেছে। বাহির হইবার সময়েই রামকেশব জ্বালিয়াছিল। তারই মলিন আলোতে ঘরখানার মলিনতা অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। ভাঙা চাটাইর উপর ময়লা ছেঁড়া কাঁথা পাতিয়া বিছানা। দুইটি বালিশের একটিতে তুলা বাহির হইয়াছে। সেটিতে রামকেশব শুইয়াছিল, চুলে দাড়িতে একটু একটু তুলা এখনো লাগিয়া রহিয়াছে। অন্য বালিশটিতে মাথা রাখিয়া যে শুইয়া আছে, খুব ভারী রোঁয়াওঠা কাঁথাতে তার পা থেকে মাথার বালিশ অবধি ঢাকা। সে রামকেশবের পরিবার।

 ‘অ বুড়ি, উঠ্ চাইয়া দেখ্—’

 কাঁথার পুঁটুলি নড়িয়া উঠিল। মলিন কন্থাবরণের অন্তরাল হইতে উন্মোচিত হইয়া ততোধিক মলিন মুখখানা প্রশ্ন করিল, ‘অত রাইতে বাড়িতে কোন্ কুটুমের পাড়া।’

 ‘বজ্জাত বুড়ি, কথা কইস্ না। জামাই!’

 জামাই! জীর্ণ স্মৃতির ছেঁড়া সূতাগুলি মিলাইতে অনেকবার চেষ্টা করিল। কিন্তু তার বাড়িতে জামাই কে আসিতে পারে হিসাবে মিলাইতে পারিল না। পিচুটি-পড়া চোখে ঘুমের ঘোর। ছাপপড়া খড়িওঠা চামড়ার মুখমণ্ডলে ঘুমের জড়-প্রলেপ। তার উপর ফাঁকে ফাঁকে দাঁত না থাকায় মুখের হাঁ—এ সকল মিলাইয়া বুড়ির হতবুদ্ধির মত তার দিকে চাহিয়া থাকাকে রামকেশবের নিকট এত কুৎসিৎ মনে হইল যে, আর সহ্য করিতে পারিল না। হাত ধরিয়া তাকে এক টানে তুলিয়া বসাইল। খুলিয়া-যাওয়া কটির ও বুকের কাপড় অশেষ চেষ্টায় ঠিক করিতে করিতে বুড়ি জিজ্ঞাসা করিল, ‘জামাই আইল কোন খান থাইক্যা, না কইলে কেম্‌নে বুঝি কও।’

 ‘যাত্রাবাড়ির জামাই। বসন্তর বাপ।’

  ভাগ্‌নী-জামাই। দেশদেশান্তরে মান্য করে। ভাগ্‌নী মরিয়া গিয়াছে। তাই এবাড়িতে আর আসা-যাওয়া নাই।

 বুড়ির মাথা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হওয়ার পর ঘোমটা টানিয়া দেওয়ার কথা মনে পড়িল।

 রাতের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া অনেক দূরে মোরগ ডাকিয়া উঠিল। যারা খাটিয়া খায় ইহা তাদের নিকট ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই সময়ে চাষীর মেয়েরা ধানসিদ্ধ করিবার জন্য উনুনের মুখে আগুন দেয়। মালোর মেয়েরা চোখে মুখে জল দিয়া শণসূতা কাটিতে বসে। পুরুষেরা যারা আগ-রাতে যায় নাই, এই সময়ে জাল-কাঁধে রওনা হয়।

 কাঁধে জাল হাতে হুকা রামকেশব বাহিরে পা দিতে দিতে বলিল, ‘মাত্‌বরের পুত্, আইজ কিন্তু যাইও না।’


 প্রতিটি ঘরের আঙ্গিনাতে রোদ নামিয়াছে। সকালের সোনালি রোদ। কারো বৌ-ঝি বসিয়া নাই। কারো ছেলেমেয়ে বিছানায় পড়িয়া নাই। তারা আঙ্গিনায় নামিয়া পড়িয়াছে। মায়েদের শাড়ি দুই ভাঁজ করিয়া গা ঢাকিয়া গলাতে বাঁধা ছিল। রোদ পাইয়া খুলিয়া দিয়াছে। খালি গায়ে এখন খেলাতে মগ্ন। কালোতে ফরসাতে মেশা সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশুর দল।

 রামপ্রসাদ তাহাই দেখিতে দেখিতে নদীর দিকে চলিল। তার চোখে আজ রোদের সোনা মিশিয়া চারদিক সোনাময় হইয়া গিয়াছে। আজ এরা যেন সব সোনার শিশু। সোনার খেলনা হাঁড়িখুঁড়ি লইয়া রূপার বালিতে ভাত চাপাইয়া চাঁদসুরুজের দেশে নিমন্ত্রণ পাঠাইয়াছে। তবে নেহাতই খাইবার স্থূল নিমন্ত্রণ।

 অনন্তও আঙ্গিনাতে নামিয়া খেলায় মাতিয়াছে। মায়ের শাদাপাড়ের কাপড়খানা দুই ভাঁজ করিয়া গলায় বাঁধা।

 রামপ্রসাদ তার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সেও এই শাদাচুল দাড়িওয়ালা লোকটার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর সহসা কি ভাবিয়া বারান্দার উপর উঠিয়া ডাকিল, ‘মা।’

 মা বারান্দায় নামিয়া, এমন মানুষকে তার আঙ্গিনায় এমন বিহ্বলভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া এত বিস্মিত হইল যে, না পারিল ভিতরে চলিয়া যাইতে না পারিল মাথার ঘোমটা টানিয়া দিতে।

 রামপ্রসাদ আরও অগ্রসর হইয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিয়া হাসিমুখে বলিল, আমাকে দেখিয়া তোর ভয় করে? আমি তো তোর এখানে কোন বিচার করিতে অসি নাই। আসিয়াছি কেবল তোকে দেখিবার জন্য। ভিন্ন গ্রামের মানুষ আমি। আমার বাড়িতে তোর মার মত মা নাই। আমার আঙ্গিনাতে তোর মত ছোট দাদুভাইয়েরা খেলা করে না। মা যদি এ গাঁয়ে না উঠিয়া আমার গাঁয়ে গিয়া উঠিত, এক ঘর আছি, আমার গাঁয়ে তাহা হইলে দুই ঘর হইত।