তিতাস একটি নদীর নাম

তিতাস একটি নদীর নাম

 

তিতাস একটি নদীর নাম

তিতাস একটি
নদীর নাম

অদ্বৈত মল্লবর্মণ

২২, কর্নওয়ালিস স্ট্রীট, কলিকাতা-৬

প্রথম প্রকাশ—আশ্বিন, ১৩৬৩
দ্বিতীয় প্রকাশ—আশ্বিন, ১৩৬৫

দাম সাড়ে ছয় টাকা

প্রচ্ছদশিল্পী
রণেন আয়ন দত্ত
(ব্লক নির্মাতা রণজিৎ প্রসেস এ্যাণ্ড প্রিণ্টিং ইণ্ডাস্ট্রিজ)


ইণ্ডিয়ান ফোটো এনগ্রেভিং কোং প্রাইভেট লিঃ, ২৮ বেনিয়াটোলা লেন,
কলিকাতা-৯ হইতে শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল বিশ্বাস কর্তৃক মুদ্রিত ও ২২ কর্নওয়ালিস
স্ট্রীট, কলিকাতা-৬ পুথিঘরের পক্ষ হইতে শ্রীসতীশ রায় কর্তৃক প্রকাশিত

 আজ এই গ্রন্থপ্রকাশের দিনে আমরা আমাদের প্রিয়বন্ধু অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বেদনার্ত চিত্তে স্মরণ করি। কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে যাইবার পূর্বে তিনি এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি আমাদিগকে দিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার জীবৎকালে ইহা আমরা প্রকাশ করিতে পারি নাই—লেখকের মৃত্যুর পরও কয়েকটি বৎসরই কাটিয়া গেল। আনন্দবাজার পত্রিকার অর্থানুকূল্যে অদ্বৈত স্বাভাবিক ভাবেই রোগমুক্তির পথে অগ্রসর হইতেছিলেন–কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর ইতিহাস অন্যরূপ। সে করুণ অধ্যায় আমরা এখানে উদ্ঘাটিত করিতে পারিলাম না।

 বাংলাদেশের সাংবাদিক মহলে অদ্বৈতের প্রতিষ্ঠা ছিল—নবশক্তির যুগে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকর্মীরূপে তাঁহার সাংবাদিক জীবনের আরম্ভ। তারপর আজাদ, মোহাম্মদী, যুগান্তর এবং সর্বশেষে দেশ ও বিশ্বভারতীর সহিত তিনি সংশ্লিষ্ট হইয়াছিলেন। অদ্বৈত যখন নবশক্তির সহসম্পাদকরূপে কার্য আরম্ভ করেন তখন বাংলাদেশে সাংবাদিকের বেতন অধিক ছিল না—প্রকৃতপক্ষে দেশ ও বিশ্বভারতীর সহিত সংশ্লিষ্ট হইবার পূর্ব পর্যন্ত তাঁহার নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটিয়াছে।

 সাংসারিক মানুষের কাছে এই অর্থকষ্ট অনেকটা স্বেচ্ছানিগ্রহ বলিয়াই মনে হইবে—কারণ অদ্বৈতের পারিবারিক দায় কিছু ছিল না। তিনি নিজে অবিবাহিত ছিলেন, মাতাপিতার মৃত্যুও বাল্য-বয়সেই হইয়াছিল। কিন্তু দূরের আত্মীয়েরাও এই স্বল্প আয়ের বান্ধবটিকে চিনিতে ভুল করেন নাই। আমরা চিরকাল অদ্বৈতকে তাঁহার মুষ্টি-অন্ন বহু জনের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইতে দেখিয়াছি।

 এই অর্থকষ্টের অপর কারণ হয়ত বা অদ্বৈতের গ্রন্থপ্রীতি। এই নিদারুণ কৃচ্ছ্রতার মধ্যেও সারাজীবন তিনি গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। অদ্বৈতের মৃত্যুর পর এই বিরাট সংগ্রহভাণ্ডার তাঁহার বন্ধুরা রামমোহন লাইব্রেরীর হাতে তুলিয়া দিয়াছেন। সাহিত্য, দর্শন ও চারুকলা বিষয়ক এমন একটি সুচিন্তিত ও মনোজ্ঞ সংগ্রহ সচরাচর দেখা যায় না। লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ এই সহস্রাধিক গ্রন্থ সঙ্কলনকে একটি পৃথক বিভাগে রক্ষা করিয়াছেন।

 এই প্রবল জ্ঞানলিপ্সা অদ্বৈতের মধ্যে বালককাল হইতেই দেখা গিয়াছিল। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া হইতে সামান্য দূরে একটি দরিদ্র মালোপরিবারে অদ্বৈতের জন্ম হয়। এই অধ্যবসায়ী বালক তাহার স্কুল জীবনের প্রথম পরীক্ষাগুলি বৃত্তি পাইয়া পাশ করিয়াছিল। পিতামাতা আর দশটি মালোছেলের মত ইহারও ভরণপোষণের কোন সুব্যবস্থা করিতে পারেন নাই। পাঁচ মাইল দূরের জেলেপল্লী হইতে এই বালক যখন ধূলিধূসর পায়ে স্কুলে আসিয়া নির্দিষ্ট স্থানটিতে উপবেশন করিত, তখন তাহার বালক সহাধ্যায়ীরা না হউক, অন্ততঃ কয়েকজন সহৃদয় শিক্ষক ছাত্রের মলিন মুখ দেখিয়া তাহাতে উপবাসের চিহ্নগুলি পড়িয়া ফেলিতে পারিতেন।

 শিশুকাল হইতে এই বালক আত্মার যে দুশ্চর তপস্যায় ব্রতী হইয়াছিল তাহার সিদ্ধি-অসিদ্ধির অনুভব আমাদের নাই। তবে নেহাৎ ছোট বয়স হইতেই তাহার সাহিত্যিক কৃতিত্বগুলি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। সেই বয়সে যতটুকু পড়িবার কথা অদ্বৈত তাহাপেক্ষা অনেক বেশি পড়িয়াছিলেন, এবং নানা পত্র-পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতাদি লিখিয়া নানা পুরস্কারও পাইয়াছিলেন। স্কুলের শিক্ষা শেষ হইলে তাহার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু ও শিক্ষকেরা পুরস্কারলব্ধ ধাতুখণ্ডগুলি বালকের বুকে আঁটিয়া দিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য তাহাকে কুমিল্লা পাঠাইয়া দেন।

 নানা প্রতিকূল কারণে কুমিল্লা কলেজে অদ্বৈতের পড়াশুনা বেশিদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। তারপর নবশক্তি প্রকাশের কালে সম্ভবত ক্যাপ্‌টেন নরেন্দ্র দত্ত তাঁহাকে কলিকাতা লইয়া আসেন। বিভিন্ন পত্রিকায় অদ্বৈতের লেখাগুলি বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। অনেক পত্রিকার সে সকল সংখ্যা এখন হয়ত পাওয়াও যাইবে না—তাঁহার দুই একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসও কোন কোন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় মুদ্রিত হইয়াছিল। কিন্তু অদ্বৈতের সমগ্র সাহিত্য-সাধনার মধ্যে এই গ্রন্থটিই তাঁহার সর্বোৎকৃষ্ট কীর্তি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রথমত মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হইতেছিল—গ্রন্থটির কয়েকটি স্তবক মুদ্রিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহা রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন সময় এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি রাস্তায় হারাইয়া যায়। বলাবাহুল্য অদ্বৈতের জীবনে এই ঘটনাটি সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক।

 বন্ধুবান্ধব এবং পাঠকদের আগ্রহাতিশয্যে লেখক আবার ভগ্নহৃদয়ে তিতাসের কাহিনী লইয়া বসিলেন। তখন অদ্বৈতের দায়িত্ব না হইলেও দায় বাড়িয়াছে—তিতাস পারের অনেক মালোপরিবার উদ্বাস্তু হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অদ্বৈত কলিকাতার বাহিরে গিয়া তাহাদের দেখিয়া আসেন—তাহাদের যৎসামান্য সুবিধার জন্য দেশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভারতীতে কাজ জুটাইয়া লন, আর দুই কাজের পারিশ্রমিক হইতে নিজের শাকান্নমাত্রের বন্দোবস্ত রাখিয়া বাকি সব তাহাদের মধ্যে বিলাইয়া দেন। সারাদিন চাকুরী ও অর্থার্জনের জন্য আরো নানা লেখা লেখিয়া দিনমানে একটুও সময় পান না। দিনের সকল কাজ সারিয়া সন্ধ্যায় নগরীর পূর্ব উপান্তে তাঁহার ষষ্ঠীতলার বাসাটুকুতে ফিরিয়া যান। ঐ বাড়িতে অধিকাংশই রেলের শ্রমিক, ঘরে-বারান্দায় ঠাসাঠাসি করিয়া তাহাদের খণ্ড খণ্ড সংসার; কিন্তু অপরিচ্ছন্ন অন্ধকার সিঁড়ি বাহিয়া চারতলার ছাতের ঘরটিতে পৌঁছিলে দেখা যায় আকাশ সীমাহীন—অদ্বৈত ক্লান্ত দেহ টানিয়া লইয়া রাত্রিতে তিতাসের কাহিনী লিখিতে বসিতেন, ক্রমে নগরীর আকাশ হইতে ধূমকলঙ্ক মুছিয়া গিয়া তাহা তিতাসের বুকের উপর ঝুঁকিয়া পড়া রঙীন আকাশের সঙ্গে এক হইয়া যাইত।

 এই গ্রন্থ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলিবার নাই, তাহা পাঠকসাধারণেরই বিচার্য। তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করিবার চিত্র কমই আছে। পরিচয়ের অভাবে লেখক অনেক স্থানেই মিথ্যা রোম্যাণ্টিক, আবার অনেক স্থানে সত্যের ছল হেতু তাঁহার দৃষ্টি বক্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা এই মিথ্যা রোম্যাণ্টিকতা বা সত্যের ছলনা হইতে মুক্ত। তাঁহার মানুষ, প্রকৃতি, আনন্দ, বিষাদ সমস্তই সহজ জীবন-রসিকতার ও নিগূঢ় অনুভবের পরিচয় বহন করে। আমাদের বন্ধু অদ্বৈত দীর্ঘজীবী হন নাই, হয়ত তাঁহার তিতাসের কাহিনী দীর্ঘজীবী হইবে।

প্রথম সংস্করণ হইতে পুনর্মুদ্রিত।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।