তিতাস একটি নদীর নাম/তিন/রাঙা নাও
রাঙা নাও
চৈত্র মাসের খরায় যখন মাঠঘাট তাতিয়া উঠিয়াছিল, তখন বিরামপুর গ্রামের কিনারা হইতে তিতাসের জল ছিল অনেকখানি দূরে। পল্লীর বুক চিরিয়া যে-পথগুলি তিতাসের জলে আসিয়া মিশিয়াছে, তারা এক একটা ছিল এক-দৌড়ের পথ। কাদিরের ছেলে ছাদির তার পাঁচ বছরের ছেলে রমুকে তেল মাখাইয়া রোজ দুপুরে এই পথ দিয়া তিতাসে গিয়া স্নান করিত। ছাদির তাহাকে কোলে করিয়া ঘাটে যাইত আর তার পেটের ও মুখের জবজবে তেল বাপের কাঁকালে ও কাঁধে লাগিত। বাঁ হাতে বাপের কাঁধ ধরিয়া ডান হাতে সেই তেল মাখাইয়া দিতে দিতে মাঝ পথে রমু জেদ ধরিত, ‘বাজান, তুই আমারে নামাইয়া দে।’ কিন্তু বাপ কিছুতেই নামাইত না। বরং তার নরম তুল্তুলে শরীরখানা দিয়া নিজের শক্ত পেশীবহুল শরীরে রগড়াইতে থাকিত, আর মনে মনে বলিত, কি যে ভাল লাগে।
তারপর ঘাটে গিয়া এক খামচা বালি তুলিয়া নিজের দাঁত মাজিত এবং ছেলের দাঁতও মাজিয়া দিত। গামছা দিয়া ছেলের গা, নিজের গা রগড়াইয়া ছেলেকে লইয়া গলা-জলে গিয়া ডুব দিত। কখনও একটু আলগা করিয়া ধরিয়া বলিত, 'ছাইড়া দেই?’ রামু তার কাঁধ জড়াইয়া ধরিয়া বলিত, ‘দে ছাইড়া।’
পরিষ্কার জল ফট্ ফট্ করে, তাতে মৃদুমন্দ স্রোত। কাটারিমাছ ভাসিয়া ভাসিয়া খেলা করে। বাপ-ব্যাটার গায়ের তেল জলের উপর ভাসিয়া বেড়ায়, তারই নিচে থাকিয়া ছোট ছোট মাছের ফুট ছাড়ে; রমু হাত বাড়াইয়া ধরিতে চেষ্টা করে, পারে না।
ধরিত্রীর সারাটি গ। ভীষণ গরম। একমাত্র ঠাণ্ডা এই তিতাসের তলা। জল তার বহিরবয়বে ধরিত্রীর উত্তেজনা ঠেলিয়া নিজের বুকের ভিতরটা সুশীতল রাখিয়াছে এই দুই বাপ-ব্যাটার জন্য। অনেকক্ষণ ঝাপাইয়া ঝুপাইয়াও তৃপ্তি হয় না, জল হইতে ডাঙ্গায় উঠিলেই আবার সেই গরম। ছাদির শেষে ছেলেকে বলিল, ‘তুই কান্ধে উঠ্, তরে লইয়া পাতাল যামু।’ রমু কার কাছে যেন গল্প শুনিয়াছে, জলের তলে পাতাল-নাগিনী সাপ থাকে। বলিল, ‘না বা’জান, পাতাল গিয়া কাম নাই, শেষে তরে সাপে খাইলে আমি কি করুম ক’।’
ছেলেপিলের ভয়-ডর ভাঙ্গাইতে হয়। তাই ধমক দিয়া বলিল, ‘সাপের গুষ্টিরে নিপাত করি, তুই কান্ধে উঠ্।’ বাপের দুই হাতের আঙ্গুলে শক্ত করিয়া ধরিয়া রমু তার কাঁধে পা রাখিয়া এবং কাঁপিয়া কাঁপিয়া শরীরের ভারসাম্য রাখিতে রাখিতে অবশেষে সটান স্থির হইয়া দাঁড়াইতে পারিল। শেষে খুশির চোটে হাততালি দিতে দিতে বলিল, ‘বাজান, তুই আমারে লইয়া এইবার পাতাল যা।’
ছেলের খুশিতে তারও খুশি উপ্চাইয়া উঠিল, সেও হাত দুইটা জলের উপর তুলিয়া তালি বাজাইতে বাজাইতে বলিল, ‘দম্ব দম্ব তাই তাই, ঠাকুর লইয়া পূবে যাই।’
ঘাটে নানা বয়সের স্ত্রীলোকেরা নাইতে ধুইতে আসিয়াছিল, কেউ কেউ বলিল—‘কি রকম কুয়ারা করে দেখ্।’
—‘হইব না? কম বয়সে পুলা পাইছে, পেটে থুইব না পিঠে থুইব দিশ্ করতে পারে না।’
জল হইতে উঠিয়া ছেলের গা মুছাইয়া ছোট দুই-হাতি লুঙ্গিখানা পরাইয়া বলিল, ‘এইবার হাঁইট্যা যা।’
কয়েক পা আগাইয়া শক্ত মাটিতে পা দিয়া দেখে আগুনের মত গরম। পা ছোঁয়াইলে পুড়িয়া যাইতে চায়। করুণ চোখে বাপের মুখের দিকে চাহিয়া বলে, ‘বাপ্ আমারে কোলে নে, হাঁটতে পারি না।’
বাপের কোলে চড়িয়া তার বুকের লোমগুলির মধ্যে কচি গালটুকু ঘষিতে ঘষিতে রমু বলিল, ‘বাপ, তুই আমারে খড়ম কিন্যা দে। এমুন ছোট্ট ছোট্ট দুইখান খড়ম, তা হইলে আর ত'র কোলে উঠতে চামু না।’
‘পাওয়ে গরম লাগে! ওরে আমার মুন্শীর পুত্ রে! পাওয়ে গরম লাগ্লে জমিনে কাম করবি কেমনে?’
উঠানে পা দিবার আরেকটু বাকি আছে। তিতাস হইতে এক চিলতা খাল গ্রামখানাকে পাশ কাটাইয়া সোজা উত্তর দিকে গিয়াছে। মেটে হাঁড়ি-কলসী বোঝাই একটা নৌকা জোয়ারের সময় খালে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল, ভাঁটায় আটকা পড়িয়াছে। লাল-কালো হাঁড়িগুলি খালের পাড় ছাড়াইয়া উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। এখান হইতে দেখা যায়, রোদে সেগুলি চিক্ চিক্ করিতেছে। সেদিকে আঙ্গুল বাড়াইয়। রমু বলিল, জমিনে কাজ করিবে না, পাতিল বেপার করিবে।
‘ঠুন্কা জিনিস লইয়া তারা গাঙে গাঙে চলা-ফিরা করে, নাওয়ে নাওয়ে ঠেস-টাক্কুর লাগলে, মাইট্যা জিনিস ভাইঙ্গা চুরমুচুর হইয়া যায়। তুই যে রকম উটমুইখ্যা, তুই নি পারবি পাতিলের বেপার করতে?’
‘—তা অইলে আম-কাঠালের বেপার করুম।’
‘নাওয়ে আম-কাঠাল বড় পচে। কোনো গতিকে দুই একটাতে পচন লাগ্লে, এক ডাকে সবগুলিতে পচন লাগে, তখন নাও ভরতি আম-কাঠাল জলে ফালাইতে হয়। লাভে-মূলে বিনাশ। তুই যে রকম হুঁস-দিশা ছাড়া মানুষ, পচা লাগলে টের নি পাইবি; শেষে আমার বাপের পুঁজি মজাইয়া বাপেরে আমার ফকির বানাইবি।’
‘—তা হইলে বেপার কইরা কাম নাই।’
‘—হ বাজি। বেপারীরা বড় মিছা কথা কয়। সাত পাঁচ বারো কথা কইয়া লোকেরে ঠকায়; কিনবার সময় বাকি, আর বেচবার সময় নগদ। আর যে পাল্লা দিয়া জিনিস মাপে, তারে কিনবার সময় রাখে কাইত কইরা, আর বেচবার সময় ধরে চিত কইরা। এর লাগি ত’র নানা বেপারীরে দুই চক্ষে দেখ্তে পারে না। তুই যদি বড় হইয়া ময়-মুরুব্বির হাল্-গিরস্তি ছাইড়া দিয়া বেপারী হইয়া যাস তা হইলে ত’র নানা ত’রেও চোর ডাকব, আর—’
‘আর কি—’
‘শালা ডাকব।’
রমু একটু হাসিয়া ফেলিল; অপমানাহত হইয়া বলিল, ‘অখন আমারে নামাইয়া দে।’ মুখে তার কৃত্রিম ক্ষোভের চিহ্ন।
ক্ষেতে কাজের ধুম পড়িয়াছে। ছাদিরের মোটে অবসর নাই। ছেলের দিকে চাহিবার সময় নাই। ছেলের মার হাতেও এত কাজ যে, দুই হাতের দশগাছা বাঙ্রীর মধ্যে দুইখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। ছেলের মা হওয়ার পর হইতে সংসারে তার গৌরব বাড়িয়ছে, কিন্তু শ্বশুর কাদির মিয়া তাহাকে ছাড়িয়া কথা কহিলেও তার বাপকে ছাড়িয়া কথা কহিবে না। কোন একবার খাইতে বসিয়া যদি দেখে বেটার বৌর হাতের অতগুলি বাঙ্রীর মধ্যে কয়েকটা কম দেখা যাইতেছে, তবে নিশ্চয়ই শালার বেটি বলিয়া গালি দিবে, কেহ আট্কাইতে পারিবে না। সন্ধ্যায় বেদেনী আসিলে তাহার নিকট হইতে দুই পয়সার দুইটি বাঙ্রী কিনিয়া পুরাইয়া রাখা যাইতে পারে, কিন্তু পয়সা ছাদির দিলে ত! নিজেকে তাহার যেন বড়ই অসহায় মনে হইতে লাগিল। এই রকম মাঝে মাঝে হয়; তখন সে পুত্র রমুর দিকে তাকায়, তাকে আদর করে, কোলে নেয়, ভাবে, সে বড় হইয়া যখন সংসারের দায়িত্বের অংশ লইবে তখন কি তার মার কিছু কিছু স্বাধীনতা এ সংসারে বর্তাইবে না? এখনও রমুর দিকে চাহিবার জন্য তাহার চোখ দুইটি সতৃষ্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু কোথায় রমু?
রমু ততক্ষণে খালের পাড়ে। হাঁড়ি-বোঝাই নৌকাটির জন্য সারাক্ষণ তার মন কৌতুহলী হইয়া থাকিত। বিকাল পড়িতে বাপকে অনুপস্থিত ও মাকে কাজে ব্যস্ত দেখিয়া সে একবার হাঁড়ির নৌকাখানা দেখিতে আসিয়াছে।
হাঁড়ির একটা পাহাড় যেন ঠেলিয়া মাথা উঁচু করিয়াছে। নৌকাখানা বড়। চারিদিকে খুঁটি গাড়িয়া খোয়াড় বানাইয়া হাঁড়ির কাড়ি পরতে পরতে বড় করিয়াছে। সকালে ঝুড়ি-ঝুড়ি হাঁড়ি বিক্রয় করিতে গাঁয়ে গিয়াছিল। ধান-কড়ি লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রাঁধিয়াছে, খাইয়াছে,—এখন উহারা বিশ্রামে ব্যস্ত।
বিরাট একটা দৈত্যের মত নৌকাখানা এখানে আটকা পড়িয়াছে। জল শুক্না। নড়িবার চড়িবার ক্ষমতা নাই। কিন্তু লোকগুলির মনে সেজন্য কোনই দুশ্চিন্তা দেখা যাইতেছে না। তারা যেন দিনের পর দিন এইভাবে ঝুড়ি ঝুড়ি হাঁড়ি লইয়া গাঁওয়াল করিতে যাইবে। তারপর সব হাঁড়ি কলসী বিক্রয় হইয়া গেলে একদিন জোয়ার আসিবে, তিতাসের জল ঠেলিয়া খালে আসিয়া ঢুকিবে, এবং বহুদিন পর এই বিরাট দৈত্য গা নাড়া দিয়া উঠিবে। ইহার পর আর তাহাদিগকে কোন দিন দেখা যাইবে না। প্রতি বারে নূতন নূতন গাঁয়ে গিয়া ইহারা পাড়ি জমাইবে। তাই কি তাহাদের মনে স্ফূর্তি?
ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়াছে, একজন বারমাসী গান তুলিয়াছে—‘হায় হায়রে, এহিত চৈত্রি না মাসে গিরস্তে বুনে বীজ। আন গো কটোরা ভরি খাইয়া মরি বিষ॥ বিষ খাইয়া মইরা যামু কান্বে বাপ মায়। আর ত না দিবে বিয়া পরবাসীর ঠাঁই॥’
রমু তীরে দাঁড়াইয়া মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল।
খালের ওপারে কাঁচি হাতে দাঁড়াইয়া আরও একজন শুনিতেছিল সেই গান। সে ছাদির। কি একটা কাজের কথা মনে পড়ায় সকাল সকাল কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল সে।
গান চলিতে লাগিল স্তবকের পর স্তবক—পদের পর পদ। বিরহ-বেদনাচ্ছন্ন করুণ সুরের গানখানা বৈকালিক ঠাণ্ডা হাওয়াকে বিষাদে ভারী করিয়া তুলিতেছিল। এক বিচ্ছেদকুলা নারীর এক বুক-সেঁচা ফরিয়াদ পাতিল-ব্যাপারীর কণ্ঠস্বরে যেন ধরা দিয়াছে। সে-নারী মাসের পর মাস প্রিয়-বিচ্ছেদের দুঃখভার গানের তানে হালকা করিয়া দিতেছে।
‘আসিল আষাঢ় মাস হায় হায়রে, এহিত আষাঢ় মাসে গাঙে নয়া পানি। যেহ সাধু পাছে গেছে সেহ আইল আগে। হাম নারীর প্রাণের সাধু খাইছে লঙ্কার বাঘে॥’
অবশেষে আসিল পৌষ মাস—‘হায় হায়রে, এহিত পৌষ না মাসে পুষ্প অন্ধকারী। এমন সাধের যৈবন রাখিতে না পারি॥ কেহ চায় রে আড়ে আড়ে কেহ চায় রে রইয়া। কতকাল রাখিব যৈবন লোকের বৈরী হইয়া॥’
একটু পরে সন্ধ্যা নামিবে। বৌ-ঝিরা ওপারের ওই পথ দিয়া নদীতে যাইতেছে, কেহ কেহ ফিরিয়া আসিতেছে। গানের কথাগুলি শুনিয়া ছাদির ব্যথিত হইল। ডাকিয়া বলিল, ‘অ পাতিলের নাইয়া, এই গান তোমরা ইখানে গল। ছাইড়া গাইও না, মানা করলাম।’
পলকে গান থামিয়া গেল। বাধা পাইয়া গায়কের মুখ বেদনায় মলিন হইয়া গেল। কোন উত্তর না দিয়া সে মাথ। নিচু করিল।
ছাদিরের মনে বড় কষ্ট হইল। তাই তো, ওতো কেবল গানই গাহিয়াছে, গানের কথার ভিতর কি আছে না আছে সেদিকে তো তার লক্ষ্য ছিল না। আপন সুরে আপনি মাতোয়ারা হইয়া সে তো কেবল কোন্ বিস্মৃত যুগের কোন বিরহিণী নারীর কথাগুলি বৈকালী-হাওয়ায় মাঠের বুকে ঢালিয়া দিয়াছে মাত্র। তার দোষ কোথায়? হাঁটুজলে খাল পার হইয়া ছাদির এপারে আসিল, তারপর ছেলের হাত ধরিয়া ফিরিতে ফিরিতে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, ‘গান থামাইল। কেনে, গুন্গুনাইয়া গাও, গুন্গুনাইয়া গাও।’
উঠানের বুকটা চিতানো। জল জমিতে পারে না, সব সময় শুক্না, ঠন্ঠনে। বিকালে একপাল হাঁসমুরগী সেখানে ঝি-পুত লইয়া চরিয়া বেড়াইয়াছে এবং সারাটা উঠান নোংরা করিয়াছে। গোলায় অজস্র ধান। সারা বছর খাইয়া বিলাইয়া, হাঁড়ি-পাতিল খইয়ের-মোয়া রাখিয়াও সে-ধান কমে না, এমনি অজস্র। ঢেঁকিঘরে সাপের গর্ত ধরা পড়িয়াছে। মাটি খুড়িয়া নিঃসন্দেহ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গিয়া ধান ভানা চলে না। জ্যোৎস্না রাতের সাঁঝ। সেই উঠানেরই একদিকে ননদদের লইয়া ধান ভানিতে হইবে। মস্তবড় ঝাঁটাখানা দুই হাতে ধরিয়া কোমর বাঁকাইয়া অতবড় উঠানখানা ঝাড়ু দিয়া শেষ করিতে করিতে বেলাটুকু ফুরাইল; নবমী তিথির ঝাপসা চাঁদের আলোয় সেই উঠান চক্চক্ করিয়া উঠিল। এমন সময় দেখা গেল খালের কিনারা হইতে গোপাটের পথ ধরিয়া একটা লোক আগাইয়া আসিতে আসিতে একেবারে উঠানের কোণে আসিয়া পা দিল। চার ভিটায় চারখানা বড় ঘর। কোণা-খামচিতে আরো ছোট ছোট ঘর কয়েকখানা আছে। উঠানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ দিয়া দুইঘরের ছায়ায় আসিয়া লোকটা থমকিয়া দাঁড়াইল, চাপা গলায় ডাক দিল—‘পেশ্কারের মা, অ, খুশী!’
খুশী ঝাঁটা নামাইয়া আগাইয়া আসিল, ‘বা’জান তুমি?’
‘হ, আমি।’
‘ঘরে আইঅ।’
হাঁ, ঘরেই আসিব, এবার আর বাহিরে থাকিব না। পিঠে ‘গাতি’ বাঁধিয়া আসিয়াছি; গালাগালি করিলে আমিও করিব; মারামারি করিলে আমিও মারিব। আমি তৈয়ার।
খুশী অপমানে মাথা নিচু করিল।
গহনার দেনা মিটাইতে পারে নাই বলিয়া তার বাপ এমন চোরের মত আসে।
‘তোর পেশ্কার কই?’
উত্তরের ঘরে বাপের সাথে কিচ্ছা শুনিতেছে।
‘ও, বড় পেশ্কার কই?’
খুশী ফিক্ করিয়া একটু হাসিল, ‘হউরের কথা কও! বাজারে গেছে।’
কাদির বাজার হইতে আসিলে তিনজনে তাহার নিকট তিন রকমের তিনপ্রস্ত নালিশ জানাইবে, স্থির হইয়া রহিল। খুশীর পেটে রমুর কোন ভাই-বোন আসিতেছে। এই বিরাট সংসার হইতে সে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়া বাপের বাড়িতে যাইতে চায়। বাপ মুহুরী। তার বাড়িতে হাল নাই গিরস্তি নাই, সারাদিন কাজের ঝামেলা নাই। এই হাজার কাজের ঝামেলা হইতে দিন কয়েকের ছুটি নিয়া সেখানে একটু নিশ্বাস ফেলিতে চায় সে। বাপ এ কথাই জানাইতে আসিয়াছে কাদিরকে। কিন্তু তাহার নিজে বলার সাহস নাই। এতো আর আদালত নয় যে ধমক দিয়া মক্কেল দাবকাইবে। এ কাদির মিয়ার সংসার, এখানে তারই একচ্ছত্র অধিকার। বাপের অসহায়তা দেখিয় খুশী নিজেই বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। সে নিজেই বলিবে শ্বশুরকে, যে-কথা বাপ বলিতে আসিয়াও বলিতে পারিতেছে না, চোরের মত এক কোণে লুকাইয়া আছে।
আর এক আবেদন ছাদিরের। গত বছরের পাট বিক্রির চারশ টাকা তার চাই, দৌড়ের নৌকা গড়াইবে। শৈশব হইতে বাপের সঙ্গে খাটিতে খাটিতে সে জান কালি করিতেছে। কোনদিন কোন সাধ-আহ্লাদ পূরণের জন্য বাপের কাছে নালিশ জানায় নাই। আজ সে এ নালিশটুকু জানাইবেই। তাতে বাপ রাগিয়া উঠুক আর যাই করুক।
তৃতীয় নালিশ রমুর। নানা তাহাকে শালা বলিবে, একথা শুনাইয়া তার বাপ প্রায়ই তাহাকে অপমান করে। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত সে করিবে।
ছোট একটা ঝড়ই বুঝি-বা আসিল। কাদির মিয়া ঘরে ঢুকিলে তেমনি সকলে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন নালিশকারীই তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমতঃ কাহারও মুখে কোন কথাই জোয়াইল না। একটু দম নিয়া ছাদিরই কথা বলিতে আগাইয়া আসিল। নতুবা স্ত্রী ও পুত্রের নিকট তাহার মর্যাদা থাকে না।
‘বা’জী তোমার হাতে কি?’
‘হাতে খাইয়া-নাচুনী।’
—পরিষ্কার রাগের কথা। ছাদির নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। খুশী ঘোমটা টানিয়া ঘরের এক কোণে সরিয়া গেল। রমু নিকটে বসিয়া প্রদীপের আলোয় নানার চক্চকে দাড়িগুলোর ফাঁকে রাগেকম্পিত ঠোঁট দুইটি লক্ষ্য করিতে লাগিল।
খড়ম পায়ে দিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিয়া তামাক টানিতে টানিতে কাদির মিয়া ডাকিল, ‘অ ছাদির, অ ছাদির মিয়া!’
ছাদির উঠানে স্ত্রীর নিকট এক ঝুড়ি ধান নামাইয়া দিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘বা’জি আমারে ডাক্ছ?’
‘হ, এক বিপদের কথা কই। উজানচরের মাগন সরকার মিছা মামলা লাগাইছে।’
‘মামলা লাগাইছে?’
‘হ, মিছা মামলা। বাপ দাদার আমলের জমি-জিরাত। নেয্য মতে চইয়া খাই! দরকার হইলে ধারকর্জ করি, পাট বিক্রির পর শোধ করি। কারো ফসলের ক্ষেতে পাড়া দেই না, আমারো ফসলের ক্ষেতে কেউ পাড়া দেয় না। তার মধ্যে এমুন গজব!’
‘কি বইলা লাগাইল মামলা?’
‘তিস্রা সনের তুফানে বড় ঘর কাইত হইয়া পড়ে, তখন দুই শ টাকা ধার করি। পরের বছর পাট বেচি বার টাকা মণে। কাঁচা টাকা হাতে। আমার বাড়ির গোপাট দিয়া মাইয়ার বাড়ি যাইবার সময় ডাক দিয়া আইন্যা সুদে আসলে দিয়া দিলাম। টাকা নিয়া যাইতে যাইতে কইয়া গেল, গিয়াই তমলুকের কাগজ ছিঁড়া ফালামু, কোন ভাবনা কইর না। এতদিন পরে সেই কাগজ লইয়া আমার নামে নালিশ করছে।’
‘বা’জান তুমি বড় কাঁচা কাম কর।’
ইহাদের নামে কেউ কোন দিন মামলা করে নাই। এরাও কোন দিন কারো নামে নালিশ করে নাই। তাই এই দুঃসংবাদে সারা পরিবারে একটা বিষাদের ছায়া পড়িল। চিন্তান্বিত মুখে সকলে কাদির মিয়াকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। একটা ঝানু মামলাবাজ অতিথি যে ঘরের কোণে আত্মগোপন করিয়া আছে সে কথা কেউ জানিল না, যাও বা খুশী জানিত, সেও ভুলিয়া গেল। কিন্তু মামলার নাম শুনিলে আত্মগোপন করিয়া থাকিবার লোক সে নয়। কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া সকলের মাঝখানে ঝাঁপাইয়া পড়িল।
‘কোন তারিখে, কার কোর্টে নালিশ লাগাইয়াছে কও!’
কাদির চমকাইয়া উঠিল; ‘কেডা তুমি?’
‘আমি নিজামত মুহুরী, বেয়াই!’
‘বেয়াই! আমি মনে করছিলাম, বুঝি বউরূপী।’
‘যা তুমি মনে কর। এই জীবনে কত বউরূপীরে নাচাইলাম। শেষে তোমার কাছে নিজে বউরূপী সাজতে হইল!’
‘কও কি তুমি!’
‘ঠিক কথাই কই। দুই একটা মামলাটামলা ত কর্লা না। কি কইরা জানবা মুহুরীর কত মুরাদ। ঘুড়িরে দেই আসমানে তুইল্যা, লাটাই রাখি হাতে। যতই উড়ে যতই পড়ে, আমার হাতেই সব। জজ-মাজিষ্টর ত ডালপালা। গোড়া থাকে এই মুহুরীর হাতে। কি নাম কইলা? উজানচরের মাগন সরকার না? কোন চিন্তা কইর না। দুই চারটা সাক্ষীসাবুদ যোগাড় কইরা রাখ, মামলা তোমারে জিতাইয়া দেমু, কইয়া রাখলাম।’
ছাদিরও সমর্থন করিল, ‘বা’জান তুমি ডরাইও না। হউরে যখন সাহস দেয়, তখন জিত হইবই বা’জান।’
কাদিরের মুখের শিরাগুলি কঠিন হইয়া উঠিল।
‘বেয়াই তোমার কোনো ডর নাই! দেখ আমি কি করতে পারি। একবার দেখ—মিছা মামলা লাগাইছে, আমিও মিছা সাক্ষা লাগামু। মামলা নষ্ট ত করুমই, তার উপর তার নামে, লোক লাগাইয়া গরুচুরি করার, না হইলে খামারের ধান চুরি করার পালটা মামলা লাগামু তবে ছাড়ুম। তুমি কিচ্ছু কইর না, খালি খাড়া হইয়া দেখ—’
কাদিরের মুখ আরও কঠিন হইয়া উঠিল।
ছাদির শেষ চেষ্টা করিল, ‘বা’জান—’
‘না না, তারে আমি ডরাই না।’
‘তবে চল আমার সাথে। দেখি, কই কি করছে। মামলার গোড়া কাটা যায় কিনা। চল কাইল সকালে।’
‘হ, কাইল সকালেই যামু। কিন্তুক তোমার সাথে যামু না, আর তোমার অই আদালতেও যামু না। আমি একবার যামু তারই কাছে।’
‘তার কাছে গিয়া কি করবা?’
‘তার চোখে চোখ রাইখ্যা জিগামু—তার ইমানের কাছে জিগামু, আমার বাড়ির গোপাট দিয়া যাইবার সময় তারে বিনাখতে টাকা দিছি—সেই-কথাটা তার মনে আছে কি না।’
‘যদি কয় মনে নাই?’
‘পারব না। মুহুরী পারব না। আমার এই চোখের ভিতর দিয়া আল্লার গজব তারে পোড়াইয়া খাক করব। কি সাধ্য আছে তার, এই রকম দিনে ডাকাতি, হাওরে ডাকাতি কর্ব?’
ছেলে হতাশ হইয়া বলিল, ‘বা’জান, তুমি বড় কাঁচা কাম কর।’
ততোধিক হতাশ হইয়া মুহুরী বলিল, ‘পাড়াগাঁওয়ে থাক, পাড়াগাঁইয়া বুঝ্ তোমার। তোমারে খামকা উপদেশ দিয়া লাভ নাই। তোমারে কওয়া যা, ধান ক্ষেতে গিয়া কওনঅ তাই! থাক গরুর সাথে মাঠে, গরুর বুদ্ধিই তো হইব তোমার।’
এভাবে বুদ্ধির খোটা দেওয়ায় পিতাপুত্র দুজনেই চটিল।
‘আমার কাছে কত লোক যায় মামলা মোকদ্দমার পরামর্শ লইতে। তুমি শালা কোন দিন কি গেছলা? অত জমিজমা ক্ষেত্পাখর তোমার। জীবনে দুইদশটা মামলা করলা না, কিসের তুমি কুঠিয়াল? পুঁটি মাছের পরাণ তোমার। মামলার নামে কাঁইপ্যা উঠ। নইলে দেখতা, মাগন সরকারেরে কি ভাবে আমি কাইত করি।’
একটু অহেতুক বচসার সৃষ্টি হইল। মুহুরী রাগিয়াই আসিয়াছিল। মুহুরী নামক জীবকে দুইচক্ষে দেখিতে পারে না, কাদির এ কথা স্পষ্ট ভাবে জানাইয়া দেওয়াতে তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগিল। বলিল, ‘থাকি আমি ভদ্রলোকের গাঁওয়ে, চলি আমি বাবু ভুঁইয়ার সাথে। কারো কাছে কি কই যে, আমি সম্বন্ধ করছি তোমার মত চাষার সাথে?’
‘গরীবের বাড়িতে হাতীর পাড়া পড়ুক, এও আমারা চাই না বা’জি।’ বাপের হইয়া জবাব দিল ছাদির।
বাপ তার এভাবে বসিয়া অপমানিত হইয়াছে, দেখিয়া খুশীর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। আড়াল হইতে সে সকলকে শুনাইয়া বলিল, এমন অসম্মানী হইবার লাগি এই গাঁওয়ে তুমি কেনে আইঅ বা’জি।’
মুহুরী জানাইল সে ভুল করিয়াছে। সে এখনই চলিয়া যাইতেছে। অতঃপর সব বাড়িতে যাইবে, কিন্তু চাষার বাড়িতে কোনদিন যাইবে না।
কাদির ততোধিক চটিয়া বলিল, রাত দুপুরে চলিয়া যাইবে। সাহস কত। যাও না যদি ক্ষমতা থাকে।
মুহুরী যাইতে উদ্যত হইলে তাড়াতাড়ি কাদির দুইটা লাঠি বাহির করিল। মুহুরী হতভম্ব হইয়া গেল। কাদির একটা লাঠি নিজের হাতে লইল এবং বাকি লাঠিটা নাতি রমুর হাতে দিয়া বলিল, ‘নে শালা, তর্ দাদারে মার্।’
রমু লাঠিটা হাতে লইয়া গো-বেচারার মত একবার কাদিরের মাথার দিকে আরেকবার মুহুরীর মাথার দিকে তাকাইতে লাগিল; কার মাথায় মারিবে বুঝি-বা ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।
সেইদিন বিকালবেলা, মাগন সরকার মামলা লাগাইয়া ব্রাহ্মণবাড়ীয়া হইতে বাড়ি ফিরিতেছিল। তিতাস-নদীর তীর ধরিয়া পথ। সূর্য এলাইয়া পড়িয়াছে। তিতাসের ঐ পারে মাঠ ময়দান ছাড়াইয়া অস্পষ্ট গ্রামের রেখা। তারই ওপারে সূর্য একটু পরেই অস্ত যাইবে। পশ্চিমাকাশ লাল হইয়া উঠিয়াছে। তার সেই লালিমা আবার মেঘের স্তরে স্তরে নানা রঙের পিচকারী ছুড়িয়া মারিতেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়াছে। চারিদিকে শান্ত, সমাহিত ভাব। কাছেই বাড়িঘর। গাইগরু ধীরেসুস্থে আপন মনে বাড়িতে ফিরিতেছে। রাখালের তাড়া করার অপেক্ষা রাখিতেছে না। বামদিকে তটরেখা, ডানদিকে বেড়া। কি সব ক্ষেত লাগাইয়াছে, তারই জন্য বেড়া। গলায় ঝুলানো রেশমী চাদর হাওয়ায় উড়িয়া এক একবার বেড়ার কঞ্চিতে গিয়া লাগিতেছিল। পায়ের মসৃণ জুতায় লাগিতেছিল জমিনের ধূলা। সব কিছু বাঁচাইয়া পথ চলিতে মাগন সরকারের মন চিন্তায় উদ্বেল হইয়া উঠিল। এ মাঠেও তার অনেক জমি আছে। কত জমি, সে নিজেই অনেক সময় ঠাহর রাখিতে পারে না। মাঝে মাঝে গোলাইয়া যায়, কত জমি সে করিয়াছে; কিন্তু কি করিয়া সে-সব জমি করিয়াছে, সে-খবর জ্বলন্ত অঙ্গারের মতই তার চোখের সামনে আজ যেন জ্বল্জ্বল্ করিয়া দুই একবার জ্বলিয়া উঠিল।
এমন সময় পথে রশিদ মোড়লের সঙ্গে দেখা।
রশিদ মোড়লের খালি পা, লুঙ্গি পরা, গায়ে একটা ফতুয়া। বয়সে মাগন সরকারের মতই প্রবীণ।
‘রসিদ ভাই!’
‘কি?’
‘দোলগোবিন্দ সা’র খবর শুন্ছ ত?’
‘তা আর শুন্ছি না। কলিকাতা থাইক্যা তার ভাতিজার নামে চিঠি আইছে।’
‘অবস্থা নাকি খারাপ?’
‘হ। একেবারে হাতে-বৈঠা-ঘাটে-নাও অবস্থা।’
‘কি হইব দাদা!’
‘কি আর হইব, মরব!’
‘মইরা কি হইব?’
রশিদ একটু হাসিল, কিন্তু জানিল না যে, মাগনের একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস তিতাসের ছোট ঢেউয়ের মত বাতাসে একটু ঢেউ খেলাইয়া দিয়া গেল!
পরের দিন সকালে কাদির মিয়া আসিয়া ডাক দিল।
তার চোখ দুইটি দেখিয়া মাগন সত্যই আঁতকাইয়া উঠিল। সে-দুটি চোখ জবাফুলের মত লাল। সারারাত তার ঘুম হয় নাই। কেবল ভাবিয়াছে, আল্লা মানুষ এত বেইমান হয় কেন? মানুষে মানুষকে এতটুকু বিশ্বাস করিবে না কেন? আর কেনই বা মানুষ বিশ্বাসের মাথায় এভাবে নিজ হাতে মুগুর মারিতে থাকিবে। মানুষ না দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জীব?
এদিকে মাগনেরও সারারাত ঘুম নাই। কাল রাত্রিতে বাড়িতে আসিয়া শুনিয়াছে, দোলগোবিন্দ সাহা আর ইহজগতে নাই। টেলি আসিয়াছে তার ভাইপোর নামে। হায় দোলগোবিন্দ! তুমি, আমি, রসিক ভাই একই ডিঙ্গার কাণ্ডারী, একই চাকরিতে ঘুষ খাইয়া পয়সা করিয়াছি, একই উপায়ে লোককে ঋণের জালে জড়াইয়া ভিটামাটি ছাড়া করিয়াছি, জমিজিরাত দেনার দায়ে নিলাম করিয়াছি; আজ তুমি মরিয়া গিয়াছ। আমিও তো মরিয়া যাইব। হায় দোলগোবিন্দ! তুমি মরিয়া গিয়াছ!
কাদির দেখিয়া অবাক হইল, তারও চোখ দুইটি সন্ধ্যার অস্তরাগের মতই লাল।
কাদির কিছু বলিল না। চুপ করিয়া তার সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।
মাগন শিহরিয়া উঠিল, দোহাই তোমার কাদির মিয়া। শুধু একটিবারের জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। জীবনে সর্বনাশ তো অনেকেরই করিলাম। আর কারোর সর্বনাশ আমি করিব না, শেষবারের মতো শুধু তোমার এই সর্বনাশটুকু করিতে দাও। বাধা দিওনা, প্রতিবাদ করিও না, শুধু সহ্য করিয়া যাও। এই আমার শেষ কাজ। দেখিবে, তোমাকে ঠকানোর পর থেকে আমি ভাল মানুষ হইয়া যাইব! আর কাউকে ঠকাইব না; এই শেষবারের মত শুধু তোমাকে ঠকাইতে দাও!
কাদির হতভম্ভ হইয়া গেল। কিছু না বুঝিয়াই বলিল, তাই হোক মাগন বাবু, আমি সহ্যই করিয়া যাইব। তোমার কোন ভয় নাই, নির্ভয়ে তুমি মামলা চালাও। কোনো সাক্ষীসাবুদ আমি খাড়া করিব না। নীরবে সব স্বীকার করিয়া লইব এবং টাকা ডিগ্রি হওয়ার পর নগদ না থাকে তো জমি বেচিয়া শোধ করিব। তবু তুমি ভাল হও।
পরের দিন খবর পাওয়া গেল, মাগন সরকার মরিয়া গিয়াছে। বড় বীভৎস সে-মৃত্যু। একটা নারিকেল গাছে উঠিয়া মাটির দিকে নাকি সে লাফ দিয়াছিল।
এই সংবাদে কাদিরের মনটা কেমন যেন উদাস হইয়া গেল।
কাজেই ছাদির যখন একদিন প্রস্তাব করিল, এবার শ্রাবণে সে নৌকা দৌড়াইবে, এজন্য দৌড়ের নৌকা একটা বানাইতে হইবে, তার জন্য টাকা চাই, কাদির তখন ঝাঁপি খুলিয়া চারশ টাকা তার হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘নে, নাও বানা, ঘর বানা, পানিতে ফালাইয়া দে। যা খুশি কর্।’
অত সহজে কাজ হাসিল হইয়া গেল দেখিয়া ছাদিরের খুশি আর ধরে না।
ছাদিরের কাঠ কেনার প্রসঙ্গে একদিন ঘরে আলোচনা হইল।
ছাদির বলিল, ‘সে এক পরস্তাব।’
গল্পের আভাস পাইয়া রমু তার কোল ঘেঁষিয়া বসিল এবং প্রকাণ্ড একটা বিস্ময়-ভরা জিজ্ঞাসা লইয়া বাপের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
তারা নাকি দুজন মালো। গায়ে নাকি তাদের হাতীর মতন জোর। নামও তাদের তেমনি জমকালো—একজনের নাম ইচ্ছারাম মালো, আরেকজনের নাম ঈশ্বর মালো—নিবাস নবীনগর গাঁয়ে।
তারা কি করিয়াছে, না, পাহাড় হইতে বহিয়া আসে যে জলের স্রোত, তারই সঙ্গে সঙ্গে কোমরে কাছি বাঁধিয়া বড় বড় গাছের গুঁড়ি টানিয়া নামাইয়াছে। সে গাছের গুঁড়ি চিরিয়া তক্তা করা হইবে, তাহাতে তৈয়ারী হইবে ছাদিরের দৌড়ের নৌকা, সে নৌকা সে হাজার বৈঠা ফেলিয়া আরও দশবিশটা দৌড়ের নৌকার সঙ্গে পাল্লা দিয়া দৌড়াইবে, আর সব নৌকাকে পাছে ফেলিয়া জয়লাভ করিবে, করিয়া মেডেল পাইবে, পিতলের কলসী পাইবে আর পাইবে বড় একটা খাসি।
‘বেহুদা—একেবারে বেহুদা! এর লাগি কত হাঙ্গামা কইরা নাও গড়াইবি?’ কাদির টাকা দিবার পর একদিন প্রশ্ন করিয়াছিল।
ছাদিরও জবাব দিয়াছিল, ‘জিনিসগুলি খুব থোরা দেখলা, না? কিন্তুক, জিত্লে খালি তোমার আমার গৈরব না, সারা বিরামপুর গাঁওয়ের গৈরব।’
‘একদিন হৈ-হাঙ্গামা করবি, জিত্বি, পিতলা কলস পাইবি, মানলাম। তারপর এই-নাও দিয়া তুই করবি কি? কি কামে লাগব এই দেড়শ-হাতি লিক্লিকা পাতাম নাও?’
—কেন, অনেক কাজে লাগিবে। বর্ষার যে-কয়মাস ক্ষেতে-খামারে পানি থাকিবে, এ নৌকা লইয়া বিলে গিয়া বোঝাই-ভরতি ঘাস কাটিয়া আনা যাইবে গাই-গরুর জন্য।
—সে কাজ তো একটা ঘাস কাটা পাতাম দিয়াই চলে?
—চলে, কিন্তু ঘাস কাটা পাতাম দিয়া তো আর নাও-দৌড়ানি চলে না। আর এই নাও দিয়া দৌড়ানিও চলে ঘাস কাটাও চলে।
—বিলের পানি শুকাইয়া গেলে তো এ নাও অচল, তখন তারে দিয়া কি করিবি? রোদে তখন সেত খালি ফাটিবে।
—ফাটিবে কেন? গেরাপি দিয়া তারে তিতাসের পানিতে ডুবাইয়া রাখিব, তার পেটে কতগুলি ডালপালা রাখিয়া দিব, আশ্রয় পাইয়া মাছের আসিয়া জমিবে; তখন সময়-সময় জল সেঁচিয়া সে-মাছ ডোলা ভরিয়া বাড়িতে আনিব।
ছাদিরের বুদ্ধি দেখিয়া কাদির অবাক হইল, বলিল, ‘মিয়া, বুদ্ধি বাৎলাইছ চমৎকার।’
রমু কয়েক রাত স্বপ্ন দেখিয়াছে সেই মালো দুজনকে—যে দুজন কোমরে কাছি বাঁধিয়া নদী নালা ভাঙ্গিয়া তার বাপের জন্য কাঠ লইয়া আসিতেছে।
একদিন তিতাসের পারে গিয়া দেখে, দূর হইতে একখানা কাঠের ‘চালি’ ভাসিয়া আসিতেছে, ভেলার মত। তাহাতে ছোট একখানা ছই।
সেই দুজনকেও দেখা গেল। তারা চালির দুই পাশ হইতে মোট লগি ঠেলিতেছে। সেই ঈশ্বর মালো আর ইচ্ছারাম মালো নামে রূপকথার মানুষ দুইটা। পাহাড় পর্বত ভাঙ্গিয়া, খালবিল ডিঙ্গাইয়া, কত দেশদেশান্তরের বুক চিরিয়া তারা যেন এক বোঝাই গল্প লইয়া আসিয়াছে। ছোট ছইখানার ভিতরে দুইজনার সংক্ষিপ্ত ঘরকরনা। পরণে দুইজনেরই এক একখানা গামছা, গা মসৃণ কালো। শুশুকের মতই যেন জল হইতে ভাসিয়া উঠিয়া কাঠের চালিতে লগি ঠেলিতেছে। কাঠ বিক্রি হইয়া গেলে, আবার যখন শুশুকের মতো একডুবে জলের ভিতর তলাইয়া যাইবে, তখন আর তাহাদের কোন চিহ্নই জলের বাহিরের এই সংসারে দেখিতে পাওয়া যাইবে না।
ছাদিরের সঙ্গে সামান্য দুই একটি কথাবার্তা শেষ করিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই তাহারা প্রকাণ্ড একটা গুঁড়ি, চালির বাঁধন হইতে খুলিয়া রাখিয়া আবার আগাইয়া চলিল। ছাদির বলিতেছিল, মালোর পুত, আজ দুপুরে এখানে পাকসাক কর, থাক, খাও, কাল ফজরে উঠিয়া চালি চালাইও।
শুধু একটি মাত্র কথা তাহারা বলিল, না শেখের পুত্। এখানে চালি থামাইব না, রমারম্ গোকনের ঘাটে গিয়া পাক বসাইব।
বলিয়াই তাহার লগি ঠেলা দিল। মুখে কত বড় ব্যস্ততা কিন্তু চলনে কতখানি ধীর! কোন্ আদিম যুগের যেন যান একখানা, একালের চলার দ্রুততার সঙ্গে এর যেন কোন পরিচয়ই নাই। অত ধীরে চলে, কিন্তু থামিয়া সময় নষ্ট করে না। রমু ভাবিয়াছিল, এই দুইজনের কাছে একবার সাহস করিয়া ঘেঁষিতে পারিলে অনেক কিছু জানিয়া লওয়া যাইবে। কিন্তু তাহারা ধীরে ধীরে চলিয়া যাইতেছে। এমন ধীরে ধীরে, যেন হাঁটিয়া গিয়া অনায়াসে ইহাদিগকে পিছনে ফেলিয়া রাখা যাইবে—এত ধীরে—কিন্তু কি গম্ভীর সে-চলা। দ্রুত হাঁটার মধ্যে কোথায় সেই গাম্ভীর্য!
রমু এই বলিয়া নিজের মনকে প্রবোধ দিল, যারা অনেক দূরের অনেক কিছু খবরাখবর বহিয়া বেড়ায়, তারা অধিকক্ষণ থাকে না, এমনি ধীরে ও দৃঢ়তায়, এমনি ধীরে ও নিষ্ঠুরতায় তারা চলিয়া যায়।
পরের দিন সকালে প্রকাণ্ড একটা করাত কাঁধে লইয়া চারিজন করাতী আসিল। তিতাসের পারে একখণ্ড অকর্ষিত জমির উপর একটা আড়া বাঁধিয়া, পাড়ার লোকজন ডাকিয়া প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়িটাকে আড়াআড়িভাবে তাহাতে স্থাপন করিল, তারপর নিচে দুইজন উপরে দুইজন করাতী চান্চুন্ চান্চুন্ করিয়া করাত চালাইয়া দিল।
দুইদিনে সব কাঠ চেরা হইয়া গেলে, তক্তাগুলি পাট করিয়া রাখিয়া পারিশ্রমিক লইয়া করাতীরা বিদায় হইল, আর রমুর বয়সের ছেলেমেয়েরা একগাদা করাতের গুঁড়ায় দাপাদাপি করিয়া খেলায় মাতিয়া গেল।
বাপ আচ্ছা এক মজার কাণ্ড শুরু করিয়া দিয়াছে। এ গাঁয়ে যা কোনদিন কেউ করে নাই, তেমনি এক কাণ্ড। রমু মনে মনে ভাবিতে লাগিল।
তারপর একদিন দেখা গেল, তিতাসের পারে একখানা অস্থায়ী চালাঘর উঠিয়াছে। কয়েকদিন পরে সে-ঘরের বাসিন্দারাও ছোট ছোট কয়েকখানা কাঠের বাক্স মাথায় করিয়া হাজির হইল। তারা চারিজন ছুতার মিস্ত্রী। নাও গড়াইবার যাবতীয় হাতিয়ার লইয়া সে-ঘরে বসতি স্থাপন করিয়াছে।
আগাপাছার ‘ছেউ’ ঠিক করিয়া যেদিন তাহারা নাও ‘টাঙ্গিল’, সেদিন রমুর বিস্ময়ের সীমা রহিল না। নৌকার মেরুদণ্ড মাত্র পত্তন করা হইয়াছে। সেই মেরুদণ্ডের ডগা আড় হইয়া আকাশ ঠেলিয়া কতখানি যে উপরে উঠিয়াছে, রমুর ক্ষুদ্র দৃষ্টি তার কি পরিমাপ করিবে! কিন্তু মিস্ত্রী দুইজন অত উঁচুতে গিয়া বসিয়াও কেমন হাতুড়ি পিটাইতেছে, আর পেরেক ঠুকিতেছে!
মাপজোখ লইয়া এই মেরুদণ্ড ঠিক করিতে কয়েকদিন লাগিল। তারপর পূরাদমে শুরু হইল কাজ। এক একটা তক্তায় কাদা মাখাইয়া আগুনে পোড়াইয়া টানা দিয়া মোড়ন দিয়া বাঁকাইয়া, খাঁজ কাটিয়া জোড়া দেয়, আর পাতাম লোহার একদিক বসাইয়া আস্তে হাতুড়ির টোকা দেয়, একদিক সামান্য একটু বসিলে, আরেকদিক ঘুরাইয়া খাঁজের উপর বসাইয়া হাতুড়ি দিয়া পিটিতে থাকে—ডুম্ ডুম্—টাকুর টাকুর ডুম্!
দেখিতে দেখিতে নৌকার অস্থিমাংস জোড়া লাগিতে লাগিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ পাইতে এখনও অনেক বাকি।
ছাদির বলিল, ‘রমু, বা’জি একটা কাম কর। আমি ক্ষেতে যাই, তুমি মেস্তুরেরে তামুক জ্বালাইয়া দিও, কেমুন!’
একটা কাজ পাইয়া রমু বর্তাইয়া গেল। সেই হইতে বাড়িতে বড় একটা সে আসেই না। কেবল ঠিক-দুপুরে মিস্ত্রিরা যখন কাজ থামাইয়া রান্না চড়ায়, তখন সে একবার নিজের ক্ষুধাটা অনুভব করিয়া বাড়িতে আসে। কিন্তু মন পড়িয়া থাকে মিস্ত্রিদের উন্মুক্ত ছোট সংসারখানাতে। সেখানে শুধু কয়েকটি হাতুড়ি আর বাটালির কারসাজিতে কেমন লম্বা লিক্লিকে একটা নৌকা গড়িয়া উঠিতেছে।
রমুর ভবিষ্যৎ লইয়া একদিন বাপ-ছেলেতে কথা কাটাকাটি হইয়া গেল। ছাদির বলিল, তারে কিতাব হাতে দিয়া মক্তবে পাঠাইব। কাদির হাসিয়া বলিল, না, তারে পাচন হাতে দিয়া গরুর পিছে পিছে মাঠে পাঠাইব।
মাঠে পাঠাইলে সে আমার মত মূর্খ চাষাই থাকিয়া যাইবে। দুনিয়ার হাল-অবস্থা কিছুই জানিতে পারিবে না। মানুষ হইতে পারিবে না।
আর ইশ্কলে পাঠাইলে, তোর শ্বশুরের মত মুহুরী হইতে পারিবে আর শাশুড়ীর বিছানায় বৌকে ও বৌয়ের বিছানায় শাশুড়ীকে শোয়াইয়া দিয়া দূরে সরিয়া ঘুষের পয়সা গুণিতে পারিবে। কাজ নাই বাবা অমন লেখাপড়া শিখিয়া।
রমুর মার রাগ হইল। যত দোষ বুঝি আমার বাপের। আমার বাপ ঘুষ খায়; আমার বাপ চুরি করে; আমার বাপ ফল্না করে, তস্কা করে—কি যে না করে!
তুই থাম্, ছাদির ধমক দিল।
না, থামিব না, আমার বাপ যখন অত দোষের দোষী, তখন জানিয়া শুনিয়া এমন চোরের মাইয়া ঘরে আনিলে কেন? আর আনিলেই যদি, খেদাইয়া দিলে না কেন?
খেদাইয়া দিলে আরেক খানে গিয়া খুব সুখে থাকিতে পারিতিস্, না?
আহা, কত সুখেই না আছি এখানে!
বিষমুখী তুই থামিবি, না চোপা বাজাইবি?
ইস্ থামিবে। আমি বিষমুখী, আমার বাপ চোর, আবার থামিবে।
রাগে ছাদির উঠিয়া গিয়া মারে আর কি। কাদির তাহাকে ঘাড় ধরিয়া বসাইয়া দিল।
মেয়েটার মধ্যে এক বিদ্রোহের মূর্তি দেখা গেল এই প্রথম। কাদিরের মনে কোথায় যেন একটু খোঁচা লাগিল। মুহুরীর মেয়ে জোর গলায় বলিয়া চলিল, ‘চোর হোক ধাওর হোক, তারইত আমি মাইয়া। বাপ হইয়া মার মতন পালছে, খাওয়াইছে ধোয়াইছে—হাজার হোক, তবু বাপ। চোর হইলেও আমারই বাপ, আর কাউর বাপ না। আমি মরলে এই বাপেরই বুক খালি হইব। আর কোন বাপের বুক খালি হইব না।’
‘না হইব না! চোরের মাইয়ার আবার টাস-টাইস্যা কথা। খালি হইব না তোমারে কইল কেডায়?’—কাদিরের চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। তার জমিলার কথা মনে পড়িয়া বেদনায় বুকটা টন্টন্ করিতে লাগিল, মনে মনে বলিল, মুহুরী যত দোষের দোষী না, তার চাইতে অধিক দোষী করিয়া আমরা এই অসহায় মেয়েটাকে সকলে মিলিয়া জর্জরিত করিতেছি। আমি যত দোষের দোষী না, তার চাইতেও অধিক দোষের দোষী করিয়া তারাও যদি আমার জমিলাকে এমনি জর্জরিত করিতে থাকে, জমিলা কি তখন নিথর পাষাণের মত চুপ করিয়া শোনে আর চেখের জল ফেলে? জমিলা কি তার এতটুকু প্রতিবাদ করে না? করিলে তবু মেয়েটা বাঁচিয়া যাইত মন হালকা করিয়া, কিন্তু না করিলে, সে যখন নিরুপায়ের মত সহিতে হইবে মনে করিয়া তিলে তিলে ক্ষয় হইতে থাকিবে, তখন তাহাকে দুইটা সান্ত্বনার কথা শুনাইবে কে? জমিলা। সে ও মা-মরা মেয়ে। এ যেমন মুহুরীর বুক-সেঁচা ধন, জমিলাও তেমনি কাদিরের বুক-সেঁচা ধন। তবে, বাপ হিসাবে মুহুরীতে আর কাদিরেতে তফাৎ কি? তফাৎ শুধু এই যে, মুহুরী আবার একটা শাদি করিয়াছে। কাদির তার ছেলের দিকে চাহিয়া তাহা করে নাই। আরেকটা শাদি করিয়াও যখন মুহুরী মেয়েটাকে ভুলিতে পারে নাই, তখন কাদির ঘরে একটা গৃহিণী না আনিয়া, ছেলেটার ও মেয়েটার উপর হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করিয়া দিয়া, জমিলাকে কেমন করিয়া ভুলিয়া থাকিবে? কিন্তু তবু ভুলিয়া সে আছে ইহা ঠিক। যদি ভুলিয়া না থাকিত, কতদিন আগে একবার সে দুই দিনের জন্য এখানে আসিয়াছিল—সেই গত অঘ্রাণে—দুই দিন থাকিয়া চলিয়া গিয়াছে। অতদিন আগে সে আসিয়াছিল, ভুলিয়া না থাকিলে এতদিনের মধ্যে দুইবারও কি জমিলাকে এখানে আনা হইত না? কিন্তু কেন কাদির অত আদরের জমিলাকেও ভুলিয়া থাকিতে পারে? কেন? এই রাক্ষুসী মেয়েটারই জন্য নয় কি? সে আসিয়া এ বাড়িতে কাদিরের বুকে জমিলার যে স্থানটুকু ছিল, সেটুকু যদি অধিকার করিয়া না বসিত, বুড়া কাদির কি তাহা হইলে পরের ঘরে মেয়ে দিয়া বাঁচিতে পারিত!
রমুর মা খুশী তখনও গজরাইতেছে, সাধে কি লোকে বলে পরের ঘর! পরের ঘরই ত। যে-ঘরে আসিয়া বাপ হয় চোর, আর নিজে হয় বিষমুখী, সে-ঘর কি আপনা-ঘর! সে ঘর কি পরের ঘর নয়?
হ, হ, পরের ঘর। মুহুরীর মেয়েটা বলে কি? রাত না পোহাইতে উঠিয়া বিশটা গরুর গোয়াল সাফ করা, খইলভুষি দেওয়া, ঝাঁটা হাতে বাহির হইয়া এত বড় উঠানবাড়ি পরিষ্কার করা, কলসের পর কলস পানি তোলা, রান্ধা, খাওয়ানো, ধান শুকানো, কাক তাড়ানো, উঠান-ভরতি ধান রোদে হাঁটিয়া পা দিয়া উল্টানো পাল্টানো, তারপর খড় শুকানো, শোলা শুকানো, পাট ইন্দুরে কাটে, তারে দেখা, অত অত ধান ভানা, ফের রান্নাবাড়া করা—এত হাজার রকমের কাজ—পরের ঘরে কি কেউ এত কাজ করে কোন দিন? শরীর মাটি করিয়া এত কাজ যে-ঘরের জন্য করিতেছে, তারে কয় কিনা পরের ঘর! কহিলেই হইল আর কি, মুখের ত আর কেরায়া নাই।
খুশীর চোখে এবার দ্বিগুণ বেগে জল আসিয়া পড়িল। এবার সে ফোঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। অনেক কাঁদিবার পর তাহার মনে হইল, এমন কাঁদন কাঁদিয়াও সুখ।
পরিশেষে কাদির বলিল, ‘দে, তোর পুতেরে মক্তবে দে, কিন্তু কইয়া রাখলাম, যদি মিছাকথা শিখে, যদি জালজুয়াচুরি শিখে, যদি পরেরে ঠকাইতে শিখে, তবে তারে আমি কিছু কমু না, শুধু তোমার মাথাটা আমি ফাটাইয়া দিমু, ছাদির মিয়া।’
পরের দিন রমু নূতন লুঙ্গি জামা পরিয়া নূতন টুপি মাথায় দিয়া মক্তবে গেল। পড়িয়া আসিয়া মার কাছ হইতে কিছু খাবার খাইয়া হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, সেই চারজনকে ত নূতন লুঙ্গি গেঞ্জি টুপি দেখানো হয় নাই। মক্তবের ছেলেরা কতবার চাহিয়া দেখিয়াছে। আর সেই চারজন দেখিবে না।
নূতন পোষাকে সজ্জিত রমুকে তাহাদের জন্য তামাক সাজিতে বসিতে দেখিয়া তাহাদের একজনের বড় মায়া হইল, বলিল, থাক্ থাক্ মুনশীর পুত। তোমার আর টিকার কালি ঘাটিয়া দরকার নাই।
বেলা পড়িয়া আসিতেছে। অদূরেই ঘাটের পথ। লাল-কালো, ডুরি-ডুরি শাড়ি পরা গেরস্থ বৌ-ঝিরা সেই পথ দিয়া তিতাসের ঘাটে যাইতেছে। কারে হাতে চালের ধুচ্নি, কারো কাঁখে কলসী। কারো পায়ে রূপার মল।
দেখিয়া জনৈক ছুতারের গলায় গান জমিয়া উঠিল: ছোট লোকের খানা-পিনা রে বিহানে বৈকালে, বড় লোকের খানা-পিনা রাত্র নিশা কালেরে—হায় কান্দে, কান্দে রে দেওয়ান কটু মিয়ার মায়॥
সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ ছুতার বাধা দিল, দেখ বুদ্ধিমানের পুত, ইহাদিগকে শুনাইয়া গান গাহিলে মাথা লইয়া দেশে যাইতে পারিবে না।
মাথা না হয় রাখিয়াই যাইব।
একটা লোক মাথা রাখিয়া আবার যায় কি করিয়া রমু ভাবিয়া পাইল না। তবে গানটা শুনিতে তার খুব ভাল লাগিল।
থামিলে কেন, গাওনা তোমার গান।
বড় মিস্ত্রী তার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, দুপুর বেলা আসিলে আমি গান শুনাইতে পারি, সকালে বিকালে পারি না।
দুপুরে যে আমি পড়িতে যাই।
তবে গান শুনিয়া কাজ নাই।
কাজ নাই কেন?
পড়িতে হইলে গান শোনা হয় না, আর গান শুনিতে হইলে পড়া হয় না, এই রকম যখন অবস্থা, তখন পড়াই ভাল, গান শুনিয়া কাজ নাই।
শুক্রবারে বক্তব ছুটি থাকে! দুপুর বেলা রমু লুঙ্গি পরিল, টুপি পরিল, কিন্তু গেঞ্জি পরিতে ভুলিয়া গেল। তারপর সে মিস্ত্রিদের নিকট হাজির হইল। কিন্তু বড় মিস্ত্রী তাহাকে নিরাশ করিয়া জানাইল, হাতে বড় কাজ এখন সুবিধা হইবে না। আরও বলিয়া দিল, বাড়িতে গিয়া বল, দুধ জ্বাল দেওয়ার ঝামেলা পোহাইবার আজকাল আর সময় নাই। দুধ যেন বাড়ি হইতেই জ্বাল দিয়া চিড়াগুড়ের সঙ্গে পাঠাইয়া দেয়।
রমুর মা দুধ জ্বাল দেওয়ার কড়াখানাকে ঝামা দিয়া দুই তিন বার মাজিয়া দুধ ফুটাইল এবং বড় একটা লোটার গলায় ফাঁস পরাইয়া রমুকে দিয়া পাঠাইল। মাথায় চিড়ার বোঝা, হাতে দড়ি-বাঁধা দুধের লোটা এই বেশে রমুকে দেখিয়া মিস্ত্রিরা হাসি সম্বরণ করিতে পারিল না।
তারপর দেখিতে দেখিতে একদিন গোটা একটা নৌকা তৈয়ার হইয়া গেল। এখন শুধু বাকি রহিল, নৌকা কাত করিয়া তলার দিকটা পালিশ করা। সে কাজের ভার ছোট তিনজনার হাতে ছাড়িয়া দিয়া বড় মিস্ত্রী হুকা হাতে লইয়া বসিল এবং আস্তে আস্তে গান জুড়িয়া দিল—হস্তেতে লইয়া লাঠি, কান্ধেতে ফেলিয়া ছাতি, যায়ে বুরুজ দীঘল পরবাসে॥
তারপর, পথশ্রমে বুরুজ ক্লান্ত হইল এবং—চৈত্রি না বৈশাখ মাসে, পিঙ্গল রৌদ্রির তাপে, লাগিল দারুণ জল-পিপাসা॥ তখন সে জলের জন্য এদিক ওদিক তাকাইতে লাগিল, কিন্তু কোথাও না নদী, না পুষ্করিণী। কিন্তু সহসা তার চোখে পড়িল—ঘরখানা লেপাপুছা, দুয়ারে চন্দনের ছিটা, এটা বুঝি ব্রাহ্মণের বাড়ি॥ বুরুজ নিজে ব্রাহ্মণ, কাজেই ব্রাহ্মণের বাড়ি চিনিতে তাহার বিলম্ব হইল না। এত যখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তখন এটা কোনও ব্রাহ্মণের বাড়ি না হইয়া যায় না। বুরুজ তখন আগাইয়া ডাক দিল—ঘরে আছ ঘরণীয়া ভাই, জল নি আছে খাইতে চাই, পরবাসী তিয়াস লেগে মরি॥ তাহার আহ্বান ব্যর্থ হইল না—ডান হস্তে জলের ঝারি, বাম হস্তে পানের খাড়ি, যায়ে কন্যা জলপান করাইতে॥ পিপাসাকাতর বুরুজ—জল খাইয়া শান্ত হইয়া, জিগাস করে তুমি কোন্ জাতের মাইয়া, (বলে) জাতে আমরা গন্ধভুঁইমালী॥ বুরুজের জাতি গেল, হায় হায়, ব্রাহ্মণ বুরুজের জাতি গেল। আগে পরিচয় জিজ্ঞাসা না করিয়া যার হাতের জল সে পান করিল, সে ত ব্রাহ্মণের মেয়ে নয়। সে ছোট জাতের মেয়ে—আছাড় খাইয়া বুরুজে কান্দে, পিছাড় খাইয়া বুরুজে কান্দে, জাতি গেল ভুঁইমালিয়ার ঘরে॥ বুরুজের জাতি গিয়াছে। সে কি করিবে? না গেল প্রবাসে না গেল দেশে, ফিরিয়া যেখানে তাহার জাতি নষ্ট হইল, সেখানেই সে রহিয়া গেল, আর বলিয়া দিল—সঙ্গের যত সঙ্গীয়া ভাই, কইও খবর মা বাপের ঠাঁই, জাতি গেল ভুঁইমালিয়ার ঘরে॥
বেঘোরে একটা লোকের জাতি নষ্ট হইয়াছে শুনিয়া রমুর খুব দুঃখ হইল। জীবনে ব্রাহ্মণ সে দেখে নাই। তবে তার সম্বন্ধে যতটুকু শুনিয়াছে, মনে মনে বিচার করিয়া রাখিয়াছে, সাধারণ মানুষ অপেক্ষা তাহারা মাথায় অনেক উঁচু। তারা নাকি মন্ত্র বলে। তারা নাকি অনেক মোটা মোটা কিতাব পড়িয়া শেষ করিয়া রাখিয়াছে। আর মালী! তারা তো শুনিয়াছি হিন্দু বাড়ির বিবাহে কলাগাছ পুঁতিয়া দেয়। এ আর তেমন কি কাজ তারা করে। আর এইরকম এক মালীর ঘরেই অমন-একটা পণ্ডিত মানুষের জাতি নষ্ট হইয়া গেল। ব্রাহ্মণত্ব খোয়াইয়া সে মালী হইয়া মালী-বাড়িতে রহিয়া গেল। এখন কি আর সে বিবাহ-বাড়িতে গিয়া মন্ত্র পড়িবে, না মোটা মোটা কিতাব মুখস্থ করিবে? এখন হইতে সে শুধু বিবাহ-বাড়িতে গিয়া কয়েকটা কলাগাছ পুঁতিয়া দিবে। এই সামান্য কাজের দরুণ কেউ তাহার দিকে ফিরিয়াও তাকাইবে না। কিন্তু তার অত বড় জাতি, সেটা নষ্ট হইল কেন? এ ত সাংঘাতিক কথা।
—তিয়াস লাগিল, একগেলাস পানি খাইল, আর জাতি গেল!
‘গেল ত!’
‘কেনে গেল!’
‘কেনে জানি না। কিন্তুক গেল।’
—গেল যে, তাই বা সে জানিতে পারিল কি করিয়া!
বড় মিস্ত্রী চুপ করিয়া রহিল। ছোট মিস্ত্রিদের একজন রাগিয়া উঠিল: ভারী ত চাষার ছেলে, পাচন হাতে গরু রাখিবে, তার কথার কেমন প্যাঁচ দেখ না।
সে-কথায় কান না দিয়া রমু বলিল, আমার হাতের পানি খাইলে তোমার জাত যাইবে?
শক্ত প্রশ্ন। বড় মিস্ত্রী চট করিয়া মীমাংসা করিয়া বলিল, না।
—আমার মার হাতের পানি খাইলে?
—না।
—আমার বাপের হাতের? নানার হাতের?
—না, না, না। তোমাদের সাথে জানা-পরিচিতি হইয়া গিয়াছে।
—জানা-পরিচিতি হইলে জাত যায় না?
—না।
—তবে বুরুজ ঠাকুরের যদি ঐ মালীর-ছেমরীর সাথে জানা-পরিচিতি হইয়া যাইত তবে পানি খাইলে জাত যাইত না?
বড় মিস্ত্রী হাঁ না কিছুই বলিল না। তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া রমু সহসা হাততালি দিয়া হাসিয়া উঠিল।
বড় মিস্ত্রী বিরক্ত হইয়া বলিল, হাসিলে যে।
—হাসিলাম একটা কথা মনে করিয়া। কথাটা এই, আমার ছোঁয়া পানি খাইলে তোমাদের যদি জাত যাইত তবে বেশ হইত।
বড় মিস্ত্রীর দুই চোখ বিস্ফারিত হইল, কি রকম?
—বুরুজ ঠাকুরের মত তোমাদিগকেও আমাদের বাড়িতে থাকিয়া যাইতে হইত।
বড় মিস্ত্রী ঠকিয়া গিয়া কাজে মন দিল।
যে-দিন নাও গড়ানি শেষ হইল সেদিন মিস্ত্রিদের খুশি আর ধরে না। দীর্ঘদিনের চেষ্টা ও শ্রম আজ সফল হইল। এমন একখান চিজ তারা গড়িয়া দিল যে-চিজ অনেক—অনেকদিন পর্যন্ত জলের উপর ভাসিবে—কত লোক তাতে চড়িবে, বসিবে, নদী পার হইবে—এক দেশ হইতে আরেক দেশে যাইবে—কত জায়গায় দৌড়াইবে, বখ্শিস্ পাইবে—আর এই চারজনার হাতের স্বাক্ষর স্বগর্বে বহন করিতে থাকিবে। কেউ জানিবে না, কারা গড়িয়াছিল, কাদের বিন্দু বিন্দু শ্রম ও বুদ্ধির সঞ্চয় সম্বল করিয়া ধীরে ধীরে সে গড়িয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নাও? সে কি ভুলিয়া যাইবে এই চার জনকে? কিছুতেই না!
সেদিন তাদের খুশি উপচাইয়া উঠিল। লোকজন জড় করিয়া চারি জনে মিলিয়া তারা পায়ের পরে পা ফেলিয়া নাচিল এবং সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়া গাহিল—শুনরে নগইরা লোক, নাও গড়াইতে কত সুখ॥
নাও-গড়ানি শেষ করিয়া মিস্ত্রীরা পাওনা গণ্ডা বুঝিয়া লইয়া সত্যি একদিন কাঠের বাক্স মাথায় করিল, হাঁটুর কাপড় টানিয়া টানিয়া খাল পার হইল এবং গোপাটের পথ ধরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া গেল, কিন্তু দেখিতে তারা এক-একটা কাকের মত ছোট হইয়া গেল, তারপর এক সময় আর তাহাদিগকে দেখা গেল না!
আর একদিন কোথা হইতে তিনজন কারিগর আসিয়া দিনরাত কাজ করিয়া নৌকায় তুলি বুলাইয়া বুলাইয়া রঙ লাগাইয়া গেল। দুই পাশে লতা হইল, পাতা হইল, সাপ হইল, ময়ূর হইল আর একজোড়া করিয়া পালোয়ান হইল।
তারপর একদিন নৌকা জলে ভাসিল। ছাদির পাড়ার লোক ডাকিয়া আনিয়াছিল আর আনিয়াছিল এক হাঁড়ি বাতাসা। তাহারা নৌকার গোরায় গোরায় ধরিল; একজন বলিল, জোর আছে? সকলে বলিল, আছে। আবার সকলে বলিল, যে জোর থুইয়া জোর না করে তার জোর খায় মরা কাষ্টে রে-এ-এ...। এই বলিয়া এমন জোরে টান মারিল যে, নৌকা একটানেই জলে গিয়া পড়িল। কিন্তু তারা নৌকা থামিতে দিল না, সকলে মিলিয়া গায়ের জোরে ঠেলা দিল। ঠেলার বেগে নৌকা তিতাসের মাঝ পর্যন্ত গিয়া থামিল। ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে তালে হেলিয়া দুলিয়া নাচিতে লাগিল। রমুর দুই চোখও আনন্দে নাচিতে লাগিল।
অমন অপূর্ব জিনিস আর দেখা যায় নাই! এমন রঙ, এমন শোভা! ধনুকের মত বাঁকা আসমানের রামধনুটা বুঝিবা উল্টাইয়া তিতাসের জলের উপর পড়িয়া গিয়াছে।
ভাদ্রের পয়লা তারিখে কাদিরের বাড়িতে খুব ধুমধাম পড়িল। সকাল হইতে না হইতেই শত শত জোরদার চাষী তরুণ সেদিন তার বাড়িতে জমায়েত হইল। তারপর তারা রাঙা বৈঠা হাতে করিয়া নৌকায় উঠিয়া গোরায়-গোরায় বসিয়া গেল।
রমু এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করিতেছিল। এই সময় তার বাপকে একান্তে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘বা’জান তোমরা নাও দৌড়াইতে যাইবা, আমারে নিবা না?
‘অখন কিসের নাও-দৌড়ানি? অখন ত খালি তালিম দিতে যাই। নাও-দৌড়াইতে যামু দুপুরের পর।’
‘তখন আমারে নিবা না?’
‘হ হ’, বলিয়া ছাদির ঝড়ের বেগে ছুটিয়া গেল।
গাঙ-বিলে ঘুরিয়া, গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরিয়া তালিম দিয়া আসিয়া দেখা গেল, নাও খুব ভাল হইয়াছে, চলেও খুব। সব লোকে একযোগে বৈঠা মারিলে সাপের মত হিস্ হিস্ করিয়া চলে, শিকারীর তীরের মত সাঁ সাঁ করিয়া চলে, গাঙের সোঁতের মত কলকল করিয়া চলে।
সকলে দুপুরের খাওয়া সারিয়া আবার যখন বৈঠা হাতে করিয়া নৌকায় উঠিল, রমুও তখন সকলের দেখাদেখি, রাঙা লুঙ্গিখানা পরিয়া, গেঞ্জিখানা গায়ে দিয়া এবং রঙিন টুপিখানা মাথায় চড়াইয়া সকলের সমারোহের মধ্যে নদীর পারে আসিয়া দাঁড়াইল।
দুই পাশে দুই সারি লোক বৈঠা হাতে বসিয়া পড়িল। মাঝখানে কয়েকখানা তক্তার উপর, মাস্তুলের মত ছোট একখানা খুঁটি ঘিরিয়া কয়েকজন প্রবীণ লোক দাঁড়াইল। তারা সারি গাহিবে। একটি ঢোলক এবং কয়েকজোড়া করতালও উঠিল। আর উঠিল কিছু মারপিটের লাঠি।
সব কিছু উঠাইয়া ছাদির নিজে উঠিতে যাইবে, এমন সময় রমু তাহাকে কাঁকড়ার দাঁড়ার মত আঁকড়াইয়া ধরিল, ‘বাজান আমারে লইয়া যাও, অ বাজান আমারে লইয়া যাও।’
‘কামের সময় দিক্ করিস না, ভাল লাগে না।’ বলিয়া ছাদির তাহাকে এক ঝটিকায় ছাড়াইয়া, ঠেলিয়া দিল, তারপর নৌকায় উঠিয়া হালের খুঁটিতে হাত দিল।
আলীর নাম স্মরণ করিয়া তাহারা নৌকা খুলিল, শত শত বৈঠা এক সঙ্গে উঠিল, পড়িল, জলের উপর কুয়াসা সৃষ্টি করিল, তারপর তিতাসের বুক চিরিয়া যেন একখানা শিকারীর তীর হিস্ হিস্ করিয়া ছুটিয়া চলিল।
ছাদির যখন হাল-কাঠি ধরিয়া সারিগানের তালে তালে তক্তার উপর পদাঘাত করিয়া নাচিতেছে, রমু তখন তিতাসের শূন্য তীরে বসিয়া ফোঁফাইয়া ফোঁফাইয়া কাঁদিতেছে। নানা সাধিল, মা সাধিল, কিন্তু কারো কথা সে শুনিল না। মুখে তখনও সে বলিতেছে, ‘বাজান, আমারে লইয়া যাও।’
তিতাসের বুকে সেদিন অনেকগুলি পালের নৌকা দেখা গেল। সব নৌকারই গতি এক দিকে। যে স্থানে আজ দুপুরের পর নৌকা-দৌড় হইবে, সেই দিক লক্ষ্য করিয়া ছোট বড় নানা আকারের পালের নৌকা ছুটিয়া চলিয়াছে। অনেক নৌকাতেই যত পুরুষ তার বেশি স্ত্রীলোক। বনমালীর নৌকাতেও তাই। পুরুষের মধ্যে বনমালী নিজে আর বড়বাড়ির দুইজন। তাছাড়া অনন্ত। মেয়েদের মধ্যে আসিয়াছে বড়বাড়ির সকলে আর তাদের নন্দিনী অনন্তবালা, আর আসিয়াছে বনমালীর বোন উদয়তারা।
নৌকা-দৌড়ের স্থানটিতে গিয়া দেখে সে এক বিরাট কাণ্ড। তিতাসটা এইখান হইতে মাইল খানেক পর্যন্ত অনেকটা মোটা হইয়া গিয়াছে। তারই দুইপার ঘেঁষিয়া হাজার হাজার ছোট বড় ছইওয়ালা নৌকা খুঁটি পুঁতিয়াছে। কোথাও বড় বড় নৌকা গেরাপি দিয়াছে, আর তাহারই ডাইনে বাঁয়ে ও সামনের দিকে দশ বিশটা ছোট নৌকা তাহাকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। এই ভাবে যত দূর চোখ মেলা যায়, কেবল নৌকা আর নৌকা, আর তাতে মানুষের বোঝাই। নদীর মাঝখান দিয়া দৌড়ের নৌকার প্রতিযোগিতার পথ।
সবে বেলা পড়িতে শুরু করিয়াছে। প্রতিযোগিতা শুরু হইবে শেষবেলার দিকে। এখন দৌড়ের নৌকাগুলি ধীরে-সুস্থে বৈঠা ফেলিয়া নানা সুরের সারিগান গাহিয়া গাঙ্ময় এধার ওধার ঘুরিয়া ফিরিতেছে। হাজার হাজার দর্শকের নৌকা হইতে দর্শকেরা সে-সব নৌকার কারুকার্য দেখিতেছে, বৈঠা মারিয়া কি করিয়া উহারা জলের কুয়াসা সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা দেখিতেছে।
এক সঙ্গে এতগুলি দৌড়ের নাও দেখিয়া অনন্তর বুক আনন্দে লাফাইয়া উঠিল। একটা নাও ছাৎ করিয়া অতি নিকট দিয়াই চকিতে চলিয়া গেল, গানের কলিটাও শোনা গেল বেশ—আকাঠ মান্দাইলের নাও, ঝুনুর ঝুনুর করে নাও, জিত্যা আইলাম রে, নাওয়ের গলুই পাইলাম না॥
গানের মত গান গাহিতেছে বটে একখানা নৌকা। ধীরে সুস্থে চলিতেছে। বৈঠা জলে ছোঁয়াইয়া একসাথে শত শত বৈঠাকে উল্টাইয়া উপরে তুলিতেছে আর বৈঠার গোড়াটাকে
একই সাথে নাওয়ের বাতায় ঠেকাইয়া বৈঠাধারীরা সামনের দিকে ঝুঁকিতেছে, আবার বৈঠা তুলিয়া জলে ফেলিতেছে। যেন হাজার ফলার একখানা ছুরি যাইতেছে আর তার সবগুলি ফলা একসাথে উঠিতেছে পড়িতেছে, আবার খাড়া হইয়া শির উঁচাইতেছে। মাঝখানে থাকিয়া একদল লোক গাহিতেছে, আর বৈঠাধারীরা সকলে এক তালে সে গানের পদগুলির পুনরাবৃত্তি করিতেছে।
তারে ডাক দে, দলানের বাইর হইয়া গো, অ দিদি প্রা-ণ্ বন্ধুরে তোরা ডাক দে॥
আমার বন্ধু খাইবে ভাত, কিন্যা আন্লাম ঝাগুর মাছ গো, অ দিদি দুধের লাগি পাঠাইয়াছি, পয়সা, কি সুকি, কি টেকা গো, অ দিদি প্রাণবন্ধুরে তোরা ডাক দে॥
আমার বন্ধু ঢাকা যায়, গাঙ্ পারে রান্ধিয়া খায় গো, অ দিদি জোয়ারে ভাসাইয়া নিল হাঁড়ি, কি ঘটি, কি বাটি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে॥
আমার বন্ধু রঙ্গি ঢঙ্গি, হাওরে বেন্ধেছে টঙ্গি গো, অ দিদি, টঙ্গির নাম রেখেছে উদয়তারা, কি তারা গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে॥
আমার বন্ধু আসবে বলি, দুয়ারে না দিলাম খিলি গো, অ দিদি, ধন থুইয়া যৈবন করল চুরি, কি চুরি, কি চুরি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে॥
উদয়তার হাসিল, ‘খুব ত গান। মাঝখানে আমার নামখানি ঢুকাইয়া থুইছে।’
সকলেই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সকল নৌকাতেই এমন সুন্দর গান হইতেছে তাহা নয়। একটি নৌকা হইতে শোনা গেল নিতান্ত গদ্যভাবের গান—চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে, দারোগা জিজ্ঞাসে, আরে চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে॥ দর্শকদের এক নৌকা হইতে কেউ বলিয়া উঠিল, ও, চিনিয়াছি; বিজেশ্বর গ্রামের নাও, চর দখল করিতে গিয়া উহারাই খুনাখুনি করিয়াছিল। গানটা বাঁধিয়াছে সেই ভাব থেকেই।
তারপর যে দুইখানা নাও সারি গাহিয়া গেল, তাহাদের একটি হইতে শোনা গেল—জ্যৈষ্ঠি না আষাঢ় মাসে যমুনা উথলে গো, যাইস্ না যমুনার জলে। যমুনার ঘাটে যাইতে দেয়ায় করল আন্ধি। পন্থহারা হইয়া আমরা কিষ্ণ বলে কান্দি॥ যমুনার ঘাটে যাইতে বাইরে-ঘরে জ্বালা। বসন ধরিয়া টানে নন্দের ঘরের কালা॥
পরের নাওখানার গান শুনিয়া বোঝা গেল রাধা বিপ্রলব্ধা হইয়াছে—আম গাছে আম নাই ইটা কেনে মারো, তোমায় আমায় দেখা নাই আঁখি কেনে ঠারো॥ তুমি আমি করলাম পীরিত কদমতলায় রইয়া, শত্তুরবাদী পাড়াপড়শী তারা দিল কইয়া॥
সঙ্গের একখানা ছইওয়ালা নৌকা হইতে বলিতে শোনা গেল, গোঁসাইপুরের নিকট রাধানগর আর কিষ্টনগর নামে দুই গাঁও আছে—সেই দুই গ্রামেরই এই দুই নাও।
শুনিয়া বনমালী মন্তব্য করিল, তবে একখানাতে রাধাউক্তি আরেকখানাতে কিষ্ণউক্তি করিল না কেন? পূর্বোক্ত নৌকা হইতে জবাব আসিল, সবখানেই রাধা রে দাদা, সবখানেই রাধা।
চোখা মন্তব্যটা শুনিয়া আশেপাশের নৌকার লোকজন হাসিয়া উঠিল। এমন সময় বড়বাড়ির একজন উদয়তারার মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া বলিল, এদিকে শুন ভইন কি মজার গানখান হইতেছে—
ও তোরে দেখিনাই রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে। থানায় থানায় চকিদার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, কোন্ কোন্ নারীর শুভ বরাত, আমার বরাত পুড়ে—বরাত পুইড়া গেলরে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে॥
হবিগঞ্জে নবীগঞ্জে কোণাকুণি পথ, প্রাণবন্ধু গড়াইয়া দিছে ইল্শা-পাট্যা নথ—সে নথ পইড়া গেল রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে॥
শুনিয়া উদয়তারা একটু হাসিল। পরে খানিকক্ষণ কান খাড়া রাখিয়া বলিল—এমন গান আরও কত আছে —অই শুন না, পেটমোটা পাতাম নাওয়ে কি গানখান হইতেছে—সামনে কলার বাগ, পূব-দুয়ারী ঘর। রাইতে যাইও বন্ধু, প্রাণের নাগর॥
আরেকখানা গান অনন্তবালার প্রতি সকলকে সচেতন করিয়া তুলিল—তীরের মত লম্বা নাও, কিন্তু চলিতেছে ধীরে ধীরে; চলিতেছে আর গাহিতেছে—ঝিয়ারীর মাথায় লম্বা কেশ, খোঁপা বান্ধে নানান বেশ, খোঁপার উপর গুঞ্জরে ভোমরা॥ গাঙে আইলে আঞ্জন মাঞ্জন, বাড়িতে গেলে কেশের যতন, ঝিয়ারী জানি কোন পীড়িতের মরা॥
গানটা শুনিতে শুনিতে অনন্তবালার বয়সাধিক বড় খোপাটা ধরিয়া উদয়তারা আস্তে একটু মোচড়াইয়া দিল।
অনন্ত আর অনন্তবালার চোখ অন্যদিকে। দুইটি প্রকাণ্ড মাটির গামলা বিচিত্র রঙে সাজাইয়া, দুইটি করিয়া হাত-বৈঠা হাতে করিয়া দুইটি লোক উহাদিগকে লইয়া ভাসিয়া পড়িয়াছে। উহাদের মুখে গান নাই, হাতে ছন্দ নাই। ফেশন করিয়া চুল দাড়ি ছাঁটাই করা, মাথায় জব্জবে তেল, পরিষ্কার ধুতির উপর গায়ে সাদা গেঞ্জি। মুখ টিপিয়া হাসিতেছে। আর জলে বৈঠা ডুবাইয়া এলোমেলো ভাবে টানিয়া আগাইতেছে।
দেখিতে দেখিতে তারা অনন্তদের নৌকার একান্ত নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে, আর একটু অসাবধান হইলে তাহাদের নাওয়ের বাতায় ঠেকিয়াই গামলা ভাঙ্গিবে। অনস্তবালা হাত বাড়াইয়া ছুঁইতে গেলে লোক দুইটা বৈঠা দেখাইল। বনমালী মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া বলিল, ‘সকলে দৌড়ায় নাও, তাইনে দৌড়ায় গামলা।’ অনন্তও বলিল, ‘জুড়ি কেনে ধরনা তোমরা, দেখতাম কে আগে যাইতে পারে।’ কিন্তু লোক দুটি এসব কথায় কান দিতেছে না। তাদের দিকে গ্রাম গ্রামান্তরের মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতেছে, ইহাতেই তাহারা খুশি।
‘আমি কেনে একটা গামলা আন্লাম না। তা হইলে ত বৈঠা মাইরা বেশ দৌড়াইতাম।’ অনন্ত বলিল।
‘তুমি একলা পারতা নাকি, জিগাই? তুমি কি ঐ লোকটার মতন চালাক, না চতুর? বৈঠা হাতে লইয়া চাইয়া থাকবা দৌড়ের নাওয়ের দিকে, শুন্বা কথা, আর কোন্খানের কোন্ যাত্রিকের নাও দিব ধাক্কা। ঠুন্কা গামলা ভাঙ্গলে তখন কি হইব। তুমি আমি দুইজনে থাকলে কোন ডর নাই; তুমি যখন একদিকে চাইয়া থাক্বা, গামলারে আমি তখন সামলামু। আর গামলা যদি ভাইঙ্গা যায়, তখন তুমি আমারে সামলাইও, কেমুন?’
‘ঠিক কথা।’
তাহারা এইরূপ কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিল, এমনি সময়ে নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে উদয়তারা হাসিয়া উঠিল। উদয়তারা এমনি। মনে মনে কোনকিছু ভাবিতে থাকে। ভাবিতে ভাবিতে মন তার অনেকদূর আগাইয়া যায়। কোথাও গিয়া তার চিন্তা ঠেকিয়া যায়। তখন সে কোনদিকে না চাহিয়া, কাহারও উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন না হইয়া, হঠাৎ আপন মনে হাসিয়া উঠে।
স্ত্রীলোকদের একজন, অনন্তবালার কাকীমা, মুখ ফিরাইয়া বলিল, ‘হাস্লা কেনে দিদি।’
‘হাসলাম ভইন একখান কথা মনে কইরা!’
‘কি কথা বেঙের মাথা—কও না শুনি।’
উদয়তারা মনে মনে বলিল, সে কথা কি বলা যায়? যে-কথা মনে করিয়া ক্ষণেক্ষণে হাসি, কারুরেই কইলাম না সে কথা—আর তুমি ত তুমি।
অনন্তবালার কাকী তরুণী। কৌতূহলে দুই চোখ ভরা। ছাড়িবার পাত্রী সে নয়। আবার ধরিল। ‘কও না গ দিদি?’
‘কি কমু গ ভইন।’
‘কেনে হাস্লা!’
‘হাসি আইল, হাসলাম।’
‘জেতা মানুষেরে ভাঁড়াইতে চাও। না কইবা ত না কইবা।’
‘তবে কই শুন। যে-কথাখান মনে কইরা হাসলাম, সেই কথাখান এই—গাঙের উপর দিয়া কত নাও যায়। তারা কত রকমের গান গাইয়া যায়, ভালা গান, বুরা গান—ঘেন্নার গান অঘেন্নার গান! গাইয়া যায় ত?’
‘যায়।’
‘একটু আগেই ত শুন্লা, কি বিটলা গান একখান্ তারা গাইতাছে।’
‘শুন্লাম।’
‘তার একটু পরেই শুন্লা, একখানা সুন্দর গান গাইয়া গেল।’
‘গেল।’
‘আচ্ছা, এই যে ভালাবুরা গান গাইয়া যায়—আমি ভাবি, গাঙ্গের বুকে ত সেই ভালাবুরার আর কোন রেখ্ই থাকে না। থাকে কি?’
‘না।’
‘এইজন্যই হাসলাম।’
‘আমিও কথাখান বুঝলাম।’
‘বুঝলা যদি, তা হইলে আসল কথাখান কই। অনন্ত আর অনন্তবালা। নামে নামে মিলছে। মনে মনেও মিলছে। কথাখান এই।’
এমনি সময়ে পাশেই একখানা নৌকা ভিড়িয়াছে, তার মধ্যে একজন স্ত্রীলোককে আরেকজন স্ত্রীলোক এই বলিয়া প্রবোধ দিতেছে, ‘চিন্তা কইরা শরীর কালা কইর না দিদি। গাঙের বুকে কত লোক কত গান গাইয়া যায়, গাঙে কি তার রেখ্ থাকে?’
এমন সময় অনন্ত ফিস্ফিস্ করিয়া অনন্তবালার কানের কাছে বলিল, ‘মাসী।’
অনন্তবালার চোখ কৌতূহলে বড় হইয়া উঠিল। অনন্তর দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সে তার ঐতিহাসিক মাসীকে দেখিল।
বিধবা নারী। এখনও তরুণীর পর্যায়েই দাঁড়াইয়া আছে, কিন্তু শরীরের লাবণ্য ধুইয়া গিয়াছে। মুখখানা সুন্দর, কিন্তু মলিন। দেখিলে মায়া লাগে।
‘এই মাসীই তোমারে তাড়াইয়া দিল!’
‘দিল ত!’
মাসী ডাকে আকৃষ্ট হইয়া সুবলার-বৌ চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তারপর সহসা উদ্দাম হইয়া বলিয়া উঠিল, অনন্ত! আমার অনন্ত!
দুই নৌকার বাতা লাগানো ছিল। লাফাইয়া সে এ নৌকাতে আসিয়া উঠিল এবং অনন্তর দিকে দুই হাত বাড়াইয়া দিল। মাসী মাসী বলিয়া অনন্তও হাত বাড়াইল। দেখিল, মাসীর দুই চোখে অশ্রুর বন্যা বহিয়াছে। তাহার নিজের চোখেও জলে ভরিয়া উঠিল।
এমন সময় উদয়তারা পাষাণের মূর্তির মত নিবাত-নিষ্কম্প ভাবে আগাইয়া আসিল।
তার দিকে মন না দিয়া মাসী অনন্তকে আরও জোরে বুকে চাপিয়া ধরিল, তারপর তার পিঠে হাত বুলাইতে বুলাইতে, রুদ্ধ গলা কোন রকমে পরিষ্কার করিয়া বলিল, এতদিন তুই কোথায় ছিলি।
দুই চোখ বুজিয়া সে বলিয়া চলিয়াছে, এতদিন কোথায় ছিলি, কার কাছে ছিলি, কে তোকে খাইতে দিত, কে শুইবার সময় গল্প শুনাইত, ঘুম পাড়াইত।
নির্মম নিষ্ঠুর উদয়তারার সুর সপ্তমে চড়িল, ‘হ, যারে কুলার বাতাস দিয়া দূর কইরা দেয়, তারে কয় কে ঘুম পাড়াইত!’
অনন্তর পূর্ব-কথা স্মরণ হইল। তার মুখের শিরাগুলি, হাতের কব্জি দুইটি কঠিন হইয়া উঠিল। মাসীকে ছাড়িয়া দিয়া ঘাড় নিচু করিয়া বলিল, ‘মাসী আমারে তুমি ছাইড়া দেও।’
‘তুইও কি আমার পর হইয়া গেলি অনন্ত!’
—আপন তো কোন কালে নই মাসী। মার সই তুমি। মা যতদিন ছিল, তোমার কাছে আমার আদরও ততদিনই ছিল। মা মরিয়া গেলে, সে আদর একদিন হাট-বাজারের মতই ভাঙ্গিয়া পড়িল।
—ভাঙ্গিয়া পড়িল! কি করিয়া তুই বুঝিলি যে, ভাঙ্গিয়া পড়িল?
—যাও যাও আমি সব বুঝি। যেদিন হইতে মা গেছে, সেদিন হইতে সব গেছে। সেদিন হইতেই আমি ধরিয়া রাখিয়াছি পরবাসী বনবাসী আমি,—যে ডাকিয়া ঘরে লইবে তার ঘরই আমার ঘর, যে ঘৃণা করিয়া তাড়াইয়া দিবে, তার ঘরই আমার পর।
‘আরে বেইমান কাউয়া, এই সগল কথা তোরে কে শিখাইল, কোন্ বান্দিনীর ঝিয়ে শিখাইল?’
উদয়তারা এবার ফাটিয়া পড়িল, ‘আ লো বান্দিনীর ঘরের চান্দিনী। মুখ সামলাইয়া কথা ক, বুক সামলাইয়া বাড়ি যা। বেশি কথা তুলিস না, ছালার মুখ খুলিস না।’
সুবলার বউ আর সহ্য করিতে পারিল না। সাংঘাতিক একটা কিছু করিবার আয়োজনে সে আরও একটু আগাইয়া আসিয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিল। অনন্তও জোর করিয়া মাসীর হাত ছাড়াইয়া উদয়তারার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ করিয়া লইয়া বলিল, ‘তুমি আমারে আদর জানাইও না মাসী।’
মাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল। অপমানে তার মাথা লুটাইয়া পড়িতে চাহিল। উদয়তারা অবিশ্রাম গালি দিয়া চলিয়াছে। সবই অনন্তর জন্য। রাগে মাসীর আপাদমস্তক জ্বলিয়া গেল, বলিল, আদর আমি তোকে জানাইবই, তবে, মুখে নয়, হাতে।
এই বলিয়া সে অনন্তর চুলের মুঠি ধরিয়া পিঠে দুম্দুম্ করিয়া কীল মারিতে লাগিল। অনন্ত ভয়ার্ত চোখে মাসীর ক্রুদ্ধ জ্বলন্ত চোখ দুটির দিকে চাহিয়াই চোখ নত করিল এবং তার ক্রোধের আগুনে নিজেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দিল। মার খাইতে খাইতে অনন্ত পাটাতনে নেতাইয়া পড়িল। সকলে থ হইয়া দেখিতেছিল। সহসা যেন সম্বিৎ পাইয়া উদয়তারা গর্জাইয়া উঠিল এবং সিংহিনীর থাবা হইতে হরিণ-শিশুর মত অনন্তকে মাসীর কবল হইতে মুক্ত করিল। অনন্ত তখন বলির কবুতরের মত কাঁপিতেছে।
তারপর যে কাণ্ড হইল তাহা বলিবার নয়। উদয়তারা সহ নৌকার সব কয়জন স্ত্রীলোক মিলিয়া সুবলার বৌকে পাটাতনে শোয়াইল, তারপর সকলে সমবেতভাবে হাতেপায়ে প্রহারের পর প্রহারের দ্বারা জর্জরিত করিতে লাগিল।
অনেক মার মারিয়া জব্দ করার পর, শেষে তাহারা ছাড়িয়া দিল। অতি কষ্টে দেহটা টানিয়া তুলিয়া সুবলার-বৌ বুকের ও ঊরুর কাপড় ঠিক করিল এবং আলুথালু বেশে টলিতে টলিতে নিজেদের নৌকায় গিয়া উঠিল। চারিদিকের নৌকাগুলি হইতে হাজার হাজার লোক তখন তাহার দিকে চাহিয়া আছে।
অপমানে, লজ্জায় সে আর মাথা তুলিতে পারিল না। সঙ্গিনীরা তাহাকে ধরিয়া বসাইলে সে পাটাতনের উপর শুইয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
উদয়তারার দল বিজয়গর্বে ফুলিতে লাগিল। কিন্তু অনন্ত তখনও কাঁপিতেছে। পুরুষেরা দাঁড় টানিয়া নৌকা সরাইয়া লইতেছে। আর কোনদিন বোধ হয় দেখা হইবে না। অনন্ত ভয়েভয়ে ওদিকে ঘাড় ফিরাইল। মাসী পাঠাতনের উপর উপুড় হইয়া ফোঁপাইতেছে। সেই নৌকার পুরুষেরা হতভম্ব হইয়া পড়িয়ছিল। বলিল, থাক আর নাও-দৌড়ানি দেখিয়া কাজ নাই। চল ফিরিয়া যাই।
তাহারা ফিরিয়া চলিল। অনেক দূরপথ। কিন্তু তাড়া নাই। অনেক বেলা আছে। নৌকা-দৌড়ের এলাকা ছাড়াইয়া খোলা জায়গায় আসিয়া তাহার হাঁপ ছাড়িল। দেখা গেল, এত দেরী করিয়াও একখানা নৌকা দৌড়ের এলাকার দিকে যাইতেছে। যাইতেছে আর সারি গাহিতেছে—সকলের সকলি আছে আমার নাই গো কেউ। আমার অন্তরে গরজি উঠে সমুদ্দুরের ঢেউ॥ নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে। নাও আছে কাণ্ডারী নাই শুধু ডিঙ্গা ভাসে॥