তিতাস একটি নদীর নাম/চার/দুরঙা প্রজাপতি

চার

দুরঙা প্রজাপতি


 সুবলার-বউয়ের জীবনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বহিয়া গিয়াছে। ছেলেবেলা মা বাবা তাকে অত্যন্ত ভালবাসিত। কোনদিন তারা তার গায়ে হাত তোলে নাই। মালোদের পাড়ার মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়া হয়, গালাগালি করে। কিন্তু পাড়ার পাঁচজনের কেউ কোনদিন তার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করে নাই। পাড়ার মধ্যে তার নিজের একটা মর্যাদা ছিল। একটা গর্ব ছিল। আজ তাহা একেবারে খর্ব হইয়া গিয়াছে।

 আজ সে দেহে মনে বিপর্যস্ত। সমস্ত শরীরে ব্যথা; এখানে-ওখানে ফুলিয়া গিয়াছে। নৌকা হইতে নামিয়া কোনো রকমে বাড়ি আসিল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া একটা পাটি বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। নৌকাতে অন্যান্য মেয়ে যারা ছিল, তাদের নিকট হইতে সকল প্রতিবেশীরা অগৌণে ঘটনাটা জানিতে পারিল। সকল কথা শুনিয়া তার মা একবাটি হলুদ-বাটা গরম করিয়া আনিয়া বলিল, ‘কাপড় তোল, কুন্‌খানে কুন্‌খানে বেদনা করে ক’। দেখি। ইস্, গাও যে আগুনের মত ততা।’

 আদর পাইয়া তার চোখে জল আসিয়া পড়িল।

 মা তার দুই চোখ মুছাইয়া দিয়া বলিল, ‘আ-লো নিশত্তুরি, তর নি এই দশা। তর বুকের না, পেটের না, তার লাগি তর কি!’

 সুবলার বউ কোনো কথা বলিল না।

 —ঐ কলিজা-খেকোকে তুই কেন আদর জানাইতে গেলি, দশজনের মাঝে তুই বেইজ্জত হইলি!

 সে এবারও নিরুত্তর রহিল।

 তার মা আর কথা না বাড়াইয়া, তারই কাছে শুইয়া পড়িল। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে।

 বুড়ি শুইয়া শুইয়াই তামাক টানিল, তারপর বাতি নিভাইল এবং সারারাত মেয়েকে বুকে করিয়া রাখিল। তার স্তন দুটি শুখাইয়া দড়ির মত হইয়া গিয়াছে। মেয়ে তারই মধ্যে তার অলস স্তনদুটি ডুবাইয়া দিয়া গভীর আরাম পাইল। মা তার তোবড়ানো গালের সঙ্গে মেয়ের মসৃণ গৌরবর্ণ গালখানা মিশাইলে, মেয়ের দুই চোখ ঘুমে জড়াইয়া আসিল। শরীরের ব্যথায় মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙ্গে, আবার ঘুম আসে। এই চেতন-অচেতনের ফাঁকে ফাঁকে কেবলই তার মনে হইতে থাকে, এ সংসারে কেবল মা-ই সত্য, আর কিছু না।

 পরের দিন তার শরীরের ফোলা কমিয়া গেল, ব্যথা কমিয়া গেল। মনও অনেকট হালকা হইয়া আসিল। মনে তখনো যেটুকু দাহ ছিল, জুড়াইবার জন্য সূতা-কাটা আর জাল-বোনাতে আত্মনিয়োগ করিল। কিন্তু পাড়াতে তার হারানো মর্যাদা আর ফিরিয়া পাইল না।

 পাড়ার পাঁচজনের মুখ হইতে ঘটনাটা ভিন্‌জাতের পাড়াতেও ছাপাইয়া পড়িল। এঘটনার পর পাড়ার যুবকদের নিকটই তার মুখ দেখাইতে লজ্জা করিত। তার উপর বামুন কায়েতের যুবকরা পর্যন্ত উঠান দিয়া যাইবার সময় তার ঘরের দিকে উঁকি মারিতে থাকিত। এভাবে লাঞ্ছিত হইয়া শেষে সে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া রাখিত, সারাদিন আর খুলিত না। কিন্তু তবু তার নিষ্কৃতি হইল না। একদিন থালা ধুইবার জন্য ঘাটে যাওয়ার সময়ে মঙ্গলার বউ তাকে পথে দেখিতে পাইয়া বলিল, ‘কি গ ভইন, বাড়ির কাছে বাড়ি, ঘরের কাছে ঘর, তবু যে দেখা পাওয়া যায় না, কারণ কি।’

 ‘শরীর ভাল থাকে না দিদি। মধ্যে মধ্যে জ্বর জ্বর লাগে। আর বাপের জালখান পুরান হইয়া গেছে। মাছের গুঁতায় টিকে না। নতুন একখান জালও চাই। ঘরে কি পাঁচটা ভাই আছে না ভাই-বউ আছে। একলা আমারই ত বেবাক করন লাগে।’

 ‘ত দরজা বন্ধ থাকে কিয়ের লাগি?’

 সুবলার বউ ইহার কোন উত্তর দিল না।

 ‘তা, দুয়ার বন্ধই কর আর যাই কর ভইন, কথাখান নগরে বাজারে জানাজানি হইয়া গেছে।’

 সুবলার বউ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল, ‘কোন্ কথাখান, কি গ মহনের মা, কোন্ কথাখান।’

 —আমার কোনো দোষ নাই ভইনসকল। বাজারের লোক যারা তামসীর বাপের বাড়ি তবলা বাজায় তারা কহিয়াছে। তারা বামুন, তার কায়েত। তারা শিক্ষিত লোক। মালোদের চেয়ে তারা বুঝে শুনে বেশি। তাদের দোকান থেকে মালোর জিনিস বাকি আনে। জিয়লের ক্ষেপে, যাইবার সময় তমসুক দিয়া তাদের নিকট হইতে টাকা আনে। বিয়া-শাদিতেও টাকা ধার দেয় তারা। গ্রামের অধিক মালো তাদের বশ। তাদের কথা মালোরা কি গ্রাহ্য না করিয়া পারে। তারা যা বলিয়াছে মালোদের কাছে তা ব্রহ্মার লেখ্। তারা বলিতেছে, বিধবামানুষ দরজা বন্ধ করিয়া থাকে, লাজে মুখ দেখায় না, কি হইয়াছে আমরা কি তাহা বুঝিতে পারি না?

 শুনিয়া সুবলার বউ স্তম্ভিত হইয়া গেল। পায়ের তলা হইতে তার যেন মাটি সরিয়া যাইতেছে। কিন্তু সম্বিৎ হারাইল না। পড়ি পড়ি করিয়া সে বাড়ি চলিয়া আসিল।


 ইহার পর যে-কেহ তার দিকে তাকাইত, সে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া তার দিকে এমনি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিত যে, সেখানে তার তিষ্টিবার উপায় থাকিত না। একদিন তামসীর বাপের বাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া যারা তবলা বাজায় গান গায়, তাদের লক্ষ্য করিয়া এমন গালি শুরু করিল যে, একঘণ্টার আগে থামিল না। পাড়ার আর আর সব মেয়েরা বলিতে লাগিল, মাগো মা, রাঁড়ি যেন একবারে ‘বান্ধে খাড়া’ হইয়াছে।

 সে মালোপাড়া হইতে উহাদের পাট উঠাইবাব চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কোন পথ পাইল না। আগের মাতবররা এখন আর তেমন নাই, থাকিলে অনায়াসে একটা বিহিত করা যাইত। যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ মালো-সমাজে বিধবাবিবাহ চালাইতে গিয়া জব্দ হইয়াছে। গ্রামের চক্রবর্তী ঠাকুর পুরোহিত দর্পণ খুলিয়া মালোদিগকে বুঝাইয়াছে, বিধবার বিবাহ দিলে নরকে যাইতে হইবে। কাজেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কথা শিরোধার্য করিয়া রামপ্রসাদকে তাঁরা অগ্রাহ্য করিয়াছে। এখন আর মালো-সমাজে তাঁর তত প্রভাব নাই। দয়ালচাঁদ আগে উচিত কথা বলিত। তাদের যাত্রা দলে সেজন মুনিঋষি সাজিত। শহরে যাত্রা গাহিয়া তারা তাকে বড়লোকের কাছ থেকে সোনারূপার মেডেল পাওয়াইয়াছে। ইহার পর দয়ালচাঁদও আজকাল ইহাদের দিকেই ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। এখন আর আগের মত উচিত কথা কহিবে না।

 কিন্তু সুবলার বউয়ের মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। সে দমিতে জানে না।

 ‘মহনের মা, এই গাঁওয়ের মাইয়া আমি, বিয়া হইছে এই গাঁওয়ে। আমি নি ডরাই বাজাইরা লোকেরে গো।’

 মঙ্গলার বউ বলে, ‘তুমি মাইয়া-মানুষ। তুমি কি করতে পার ভইন।’

 ‘আমি সব পারি। আর কিছু না পারি আগুন লাগাইয়া গাঁও জ্বালাইয়া দিতে পারি।’

 ‘গাঁওয়ের একঘরে আগুন লাগলে সহস্রেক ঘর পুড়া যায়। বাজাইরা পাড়া যেমুন পুড়ব মালোপাড়াও পুড়ব। তোমার ঘর পুড়ব, আমার ঘর পুড়ব। তারা যেমুন মরব, আমরাও ত মারা যামু ভইন।’

 ‘অপমানের বাঁচনের থাইক্যা সম্মানের মরণও ভালা দিদি।’

 কথাটা মালোর ছেলেদেরও মনে ধরিল। তিনজন লোক তবলা বাজাইয়া বেশি রাতের পর উঠিয়া বাড়ি যাইবার সময় মালোর ছেলেরা পথে পাইয়া তাহাদিগকে শুধু হাতে অনেক মার মারিল। মার খাইয়া দলের লোকজন ডাকাইয়া তারা একত্র মিলিত হইল, কি করা যায় তাহা স্থির করার জন্য। অনেক বাদানুবাদের পর স্থির হইল তারা সামনাসামনি প্রতিশোধ নিবেনা। মালোদের জানমাল বলিতে গেলে তাহাদেরই হাতে। মালোদিগকে তারা হাতে না মারিয়া অন্য উপায়ে মারিবে।

 সেই দিন হইতে মালোপাড়ার আকাশে একখণ্ড কাল মেঘ ভাসিয়া থাকিল। কেউ জানিল না তার ছায়া কালক্রমে কতখানি আতঙ্কের বিষয় হইয়া দাঁড়াইবে।


 সেদিন কাদিরের ছেলের নূতন যে নৌকা দৌড়াইবার জন্য খলায় গিয়াছিল, সে নৌকা আর ফিরিল না। প্রতি বৎসরই এমন হয়। কোনো-না কোন গাঁয়ের নৌকার সঙ্গে কোনো না কোন গাঁয়ের নৌকার সংঘর্ষ লাগেই। পুরানো ঝগড়া থাকিলে তো কথাই নাই। সুযোগ দেখিয়া নৌকাখানা সটান শত্রুনৌকার পেটে ঢুকাইয়া দেয়। বিদীর্ণ হইয়া যায় সে নৌকা। মারের উপকরণ নৌকাতেই প্রস্তুত থাকে। শুরু হইয়া যায় মারামারি। কত লোকের মাথা ভাঙ্গে, হাত, পা, কোমর ভাঙ্গে। কত লোক জলে পড়িয়া গিয়া আর উঠে না। প্রতিবৎসরই এমন একটা দুটা মারামারি হয়। প্রতিযোগিতার সময় প্রতি বৎসরই কোন না একটা নৌকা আর একটা নৌকার উপরে উঠিয়া পড়ে। এবৎসর উঠিল ছাদিরের নৌকার উপরে।

 ছাদিরের নৌকাখানাকে বিদীর্ণ করিয়া দিল যে নৌকাখানা, ছাদিরের লোক তাদের চেনে না। ঘটনাটা চক্ষুর নিমেষে ঘটিয়া গেল! একমুহূর্ত আগেও তার নৌকা ময়ূরের মত বৈঠার পেখম উড়াইয়া সর্পের গতিতে চলিতেছিল। পলক ফেলিতে দেখে তারা বিক্ষিপ্ত হইয়া জলে পড়িয়া গিয়াছে।

 ঘর নিস্তব্ধ! কাহারো মুখে কথা নাই। সকলে রুদ্ধ নিশ্বাসে শুনিতেছে। এবাড়ির সকলের ভাগ্যে যেন একটা ঝড় বহিয়া এখন সবকিছু স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কেরোসিনের বাতিটা টিমটিম করিয়া ঘরটাকে আলো দিয়া রাখিয়াছে মাত্র। আসলে সব কিছুই যেন আঁধারে জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। সকলের আগে রমু। সে তার বাপের প্রত্যেকটি কথা গিলিতেছে। বাপকে তার কাছে খুব বড় বোধ হইতে লাগিল। এতবড় একটা বিপদ ঘাড়ে লইয়া বাঁচিয়া আসিল যে মানুষ, সে এত বড় যে নাগাল পাওয়া যায় না।

 দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কাদির মিয়া বলিল, ‘খোদা মেহেরবান, তোরে বাঁচাইছে। আর সব লোকের না-জানি কি গতি হইল।’

 ‘জানি না বাপ। আমিই কি বাঁচতাম। জলে পইড়া দেখি, শতে বিশতে নাও। কোনটা গেল মাথার উপর দিয়া, কোনটা গেল ডাইনে দিয়া, কোনটা গেল বাঁয়ে দিয়া। কোনটার লাগল ছিটাপানি, কোনটার লাগল বৈঠার বাড়ি। শেষে আমি দুই চক্ষে অন্ধকার দেখলাম! এমন সময় দেখলাম তারে। চিনলাম। হাত বাড়াইলাম। ঝাঁপ দিয়া পানিতে পড়ল। আমারে পাছড়াইয়া শেষে তার নাওয়ে নিয়া তুলল। ঐ যে আলুর নাও ডুববার কালে যেজন বাঁচাইছিল সেই জাল্লা ভাই।’

 সকৃতজ্ঞ চোখে সকলেই আর একবার বনমালীকে দেখিল। তার উপর রমুর অসীম শ্রদ্ধা হইল।

 পাড়াতে একটা কান্নাকাটির রোল উঠিবার উপক্রম হইয়াছিল। পাড়ার যুবক বলিতে যারা ছিল সকলেই ছাদিরের নৌকাতে গিয়াছিল। এই বিপদের কথা শুনিয়া সকলেই অভিভূত হইয়া পড়িল। এমন সময় তাদের দুই একজন করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইতেছে দেখিয়া কাদির বলিল: এখন চঞ্চল হইও না, আর কতকক্ষণ বিলম্ব কর, খোদা আনিলে দেখিবে, সকলেই আসিয়া পড়িবে।

 তার কথাই ঠিক হইল। এই পথে যত নৌকা আসিতেছে প্রায় সবগুলিতেই দুইজন চারিজন করিয়া তারা সকলেই প্রায় নিরাপদে ফিরিয়া আসিল।

 রমুর ভাবনা হইল, যখন সকলেই আসিল, তখন নৌকাখানাও ফিরিয়া আসিলে ভাল হইত। এক সময়ে ছাদির সহসা অভিভূত হইয়া বলিল, ‘বাজান, তোমার পাঁচশ টাকা দিয়া আইলাম তিতাসের তলায়।’ কাদির অনেক সান্ত্বনা বাক্যে তার মনের ভার লাঘব করিলে সে বনমালীর হাত ধরিয়া বলিল, ‘তুমি ভাই হইলেও আছ, বন্ধু হইলেও আছ। চাইরটা জলচিড়া না খাওয়াইয়া ছাড়ছি না।’

 কাদিরেরও মনে হইল, ঠিক কথা, ইহাদিগকে আপ্যায়ন করিতেই হইবে।

 বাপ-বেটার মিলিত অনুরোধ তারা কিছুতেই এড়াইতে পারিল না।


 রমুর মার বাপের-বাড়ি হিন্দুপাড়ার নিকটে। সে প্রশস্ত গোয়াল ঘরখানা বেশ করিয়া নিকাইয়া দিল। কলসী হইতে চিড়া বাহির করিয়া ক্ষিপ্রহস্তে কুলাতে করিয়া ঝাড়িয়া দিল। ছাদির ক্ষিপ্রহস্তে গাই দুহিয়া অনেক দুধ আনিয়া দিল। কাদির মিয়া কুমার পাড়া হইতে একদৌড়ে নিয়া আসিল একটি নূতন হাঁড়ি।

 উদয়তারা তিনখানা মাটির ঢেলার উপর হাঁড়ি বসাইয়া কাঠের আগুনে দুধ জ্বাল দিতেছে। আগুনটা একেকবার কমে, আবার দপ্ করিয়া বাড়িয়া উঠে। যখন বাড়িয়া উঠে তখন উদয়তারার মুখটা লাল দেখায়। যখন নিভিয়া যায়, মুখটা নিচু করিয়া ফুঁ দেয়। তখনি সহসা জ্বলিয়া উঠে। সে আগুনে উদয়তারার মুখটা আবার লাল দেখায়। দূরে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছিল জমিলা। কাদিরের একমাত্র মেয়ে সে। শেষে নিশ্চিত ভাবে চিনিয়া ফেলিল। রমুর মাকে বারান্দা হইতে টানিয়া নামাইয়া কহিল, ‘অ ভাবী, এ যে সেই মানুষ। আমার পয়লা নাইওরের সময় পথে যারে দেখ্‌ছিলাম। ডুবাইয়া ডুবাইয়া কলসী ভরছে সেই মানুষ। যার কথা কতবার কইছি।’

 সারা দিনের শ্রান্তি। ঝগড়ার ঝামেলা। তার উপর ক্ষুধা। গোয়ালঘরে বসিয়া কলাপাতায় দুধবাতাসা মিশাইয়া তারা সেদিন পরিতৃপ্তির সহিত ‘জলচিড়া’ খাইল। খাওয়ার পর জমিলা উদয়তারাকে টানিয়া অন্দরে নিয়া বসাইল, বলিল: বিয়ার পর আমার পয়লা নাইওর। আমি ছিলাম নৌকাব ছইয়ের ভিতরে। ছইয়ের মুখ ছিল একখানা শাড়ি গুঁজিয়া বন্ধ করা। বাতাসে শাড়ির গোঁজাটা খুলিয়া গেল। তুমি তখন ঘাটে ঢেউ দিয়া জল ভরিতেছিলে। আমি তোমাকে দেখিলাম। মনে হইল যেন কতকালের চেনা। জানা নাই শোনা নাই, কি জানি কেন একজনকে দেখিয়া এত ভাল লাগে। তাই আমি বারে বারে দেখিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে দেখিলে না। পরের বারে এখানে আসিয়া বাপকে বলিয়াছিলাম, সই পাতিব। বাপ বলিল, নাম জানিনা নিশানা জানিনা, কি করিয়া খুঁজিয়া পাইব। তারপর কতবার তোমার ঘাট দিয়া নাইওরে গিয়াছি। তখন আমি পুরানা। শাড়ির বেড়া নিজ হাতে খুলিয়া আতিপাতি করিয়া চাহিয়াছি, তোমাকে দেখিতে পাই কিনা। দেখিতে পাই নাই। আর কি কাণ্ড, আজ তুমি নিজে যাচিয়া আসিয়াছ। আসিয়াছ যখন, তুমি এখানে দুইদিন বেড়াও, তোমার বাড়িতে আমারে নিয়া দুইদিন রাখ।

 শুনিয়া উদয়তারা শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তার জমিলা নামটা খুব ভাল লাগিল, কিন্তু সে সংসারের সম্বন্ধে এত অনভিজ্ঞ দেখিয়া বেদনাবোধ করিল।

 কালোমেঘ সরিয়া গিয়া চাঁদ উঠিলে দেখিতে কেমন সুন্দর হয়; তেমনি একটা খুববড় বিপদ কাটিয়া গিয়া মনের সুখের উদয় হইলে সে মুখ কত মধুর হয়, তাহা কাদিরের বাড়িতে তখন যে না দেখিয়াছে তাহাকে কি বলিয়া বুঝানো যায়।

 নৌকায় ঝগড়া মারামারির দরুণ মনে যে অস্বস্তিটুকু ছিল কাদিরের বাড়ি অতিথি হইয়া তারা তাহা সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গেল। মনে স্নেহ ও প্রীতির অনুপম এক ছোপ লইয়া তারা নৌকাতে গিয়া উঠিল।

 আকাশে তখন চাঁদ উঠিয়াছে। তারই আলোকে তিতাসের ছোট ছোট ঢেউগুলি চিক্‌মিক্‌ করিতেছে। সেই ঢেউ ভাঙ্গিয়া নৌকা আগাইয়া চলিল। গেল না কেবল বনমালী আর অনন্ত। গৃহকর্তার নির্বন্ধাতিশয্যে তারা আজ এখানে রহিয়া গিয়াছে।


 পরদিন সকালে অনন্তর ঘুম ভাঙ্গিলে বাহিরে গেল। গোয়ালঘরে একপাল গরু ডাকাডাকি করিতেছে। বাছুরগুলি ছাড়া পাইয়া অকারণে লাফাইতেছে। অদূরেই বর্ষার জল থই থই করিতেছে। ছোট বড় নানা জাতের গাছগুলি কোমর-জলে আটকা পড়িয়াছে। তারই সঙ্গে এক একটা ডিঙ্গি বাঁধা। একটা খোলা জায়গাতে বাঁশের লম্বা ‘আড়া’ বাঁধিয়া তার উপর ঝুলাইয়া পাট শুকাইতে দিয়াছে। যেন খুব বড় একটা পাটের দেওয়াল বানাইয়া রাখা হইয়াছে। ভিজা পাটের গন্ধ দিগ্বিদিকে ছাইয়া ফেলিয়াছে। আকৃষ্ট হইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে ফড়িং উড়িতেছে বসিতেছে। অনন্ত নিবিষ্ট মনে সেগুলি দেখিয়া চলিয়াছে। দেখিতে দেখিতে একখানে মোড় ঘুড়িবার সময় দেখিল রমু দাঁড়াইয়া আছে। অনন্তর মত তারও চোখেমুখে বিস্ময়। তার সঙ্গে কথা বলিবার জন্য রমুর প্রাণ ছটফট করিতেছিল। সে শুধু ভাবিতেছিল তাহাদের বাড়িতে এরা রহিয়া গিয়াছে, তাদের আপন হইয়া গিয়াছে, কি মজা। কথা বলার উপলক্ষ্য খুঁজিতে খুঁজিতে এক সময়ে রমু বলিল, ‘তুমি ফড়িং ধরনা?’

 অনন্ত বলিল, ‘না।’

 রমু আবার বলিল: ওই বাঁশের পুল পার হইয়া যে-বাড়ি, সে-বাড়িতে থাকে গফুর, আমার চাচাত ভাই। সে খুব ফড়িং ধরে আর আড়কাঠি বিঁধাইয়া ছাড়িয়া দেয়, তারা ছটফট করিয়া মরিয়া যায়। দেখিয়া আমার মনে বড় কষ্ট লাগে। তুমি ফড়িং ধরনা, তুমি কত ভাল।

 এমন সময় রমুর মা গাদায় ফেলিবার জন্য গোয়ালঘর হইতে এক ঝুড়ি গোবর লইয়া যাইতেছিল। তারা দুইজনকে একসঙ্গে পরিচিতের মত কথা বলিতে দেখিয়া তার মাতৃহৃদয় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। যাইবার সময় শশা গাছ হইতে টুক্‌ করিয়া একটি শশা পাড়িয়া অনন্তর হাতে দিয়া বলিল, ‘ধর বা’জি, খাও।’

 শশাটা হাতে লইয়া অনন্ত বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিল। রমু বলিয়া দিল, মা।

 মা নাম শুনিয়াই অনন্ত তার পায়ে ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম করিয়া আসিল।


 গ্রামে ফিরিয়া অনন্ত লেখাপড়ায় মন দিল। গোঁসাই বাবাজী যেদিন তাকে প্রথম ‘কালা আখর’ শিখাইল, সেদিন তার আনন্দ উপছাইয়া উঠিল। একটি নূতন জগৎ তাকে দ্বার খুলিয়া ডাকিয়া নিয়া গেল। তারপর দুই আখরে তিন আখরে মিলিয়া এক একটা কথা হইল। এ সকল কথা মুখে যেমন বলা যায় তেমনি লিখিয়াও প্রকাশ করা যায়। দেখিয়া তার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। তিনকোণা, চারকোণা, গোল, নানারকমের আখরগুলি কলাপাতায় নক্‌সা করিতে কি যে ভাল লাগে। রাতে শুইলেও সেগুলি আকার নিয়া চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিতে থাকে।

 দেখিতে দেখিতে শিশুশিক্ষা শেষ হইয়া যায়। বনমালীর গর্ব হয়। সে বইটার যে-কোন একটা জায়গা আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলে, এইখানে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। আবার অন্য জায়গায় দেখায়, এইখানে কি লেখা আছে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। কোথাও ঠেকে না। মাঝে মাঝে বনমালীর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। বলে, ‘কালা আখর কেমুন জিনিস সময় থাকতে জানলাম না, অখন তা-ই শিখলাম।’

 শিশুশিক্ষা শেষ করিয়া বাল্যশিক্ষা ধরে। তার সঙ্গে ধারাপাত। ঘোড়ায় চড়িল আবার পড়িল, কথাগুলি নূতন কিন্তু আখরগুলি চেনা। শিশুশিক্ষাতেই এ সবই পাওয়া গিয়াছে। এখানে একটা ছবি আছে। লোকটা ঘোড়া ছুটাইয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার ছবি নাই। কোন্ সময় পড়িয়া গিয়া উঠিয়া পড়িয়াছে, সেটা দেখিতে পায় নাই বলিয়াই ছবি দেয় নাই। তারপর আসিল যুক্তাক্ষর। এগুলি কঠিন এবং জটিল। কিন্তু এই কঠিনতায় জটিলতায় যে একটা মোহ আছে, অনন্তকে তাহা পাইয়া বসিল। তারা নূতন নূতন রূপ নিয়া তার মানসলোকে আপনা থেকে আসিয়া ধরা দিতে লাগিল।

 অনন্তবালাকেও তার কাছে পড়িতে দেওয়া হইল। কিন্তু মেয়েটার পড়াতে বিশেষ মন নাই। কিছুই শিখিতে পারে না। পড়েই না শিখিবে কি করিয়া। সে কেবল একবার অনন্তর দিকে চাহিয়া থাকে, আবার বাহিরে যেখানে ধানক্ষেতের সঙ্গে আকাশ মিশিয়াছে সেইদিকে চাহিয়া থাকে। হয়তো দূরে যেখানে আরেকটা গাঁ আছে তার দিকে চোখ মেলিয়া ধরে। আর সুযোগ পাইলেই কেবল কথা বলে। কোনো অর্থ হয় না, কোনো দরকারে লাগে না এমন সব কথা বলিতে থাকে। একবার বলিতে থাকিলে থামানে মুশকিল হয়।

 কোনদিন বলে, আজ আমাদের বাড়িতে অনেক কথা হইয়াছে। তোমারে আমারে নিয়া। নামে নামে মিল আছে কিন্তু অত মিল ভাল নয়। তাই তোমার নামটা বদলাইলে আমার নামও বদলাইতে বলিব। জান, তোমার কি নাম রাখিবে। মা বলিয়াছিল হরনাথ রাখিতে। কিন্তু ছোটখুড়ির পছন্দ হইল না, বলে পীতাম্বর রাখিতে। কিন্তু এ নাম আবার বড়খুড়ির পছন্দ না হওয়াতে অনেক তর্কাতর্কির পর বড়খুড়ি যে-নাম রাখিতে বলিল তাহা রাখা হইবে স্থির হইল। তোমার নাম হইবে গদাধর।

 —এ নাম আমার মাসীর পছন্দ হইবে না।

 —কিন্তু রাখা যখন হইয়া গিয়াছে, আর ত বদলাইতে পারিবে না।

 —আমার নাম বদলাইবার আবার কি দরকার পড়িল।

 —তুমি বুঝি জান না। মা জানে, বাবা জানে, আমি জানি। আর তুমি জান না। তোমাকে বলিতে আমায় নিষেধ করিয়াছে তাই বলিব না। তোমাকে নিয়া আমাদের বাড়িতে অনেক কথা হয়। তোমাকে চিরদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে থাকিতে হইবে। তারা কোথাও যাইতে দিবে না। তারা বলে তোমাকে কেবল আমার সঙ্গেই মানাইবে, আর কারো সঙ্গে না।

 —আমি যদি না থাকি।

 —জোর করিয়া রাখিবে। বাঁধিয়া রাখিবে।

 —হে, আমাকে বাঁধিয়া রাখিবে। এক সময় হুট্ করিয়া কোথায় চলিয়া যাইব। জানিলে ত।

 অনন্ত সত্যই যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। পাঠশালার ফিরতি-পথে এক নাপিত-বাড়িতে পেয়ারা গাছ ছিল। নাপিতানী একদিন তাকে পেয়ারা খাইতে দিয়াছিল আর ছুটির দিন তাকে গিয়া রামায়ণ পড়িয়া শুনাইতে বলিয়াছিল। রামায়ণ শুনিতে শুনিতে নাপিতানী তার মনে এক অনির্বাণ অগ্নি জ্বালাইয়া দিল।

 —অনন্ত তোর রামায়ণ-পড়া আমার খুব ভাল লাগে। তোকে আমি ভাল পরামর্শ দিই। তুই চলিয়া যা। এখানে তোকে দ্বিতীয় শ্রেণী পড়াইয়া জেলে-নৌকায় তুলিবে। অধিক পড়া তোর হইবে না। কিন্তু তোকে আরো শিখিতে হইবে, বিদ্বান হইতে হইবে। বামুন কায়েতের ছেলেদের মত এলেবিয়ে পাশ করিতে হইবে। এই তিনকোণা পৃথিবী চন্দ্র সূর্য ভূমণ্ডল সব তোকে জানিতে হইবে। সাতসমদ্দুর তের নদীর কথা, পাহাড় পর্বত হাওর প্রান্তরের কথা তোকে জানিতে হইবে। এ সংসারে কত বই আছে। হাজার হাজার বই লক্ষ লক্ষ বই। এক এক বইয়ে এক এক রকম কথা। তোকে সব পড়িতে হইবে, পড়িয়া সব শিখিতে হইবে।

 ‘অত বই আছে সংসারে?’

 —আছে। এখানে থাকিয় তা তুই কি করিয়া বুঝিতে পারিবি। এখানে থাকিলে তুই আর কখানা বই পড়িতে পাইবি। শহরে চলিয়া যা। কাছের শহরে নয়। দূরের। তুই একেবারে কুমিল্লা শহরে চলিয়া যা।

 ‘যামু যে, খামু কি কইরা। পড়ার টাকা পামু কই।’

 —পরের মাকে মা ডাকিবি, পরের বোনকে বোন ডাকিবি। ভগমানে তোকে না খাওয়াইয়া রাখিবে না। তোর লেখাপড়াতে মন আছে দেখিলে তারা তোর নিকট পড়ার বেতন লইবে না। নিজের খরচে তোকে বই কিনিয়া দিবে।

 অনন্ত এসব কথা শুনিয়া আসিত আর রাতদিন কেবল ভাবিত। অজানা একটা রহস্যলোক তাকে নিরবধি হাতছানি দিয়া ডাকিত। আনন্দের একটা অনাস্বাদিত উন্মাদনায় তার মন এক এক সময় ভয়ানক চঞ্চল হইয়া পড়িত।

 শেষে শীঘ্রই একদিন সে তার প্রার্থিত বস্তুর সন্ধানে পথে পা বাড়াইল।


 মালোদের একতায় যেদিন ভাঙ্গন ধরিল, সেইদিন হইতে তাদের দুঃসময়ের শুরু। এতদিন তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল বজ্রের মত দৃঢ়; পাড়াতে তারা ছিল একটা আঁটসাট সামাজিকতার সুদৃঢ় গাঁথুনির মধ্যে সংবদ্ধ। কেউ তাদের কিছু বলিতে সাহস করে নাই। পাড়ার ভিতর যাত্রার দল ঢুকিয়া সেই ঐক্যে ফাটল ধরাইয়া দিল।

 যাত্রাদলের যারা পাণ্ডা, তারা অর্থে ও বুদ্ধিতে মালোদের চেয়ে অনেক বড়। তারা অনেক শক্তি রাখে। কিন্তু একসঙ্গে সর্বশক্তি প্রয়োগ না করিয়া, অল্পে অল্পে প্রয়োগ করিতে লাগিল। যেদিন বিরোধের সূত্রপাত হইয়াছিল তার পরের দিন তারা তামসীর-বাপের বাড়িতে আরও জাঁকিয়া বসিল। এতদিন ছিল শুধু তবলা, এবার আসিল হারমনিয়ম, বাঁশি ও বেহালা। গীতাভিনয়ের তিন রকমের তিনটা বই আসিল। আগে কেউ নামও শুনে নাই এমনি একটা পালার তালিম দেওয়া সুরু হইল। তামসীর বাপ আগে সেনাপতি সাজিত, তাকে দেওয়া হইল রাজার পাঠ। জানাইয়া দিল মালোপাড়ার ছেলেদের তারা সখীর পাঠ দিবে। অভিভাবকেরা ছেলেদের যাত্রাদলে যোগ দিতে নিষেধ করিল। তারা বিড়ি খায়, ঘাড়কাটা করিয়া চুল ছাঁটে, গুরুজনের সামনে বেলাহাজ কথা বলে। ঠাকুর দেবতার গান ছাড়িয়া পথেঘাটে সখীর গানে টান দেয়, এতে তাদের স্বভাবচরিত্র খারাপ হইয়া যায়।

 অন্য পাড়া হইতে সখী সংগ্রহ হইল। কিন্তু সাজ-মহড়া হইল মালোপাড়াতে। তামসীর-বাপের উপর মালোর চটিল। কিন্তু মালোর মেয়েরা মহড়া দেখিতে গিয়া মুগ্ধ হইল, কাঁদিয়া ভাসাইল এবং ছেলেদের সখী সাজিতে দিবে বলিয়া সঙ্কল্প করিল।

 পরের মহড়ায় মালোপাড়ার কয়েকটি ছেলে অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সখী সাজিয়া নাচিল। বাম হাত কোমরে রাখিয়া ডান হাতের আঙ্গুল চিবুকে লাগাইয়া গাহিল, ‘চুপ্ চুপ্ চুপ্ লাজে সরে যাবে, ধীরে ধীরে চল্ সজনীলো। ধূলা দিয়ে সখী আমাদের চোখে গোপনে প্রণয় রেখেছে ঢেকে, এবার ভোমর যাবে লো ছুটে, চল্, না যেতে যামিনী লো, চুপ্ চুপ্’ ইত্যাদি।

 তাদের মায়েরা দিদিরা মুগ্ধ হইল। নাচখানা যেমন অপূর্ব গানখানাও তেমনি নূতন। এর ভাব, এর ভাষা, এর ভঙ্গি মালোদের গানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর সুরও অন্য রাজ্যের। তারা মুগ্ধ হইল এবং পরদিন হইতে যাত্রা দলের প্রতি অনুরক্ত হইল।

 অন্যান্য মালোরা তাদের বাধা দিল। একঘরে করিবার ভয় দেখাইল। বুঝাইতে চেষ্টা করিল যাত্রার ঐ গান গানই নহে। উহার ভাব খারাপ, অর্থ খারাপ। এতে ছেলেদের মাথা বিগড়াইবে। মেয়েদেরও মন খারাপ হইবে। কিন্তু তারা বিচলিত হইল না। বরং বলিল: আরে রাখ রাখ, মালোদের গান আবার একটা গান। এও গান আর আমরা যা গাই তাও গান। আমরা তো গাই—‘আজো রাতি স্বপনে শ্যামরূপ লেগেছে আমার নয়নে। ফুলের শয্যা ছিন্নভিন্ন ছিন্ন রাধার বসনে॥’ কিবা গানের ছিরি। যাত্রার ঐ গানের কথা যেমন সুন্দর, সুরও তেমনি, শোনা মাত্রই মুগ্ধ করে। আমরা ছেলে যাত্রাদলে দিবই, তোমরা একঘরে কর আর যাই কর।

 ফলে মালোদের মধ্যে দুইটা পক্ষ হইয়া গেল।


 মঙ্গলার বউ একদিন ঘাটে পাইয়া জানাইল, ‘পথে বিপদ আছে ভইন, একটু সাবধানে পা বাড়াইও। একজন নাকি তোমারে ‘আজ্‌নাইবে’। কথাখান আমার মহনের কানে আইছে।’

 সে কে, জিজ্ঞাসা করাতে মঙ্গলার বউ যার নাম করিল সে পাটনী-পাড়ার অশ্বিনী। বেটে-খাট চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আগে গয়নার নৌকা বাহিত। এখন যাত্রাদলে রাজার ভাই সাজে।

 এর প্রমাণও একদিন পাওয়া গেল।

 সুবলার বউ কলসী ও কাপড় লইয়া ঘাটে গেলে, সহসা দেখিতে পাইল অশ্বিনী একটু দূরে থাকিয়া তাহাকে দেখিতেছে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সে গান তুলিল, ‘যেই-না বেলা বন্ধুরে ধইল-ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী সিনানে যাই। কুখেনে বাতাস আইলো বুকের কাপড় উড়াইল, প্রাণবঁধু দেখিল সর্ব গাও।’

 গানের অর্থ সহজেই হৃদয়ঙ্গম হইল।

 দুপুরে ঘরে বসিয়া রাঁধিতেছিল। এমন সময় সেই গানেরই আর একটা কলি শোনা গেল। উঠান দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে আর গান করিতেছে, যেই না বেলা বন্ধুরে রাজ-দরবারে যাও, সেই বেলা আমি রান্ধি। কাঁচা চুলা আর ভিজা কাষ্ঠরে বন্ধু, ধুঁয়ার ছলনা কইরে কাঁন্দি।’

 এতদূর পর্যন্তও সহ্য করা গিয়াছিল। কিন্তু আরেকদিন যখন খাইতে বসিয়া সুবলার বউ আবার সেই গানেরই আরেক কলি শুনিল, ‘যেইনা বেলা বন্ধুরে বাঁশিটি বাজাইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী খাই। শাশুড়ী ননদীর ডরে কিছু না বলিলাম তোরে, অঞ্চল ভিজিল আঁখির জলে।’ তখন সে আর সহ্য করিতে পারিল না। এঁটো হাতেই ছুটিয়া বাহিরে আসিল, চীৎকার করিয়া বলিল, ‘আমার ঘরে শাশুড়ীও নাই ননদীও নাই। আমি কুন বেটারে ডরাই না। নির্ভয়েই কই, তুই আয়। বাপের ঘরের হইয়া থাকিস তো, অখনই আয়। আশপড়সীর সামনে দিনে পরেই তরে আমি ঘরে নিতে পারি, তুই আয়।’

 তার গলা শুনিয়া মঙ্গলার বউ, দয়ালচাঁদের বিধবা ভগিনী, কালোবরণের মা সকলেই বাহির হইল। তার চীৎকারের কারণ শুনিয়া ওদিকে মঙ্গলার ছেলে মহন, রামদয়াল গুরুদয়াল তারা দুই ভাই, লাঠি লইয়া ছুটিয়া আসিল। কিন্তু অশ্বিনী ততক্ষণে পাড়া ছাড়াইয়া বাজারে পা দিয়াছে।

 ‘কিরে মহন, কি অ সাধুরবাপ মধুরবাপ! ইটা আমার বাপের দেশ ভাইয়ের দেশ। ইখানে আমি কারুরে ডরাইয়া কথা কই না। ইখানে আমারে যেজন আজ্‌নাইব, এমন মানুষ মার গর্ভে রইছে। আমার কথা ছাড়ান দেও, আমি কই মালোপাড়ার কথা। দিনে দিনে কি হইল কও দেখি?’

 রামদয়াল গুরুদয়াল সকলেই খুব চটিল এবং পাড়ার লোককেও চটাইল, আর তাকে সমুচিত শাস্তি দিবে বলিয়া সকলে সঙ্কল্পও করিল। কিন্তু যাত্রার মহড়াতে সে যখন দরাজ গলায় গানে টান দিল, ‘হরির নামে মজে হরি বলে ডাক, অবিরাম কেন কাঁদবে বেটী-ঈ-ঈ-।’ তখনই মালোদের রাগ পড়িয়া গেল। কেবল মোহনের মনে সুবলার বউয়ের কথাগুলি জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলজ্বল করিতে লাগিল।


 মালোদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। গানে গল্পে প্রবাদে এবং লোকসাহিত্যের অন্যান্য মালমসলায় সে সংস্কৃতি ছিল অপূর্ব। পূজায় পার্বণে, হাসি ঠাট্টায় এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃতি ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মালো ভিন্ন অপর কারো পক্ষে সে সংস্কৃতির ভিতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালোদের সাহিত্য উপভোগ আর সকলের চাইতে স্বতন্ত্র। পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের গানগুলি ভাবে যেমন মধুর, সুরেও তেমনি অন্তরস্পর্শী। সে ভাবের, সে সুরের মর্ম গ্রহণ অপরের পক্ষে সুসাধ্য নয়। ইহাকে মালোরা প্রাণের সঙ্গে মিশাইয়া নিয়াছিল, কিন্তু অপরে দেখিত ইহাকে বিদ্রূপের দৃষ্টিতে। আজ কোথায় যেন তাদের সে সংস্কৃতিতে ভাঙ্গন ধরিয়াছে। সেই গানে সেই সুরে প্রাণ ভরিয়া তান ধরিলে চিত্তের নিভৃতিতে ভাব যেন আর আগের মত দানা বাঁধিতে চায় না, কোথায় যেন কিসের একটা বজ্রদৃঢ় বন্ধন শ্লথ হইয়া খুলিয়া খুলিয়া যায়। যাত্রার দল যেন কঠোর কুঠারাঘাতে তার মূলটুকু কাটিয়া দিয়াছে।

 অনেকেই নিরাশ হইয়া কালের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিল। নিরাশ হইল না কেবল মোহন। তার গলা ভাল। গানেও সে অনুরাগী। বাপ পিতামহের কাছ থেকে ভাটিয়ালী গান, হরিবংশ গান, নামগান অনেক শিখিয়াছিল। অধুনা মালোরা সে সব গান ভুলিয়া যাইতেছে। নূতন ধরণের হাল্কা ভাবের হাল্কা কবির গান আসিয়া সে সব গাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রাণময়, ভাব-সম্পদময় গানের স্থান অধিকার করিতেছে। এ দুঃখ সে মনের গভীরে বহুদিন অনুভব করিয়াছে। কিন্তু কালের স্রোত রুধিবার শক্তি কার আছে। এখন কালই পড়িয়াছে এই রকম। ভালো জিনিস পুরানো হইয়া হইয়া বাতিল হইয়া যাইবে আর হালকা জিনিস আসিয়া দশজনের আসরে জাঁকিয়া বসিবে। সে লোক ডাকিয়া খঞ্জনি ও রসমাধুরী যন্ত্র লইয়া দুপুর বেলাতেই গান গাহিতে বসিল।

 কিন্তু তারা যখন গাহিল, ‘গউর রূপ অপরূপ দেখলে না যায় পাসরা। আমি, গিয়াছিল সুরধুনী, ডুবল দুই নয়নতারা।’ তখন অপর দুইজন মালোরছেলে আর দুইটি যুগী ছেলের সঙ্গে সুর মিলাইয়া পাশের বাড়ির উঠান হইতে তারস্বরে গাহিয়া উঠিল, ‘সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে। তোমরা যত সৈন্যগণ যুদ্ধের কর আয়োজন, সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে।’ দেখিয়া মোহনের মনে খেদ উপস্থিত হইল যে, তার গান ঐ গানের মধ্যে কোথায় তলাইয়া যাইতেছে। তার দলের লোকেরাও যেন অন্যমনা হইয়া গিয়াছে। মনে মনে যেন সেই গানেরই তারিফ করিতেছে। আজকাল দুপুরবেলা আর গান জমে না, এই বলিয়া তারা বৈঠক ভাঙ্গিয়া উঠিয়া পড়িল।


 কিন্তু এখনো পর্যন্ত যাহা শুনিতে বাকি ছিল, একদিন বৈকালে তাহাও শুনিতে পাওয়া গেল; আজ রাতে যাত্রার নূতন পালার মহড়া হইবে কালোবরণের বাড়িতে।

 মালোদের এখনো যারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচাইতে তৎপর তারা শুনিয়া হায় হায় করিতে লাগিল। কেউ কেউ কালোবরণকে গিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিল: দেখ বেপারী, মালোপাড়ার যারা মাথা, সেই দয়ালচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র, হরিমোহন সবইত যাত্রার দিকে ঝুঁকিয়াছে। ছিলাম এক, হইয়া গেলাম দুই, নিত্য রেষারেষি, নিত্য খোঁচাখুঁচি। কোন্ দিন আমরা নিজেরাই লগি-বৈঠা লইয়া মারামারি করিতে লাগিয়া যাইব তার ঠিক নাই। মালো পাড়ার মাথায় যারা এই বজ্র ডাকিয়া আনিল, শেষ পর্যন্ত তুমি তাদের পথেই পা বাড়াইলে! না বেপারী, তুমি আমাদের দলে থাক। চল, মাতবরদের বুঝাইয়া সুঝাইয়া আবার মালোপাড়াতে আগের মত একতা ফিরাইয়া আনি। আমরা যাত্রা গাহিব কেন। আমাদের কি গান নাই! ময়-মুরুব্বিরা কি আমাদের জন্য গান কিছু কম রাখিয়া গিয়াছে। সে সব গানের কাছে যাত্রা গানতো বাঁদী। সামনে ঘোর দুর্দিন দেখিতেছি। যাত্রা লইয়া পাড়াতে যাহা শুরু হইয়াছে, তাহার শেষ না জানি কত ভয়ানক হইবে, সেই চিন্তাই করি। এখন তুমিই ভরসা। আজ তোমার বাড়িতে যাত্রা গাহিয়া যাওয়ার অর্থই সারা মালোপাড়ার বুকের উপর বসিয়া যাত্রা গাহিয়া যাওয়া।

 কিন্তু কালোবরণ কথাগুলি শুনিয়াও যেন শুনিল না এইরকম ভাব দেখাইয়া চুপ করিয়া রহিল।

 তারা ক্ষুণ্ণমনে ফিরিয়া আসিল।

 ‘অ, মহন, অ মন্‌মহন, আর ভরসা নাই। কালনাগে দেখি তারেও খাইছে।’

 মনমোহন নিস্তেজ কণ্ঠে বলিল, আমাদিগকে ফেলিয়া সকলেই লঙ্কা পার হইতেছে। দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। গৌরকিশোর গিয়াছে, কালোবরণও গেল। সব যাইবে।

 ‘না না, মহন, সব যাইব না।’ সুবলার বউয়ের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সকলেই যেন সচকিত হইয়া উঠিল।

 —দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। আরে মহন, তুইত যাস নাই। তুই আছিস্, সাধুর বাপ মধুর বাপ আছে। ছ’কুড়ি ঘরের তিনকুড়ি গিয়াছে। আরো ত তিনকুড়ি আছে। এই নিয়াই আমরা শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকিব। বেনালে বেঘোরে আমরা গা ভাসাইব না। যে ক’ ঘর থাকিবে, তাই নিয়া আমরা শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া যাইব। মালোপাড়াতে যারা বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে, এক গুয়া কাটিয়া যারা দুইভাগ করিয়াছে, আমরা কিছুতেই তাদের নিকট নতি স্বীকার করিব না। কালোবরণ বেপারীর বাড়িতে আজ যদি যাত্রা দেয় ত, তোর বাড়িতেও আসর জমা। আজ একটা পরীক্ষা হইয়া যাক।

 সুবলার বউ মোহনকে লইয়া বসিল। দুইজনেই স্মৃতির দুয়ার খুলিয়া যে সকল ভাল ভাল গান বিস্মরণ হইয়াছিল, মনের মধ্যে সেগুলিকে ডাকিয়া আনিল। তারমধ্যে আবার যেগুলি খুব জমে, সেগুলিকে লইয়া মুখে মুখে একটা তালিকা প্রস্তুত করিল।

 ‘এই-এইগুলি বিচ্ছেদ গান। দেহতত্ত্বের পরেই গাইবি। আর নিশি-রাতে গাইবি ভাইট্যাল গান। হরিবংশ গাইবি রাত পোহাইবার অল্প বাকি থাকতে। ভোরে ভোরগান আর সকালে গোষ্ঠগান গাইয়া তারপর মিলন গাইয়া আসর ভঙ্গ করবি।’


 যাত্রাওয়ালারা সন্ধ্যার পর বেহালা ও হারমনিয়ামের বাক্স এবং বাঁয়া-তবলা লইয়া কালোবরণের উঠানে বসিয়া যখন ঢোলকে চাপড়ি দিল তখন মোহনের দলও খঞ্জনি রসমাধুরী যন্ত্র লইয়া বসিয়া গেল। এবাড়িতে ওবাড়িতে দূরত্ব শুধু খানদুই ভিটা। ওবাড়িতে কথা বলিলে এ বাড়ি থেকে শোনা যায়।

 ও বাড়িতে যখন বীরবিক্রমে বক্তৃতা চলিতেছে, এবাড়িতে মোহনের দল দেহতত্ত্ব শেষ করিয়া বিচ্ছেদগান শুরু করিয়াছে: ভোমর কইও গিয়া, কালিয়ার বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া॥ না খায় অন্ন না লয় পানি, না বান্ধে মাথার কেশ, তুই শ্যামের বিহনে রাধার পাগলিনীর বেশ॥

 সারা মালোপাড়া দুই ভাগে ভাগ হইয়া দুই বাড়িতে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। বেশির ভাগ গিয়াছে কালোবরণের বাড়িতে। তাদের চোখমুখে নূতনের প্রতি অভিনন্দনের ভাব। মোহনের বাড়িতে যারা আসরে মিলিয়া বসিয়া গিয়াছে তাদের চোখে মুখে সংস্কৃতি রক্ষার দৃঢ়তা।

 রাধার বিচ্ছেদবেদনা সুরে সুরে লহরে লহরে উৎসারিত ও বিচ্ছুরিত হইতেছে। সকলের প্রাণের মধ্যে একটা বেদনার হাহাকার গুমরিয়া উঠিতেছে। দলের বড় গায়ক উদয়চাঁদ রসমাধুরী ঠাট করিতে করিতে বলিল, এখানে এ গানটা চলিতে পারে, ‘জীবন জুড়াব যেয়ে কার কাছে, দয়াল কৃষ্ণবিনে বন্ধু ভবে কে আছে।’ কারো কারো মনঃপুত না হওয়াতে বলিল, তবে এটা তুলিতে পার, ‘কি গো কালশশী, তোমার বাঁশি কেনে রাধা বলে, কৃষ্ণ বলে না। দুঃখিনী রাধারে হরি সঁপলা কার ঠাঁই। ব্রজগোপীর ঘরে ঘরে ঠাঁই মিলে না দাঁড়াইবার।’

 তার চেয়েও উত্তম গান মোহনের স্মরণেই ছিল। বলিল, তার আগে এই গানটা হোক, ‘এহি বৃন্দাবনে ব্রজগোপীগণে ঝুরিয়াছে দু’নয়ানে। পশুপক্ষী সবে কান্দিছে নীরবে হায় হায় কৃষ্ণবলে।’

 আজ কৃষ্ণের মথুরায় গমন। শূন্য বৃন্দাবন একসারে ক্রন্দন করিতেছে। পশুপাখী, গাভীবৎস, দ্বাদশবন, যমুনাপুলিন, চৌরাশি ক্রোশ ব্রজাঙ্গন একযোগে রোদন করিতেছে। ব্রজগোপীর চোখের জলে পথ পিছল। সেই পিছল পথে রথের চাকা কতবার বসিয়া গিয়াছে। ব্রজগোপী কতবার গাহিয়াছে, ‘প্রাণ মোরে নেওরে সঙ্গেতে, ব্রজনাথ রাখ রথ কালিন্দীর তটেতে।’ কিন্তু তবু তার যাত্রা থামে নাই। ব্রজগোপীর বুকজোড়া কামনা হৃদয়ছোঁয়া ভালবাসাকে দলিত মথিত করিয়া, তার বুকখানা দুমড়াইয়া গুঁড়াইয়া দিয়া তার রথ চলিয়া গিয়াছে। ব্রজগোপী সবদিক দিয়া আজ কাঙাল। তবু আশা ছাড়ে না। তবু বলে, ‘ম’লে নি গো পাব, এ প্রাণ জুড়াব, যায় যায় চিত্ত জ্বলে।’

 একটা বেদনা-বিধুর ভারাক্রান্ত পরিবেশের মধ্যে গানটা সমাপ্ত হইল। ও বাড়িতে তখন বিবেকের গলা শোনা গেল, ‘লাগল বিষম যুদ্ধ এবার দেবতা দানবে—এ-এ। লাগল বিষম যুদ্ধ এবার।’

 বিশ্রাম নিতে নিতে উদয়চাঁদ বলিল, লাগছে যখন, যুদ্ধ ভাল কইরাই লাগুক। ভাইট্যাল গান একটা স্মরণ কর মহন।’

 রাত বাড়িয়া চলিয়াছে। কালোবরণের বাড়ি হইতে হাসির কলরোল ভাসিয়া আসিতেছে। বোধ হয় কোনো হাসির পাঠ অভিনয় হইতেছে। মালোদের ছেলেমেয়ে বউঝি গিন্নিবান্নিরা পর্যন্ত সেখানেই গিয়া ভিড় বাড়াইতেছে। মোহনের বাড়ির জনতা পাতলা হইয়া আসিতেছে। কিন্তু যারা গাহিতেছে, জনতা বাড়িল কি কমিল সেদিকে তাদের লক্ষ্য নাই। এখন রাত গভীর হইয়াছে। এখন ভাটিয়াল গাহিবার সময়। এখন এমন সময়, যখন জীবনের ফাঁকে ফাঁকে জীবনাতীত আসিয়া উঁকি দিয়া যায়। এখন কান পাতিয়া রাত্রির হৃদস্পন্দন শুনিতে শুনিতে অনেক গভীর ভাবের অজানা স্পর্শ অনুভব করা যায়। অনেক অব্যক্ত রহস্যের বিশ্বাতীত সত্তা এই সময় আপনা থেকে মানুষের মনের নিভৃতে কথা কহিয়া যায়। সে কথা ভাটিয়ালী সুরে যে ইঙ্গিত দিয়া যায় অন্য সময়ে তাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যায় না।

 মোহনের দল এখন যে গান তুলিল, তিতাসের অপর তীরে গিয়া তাহা প্রতিধ্বনি জাগাইয়া দিল। ‘কানাইরে বেলা হইল দুই রে প’র। প্রাণটি কাঁপে রাধার থর থর রে, মথুরার বিকি যায় রে বইয়া রে সুন্দর কানাইরে। কানাইরে, পার হইতে কংস রে নদী, নষ্ট হইল রাধার ভাণ্ডের দধি রে অ কানাই, নষ্ট করলি দধির ভাণ্ড ছঁইয়া রে সুন্দর কানাইরে।’ এই রাধা বৃন্দাবনের প্রেমাভিসারিকা রাধা নহে। এ রাধা জন্ম-মৃত্যু দুই তীরের পারাপারশীল মানব আত্মা। কংসনদী অর্থাৎ যমুনা নদী এখানে জন্মমৃত্যুর সীমারেখা। আত্মা তার খেলাঘর ছাড়িয়া উজান ঠেলিয়া চলিয়াছে। নিঃসীম অন্ধকারে তার এপার ওপার আবৃত। কানাই বেশী ভূমাই তাহাকে পার করিয়া চালাইয়া নিবার মালিক, আত্মা নিষ্কলুষ হইলে কি হইবে, তার পার্থিব দধিভাণ্ডের প্রতি মায়া জাগে। কিন্তু নারায়ণ তাকে ঐহিক সবকিছুর কলঙ্ক-স্পর্শ থেকে নির্মুক্ত করিয়া, পরিশুদ্ধ করিয়া লইতে চান, নিজের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে। এই জন্য তিনি দধির ভাণ্ড স্পর্শ করিয়া সব দধি নষ্ট করিয়া দিয়াছেন। সকল মালো এর সব অর্থ না বুঝিলেও, গানের সুরে সুদূরের কি কথা যেন ভাসিয়া আসিয়া তাদের জীবনে এক জীবনাতীতের বাণী শুনাইয়া গেল। গানে তারা উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে।

 ‘কালো কালো কোকিল কালো, কালো ব্রজের হরি। খঞ্জন পক্ষীর বুক কালো, চিত্ত ধরিতে না পারি॥ শুতিলে না আসে নিদ্রা বসিলে ঝুরে আঁখি। (আমি) শিথান বালিশ পইথান বালিশ বুকে তুইল্যা রাখি॥’ পরম প্রার্থিতের সঙ্গে মিলনের চরম ক্ষণ ঘনাইয়া আসিতেছে। রজনীর ক্রমবর্ধমান গভীরতা এই কথাই জানাইয়া দিতেছে। চতুর্দিকে আদি অন্তহীন কালোবরণ। তারই স্নিগ্ধ অরূপ রূপমাধুর্যে চিত্ত পিপাসিত। এ পিপাসা অনন্তের রূপসুধা পানে উন্মুখ। মুহূর্তগুলি আর কাটিতে চাহিতেছে না। ক্রমেই অস্থিরতা বাড়িতেছে, এমন সময় আসিয়াছে যখন শুইলে না আসে নিদ্রা বসিলে ঝুরে আঁখি।

 রাত বোধ হয় আর বেশি নাই। এখনই হরিবংশ গানের সময়। এর নাম কি কারণে হরিবংশ গান হইল, মালোরা তাহা জানে না। বাপ পিতামহের কাছ হইতে শিখিয়াছে এই গান, আর শিখিয়া রাখিয়াছে যে এর নাম হরিবংশ গান। এর কথা বিচ্ছেদবিধুর মানবাত্মার সুগম্ভীর আকুতি। এর সুর অত্যন্ত দরাজ। পুরা করিয়া টান দিলে দিক্‌দিগন্তে তাহা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। এ গান এখন আর বেশি লোকে গাহিতে পারে না। পুরাপুরি সুর খুলিয়া গাহিতে পারে একমাত্র উদয়চাঁদ।

 ‘মাটির উপরে বৃক্ষের বসতি, তার উপরে ডাল, তার উপরে বগুলার বাসা, আমি জীবন ছাড়া থাকব কত কাল॥ নদীর ঐ পারে কানাইয়ার বসতি, রাধিকা কেমনে জানে।...’ কথার ওজস্বিতায় না হোক সুরের উদাত্ততায় জীবন-রাধিকা কাণ্ডারী-কানাইকে সহজেই খুঁজিয়া বাহির করিল এবং মরণ-নদী পার হইল। এদিকে রাত্রিও শেষ হইয়া আসিয়াছে। ওদিকে কালোবরণের বাড়ি হইতে তখনও গান ভাসিয়া আসিতেছে, ‘সারারাতি মালা গাঁথি মুখে চুমু খাই রে, চিনির পান মুখখানা তোর আহা মরে যাইরে।’ কিন্তু এ গান অপেক্ষা ভাটিয়াল গানের আকর্ষণ অধিক হওয়ায় দলে দলে লোক কালোবরণের বাড়ি হইতে মোহনের বাড়িতে চলিয়া আসিল। উৎসাহ পাইয়া উদয়চাঁদ তার সবচেয়ে প্রিয় গানখানাই এবার তুলিল। সকলেই জানে যে এ গানটি যতবার গাহিয়াছে প্রত্যেকবারই উঠিয়া সঙ্গে সঙ্গে নাচিয়াছে। এ গানে তার সঙ্গে আরও দুই একজনে উঠিয়া হাত নাড়িয়া নাচিয়া থাকে।

 ও বাড়িতে তারা অন্যের গান কেবল শুনিয়াছে, গাহিবার যারা তারা একাই গাহিয়াছে। কিন্তু এবাড়ির গান মালোদের সকলেরই প্রাণের গান। যতদূরেই থাক, এর সুর একবার কানে গেলে আর যায় কোথা। অমনি সেটি প্রাণের ভিতর অনুরণিত হইয়া উঠে। কাছে থাকিলে সকলের সঙ্গে গলা মিলাইয়া গায়। দূরে থাকিলে আপন মনে গুন্ গুন্ করিয়া গায়। আজও তারা উদয়চাঁদের সহিত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ মিশাইয়া গাহিল:

না ওরে বন্ধ্ বন্ধ্ বন্ধ্, কি আরে বন্ধ্ রে, 
তুই শ্যামে রাধারে করিলি কলঙ্কিনী।
মথুরার হাটে ফুরাইল বিকিকিনি॥
না ওরে বন্ধ্— 
তেল নাই সলিতা নাই, কিসে জ্বলে বাতি।
কেবা বানাইল ঘর, কেবা ঘরের পতি॥
না ওরে বন্ধ্— 
উঠান মাটি ঠন্‌ ঠন্‌ পিড়া নিল সোতে।
গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে॥

 এমন সময় কাক ডাকিয়া উঠিল। চারিদিক ফরসা হইয়া আসিল এবং আসরের বাতি নিভাইয়া দেওয়া হইল। কালোবরণের বাড়ি একেবারেই নীরব ও নির্জন হইয়া গিয়াছে। মোহনের উঠানে লোকের আর ঠাঁই কুলাইতেছে না। বিজয়ের গর্বে উল্লসিত মোহন বলিয়া উঠিল, ‘ঠাকুর সকল, দুইখান নামগান গাইয়া যাও। আমি গিয়া খোল করতাল আনি।’

 নামগান আরও কঠিন। তাই বহুদিন ধরিয়া গাওয়া হয় না। আজ অনেকদিন পরে এক উঠানে সব মালো সমবেত হইয়াছে। এমন আর কোন্ দিন হইবে। তাই আজ একবার প্রাণ ভরিয়া নামগান গাহিতেই হইবে। এ গানের সুর খুব চড়া। গাহিতে খুব শক্তির দরকার। গায়কেরা চার ভাগে ভাগ হইয়া খণ্ডে খণ্ডে উহাকে গাহিয়া নামায়। একটি গান নামাইতে ঝাড়া এক প্রহর সময় লাগে।

 মোহন বলিল, ‘ঠাকুর সকল, সহচরী গাইবা না বস্ত্রহরণ গাইবা।’

 ‘সহচরী’ই গাহিবে ঠিক হইল।

 ‘সহচরী, উপায় বল কি করি,’ এই বলিয়া রাধা তার আক্ষেপ শুরু করিল। আমার অতি সাধের সাধনার ধন হারাইলাম। আগে জানিলে কি সই করিতাম প্রেম, তারে দিতাম কুলমান। যা হোক, অনেক চেষ্টা চরিত্র করিয়া তাকে তো প্রায় ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। কিন্তু তোর একি করিলি, চিত্রপটে তার রূপ দেখাইয়া আমায় আবার কেন তাকে মনে করাইয়া দিলি। তোরা আমায় ধর; আমার জীবন যাইবার সময় উপস্থিত, তোরা আমায় ধর।

 গান শেষ হইল, যখন রোদ চড়িল তখন। মালোদের মনও বুঝি এই কাঁচা রোদের মতই স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে। অনেকদিন পরে আজ তারা প্রাণ খুলিয়া মিশিল এবং গান গাহিয়া মনের গ্লানি দূর করিল।

 কিন্তু দুইদিন পরে যখন কালোবরণের বাড়িতে বাক্স-বাক্স সাজ আসিল, এবং রাত্রিতে যখন সাজ পোষাক পড়িয়া সত্যিকারের যাত্রা আরম্ভ হইল, মালোরা তখন সব ভুলিয়া যাত্রার আসর ভরিয়া তুলিল। বালক বৃদ্ধ নারী পুরুষ কেউ বাদ রহিল না। সকলেই গেল। মাত্র দুইটি নরনারী গেল না। তারা সুবলার বউ আর মোহন। অপমানে সুবলার বউ বিছানায় পড়িয়া রহিল, আর বড় দুঃখে মোহনের দুই চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল।