তীর্থরেণু/আত্মঘাতিনী
আরেক দুর্ভাগিনী
গেছে সংসার থেকে,
জীবন যাতনা মানি’
মৃত্যু নিয়েছে ডেকে।
ধর্ গো আস্তে ধর্
সাবধানে তোল্, বাছা;
মুখখানি সুন্দর,
বয়েস নেহাৎ কাঁচা।
তবু সে পরেছে আজ
মহাযাত্রার সাজ;
আর্দ্র বসনে, চুলে
অবিরত জল ঝরে;
ঝটিতি নে গো নে তুলে,
ঘৃণা ভুলে, স্নেহভরে।
তুলিস্নে হেলা ক’রে,
ব্যথার ব্যথী হ’, ওরে!
দাও নয়নের বারি;
গ্লানি তার ঘুচিয়াছে,
এখন যেটুকু আছে—
সে যে পবিত্র-নারী।
তার সে মতিভ্রমে
ভাবিনে আজ ভ্রমে,—
আর সে অত্যাচারে;
সব কলঙ্ক শেষ,
শুভ-সুন্দর বেশ
মৃত্যু দিয়েছে তারে।
থাক্ তার শত ক্রটি
তবু সে মানুষ, ওরে,
লালাস্রাবী ঠোঁট দুটি
মুছে দে যতন ক’রে।
কবরী পড়েছে খসি’
জড়ায়ে দে চুল মাথায়,
কি নিবিড় কেশরাশি!
বিস্ময়-নীরে ভাসি’-
ঘর ছিল তার কোথায়?
বাপ, মা,—কেহ কি নাই?
নাই কি আপন বোন্?
নাই সহোদর ভাই?
আর কোনো প্রিয় জন?—
প্রিয় যে সবার চেয়ে?
হায়, অভাগিনী মেয়ে!
পর-দুখ-অনুভব
হায় সে কি দুর্লভ!
সংসার সুকঠিন!
থাম-দেওয়া মোটা মোটা
এত বাড়ী, এত কোঠা,—
তবুও সে গৃহহীন!
বাপ, মা, ভায়ের স্নেহ
দিতে পারিলেনা কেহ?
কি বিষম! কি ভীষণ।
প্রেম—গৌরব-হারা,
(প্রমাণ খুঁজিছে কারা?)
দেবতার কৃপাধারা
তাও যে অদর্শন।
কত গৃহে আলো জ্বলে’-
ঝলকে নদীর জলে,
কত উৎসব হয়,
অভাগী আঁধারে থেকে
অবাক নয়নে দেখে,
নিশীথে নিরাশ্রয়!
কন্কনে হিম হাওয়ায়
কাঁপিয়ে দেছিল তারে,—
কাঁপাতে পারেনি যাহায়
স্রোতে কি অন্ধকারে;
লাজ অপমান স্মরি’
মরণ নিল সে সরি’,—
পরাণ ছুটিতে চায় রে!
যেথা হোক্! যেথা হোক!
এ-জগতের বাইরে!
নদীর খরস্রোতে
গেল সে শীতল হ’তে,—
ঝাঁপ দিল বিহ্বলে;
লুব্ধ পুরুষ! কই?
এসে দেখে যাও, ওই
কর্ম্মের ফল ফলে!-
পার যদি স্নান কোরো,—
পান কোরো ওই জলে।
ধর্ গো আস্তে ধর্,
সাবধানে তোল্, বাছা;
মুখখানি সুন্দর!
বয়েস নেহাৎ কাঁচা।
তনুখানি নমনীয়
থাকিতে থাকিতে, ওরে
যতনে শোয়ায়ে দিয়ো
শেষ শয্যার ‘পরে;
চকিত চোখের পাতা
খোলা যেন থাকে না তা’,—
দিয়ো সে বন্ধ ক’রে।
ভীষণ চাহিয়া আছে
মৃত্যু-হতাশ আঁখি,
ভবিষ্যতের পানে
যেন সে দৃষ্টি হানে
গ্লানির মাঝারে থাকি’।
অমানুষ মানুষের।
গভীর অবজ্ঞায়
এ দশা আজিকে এর,
তাই পাগলের প্রায়
খুঁজেছে সে বিশ্রাম;
শোচনীয় পরিণাম।
দু’টি হাত ধীরে ধীরে
রাখ গো বুকের ‘পরে,
মরণ-নদীর তীরে
যেন ঈশ্বরে স্মরে।
দোষ তার মেনে নিয়ে,
ক্রটি—সে স্বীকার ক’রে,
সঁপে তারে যাও দিয়ে
বিভুর চরণ ‘পরে।