তীর্থরেণু/সাগরের প্রতি
হে পিঙ্গল মত্ত পারাবার,
মোর তরে মন্দ্রভাষী তুমি এনেছ এনেছ সমাচার।
বিপুল বিস্তৃত পৃষ্ঠ তুলি’
চলেছে তরঙ্গ-ভঙ্গ তব; মাঝে মাঝে ক্রোড়-সন্ধিগুলি।
অতল পাতাল-গুহা প্রায়,
তারি ‘পরে অস্পষ্ট সুদুর তরী চলে স্পন্দিত পাখায়।
শুনি আমি গর্জ্জন তোমার,—
কহ তুমি, “তীরে বসি’ বিলম্ব করিছ কেন মিছে আর?
“ফেন-ধৌত আকাশ পরশি’
নাচিছে উত্তাল ঢেউ যত, এস্ত চোখে তাই দেখ বসি’?
“ক্ষুদ্র এই তরী স্বল্পপ্রাণ,-
সাহসে পশেছে সেও তরঙ্গ-সঙ্গাতে, আছে ভাসমান।
“বিনাশ যদ্যপি ঘটে তার,-
তাহে কিবা? নাহি কি তাহারি মত আরো হাজার হাজার?
“দর্পভরে হও আগুয়ান,
সহজ আরামে মাটি থেক না আঁকড়ি’ ভীরুর সমান;
“নেমে এস, যাও জেনে লয়ে
কি বিহ্বল পুলক বিপদে, কি আনন্দ ভাগ্যবিপর্যয়ে।”
বটে গো প্রমত্ত পারাবার,
আমি যে তোমার চেয়ে বলী, মহত্তর উচ্ছ্বাস আমার।
উঠি তব তরঙ্গ-চূড়াতে,
সে কেবল কৌশল আমার খেলিবারে আকাশের সাথে;
আবার তলায়ে ডুবে যাই,
কোলাহল-কল্লোলের তল কোথা আছে জানিবারে তাই।
নিরাপদে তীরে সারাবেলা
খেলা, সে যে বিধাতার মহা-অভিপ্রায় ব্যর্থ ক'রে ফেলা;
এ খেলা যে সাজে না আত্মার,
মৃত্যুহীন পরম পুরুষ চিরজনমের লক্ষ্য যার।
সিন্ধু সম বিঘ্ন ও বিপদে
বিশ্বজনে ঘিরেছেন তাই ভগবান; তাই পদে পদে
সৃজিয়া বেদনা ব্যর্থতায়
বিষম জটিল ফাঁদ দেছেন জড়ায়ে আমাদের পায়;
বজ্রে 'ওতঃপ্রোত করি’ মেঘ,
বিপর্যস্ত করিছেন তাই——পাশমুক্ত করি ঝজ্ঞঝাবেগ;—
যাহে নর হয় দুঃখজয়ী,
পরাজয়ে মাতে জয়োল্লাসে যাতনার নির্যাতন সহি’,
আপনার অজেয় আত্মায়,
প্রতিকূল নিয়তির সমকক্ষ করি’ আপ্ত ক্ষমতায়।
লও মোরে হে সিন্ধু মহান,
হও মা আনন্দের হেতু, হও তুমি স্বর্গের সোপান।
হে সমুদ্র, দুরন্ত কেশরী,
তোমারে আনিব নিজ বশে হেলায় কেশর-গুচ্ছ ধরি’;
নহে ডুবে যাব একেবারে
লবণা গভীর গহ্বরে অন্ধকার অতল পাথারে।
সুবিপুল ও বপুর ভার।
ধরিব নিজের পরে, করিব নিরোধ ভাগ্যেরে আমার।
হে স্বাধীন, হে মহাসাগর!
অমেয় আত্মার বল পরখিতে আজ আমি অগ্রসর।