ত্রিপুরার স্মৃতি/পাইটকারা পরগণার অন্তর্গত দুইটী প্রাচীন জনপদ

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 351 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।



পাইটকারা পরগণার অন্তর্গত দুইটী প্রাচীন জনপদ

বরকামতা

 পাটিকারা বা পাইট্‌কারা পরগণার অন্তঃপাতী বরকামতা নামক প্রাচীন গ্রামটী ত্রিপুরা জিলার সদর ষ্টেসন্‌ কুমিল্লা নগরীর পশ্চিমদিকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত। এই স্থান হইতে উদ্ধৃত এক শিলালিপি এবং উক্ত জিলার অন্তর্গত নুরনগর পরগণার পশ্চিম প্রান্তদেশস্থ বাঘাউরা গ্রামের পুষ্করিণীর মধ্যে যে একটী বিষ্ণুমূর্ত্তি প্রাপ্তির বিষয় পূর্ব্ব প্রবন্ধে উল্লেখ করা হইয়াছে, সেই মূর্ত্তির পদনিম্নে কুটিল বা সিদ্ধ-মাতৃকা অক্ষরে উৎকীর্ণ লিপি পর্য্যবেক্ষণ করিয়া ঢাকা কৌতুক-সংগ্রহালয়ের তাত্ত্ববধায়ক নলিনীকান্ত ভট্টশালী নিৰ্দ্ধারণ করেন যে, বঙ্গদেশের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তবর্ত্তী সমতট নামক প্রদেশটী একদা নৃপতি প্রথম মহীপালের শাসনাধীন ছিল; এবং উল্লিখিত “বরকামতা” নামে খ্যাত গ্রামটীই সমতট প্রদেশের তৎকাল-প্রসিদ্ধ রাজধানী “করুমন্ত”।

 নলিনীকান্ত ভট্টশালী কর্ত্তৃক নিৰ্দ্ধারিত প্রাগুক্ত বিষয় সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাসকার ভিনসেণ্ট স্মিথ সমর্থন করিলেও কেহ কেহ যে ইহার প্রতিবাদ না করিয়াছেন এমন নহে। আবার কোন কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক এতদঞ্চল প্রাচীনকালের সুপ্রসিদ্ধ রাজ্য “কমলাঙ্গ” বলিয়াও অভিহিত হইয়াছে।

 উল্লিখিত ইতিহাসকার কর্ত্তৃক বিরচিত ভারতবর্ষের ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, বর্ণিত বরকামতা গ্রাম মধ্যে কতকগুলি প্রস্তর মূর্ত্তি ও পুরাকালের ইষ্টক নির্ম্মিত নিকেতনাদির ভগ্নাবশেষ অবস্থিত; কিন্তু অধুনা কতিপয় ইষ্টক স্তূপ ও বিকীর্ণ ইষ্টকরাশি ব্যতীত তৎসমুদয়ের কিছুই বর্ত্তমান নাই। সম্ভবতঃ মূর্ত্তিনিচয় নানা স্থানে অপসারিত হইয়াছে এবং ইষ্টক গ্রহণ উদ্দেশ্যে কিংবা গুপ্তধন প্রাপ্তির আশায় পল্লীনিবাসিগণ কর্ত্তৃক অত্রস্থ ভগ্ন নিকেতনাদি সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হইয়া থাকিবে।

 সম্প্রতি তথায় থাকিবার মধ্যে—পল্লীমধ্যস্থ ন্যূনাতিরেক ত্রিংশ-হস্ত-ব্যাপী এবং ন্যূনকল্পে বিংশ হস্ত উচ্চ এক মৃন্ময় স্তূপোপরি প্রোথিত একটী পাষাণস্তম্ভ মাত্র বিদ্যমান আছে। গ্রামস্থ লোকেরা ইহাকে শিবলিঙ্গ আখ্যা প্রদান করে।

 প্রকৃতপক্ষে ইহা শিবলিঙ্গ অথবা কোন প্রস্তরনির্ম্মিত কীর্ত্তি স্তম্ভ, এবং তদ্গাত্রে কোনরূপ লিপি উৎকীর্ণ আছে কিনা, এই বিষয় উক্ত মৃত্তিকা স্তূপ খনন করিলে জ্ঞাত হওয়া যাইত; কিন্তু এই সম্বন্ধে কেহ প্রয়াস পাইয়াছেন কিনা তাহ জ্ঞাত হওয়া যায় না। যদি স্তম্ভটীর গাত্রে কোনরূপ লিপি উৎকীর্ণ থাকে তাহা হইলে ইহার বিষয়—এমন কি এতৎ প্রদেশের তিমিরাচ্ছন্ন ইতিবৃত্তও উদ্ঘাটিত হওয়া অসম্ভব নহে।

 যদি এই জনপদ প্রকৃতই ভূপতি মহীপালের রাজধানী হয়, তাহা হইলে ইতিহাসকার ভিন্‌সেণ্ট স্মিথ কর্ত্তৃক বর্ণিত অত্রস্থ মূর্ত্তিনিচয় এবং ভগ্ন নিকেতনাদি তদীয় শাসনকালে নির্ম্মিত গৃহাদিরই ভগ্নাবশেষ হইতে পারে।

চাঁদিনা

 প্রাগুক্ত “বরকামতা” গ্রাম-সান্নিধ্যে “চাঁদিনা” নামক যে আর একটী পুরাতন গ্রাম অবস্থিত, তন্মধ্যেও কতিপয় ইষ্টক নির্ম্মিত ভবনাদির ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগোচর হয়। অত্রস্থ এক প্রাচীন পুষ্করিণী সংস্কার কালে তন্মধ্য হইতে একটী প্রস্তর নির্ম্মিত চতুর্ভূজ নারায়ণ-মূর্ত্তি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। মূর্ত্তিটী ন্যূনকল্পে তিন হস্ত উচ্চ হইবে এবং কোনরূপ বিকলাঙ্গ হয় নাই। ইহা পর্য্যবেক্ষণ করিয়া নির্ম্মাতার শিল্পচাতুর্য্যের প্রশংসা করিতে হয়। যে পুষ্করিণী হইতে উক্ত মূর্ত্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তৎসমীপবর্ত্তী এতদঞ্চলের ভূস্বামিগণের কার্য্যালয়-সন্নিধানে সংস্থাপিত দুইটী আধুনিক শিবমন্দিরের একটীর মধ্যে উক্ত মূর্ত্তি রক্ষিত হইতেছে।

 উল্লিখিত জলাশয়ের দক্ষিণপশ্চিম কোণে বৃক্ষ-লতা সঙ্কুল একটী দ্বিতল নিকেতনের ধ্বংসাবশেষ পরিলক্ষিত হয়। গৃহটী ক্ষুদ্রাকারের ইষ্টকে নির্ম্মিত। ইহা পর্য্যবেক্ষণ করিয়া অধিক প্রাচীন অনুভূত হইল না। কিন্তু নিতান্ত যে আধুনিক এরূপও মনে হয় না।

 এতদ্ব্যতিরেকে উল্লিখিত জলাশয়ের পশ্চিম প্রান্তে একটী বৃহৎ তোরণ-বিশিষ্ট প্রাচীর পূর্ব্বে ছিল বলিয়া পল্লীবাসিগণ কহে। জ্ঞাত হওয়া যায় যে, উহা এতদঞ্চলের বর্তমান ভূম্যধিপদিগের কর্ম্মচারিগণ কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত হইয়াছে।

 এই স্থান হইতে অল্প দূরে যে এক অনুমুচ্চ সমতল মৃত্তিকাস্তূপ অবস্থিত, তদুপরি একটী ইষ্টক নির্ম্মিত চতুষ্কোণ ক্ষুদ্র বেদীর অনুরূপ পদার্থ পরিলক্ষিত হয়। তৎসম্বন্ধে স্থানীয় লোকে এইরূপ কহে—উক্ত গ্রাম মুসলমান ভূস্বামীদিগের অধিকারে থাকিবার সময় এই স্থানে যে ইমামবাড়া নির্ম্মিত হইয়াছিল, ঐ বেদী সদৃশ পদার্থটি তাহারই ধ্বংসাবশিষ্ট অংশ। অদ্যাপি পল্লীনিবাসী মুসলমানগণ কোন বিশেষ যাবনিক পর্ব্বোপলক্ষে সায়াহ্নে তদুপরি দীপ প্রদান করে বলিয়া শ্রুতি গোচর হয়।

 অত্রস্থ লোকমুখে এইরূপ অবগত হওয়া যায় যে এতদঞ্চল হইতে কতিপয় প্রস্তরনির্ম্মিত মূর্ত্তি উদ্ধৃত হইয়াছিল। তৎসমুদয়ের সহিত প্রাপ্ত “মহাভিনিস্ক্রমণ” (মহাভিনিখকমণ) মূর্ত্তিটী ঢাকার কৌতুক-সংগ্রহালয়ে প্রেরিত হইয়াছে। অবশিষ্ট মূর্ত্তিনিচয় ইদানীং কুমিল্লা নিবাসী জনৈক ভদ্রলোকের বাসস্থান-সমীপে অযত্নে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। তৎসমুদয়ের মধ্যে সুচারুরূপে নির্ম্মিত একটি দ্বিভূজ নরমূর্ত্তিই উল্লেখ যোগ্য। উহা সূর্য্যমূর্ত্তি বলিয়া অভিহিত হয়। ইহার সন্নিধানে যে এক প্রস্তর নির্ম্মিত গণেশ মূর্ত্তি আছে, তাহার নির্ম্মাণ কৌশলও প্রশংসার উপযুক্ত। উহার ভুজচতুষ্টয় ও শুণ্ডের কিয়দংশ ভগ্ন হইয়াছে।