ত্রিপুরার স্মৃতি/পিলাক্‌ পাথর

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

পিলাক্‌-পাথর

 ত্রিপুররাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তবত্তী “বিলোনিয়া” উপবিভাগে “পিলাক্‌-পাথর” নামে খ্যাত এক প্রাচীন গ্রাম আছে। এই জনপদ উক্ত রাজ্যের পুরাতন রাজধানী উদয়পুরের দক্ষিণ দিকে ন্যূনাতিরেক দ্বাদশ ক্রোশ দূরস্থ পর্ব্বতমালার বেষ্টনী-মধ্যে অবস্থিত।

 উল্লিখিত গ্রামের উত্তর দিকে প্রবাহিত মুহরী নদীর সন্নিহিত বলিভীম নারায়ণের নামসমম্বিত একটী দীর্ঘিকা আছে। এই স্থান-নিবাসী জনসাধারণকর্ত্তৃক কথিত হয় যে, ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দ মাণিক্যের তনয় নৃপাল রাম মাণিক্যের শ্যালক বলিভীম নারায়ণ এই স্থানে বাস করিবার সময় দীর্ঘিকাটী খনন করাইয়াছিলেন।

 খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে ত্রিপুরেশ রাম মাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করিলে বলিভীম নারায়ণ—মৃত ত্রিপুরাধিপতির মহিষী তদীয় সহোদরার পুত্র পঞ্চ বর্ষ বয়স্ক বালক রত্ন মাণিক্যকে সিংহাসনে স্থাপন পূর্ব্বক রাজ্য শাসনভার স্বীয় হস্তে গ্রহণ করেন। এবম্প্রকারে তিনি ত্রিপুররাজ্যের সর্ব্বে-সর্ব্বা হইয়া রাজ্য শাসন পরিচালনায় প্রবৃত্ত হইলে সম্ভবতঃ প্রজাবৰ্গ তদীয় কার্ষ্যে বীতরাগ হইয়া রাজ্যমধ্যে নানারূপ উপদ্রব সৃষ্টি করিয়া থাকিবে। সেই কারণ বশতঃ তিনি তদানীন্তন ত্রিপুররাজধানী উদয়পুর পরিত্যাগ করিয়া এতদঞ্চলে আগমন পূর্ব্বক বাস স্থাপন করিয়াছিলেন।

 পিলাক্‌-পাথর নামক এই জনপদ দুই ভাগে বিভক্ত। পূর্ব্বদিকের অংশ পূর্ব্ব পিলাক্‌ এবং অপরাংশ পশ্চিম পিলাক্‌ নামে জনসাধারণ-কর্ত্তৃক অভিহিত হয়। ঐ দুই স্থান ব্যাপী যে এক সুবিস্তীর্ণ জলাভূমি আছে, তন্মধ্যবর্ত্তী পূর্ব্ব পিলাকের পশ্চিম দেশস্থ “দেবদারু” বা “দেবারু” নামে খ্যাত এক অরণ্যাকীর্ণ বিশাল মৃণ্ময় স্তূপোপরি একটী অষ্টভূজা শক্তি দেবীর প্রতিমূর্ত্তি আজানু ভূমিতে প্রোথিত আছে। ইহার আয়তন জানু হইতে মস্তক পর্য্যন্ত প্রায় দুই হস্ত হইবে।

 উক্ত জলাভূমির অন্তর্ব্বর্ত্তী “ঠাকুরাণী বাড়ী” নামে খ্যাত পশ্চিম পিলাকের এক মুক্তিকাস্তূপের পৃষ্ঠদেশস্থ অরণ্য-মধ্যে, একটী প্রস্তর-নির্ম্মিত চতুর্ভূজ ভগ্ন নৃসিংহমূর্ত্তি উত্তান ভাবে ভূলুণ্ঠিত রহিয়াছে। দৈর্ঘ্যে ইহা প্রায় দুই হস্ত হইবে। এই মূর্ত্তি হইতে অল্প দূরে, একটী ছাদ বিহীন বিধ্বস্ত ইষ্টকমন্দির-মধ্যে, ন্যূনকল্পে নয় হস্ত দীর্ঘ ও দুই হস্তের কিঞ্চিদধিক প্রস্থ একটী প্রকাণ্ড প্রস্তরমূর্ত্তি ভূপতিত রহিয়াছে। লোকে ইহাকে নারায়ণ মূর্ত্তি কহে। কিন্তু অধোমুখে নিপতিত থাকা বশতঃ প্রকৃতপক্ষে উহা কি মূর্ত্তি তাহা নির্ণয় করিতে সক্ষম হওয়া যায় না। বিশিষ্ট কারুকৌশলবিহীন বর্ণিত মূর্ত্তিত্রয় পর্য্যবেক্ষণ করিয়া অনুমিত হয় যে, কোন সুদক্ষ ভাস্কর শিল্পিক-কর্ত্তৃক মূর্ত্তি-নিচয় নির্ম্মিত হয় নাই।

 প্রাগুক্ত “ঠাকুরাণী-বাড়ী” নামক এই জনপদে প্রসিদ্ধ স্তূপের উত্তরদিকে অবস্থিত তদপেক্ষা ক্ষুদ্রাকারের আর একটী মৃত্তিকা-স্তূপোপরি বহু সস্থ্যক বিকীর্ণ ও পুঞ্জীভূত ইষ্টক-রাশি দৃষ্টিপথে পতিত হয়। জনশ্রুতি এই—তৎসমুদয় জনৈক নৃপাল-কর্ত্তৃক নির্ম্মিত নিকেতনাদির ধ্বংসাবশেষ এবং সেই কারণে এই স্থান “পুরাণ রাজবাড়ী” নামে অভিহিত হইয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বলিভীম নারায়ণ এই জনপদে আগমন করিয়া যে সমুদয় ভবনাদি নির্ম্মাণ পূর্ব্বক বাস করিয়াছিলেন উল্লিখিত ইষ্টকরাশি তাহারই বিধ্বস্ত অংশ হওয়া সম্ভব।

 বলিভীম নারায়ণের নামসমন্বিত “বলিনারায়ণ দীঘী” নামে প্রসিদ্ধ যে সরোবরের বিষয় পূর্ব্বে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে একদল বহু প্রস্তর মূর্ত্তি ছিল বলিয়া অবগত হওয়া যায়। প্রবাদ এই—কালক্রমে তৎসমুদয় ভূগর্ভে নিহিত হইয়াছে।

 এই জনপদে অবস্থিত মূর্ত্তি-নিচয়ের স্থাপন কর্ত্তার নাম এবং স্থাপন সময়ের সম্বন্ধে কোন তথ্যই নির্ণয় করা যায় না। ত্রিপুরবাজ্যের পরাক্রান্ত সেনাপতি বলিভীম নারায়ণ-কর্ত্তৃকই মূর্ত্তি সমূহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। যাহা হউক ঐ সমস্ত মূর্ত্তি যে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ-নিবাসী স্থনিপুণ ভাস্কর শিল্পিগণ কর্ত্তৃক নির্ম্মিত নহে, এই প্রদেশ-নিবাসী শিল্প কার্য্য অপটু লোক-কর্ত্তৃক নির্ম্মিত হইয়াছিল—মূর্ত্তি-নিচয় পর্য্যবেক্ষণ করিয়া এবংবিধ অনুভূত হয়।

 ত্রিপুররাজ্যের উপরিভাগ প্রাগুক্ত বিলোনিয়ার অন্তঃপাতী “লুংথুং” এর সান্নিধ্যে প্রবাহিত “মতাই ছড়া” (দেবতা ছড়া) নামক ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী হইতে একটী শক্তিমূর্ত্তি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে বলিয়া লোকে কহে। জন-সাধারণ-কর্ত্তৃক উক্ত মূর্ত্তি “মাতঙ্গিনী” নামে অভিহিত হয় এবং জ্ঞাত হওয়া যায় যে মুর্ত্তিটী “পরুশুরাম” জনপদে প্রতিষ্ঠিত আছে।