ত্রিপুরার স্মৃতি/রাজা ভবচন্দ্রের বিধ্বস্ত নিকেতন
রাজা ভবচন্দ্রের বিধ্বস্ত নিকেতন
কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণদিকে ন্যূনাবিক ১০ মাইল দূরবর্ত্তী চৌদ্দগ্রাম পরগণার অন্তর্গত ঈশানচন্দ্র নগর ও ভজনমুড়া বা ভচনমুড়া নামক যে দুইটী গ্রাম অবস্থিত, তন্মধ্যস্থ সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরের নানা স্থানে স্তুপীকৃত এবং ইতস্ততঃ বিকীর্ণ অসংখ্য ইষ্টকরাশি দৃষ্টপথে পতিত হয়। তৎসম্বন্ধে জনশ্রুতি এই—কোন এক কালে ভবচন্দ্র নামক জনৈক বাতিকগ্রস্ত রাজা এই স্থানে রাজধানী স্থাপনপূর্ব্বক এতদঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছিলেন। সেই সময় তাঁহার দ্বারা যে সমুদয় অট্টালিকাদি নির্ম্মিত হইয়াছিল, উল্লিখিত ইষ্টকরাশি তাহারই বিধ্বস্ত অংশ। স্থানীয় লোকমুখে অবগত হওয়া যায় যে, পূর্ব্বে এই স্থানে কতিপয় বৃহৎ স্তম্ভ ও প্রাচীরাদির ভগ্নাবশেষ বর্ত্তমান ছিল; তাহ মুসলমানেরা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করিয়া তদুপরি বাসস্থান নির্ম্মাণ করিয়াছে।
কেবল যে বাসস্থান নির্ম্মাণার্থে কিংবা ইষ্টক গ্রহণ উদ্দেশ্যে প্রাচীন নিকেতনাদি এই প্রকারে বিধ্বস্ত হয় তাহা নহে; গুপ্তধন উদ্ধারের প্রলোভনেও প্রাচীন স্থাননিচয় অনেকেই খনন করিয়া থাকে, এবং স্থান বিশেষে কোন কোন ব্যক্তি ভূগর্ভে প্রোথিত মুদ্রাদি যে প্রাপ্ত না হইয়াছে এরূপ নহে।
কথিত আছে—রাজা ভবচন্দ্র যেরূপ অদ্ভুত প্রকৃতির ছিলেন, রাজমন্ত্রী এবং তদীয় পার্শ্বচরগণও তদুনুররূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল। এই কারণ বশতঃ এতদঞ্চলে কেহ কোনরূপ নির্ব্বুদ্ধির কার্য্য করিলে সচরাচর লোকে তাহাকে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী বলিয়া বিদ্রূপ করিয়া থাকে।
কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী সুদীর্ঘ রাজবর্ত্মের উভয় পার্শ্বে যে দুইটী মৃক্তিকাবৃত প্রকাণ্ড ইষ্টকস্তূপ অবস্থিত, তন্মধ্যে উক্ত রাজবর্ত্মের পশ্চিমদিকস্থ স্তূপটী ও তন্নিম্নবর্তী ভূমি-ই ভজনমুড়া বা ভচনমুড়া নামে খ্যাত। সম্ভবতঃ ভবচন্দ্রমুড়াই তাহার প্রকৃত আখ্যা ছিল, অপভ্রষ্ট হইয়া ইদানীং ভচন বা ভজনমুড়া নামে পরিণত হইয়া থাকিবে।
রাজা ভবচন্দ্র উল্লিখিত স্তৃপদ্বয়ের একটীতে অবস্থিত নিকেতনে উপবেশনপূর্ব্বক অপর স্তূপোপরি নির্মিত ভবনে হুকা স্থাপন করিয়া ধূমপান কবিতেনএইরূপ কৌতুকোদ্দীপক প্রবাদ জনসমাজে প্রচলিত আছে। এতদ্ব্যতীত তাহার অদ্ভূত প্রকৃতির সম্বন্ধে আরও নানাবিধ হাস্যজনক কাহিনী শ্রুতিগোচর হয়।
জনশ্রুতি এই—এলাহাবাদ জিলার অন্তর্গত সুপ্রাচীন জনপদ ঝুসীতে “হরবং” নামক জনৈক বাতিকগ্রস্ত রাজা একদা রাজত্ব করিতেন। সেই সময় তদীয় আদেশানুসারে রাজ্য-মধ্যে সমস্ত দ্রব্য এক পরিমাণে ও একমূল্যে বিক্রয় হইত বলিয়া যে প্রবাদ প্রসিদ্ধ, রাজা ভবচন্দ্রের সম্বন্ধে প্রচলিত প্রবাদ-নিচয়ের দুই একটীতে-ও ঠিক সেইরূপ কথা উল্লেখ আছে।
কি কারণে সুদূরস্থ দুইটী প্রদেশের দুই ব্যক্তির সম্বন্ধে এবংবিধ প্রবাদেব সমতা পরিলক্ষিত হয়, তাহার কারণ উপলব্ধ হয না—বরঞ্চ প্রহেলিকাব ন্যায়ই অনুভূত হয়। রাজা ভবচন্দ্রেব সম্বন্ধে যে সকল প্রবাদ প্রচলিত আছে, তৎসমুদয়-ই কি কল্পনা-প্রসূত, অথবা তাহাতে কোনরূপ সত্যের অংশ আছে ইহা নির্ণয় করা দুষ্কর।
‘ভচনমুড়া’ বা ‘ভজনমুড়া’ “নামক ইষ্টক-স্তূপ—এবং আর যে একটি স্তূপের বিষয় পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা যে প্রাচীনকালে নির্ম্মিত কোন বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ নহে, ইহা কে বলিতে পারে? অত্রস্থ বিকীর্ণ ইষ্টক-রাশি—অধুনা যাহা রাজা ভবচন্দ্রের নিকেতনাদির বিধ্বস্ত অংশ বলিয়া জনসাধাবণ কর্ত্তৃক কথিত হয়, তৎসমুদয় কোন বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী নৃপাল কর্ত্তৃক নির্ম্মিত বৌদ্ধ-বিহার ও নিকেতনাদির বিধ্বস্ত অংশ হওয়া অসম্ভব নহে।
এই প্রবন্ধ এবং ইহার পূর্ব্ববর্তী প্রবন্ধ-নিচয় পর্য্যালোচনা করিলে ইহা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, কুমিল্লার দক্ষিণ ও পশ্চিমপ্রান্তবর্তী অঞ্চলসমূহ পূর্ব্বকালে নানা বংশ-সম্ভূত নৃপালগণের শাসনাধীনে ছিল। সম্ভবতঃ তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী এবং কেহ বা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন,—কালপ্রবাহে তাঁহাদিগের প্রকৃত ইতিবৃত্ত ঘোর তিমিরে নিহিত হইয়া অধুনা কেবল জনশ্রুতিতে পরিণত হইয়াছে।
ন্যূনাতিরেক পঞ্চাশৎবর্ষ অতীত হইল বীরমণি হাজারী নামক জনৈক ত্রিপুররাজ কর্ম্মচারী চৌদ্দগ্রাম পরগণার পূর্ব্বদিকস্থ খণ্ডল পরগণায় একটী পুষ্করিণী খনন করাইবার কালে মৃত্তিকার গর্ভ হইতে একখানি প্রস্তর-নির্ম্মিত শিব-শক্তির প্রতিমূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল। তৎকর্ত্তৃক উক্ত মূর্ত্তি সেই স্থান হইতে নীত হইয়া ত্রিপুররাজ্যের নব রাজধানী “নূতন হাবেলী” ব। “নূতন আগরতলা” নামে খ্যাত নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। স্থানীয় সর্ব্বসাধারণে বর্ণিত মূর্ত্তিকে “উমামহেশ্বর” নামে অভিহিত করে। ইহার পদনিম্নে যে লিপি উৎকীর্ণ আছে, তাহা পাঠ করিবার জন্য অনেকেই প্রয়াস প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া অবগত হওয়া যায়। কিন্তু “উমামহেশ্বর” ও অপর কয়েকটী শব্দ ব্যতিরেকে আর কিছুই পাঠ করিতে সক্ষম হয় নাই।
অধুনা ইণ্ডিয়েন মিউজিয়মের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক পণ্ডিত বিনোদবিহারী বিদ্যাবিনোদ উল্লিখিত মূর্ত্তির পদ-নিম্নস্থ উৎকীর্ণ লিপির যে পাঠ উদ্ধার করিয়াছেন, এবং তৎকর্ত্তৃক তাহার যে অর্থ ব্যাখ্যাত হইয়াছে তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইল।
শিলালিপি—
ওঁ শ্রীতড়ঙ্গচন্দ্র দেব পাদীয় সম্বৎ ১৮
মাঘদিনে ১৯ ভূভৃতা
কারিত উমামহেশ্বব ভট্টারকঃ
খচিতঞ্চ কেন্নোকেনেতি॥”
ব্যাখ্যা—
“শ্রীতড়ঙ্গচন্দ্র দেব পাদের অষ্টাদশ বর্ষ রাজ্যকালে মাঘ মাসের ১৯ তারিখে রাজা স্বয়ং এই উমামহেশ্বর ভট্টারকের মূর্ত্তি করাইলেন, কেন্নোক নামে শিল্পী ইহা নির্মাণ করিল।
খচিতঞ্চ স্থানে খচিতশ্চ পাঠই বিশুদ্ধ খচিত অর্থে fixed, blended প্রস্তর কাটিয়া উমামহেশ্বর মূর্ত্তি এক যোগে করিয়া দেওয়ার নাম খচিত। ভট্টারকঃ পুংলিঙ্গ, সুতরাং খচিতং ক্লীবলিঙ্গ না হইয়া খচিতঃ পুংলিঙ্গ হওয়াই উচিত। শ্রীতরঙ্গ চন্দ্রদেব রাজার নাম শিলায় শ্রীতরঙ্গ চন্দ্রদেব স্থানীয় উচ্চারণ ভেদে “র” স্থানে “ড়” হইয়া গিয়াছে। এরাজার পরিচয় জ্ঞান নাই। তবে ইনি যে পাল রাজগণের সমসাময়িক তাহা এই লিপিগুলির আকার প্রকারে অনুমান করা যাইতে পারে।”
ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী নানা জনপদ হইতে পুরাকালের নির্ম্মিত দেব-দেবীর প্রতিমূর্ত্তি সময় সময় উদ্ধৃত হওয়াতে অনুমিত হয় যে, একদা এতৎ প্রদেশের নানা স্থানে বিবিধ বংশোদ্ভব নৃপালগণ নানা সময়ে রাজত্ব করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদিগের দ্বারা বহু দেব মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কোন ঘটনা চক্রে মূর্ত্তি নিচয় জলাশয় প্রভৃতি নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকিবে।
অত্রস্থ প্রাচীন জনপদ সমূহের ভূগর্ভে প্রস্তর মূর্ত্তি প্রভৃতি আরও পুরাতন কীর্ত্তি-চিহ্ন নিহিত থাকা কিছুই অসম্ভব নহে। অধুনা এতদঞ্চলে যে সমস্ত সামান্য পল্লীগ্রাম অবস্থিত, কোন এক কালে তৎসমুদয় যে বহু জনে পরিপূর্ণ সমৃদ্ধিশালী নগরী না ছিল ইহাই বা বিচিত্র কি? যদি প্রকৃতপক্ষে তদ্রূপই হইয়া থাকে, তাহা হইলে কি প্রকারে ঐ সমস্ত স্থান ইদানীং এবংবিধ শোচনীয় দশাগ্রস্ত হইয়াছে, এই বিষয়েব যথাযথ ইতিবৃত্ত কখনও উদ্ঘাটিত হইবে কিনা একথা বলা দুষ্কর।