ত্রিপুরার স্মৃতি/সতররত্ন বা সপ্তদশ-রত্ন

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 351 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।



সতররত্ন বা সপ্তদশ-রত্ন

 কুমিল্লা নগরীর পূর্বপ্রান্তবর্ত্তী জগন্নাথপুর গ্রামমধ্যে “সতররত্ন” নামক সুপ্রসিদ্ধ যে ভগ্নমন্দির অবস্থিত, এতৎপ্রদেশস্থ প্রাচীন কীর্ত্তিমালার মধ্যে তাহার তুল্য স্বদ্বগু স্থপতিকার্য্যের আদর্শ একটও নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। এতদঞ্চলে উক্ত মন্দির একটী অদ্বিতীয় কীর্ত্তি-চিহ্ন বলিয়। সর্ব্বসাধারণ-কর্তৃক বিবেচিত হয়।

 কথিত আছে খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর (১০৯২ ত্রিপুরাব্দ) শেষ ভাগের ত্রিপুরাধিপতি দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য উল্লিখিত মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহার কিয়দ্দিবস পরই তিনি পরলোকে গমন করাতে তদীয় আরব্ধ মন্দিরটীর নির্ম্মাণ কার্য্য স্থগিত হয়, এবং তৎপরবর্তী কতিপয় ত্রিপুরেশের রাজত্ব কাল পর্য্যন্ত ইহার কার্য্যে আর হস্তার্পণ হয় নাই। এই বিষয় কেবল “ত্রিপুর বংশাবলী” নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে; কৃষ্ণমালা প্রভৃতি অপরাপর ত্রিপুররাজবংশ চরিত গ্রন্থে দৃষ্ট হয় না।

 খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর (১১৭০ ত্রিপুরাব্দ) খ্যাতনামা ধর্ম্মনিষ্ঠ ত্রিপুরাধিপতি কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসন অধিরোহণ করিয়া মন্দিরটীর পুন নির্ম্মাণ আরম্ভ করেন, এবং ইহার প্রস্তুত কার্য্য সমাপনান্তে ১১৮৮ ত্রিপুরাব্দে তন্মধ্যে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্ত্তি স্থাপন পূর্ব্বক উক্ত মন্দির সসমারোহে প্রতিষ্ঠা করেন।

 সচরাচর যে রূপ জগন্নাথ মূর্ত্তি পরিলক্ষিত হয় উক্ত-মূর্ত্তিত্রয় তদ্রূপ নহে। মূর্ত্তি-নিচয়ের কর—অঙ্গুলী বিশিষ্ট। এই কারণে ভ্রমবশতঃ উক্ত ত্রিমূর্ত্তিকে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া পূজারিগণ-কর্ত্তৃক কথিত হয়।

 ত্রিপুরেশ কৃষ্ণ মাণিক্যের জীবন চরিত “কৃষ্ণমালা” নামক বঙ্গভাষায় লিখিত গ্রন্থ হইতে অবগত হওয়া যায়—উল্লিখিত ব্যাপার উপলক্ষে নানা দিগ্‌দেশ হইতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত প্রভৃতি বহুলোক আহূত হইয়াছিল। এবং তৎকালে তুলাপুরুষ, পঞ্চাগ্নি, দানসাগর প্রভৃতি বহুবিধ-পুণ্যকার্য্যও ত্রিপুরেশ কৃষ্ণ মাণিক্য-কর্ত্তৃক সংসাধিত হইয়াছিল। এই বিষয় কৃষ্ণমালায় এবংবিধ বর্ণিত আছে।—

সপ্তদশ শত সংখ্য শকের সময়।
চৈত্র মাসে প্রতিষ্ঠা করিল দেবালয়॥

তখনে করিল তুলা পুরুষের দান।
কিঞ্চিৎ করিয়া কহি কর অবধান॥

* * * *
চারিকুণ্ডে সূক্ত পাঠ যাপকে করিল।

সমাপ্ত করিয়া যজ্ঞ পূর্ণাহুতি দিল॥

* * * *
মন্ত্র পঠি তুলাবৃক্ষ করিয়া রোপণ।

বাগী সমে করিল তুলাতে আরোহণ॥

* * * *
ষোড়শ ষোড়শ দান করি ক্রমে ক্রমে।

উৎসর্গ করিল দান-সাগর প্রথমে॥”

 প্রাগুক্ত দেবমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব্বেই উহার নিত্য নৈমত্তিক পূজা অৰ্চ্চনার ব্যয় নির্ব্বাহার্থে ত্রিপুরেশ কৃষ্ণ মাণিক্য-কর্ত্তৃক ১১৮৬ ত্রিপুরাব্দে কিঞ্চিদধিক পঞ্চদশ দ্রোণ ভূমি দেবোত্তর প্রদত্ত হইয়াছিল। ইহাতে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, এই পুণ্য কার্য্য সম্পাদনের জন্য পূর্ব্বেই তিনি কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন।

 যে তাম্রশাসনের দ্বারা দেবোত্তর প্রদত্ত হইয়াছিল তাহার প্রতিলিপি:—

শ্রীশ্রীযুত জগর্নাথ

মহারাজ
কৃষ্ণ মাণিক্যের
পদ্ম মোহর।

 স্বস্তি

 তোউ আড়োত্তরে (?) যাচ পূর্ব্বে কৃঞ্চপুরস্যচঞ্চাকলি গ্রাম (?) দক্ষে ভূশ্চারণ্যপুর পশ্চিমে মেহার কুলাখ্য দেশেতাং সপাদো পরি কিনকাং দ্রোশী পঞ্চদশমিতাং ভূমিং যৎসহ কিনকী ৺জগন্নাথায় দেবায় সেবায়ে হৃষ্ট মানসঃ।

 ভূপঃ শ্রীকৃষ্ণ মাণিক্য দেবোহদাদ্ধরি তুষ্টয়ে বস্বঙ্ক তর্কেন্দু মিতে শকাব্দে বিছাং গজস্যাপি রবেনবাংশে॥

পরদত্তাং ক্ষিতিং যস্তু রক্ষতি ক্ষ্মাপতিঃ প্রভূঃ।
সকোটী গুণমাপ্নোতি পুণ্যং দাতৃজনাদপি॥
যো হরেচ্চ মহীং তাবদ্দেবস্য ব্রাহ্মণস্য বা।
নতস্য দুস্কৃতি র্যাতি বর্ষকোটি শতৈরপি॥

  ইতি ১১৮৬—তারিখ ১ অগ্রহায়ণ॥
‌‌

  বর্ণিত মন্দিরের সম্বন্ধে, ত্রিপুরেশ কৃষ্ণ মাণিক্যের জীবন চরিত “কৃষ্ণমালা” নামক গ্রন্থে যে রূপ বিবৃত আছে, তৎপাঠে অবগত হওয়া যায় যে অধুনা “জগন্নাথ পুর” নামক গ্রামমধ্যস্থ সরোবরটী কৃষ্ণ মাণিক্যে খনন করাইয়া তন্মধ্যে ইষ্টকদ্বারা একটী কূপ নির্ম্মাণ পূর্ব্বক উহা পঞ্চতীর্থের সলিলে পূর্ণ করতঃ দীর্ঘিকাটী উৎসর্গ করেন। তদনন্তর তাহার পূর্ব্ব তীরে সপ্তদশ চূড়াবিশিষ্ট “সপ্তদশরত্ন” নামে প্রসিদ্ধ মন্দির সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যস্থ প্রধান চুড়া উচ্চে শত হস্ত, এবং চূড় নিচয়ের শিরোদেশ এক মন সুবর্ণে মণ্ডিত তাম্রকুম্ভ দ্বারা ভূষিত হইয়াছিল। দুই পাশ্বে দুইটী সিংহমূর্ত্তি শোভিত যে তোরণদ্বার মন্দিরের উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল বলিয়া উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ইদানীং তাহার যৎসামান্য ধ্বংসাবশেষ মাত্র দৃষ্টি পথে পতিত হয়।

 মন্দিরে কোন রূপ শিলালিপি পরিলক্ষিত হয়না; এবং এই বিষয়ে কোন কথা বলিতে কেহই সক্ষম নহে। মন্দির গাত্রে শিলালিপি সংযোজিত না হইয়া তোরণ দ্বারেও শিলালিপি সংলগ্ন থাকা সম্ভব। তোরণটী বিধ্বস্ত হইলে শিলালিপি কোন ব্যক্তির দ্বারা অপসারিত হওয়া বিচিত্র নহে।

 বর্ণিত মন্দির নির্ম্মিত হওয়ার পর ইহার কোন রূপ জীর্ণ সংস্কার হইয়াছিল কিনা জ্ঞাত হওয়া যায় না। কিন্তু অধুনা ইহা রক্ষিত না হওয়াতে এবং খৃষ্টীয় উনবিংশ ও বিংশশতাব্দীর প্রবল ভূমিকম্পে ইহার কতিপয় চূড়া ও নানা অংশ বিধ্বস্ত হইয়াছে।

 ত্রিপুররাজবংশের অদ্বিতীয় গৌরব চিহ্ন “সতররত্ন” নামক এই সুপ্রসিদ্ধ মন্দিরট এবংবিধ ধ্বংসকবলে পতিত হইতে দেখিয়া অতিশয় দুঃখ বোধ হয়। ইহার সম্পূর্ণ রূপ জীর্ণ সংস্কার না করিয়া অধুনা যে অবস্থায় রহিয়াছে, সেই ভাবেও রক্ষিত না হইলে, এতৎ প্রদেশস্থ একটী সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন কীর্ত্তিচিহ্ন সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হইয়া চিরকাল তরে বিলুপ্ত হইবে।

 মন্দিরটীর চূড়াগাত্রে প্রোথিত কতিপয় শ্রেণীবদ্ধ লৌহকীলক দৃষ্টি গোচর হয়। তৎসম্বন্ধে এইরূপ কথিত আছে—একদা রজনী যোগে জনৈক তস্কর উক্ত লৌহকীলক নিচয় মন্দির গাত্রে প্রোথিত করিয়া তাহার সাহায্যে মন্দির চূড়াতে আরোহণ পূর্ব্বক তত্রস্থ সুবর্ণপত্র মণ্ডিত কুম্ভ অপহরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু ঐ ব্যক্তি অকস্মাৎ কোনরূপ ভয় প্রাপ্ত হওয়াতে কীলক হইতে তাহার পদস্খলন হয়, এবং ভূমিতে পতিত হইয়া সেই স্থানেই তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। ঐ তস্কবের ভূলুষ্ঠিত দেহ এবংবিধ ছিন্ন ভিন্ন হইয়াছিল যে, কেহই তাহাকে চিনিতে সক্ষম হয় নাই। আবাব কেহ কেহ এইরূপও কহে—যে ব্যক্তি উক্ত মন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি চূড়াতে সংস্থাপিত কুম্ভ অপহবণ করিবার উদ্দেশ্যে মন্দির নির্ম্মাণ কালে তদ্গাত্রে লৌহকীলক নিচয় প্রোথিত করিয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে উক্ত সুউচ্চ মন্দিব চূড়াতে কুম্ভ স্থাপন সুবিধার জন্যই লৌহকীলক নিচয প্রোথিত হইয়াছিল কিনা ইহাই বা কে বলিতে পারে।

 “সতররত্ন” নামে খ্যাত উক্ত ভগ্ন মন্দিবের দক্ষিণদিকে অবস্থিত যে একটী মন্দিরমধ্যে অধুনা জগন্নাথ প্রভৃতি দেবমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে, তাহা স্বনামধন্য চন্দ্রবংশাবতংস ত্রিপুরেশ বীরচন্দ্র মাণিক্যের জননী পতিপরায়ণা সুলক্ষণা দেবী কর্ত্তৃক নির্ম্মিত। এই বিষয়ে এবংবিধ প্রবাদ শ্রুতিগোচর হয়:—

 প্রাগুক্ত ঘটনা অনুসারে সতররত্ন মন্দির-মূলে জনৈক তস্করের অপঘাত হওয়া বশতঃ মন্দিরটী কলুষিত হওয়াতে, দেবমূর্ত্তি তথা হইতে স্থানান্তর কবিবাব জন্য ত্রিপুরাধিপতি কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের মহিষী সুলক্ষণা দেবী জগন্নাথ-কর্ত্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হন। তদনুসারে তিনি বর্ত্তমান মন্দির নির্মাণ পূর্ব্বক সতররত্ন হইতে জগন্নাথ প্রভৃতি দেবমূর্ত্তি-নিচয় আনয়ন করিয়া সসমারোহে নবনির্ম্মিত মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। উক্ত মন্দির-গাত্রে সংলগ্ন শিলালিপির প্রতিলিপি:

“যঃ শ্রীকৃষ্ণকিশোরভূপতিলকো মাণিক্যবিখ্যাতকঃ,
সঞ্চাতোহবনিমণ্ডলে শশিকুলে রাজাধিরাজো মহান্‌।
পত্নী তস্য সুলক্ষণা সুবিদিতা সাধ্বী গুণৈকালয়া।
প্রাসাদঃ পরিনির্ম্মিতঃ খলু তয়া শ্রীকৃষ্ণসন্তুষ্টয়ে॥
শাকে বৈরিমৃগাঙ্কমৌলিজলধিক্ষৌণী প্রমাণে পতে
ঘস্রে ভৌমিসুতে রবে মিথুনগে পুষ্পেষুরিপ্বংশকে।

সংসারাম্বুধিপারকারণজগন্নাথস্য বাসায় বৈ
শ্রীমত্যা চ সুভদ্রয়া সহ মুদ্রা সঙ্কর্ষণেন শ্রিয়া॥
শকাব্দা ১৭৬৬ বাঙ্গালা ১২৫১ ত্রিপুরা ১২৫৪ সন মাহে ৬ আষাঢ়, মঙ্গলবার।”

 যাহাহউক—কোন বিশেষ কারণ বশতঃই সতররত্নস্থ দেবমূর্ত্তি নিচয় স্থানান্তরিত হইয়াছিল বলিয়া অনুমিত হয়।

 জগন্নাথ প্রভৃতি পূর্ব্ব বর্ণিত ত্রিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অবধি এ যাবৎ এই জনপদে যে সাংবৎসরিক রথ যাত্রা হয়, উহা সমগ্র পূর্ব্ববঙ্গে একটী সুপ্রসিদ্ধ ব্যাপার বলিয়া পরিগণিত। তাহা দর্শন করিয়া পাপক্ষয় উদ্দেশ্যে তৎকালে নানা দেশ হইতে কুমিল্লা নগরীতে বহু লোকসমাগম হইয় থাকে।