দানবদলন কাব্য/তৃতীয় সর্গ
তৃতীয় সর্গ।
সাজিল ধূম্রলোচন বীর দর্প ভরে,
সাজিল তাহার সাথে অসংখ্য অনীক।
গুড় গুড় নাদে ঘোর বাজিল দুন্দুভি;
বাজিল ভৈরবে ভেরী, কাঁপিল পবন,
কাঁপিল ত্রিদশ বুক থর থর থরে।
উঠিল আকাশ যেন আরো ঊর্দ্ধ দেশে,
সভয়ে; পাতাল যেন তলিল অতলে।
অধীরা হইয়া ধরা ঘুরিতে লাগিল।
চলিল বিকট ঠাট; চলিল সুগ্রীব,
যমধ্বজবহ, আগে পথ দেখাইয়া।
কতক্ষণে উত্তরিল হিমগিরি আগে
ভীষণ ধূম্রলোচন;—গিরি আগে গিরি
যেন! সচঞ্চল চোখে চাহে বারবর
চারিদিকে দেখিবারে সে রূপ মাধুরী,
শুম্ভ মন সরসীর সুখের হিল্লোল।
শেখরে শেখরে ফেরে, কন্দরে কন্দরে!
নিকুঞ্জেতে উকি দেয়, বৃক্ষোপরি চাহে—
কোথায় বা কি!—কিছু না দেখিতে পায়;—
অন্তর্হিত মহামায়া পাতি মায়া জাল!
অহঙ্কার ভরে তবে কহে সুগ্রীবেরে;—
"কোথা হে সুগ্রীব, কোথা সে মানিনী? দেখ
মোর প্রতাপের ঝড়ে, ভাঙ্গিয়া থাকিবে
বুঝি দর্প চুড়া তার; লুকায়ে থাকিবে
ভয়ে বুঝি কোথা বামা।—কে বা না ডরায়
মোরে, দৈত্য সেনাপতি আমি; হুহুঙ্কারে
উথলি জলধি; ঘুরে বাসবের মুণ্ড,
ঘুরাই যদ্যপি আমি এ ধূম্র লোচন।
কানেতে লাগাই তালা দিকগজগণ,
যদি টঙ্কারি এ ধনু। করিবারে পারি
পদাঘাতে ছাতুনাতু এই ভূমণ্ডলে।
দন্তের রগড়ে মোর কড় কড় রবে
ঝলকে বেরোয় অগ্নি তড়িতের প্রায়!
করবার খুলি নাক কভু কোষ হতে;
পাছে যম ডরি যারে না আসে সমরে।
কেবা তিষ্ঠে মোর আগে যদি রোষি আমি,
হিমাদ্রিরে সম্বোধিয়া কহে তবে বীর;—
কি হে গিরি! কি ভাবিছ বিরস বদনে?
লেগেছে কি ভয় তব আমায় দেখিয়া?
নির্ঝর রূপেতে অশ্রু ঝরিছে যে দেখি।
ঘাড় তুলে কি দেখিছ?—পলাবার স্থান?
কোথায় পলাবে বল?—কে দিবে আশ্রয়?
হেন সাধ্য কার তোমা রক্ষিবারে পারে
মোর হাত হতে? তুমি দেখাও সত্বরে
কোথা সে কামিনী; তারে করহ বাহির
এখনি অবশ্য তুমি জান তার খোজ।
তুমিই ত প্রহরী আছ এই প্রদেশের।
দেখেছ, ধরেছি ধনু ভীম ভুজবরে,
যুজেছি সুতীক্ষ্ণ বাণ—তোমারি লাগিয়া?
এখনি, কাটিব শৃঙ্গ খণ্ড খণ্ড করি,
গুড়া করি দিব দেহ লৌহ দণ্ডাঘাতে,
পবন বাণেতে ধুলি উড়াব সাগরে।”
এত বলি বীরমদে মুগ্ধ বীরবর
আকর্ণ শুষিলা বাণ হিমাদ্রি উদ্দেশে,
অমনি উজ্জ্বল তেজে দেখা দিলা সতী;—
হিমাচল কুট যেন মুচুকি হাসিল!
রিস্মিত অন্তরে ধূম্র কহে সুগ্রীবেরে;—
"এই বুঝি, এই নাকি, হাঁহে ও সুগ্রীব!
এই কি মে ধনী? বটে বটে, রূপ বটে,
রূপ যার নাম!—আলো করিয়াছে দিক?
কোথায় লুকায়ে ছিল? কোথা হতে এল?
পাঁতি পাঁতি করিয়া যে খুজিলাম গিরি।”
ধীরে ধীরে আসি বীর তবে গৌরী পাশে,
মধুর সম্ভাষ ভাষে ভাষিতে লাগিলা;
"হাঁগো বাছা শশিমুখি, ভীরুশান্ত শীলে।
মুখ খানি হেট করি রয়েছ কি হেতু?
ভয় কি হয়েছে মনে আমায় দেখিয়া?—
ভয় কি গো? আমি কিছু না বলিব তোমা
ভয়ার্ত্ত জনেরে আমি রক্ষা করে থাকি।
কি ভয় তোমার? আমি দৈত্য সেনাপতি,
সে ধূম্রলোচন; করে করবার মোর;
কে পারে ছুঁইতে তোমা আমি বিদ্যমানে
কেন বা লুকায়ে ছিলে হিম গিরি মাঝে?
একি লুকাবার রূপ?—দেখুক জগৎ।
হিম গিরি সাধ্য কি সে রাখে লুকাইয়ে,
তোমায়, আদেশি যদি আমি তারে রোষে
এস মোর সাথে বাছা, আমি লয়ে তোমা
রাখিগে সাহসাগার দৈত্যপতি হৃদে,
ভয়ের কি সাধ্য, তোমা পরশে সেখানে।”
নীরবিলা বীরবর, এতেক কহিয়া।
তুলি স্মেরানন তবে চাহিলা শঙ্করী
ধূম্রলোচনের পানে; উজল হইল
সে ধূম্রবরণ, মুখচন্দ্র রূপকরে;
উজল বাস্পের রাশি যেন অগ্নি যোগে।
কহিলা মধুর রবে শৈলেশ নন্দিনী;—
"হাঁগো দৈত্য সেনাপতি! এতই কি ভয়
মোর তোমায় দেখিয়া? মুখ তুলে তোমা
দেখিতে না পারি ভয়ে? কি ভয় আমার?
ভয়ের আবাস আমি, কিন্তু নাহি ডরি
এতিন ভূবনে কারে। কেনবা লুকাব বল?
লুকাবার স্থান মোর নাহিক কোথায়;
সর্ব্বত্রেই বিদ্যমান আমারে দেখিবে।
তোমার কথায় কেন ভেটিব শুম্ভেরে;
কি দায়ে পড়েছি বল?—দেখিবে এখনি
ভেটিবে আমার বাণ পরাণে তাহার।
কি হেতু এসেছ তুমি? যুঝিবারে যদি;
দেহ যুদ্ধ ত্বরা মোরে, বিলম্বে কি কাজ?”
বিস্ময় প্রস্ফুট চক্ষে আপাদ মস্তক
হেরিলা ধূম্রলোচন পুনঃ গিরিজার।
ভাবিলা অন্তরে;—একি, একি বলে বামা;
কথার ছাঁদুনী কিছু বুঝিতে না পারি।
আমারে বধিতে চাহে, এতই সাহস!
কহিলা গৌরীরে গর্ব্বে;—"দুর্ব্বুদ্ধি তোমার;
আমার মনেতে তুমি চাহ যুঝিবারে,
অঙ্গুলীর বল তব নাহি সর্ব্বাঙ্গেতে!
কেমনে জানিবে তুমি আমার শকতি?
বীর নৈলে বীরবীর্য্য কে বুঝিতে পারে।
ত্রিদিবে ত্রিদিবপতি জানে মোর বল;
ধরায় ধরণী জানে, আর কে জানিবে,
যে সহে পদের ভর নিয়ত আমার।
ভাবিয়াছ যুদ্ধ বুঝি বিপিন বিহার:
নহিলে এমন সাধ হবে কেন তব,
সমরে জিনিবে যেই বরিবে তাহারে।
এখনও বলিছি ভাল, ছাড় হেন পণ;
করাইও নাক মোরে রক্তপাত আর,
মিটিয়াছে সাধ মোর করি অই কাজ,
আজন্ম, চরমে যেন স্ত্রীঘাতী না হই।
এস মোর সাথে, আমি লয়ে ঘাই তোমা
সসন্ত্রমে, জগজ্জিত দৈত্যপতি পাশে।
সোণায় সোহাগা তব হইবে দেখিবে;
যেমন সুরূপ, বর মিলিবে তেমতি।”
"রক্তপাত করি যদি মিটিয়াছে সাধ,
(কহিলা শঙ্করী) তবে কেন এলে পুনঃ,
রণ সাজে সাজি?—নিজ রক্তপাতে বুঝি
করিবারে প্রায়শ্চিত্ত সে পাপ রাশির?
ভাসিবে যে ক্ষণপরে মোর বাণাঘাতে
শোণিত নদীতে বীর শাল কাষ্ঠসম;
দেখিবে তখনি, তব অঙ্গুলীর বল
আছে কি না আছে মোর লেমঅগ্রভাগে।
মরিবার ইচ্ছা যদি হয়ে থাকে তব,
ধর অস্ত্র শীঘ্র করি, বিলম্বে কি কাজ;
তব প্রাণে আগে অর্ঘ দিই যমরাজে,
দৈত্যকুল বিনাশের সঙ্কল্প করিয়া।”
"কি বলিলে, এত সাধ্য, আমারে বধিবে?
(কহিলা ধূম্রলোচন ঘুরাইয়া আঁখি)
কার সাধ্য বধে আমা এ তিন ভুবনে?
তুমি কি বধিবে মোরে, অবল রমণী?
রমণীর হাতে প্রাণ যাবে অবশেষে,
ত্রিলোক বিজয় করি ইন্দ্রে পরাভবি?
ধর অস্ত্র, আর তোমা করিব না দয়া,
আর না করিব ভয় স্ত্রীহত্যা পাপের।
বজ্রবাণে দর্প চূড়া করি তব গুড়া।”
এতেক কহিতে বীর আলোড়িত তনু,
তবে মহা ক্রোধে; অস্ত্র লেখা ঝন ঝনে,
অঙ্গের চালনে, অঙ্গে বাজিতে লাগিল।
আস্ফালিলা আসি বীর, টঙ্কারিলা ধনু,
হুহুঙ্কারে দিক দশ আকুল করিলা;
স্তম্ভিত হইল ভয়ে জগত সংসার!
সদর্পে ধরিলা ধনু তবে হৈমবতী,
করিলা হুঙ্কার ধ্বনি; ছাড়িল অমনি,
পবন তাহার পথ, কাঁপিল সংসার!
শর জালে আচ্ছাদিয়া নিমেষে আকাশ,
মৃদু মৃদু হাসি তবে কহিলা;—"কোথাহে,
হে ধূম্রলোচন! রক্ষ, রক্ষ বীরবর,
মোর হাত হতে এবে নিজ সেনাকুলে,
ত্রিদিব বিজয়ী তুমি জগতের ত্রাস।
এস, এস অগ্রসরি, দেখসিয়ে আসি,
আছে কিনা আছে বল অবলার ভুজে।
কি আর ভাবিছ এবে?—ভাব পরকাল।”
বিস্মিত নয়নে চাহে তবে বীরবর
রুদ্রাণীর পানে;—দেখে, অঙ্গ ভারে আর
কাতরা নহেক বামা; যৌবনের তেজ,
বীর তেজ সহ যেন দ্বন্দ্বিতেছে মরি,
কমনীয় কলেবরে; শৈবালের দলে,
দ্বন্দ্বে যেন মদকল বারণ যুগল।
সভয় অন্তরে বীর কহে তবে মনে;—
"একি দেখি ভাব, এত বীর্য্য অবলার!
ক্ষণ মাত্রে আচ্ছাদিল শর জালে দিক;
অস্থির করিল বাহ দুঃসহ প্রভাবে!
যাই হউক রক্ষি এবে নিজ দল বল।”
আরম্ভিলা ঘোর যুদ্ধ তবে বীর বর।
এবে যথা চতুর্দ্দিক আঁধারি বিঘোর
কুজ্ঝটিকা কুল, রাশি রাশি আসি ঘেরে
ঊষারে, অরুণ কান্তি, হেমাঙ্গী গৌরীরে
ঘেরিল দনুজ সৈন্য, অসংখ্য অপার।
ঘোর দর্পে অভিভূত করিল ক্ষণেক
তাঁরে; পরে তার উগ্রচণ্ডা তেজে, ক্রমে
অবসন্ন পড়ি ভূমে, কর্দ্দমিত উহা
করিল শোণিত পাতে। আকুল নয়ন,
সভয় অন্তরে তবে ভাবে মনে মনে,
সে ধূম্রলোচন, হেরি উমার প্রভাব;—
সামান্য রমণী বুঝি না হবে এ ধনী;
দানব দুর্ভাগ্য বুঝি মূর্ত্তিমতী হবে
কামিনীর রূপে। হেন বীর তেজ আমি
দেখি নাই কভু কার; দেব দৈত্য মাঝে।
যাই হউক প্রাণ পণে যুঝি ওর সনে,
পলাইয়া দৈত্যকুলে কালি নাহি দিব;
মরিলে সমরে যশ, তথাপি থাকিবে।
যুড়ি বাণ অগ্রসরি, তবে বীরবর
কহিলা উমারে;—ক্ষান্ত হও বীরাঙ্গনে,
কি ফল সমরে আর সৈন্যগণ সহ।
বুঝিলাম, ধনুর্যুদ্ধ জান তুমি ভাল।
এস মোর সাথে তবে দেখি তব বল,
কত ক্ষণ মোর অস্ত্র নিবারিতে পার,
মৃত্যু তোমা কত ক্ষণ রেয়াতিই বা করে।”
ধূম্রলোচনের বাণী শুনি হৈমবতী,
অপসারি নিলা সতী সৈন্যগণ হতে
নিজ শর জাল, তার পানে মেঘমালা।
বর্ষিয়া চলিল যেন মহীধ্র উদ্দেশে!
জর জর করি বীরে বিন্ধিতে লাগিলা।
অস্থির হইলা বলী শরের জ্বালায়!
নিমেষে লইলা তবে করে ভীম গদা;
ঘুরাইয়া মহাগদা চূর্ণি অস্ত্র জালে,
ফিরিতে লাগিলা দর্পে রণ ক্ষেত্র মাঝে;
ঘুরাইয়া শুণ্ড, যথা ফেরে মত্ত করা
বিটপ পল্লব চূর্ণি কান্তার মাঝারে।
কাটিলা সে গদা চণ্ডী বজ্র বাণাঘাতে,
সুতীক্ষ্ণ শরেতে পুনঃ বিন্ধিলা শূরেশে।
ক্রোধেতে জ্বলিয়া বীর উঠিলা তখন;
লোহিত হইল আঁখি, কাঁপিল অধর,
ভূমে পদাঘাত করি, দন্ত কড় মড়ি,
সহসা তুলিলা করে প্রকাণ্ড প্রস্তর,
হানিলা গেীরীর অঙ্গে; আঁধার নয়ন,
দেখিলা ক্ষণেক সতী। বুঝিলা অন্তরে,
অমর বিজয়ী বল। সম্বরি আঘাত,
ক্রোধেতে কম্পিত কায়, তবে শরাসনে
যুড়ি অর্দ্ধ চন্দ্র বাণ কহিলা অসুরে;—
"ভাল যুঝিতেছ বীর, ভাল বীরপণা,
সম্বর, সম্বর এবে, সম্বরহ দেখি,
অম্বরচমককারী মোর বাণ এই।
এড়িলা প্রখর বাণ; দপদপে অস্ত্র,
বিকীর্ণ প্রখর বিভা, উল্কা সম আসি,
কাটিয়া পাড়িল মুণ্ড ধূম্রলোচনের;
বিচ্যুত মস্তক, দেহ পড়িল ভূতলে;
গুম্বজ ভাঙ্গিয়া যেন পড়িল দেউল।
দেহের পতনে ধরা কাঁপিয়া উঠিল;
বিষম আঘাতে, কিম্বা গুরু ভার যেন
লাঘব হইল বলি দিল গাত্র ঝাড়া।
পলাইল সৈন্য ঠাট, এবে ইতস্ততঃ,
বাঁচিল যাহারা রণে, গিরিজার হাতে।
এবে যথা ছারখার হলে কোন পুরী
ঘোর অগ্নি দাহে, ভষ্মরাশি উড়ি চলি
জানায় দূরের লোকে সে ঘোর ব্যাপার,
চলিল সুগ্রীব আগে সম্বাদ লইয়া
দৈত্য ব্যূহ বিনাশের, সমর অনলে,
ভগ্ন মনোরথ হেতু বিরস বদন।
কতক্ষণে আসি বীর নমি রাজপদে,
করযোড়ে দীন ভাবে, রহিল দাঁড়ায়ে
নীরবে; শোণিত ধারা মন বাক্য রূপে
অবিরত বক্ষে বহি জানাতে লাগিল,
যুদ্ধ বিবরণ যেন দানবপতিরে।
দেখিয়া তাহার ভাব বুঝিলা অন্তরে,
শুম্ভ, যুদ্ধের কুসল! কহিলা;—"সুগ্রীব!
বলিবে যা তুমি আমি বুঝেছি সকলি,
বল এক বার তবু শুনি তব মুখে,
কেমনে হইল যুদ্ধ? কেমনে সে নারী
একাকিনী তোমাসবে করিল বিজয়।
কোথা সে ধূম্রলোচন? রণে পরাজিত
হয়ে বুঝি বীরবর, আছে লুকাইয়া,
লজ্জায় আমারে মুখ দেখাবে না বলি?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি তবে কহিলা সুগ্রীব;—
"লুকায়েছে সত্য প্রভো, সে ধূম্রলোচন
কাল অন্ধকূপে, আর না ভেটিবে তোমা,
আর না দেখাবে মুখ সংসারে কাহারে;
অনন্ত বিরাম বীর লভিছে ধরায়!
ধরণীর প্রেমপাশ ছেদিতে কাতর
যেন হয়ে ভীম বাহু, গাঢ় আলিঙ্গনে
বিদায় মাঙ্গিছে তারে, চরমে, নীরবে।
বিবাদ করিয়া শির দেহ সহ যেন,
পড়িয়া রয়েছে, দূরে; শোণিতের স্রোত
মধ্যস্থ হয়েছে, দোঁহা মিলাবার লাগি,
(মিলিবার নয় যাহা)। সৈন্য গণ মাঝে
কেহ নাহি অনাহত বাঁচিয়াছে যারা।
কেমনে কহিব, দেব, কেমনে যুঝিল
একাকিনী সে মহিলা মো সবার সাথে;
যুদ্ধ কালে কে বা তারে দেখেছে নয়নে;—
মধ্যাহ্ন মার্ত্তণ্ড পানে কে চাহিতে পারে?
বীর তেজ, রূপ তেজ, যৌবনের তেজে
তেজস্বিনী সে কামিনী বর্ষিতে লাগিলা
অনর্গল শরজাল রশ্মিজাল সম;
এই মাত্র তদা চোখে হেরিলাম ভূপ!
এস্ত মধুকর কুল পলায় যেমতি,
হুলী, ত্যজি মধুক্রম, যবে আসি ব্যাধ
আগুন লাগায় চক্রে; পলাইল ত্রাসে
সৈন্য গণ, ব্যূহ ত্যজি, বামার প্রভাবে।
আর কি কহিব দেব, দেখ মোরে চেয়ে,
কখন যা হয় নাই হয়েছে আমার—
বিদীর্ণ হৃদয় মোর সে নারীর বাণে,
ত্রিদিব পতির বজ্র প্রতিহত যাহে।”
বিষাদে লজ্জায় মুখ নত কৈল দূত।
বিস্মিত অন্তরে তবে কহে দৈত্যপতি;—
"অসম্ভব তব বাক্য শুনি হে সুগ্রীব;
পড়েছে কি মহাসুর, সে ধূম্রলোচন,
কামিনীর বাহু বলে? গহন কানন
পুড়েছে কি কৌমুদীর সুস্নিগ্ধ আলোকে?
বুঝিলাম সে মহিলা শক্তির আধার।
ভাল, ভাল তার তেজ, দেখিতেছি আমি;
কত ধরে বল রামা কোমল শরীরে,
কত বা অস্ত্রের শিক্ষা আছে তার ভুজে।”
তাকাইলা বীর বর চণ্ড মুণ্ড পানে।
মহাসুর দুই ভাই, নব বলে বলী;
নবঘন ঘটাসম নব অনুরাগ।
বুঝিল অন্তরে দোঁহে, দৃষ্টি ভঙ্গী দেখি
মানস, শুম্ভের। উঠিয়া, কহিলা চণ্ড;—
"সাধিতে মনের সাধ হে রাজন, যদি
অভিলাষ হয় তব, আমা দোঁহা প্রতি
দেহ অনুমতি তবে; ধরি করবার,
ধরি সে যমের গ্রীব, করবারৎসরু।”
কহিলা ত্রিদিব জয়ী;—"তোমাদেরি কাজ,
চণ্ড, বুঝিলাম এবে; সামান্য অবলা
নহে সে মহিলা; দেবগণ পক্ষ হয়ে
মায়াবিনী মহামায়া পাতিয়া থাকিবে
বুঝি, মায়াজাল; নৈলে অবলার বলে
কেন বা সমরশায়ী সে ধূম্রলোচন,
বীরত্ব পাদপ সার, সাহসের শির।
যাও, যাও দুই ভাই, যে হোক সে হোক
বামা, মহামায়া কিম্বা আর কোন মায়া,
শরেতে সংসার মায়া ছেদগে তাহার;
সেনাপতি পদে আমি বরিলাম দোঁহে।”
উঠিলা অমনি মুণ্ড; সদর্প বচনে,
কহিলা টঙ্কারি ধনু;—"কি চিন্তা রাজন্,
যে হোক সে হোক বামা, এখনি তাহারে
বাণে বাণে উড়াইয়া প্রেরিছি শ্রীপদে।
দেহ অনুমতি এবে বিলম্বে কি কাজ,
সাজি রণ সাজে মোরা; বাজুক দুন্দুভি,
বেরুক সে রবে যম, আগে হিমালয়ে।”
"এস তবে” বলি শুম্ভ, বিদাইলা দোঁহে।
সাজিতে সমর সাজে গেলা দুই ভাই।
ইতি দানব দলন কাব্যে বিগ্রহ সূত্র নামক তৃতীয় সর্গ।