দানবদলন কাব্য/চতুর্থ সর্গ
চতুর্থ সর্গ।
অবসান হলো রাতি, দেখা দিল ঊষা;
তিমিরঅবগুণ্ঠন খুলি মরি যেন
হাসিলা প্রকৃতি! দেখা দিলা প্রভাকর
ঘন ঘনাবলি মাঝে; সৈন্য ব্যহ মাঝে
দেখা দিলা চণ্ড মুণ্ড রণ সাজে সাজি।
বাজিল সমর বাদ্য শূন্য করি মন,
ভয় মায়া মোহগণে তাড়াইয়া দূরে,
ভরসা, সাহসে পুনঃ পূরি সেই স্থান।
উঠিল বিষম রোল, ঘোর কোলাহল;
লাগিল আগুন যেন সংসার ব্যাপিয়া।
এবে যথা তমঃরাশি পূরব হইতে
প্রদোষে, পশ্চিমে চলে আঁধারি সংসার,
চলিল বিষম ব্যুহ আচ্ছাদিয়া ধরা
উত্তর প্রদেশে; ত্রাসে কাঁপিল জগৎ।
অশ্বারোহী অশ্বক্ষুরে, রথচক্র ধারে,
গজ পদাতিকগণ পদের রগড়ে,
পীড়িত হইয়া ধরা ধলি ছলে যেন
পলায়ে আকাশে স্থান লইতে লাগিল।
কত ক্ষণে দেখা দিলা হিমাচল দেশে
দিতি রত্ন দুই ভাই সৈন্য ঠাটসহ;
যুগল ভাস্কর যেন উদিল সে দেশে।
বিস্তৃত নয়নে দোঁহে চাহে চারি দিকে
হেরিবারে সেইরূপ, সেই বীরাঙ্গনে,
পতিত ধূম্রলোচন, যাঁর ভুজবলে।
দেখিতে না পেলা কিছু—কেমনে পাইবে;—
অন্তর্হিত পুনঃ সতী সাধি নিজ কাজ।
সরোষে কহিলা চণ্ড তবে সুগ্রীবেরে;—
"কোথারে সুগ্রীব, ত্বরা দেখা সে মায়ারে,
শোয়াই মায়ায় আজি শরের ছায়ায়
ধরণীর কোলে, কাল নিদ্রায় ঘুমাক।
লুকাবার সাধ যদি হয়ে থাকে তার,
থুতেছি লুকায়ে আমি হেন গূঢ় স্থানে,
কেহ না দেখিতে পাবে। দেখ্ ত্বরা তারে,
কোথায় লুকায়ে আছে; সৈন্যগণে লয়ে
পাঁতি পাঁতি করি বন খোজ্ হিমাদ্রির।”
"সেবার লুকায়ে ছিল এ রকম করি,
(কহিল সুগ্রীব), পুনঃ দেখি যে আপনি
দেখা দিলা আসি বামা আপনা হইতে,
অবসন্ন হলে মোরা, খুজি তারে বৃথা।
মায়াবিনী সে কামিনী কত মায়া জানে।
খুজিগে আবার প্রভু, তবু তবাদেশে।
এত বলি সৈন্যগণে লয়ে বীরবর
হুহুঙ্কারে প্রবেশিল পার্ব্বতীয় বনে।
তোড় পাড় করি বন ভাঙ্গিতে লাগিল
প্রলয় ঝড়ের সম। করিল সে স্থান
নিমেষেতে সমভূম। অস্থির হইলা
ধরা, উদ্ভিদের লাগি; অস্থির যেমন
বস্ত্রের জ্বালায় নর, লাগিলে আগুন
তাহে। অরসন্ন হলো সবে; কিছু নাহি
পাইল দেখিতে তবু। কাতরে সুগ্রীব
ধীরে ধীরে আসি তবে কহিল চণ্ডেরে;—
"প্রভো, দেখুন তাকায়ে চারিদিক পানে
একবার, এ দেশের কি হলো দুর্দ্দশা!
শূন্য চতুর্দ্দিক;—মরি, ফেলিয়া বসন
পলাইছে যেন সৃষ্টি মো সবার ডরে!
হেন তৃণ নাহি আর ধরাতে উন্নত
লুকায় ভারুই যাহে; মানবিনী তবে
কেমনে লুকায়ে আছে বুঝিতে না পারি।
বৃথা ধরণীর ভূষা ঘুচালাম মোরা;
কিবা ফল লভিলাম দস্যু বৃত্তি সাধি।”
হাসিয়া কহিলা চণ্ড;—"তোদের এ কাজ
নহেরে সুগ্রীব। দেখ তবে আমি তারে
করিছি বাহির; রবে কোথায় লুকায়ে
এ তিন ভুবনে মোর তীক্ষ্ণ শর আগে।
ঘ্রাণেতে আঘ্রাণে যথা পলাইত পশু,
সারমেয়, মোর বাণ সন্ধানিয়া তারে
নিমেষে বিন্ধিবে গিয়া যেখানে সে রোক্।”
দর্পে ধরি ধনু বীর টঙ্কারিলা ছিলা।
কাঁপিল পবন ঘন; অমনি গিরিজা
দেখা দিলা গিরিহৃদে উজ্জ্বল বিভায়;
কাদম্বিনী ক্রোডে যেন ঝলিল বিদ্যুৎ,
ঝলায়ে প্রেমের দ্যূতি চণ্ড মুণ্ড মনে।
রূপের ছটায় গেীরী বসিলা শিখরে;
হিমাচল কুট যেন পরিল মুকুট।
আপন মনেতে বসি রঙ্গে বিনোদিনী
কত রঙ্গ করে;—কভু এলাইয়া বেণী
বিস্তারিছে কেশ; মরি রূপের লহরে
ভাসাইয়া যেন ঘন শৈবালের দল!
আবার বাঁধিছে বেণী; বাঁধিছে তাহার
সাথে, চণ্ড মুণ্ড মন, প্রত্যেক গ্রন্থিতে।
খুলিছে কুণ্ডল কভু, পরিছে আবার
কাঁচলি করিছে সইর, কটিত্র আঁটিছে;
ব্যস্ত ধনী যেন বাঁধ দিতে সুখস্রোতে।
অজ্ঞান হইয়া চণ্ড দেখে রূপসীরে;
মনেতে নাহিক মন, বিকল ইন্দ্রিয়!
বিস্ময় অন্তরে তবে কহে হিমাদ্রিরে;—
"সার্থক জনম তব মানি হিমালয়,
হেন রূপ রাশি শিরে করেছ ধারণ
কত জন্ম পুণ্য ফলে বলিতে না পারি।
গাম্ভীর্য্য গুণেতে তব মজে কি প্রকৃতি,
ললাটে দিয়াছে হেন সমুজ্জ্বল ফোটা,
পতিত্বে বরিতে? মরি, মরি কিবা রূপ—
প্রেমের মুকুর হেন দেখি বিদ্যমান;
সংসারের মনঃছবি পড়েছে উহাতে।”
কহিলা চণ্ডেরে মুণ্ড আসি তার পাশে;
প্রস্ফুট নয়ন যুগ, উন্নত উরস
আহ্লাদে;—"দেখেছ ভাই, দেখ একবার,
হিম গিরি শিখরে কি?—মানস তপন!"
হাসিয়া কহিলা চণ্ড মুণ্ড পানে চাহি;
"সব দেখেছিরে ভাই, দেখাতে আমারে
হবে নাক কিছু আর। চল তবে যাই
কাছে গিয়া ভাল করে দেখিগে উহারে।”
গেলা ধীরে ধীরে দোঁহে, যথা হররমা।
হাসি হাসি মুখ মুণ্ড, কহে শৈলজারে!—
"একাকিনী কেন ধনী বসিয়া বিরলে?—
রূপের ভাণ্ডার বুঝি লুঠি বিধাতার,
পলায়ে এসেছ হেথা লুকাবার লাগি?
হেট মুখে কেন বসি জগত আঁধারি?
তোল দেখি মুখ, দেখি দেখি, বেলা কত?
উদুক ভাস্কর ধনী ওমুখ প্রভায়!"
এতেক কহিতে মুণ্ড, আরম্ভিলা চণ্ড!—
"কি রূপসি, রূপ রাশি পর্ব্বত শিখরে
ঢালিয়াছ কেন? উচ্চ দেশে রেখেছ কি
দেখাতে সংসারে? ছিলে লুকাইয়ে তবে
কেন এতকাল? বাঁচে কি না বাঁচে জীব
তোমার বিহনে, বুঝি দেখিবার লাগি?
আপন মনেতে বসি কি ভাব ভাবিছ?—
সুখ সাগরের ঢেউ গণিছ কি বসি?
সুধাপাত্র হাতে করি বৃথা বসি আর
কেন রয়েছ সুন্দরি, কর সুধাপান;—
রূপ যৌবনের সুধা শরীরে কি বৃথা
আনাড় হইয়া ধনি, রবে চিরকাল?
এস মোর সাথে; আমি লয়ে যাই তোমা
প্রেম আক্রীড় উদ্যানে—খেল সিয়ে সেথা
কৌমুদী যেমন খেলে বিমল সরসে।”
শুনিয়া দোঁহার বাণী তুলিলা বদন
গিরিবালা; ভ্রাতৃদ্বয়ে হেরিলা বিস্ময়ে;
যুগল শরদ ঋতু মূর্ত্তিমান যেন।—
নির্ম্মল নভস সম শ্যামল বরণ,
তীক্ষ্ণরবি আঁখি যুগ জ্বলে বীরতেজে;
স্কন্ধ তক আলম্বিত চাঁচর চিকুরে
সুশোভিত শির; শোভে বনস্পতি যেন
নিবিড় পল্লব ভারে অবনত শাখা।
বিশাল তটের প্রায় বিশাল উরস
প্লাবিত সাহস নীরে; বিস্ময় মানিয়া,
কহে মনে মনে সতী;—"দেখি নাই কভু
এ হেন তেজস্বী রূপ দেবগণ মাঝে।
দিতি হৃদ আকাশের প্রভাকর এরা,
অদিতির গর্ভসর কুমুদ দেবতা।
এ হেন প্রভাব বিনা কেমনে জিনিবে
ত্রিভুবন; দেবগণ, কেন বা হইবে,
ভয়ে সঙ্কুচিত। ভাল, দেখি বীরপণা।”
এতেক ভাবিয়া দেবী কহিলা চণ্ডেরে;—
"বীর, বল দেখি মোরে কেমনে লইবে
প্রেম আক্রীড় উদ্যানে;—বনাগ্নি যে আমি—
নিমেষে দহিব বন, পশিব যেখানে।
শুনিয়া থাকিবে পণ মোর; ধর অস্ত্র,
এসে যদি থাক হেথা যুঝিবার লাগি,
ধূম্রলোচনের পথ অনুসারিবারে।
কালের হয়েছে কাল বিলম্বে কি কাজ?
ধর ধনুর্দ্ধর দোঁহে ধনুক দোঁহার;
গণ তবে উল্কাপাত,—বাণ পাত মোর,
শ্যামল শরীরে রাখি রুধিরের রেখা।
দর্পে ধরি ধনু গৌরী উঠি দাঁড়াইলা।
ঈষৎ কোপেতে অঙ্গ সচঞ্চল মরি;
সুমন্দ সমীরে যেন অনলের শিখা!
প্রীতি বিস্ফারিত চোখে দেখে দুই ভাই
কুসুমে লোহিত রাগ, কামিনীর কোপ।
কহিলা উল্লাসে মুণ্ড;—"ভাল রসবতি,
ভাল সাজিলা এখন! কেমনে গণিব,
সত্য, কেমনে গণিব, এত অস্ত্রপাত;
হানিতেছে শেল বুকে, উচ্চকুচ যুগে,
অন্তর জর্জ্জর পুনঃ কটাক্ষের বাণে,
আবার ধরিলে ধনু? সম্বর কোপনে,
সম্বরঅরির বাণ; এড় যত সাধ
লৌহময় বাণ রাশি নাহি ডরি তারে।”
"লৌহময় বাণ তবে সম্বর দনুজ,
সম্বর কালের ঘা, (কহিলা ভবানী)
ধর অস্ত্র দুই ভাই দৈত্যকুল সহ,
নিবার আমার বাণ, (একাকিনী আমি)
আকাশ ভাঙ্গিয়া ফেলি রক্ষ হাত দিয়া।
কার্য্যেতে প্রকাশ বীর, বীরত্ব আপন।”
এত বলি বাণ ধারা বর্ষিতে লাগিলা
চণ্ডী রোধিয়া বিমান পথ; স্বন্ স্বন্
শর শব্দে দিক দশ আকুল হইল,
শিথিল হইল ব্যুহ, অস্থির দুভাই;
বিস্মিত অন্তরে চণ্ড কহে তবে মুণ্ডে;
"ভাই, একি অসম্ভব; অবলার ভুজে,
এহেন অদ্ভূত শক্তি, কাল মরীচিকা,
হবে বুঝি এ মহিলা প্রমদার রূপে।
"কি চিন্তা ইহাতে ভাই (কহে তবে মুণ্ড)
ধরি আমি ধনু, দেখ কালমরীচিকা
ও প্রমদা কত দূর পলাইতে পারে,
মোর সতৃষ্ণ বাণের আগে; করিতেছি,
প্রকৃত শোণিত সর, এখনি উহারে।”
বজ্রনাদে বীরবর টঙ্কারিলা ধনু।
ধরিয়া ভায়ের হাত কহে তরে চণ্ড;—
"ভাই, থাক তুমি, আমি যুঝি ওর সনে
কালের কুটিল গতি, কি জানি কি হয়,
শৈবালের দলে বদ্ধ হয় মত্তকরি।”
"কে মানাতে পারে বাগ, অদৃষ্টেরে বল?
(কলিলা মুণ্ড) কি হেতু, বীরধর্ম্ম তবে
বিলোপ দনুজরত্ন, নিবারি আমায়
রণে। ধরিয়াছি ধনু আমি; দেহ আজ্ঞা
যাক প্রাণ রাখি মান, অসুর কুলের।
বীর ধর্ম্ম নহে সত্য, নিবারিতে রণে,
কাহারে; (কহিলা চণ্ড) ঘাও তবে ভাই,
সাবধানে যুঝ গিয়া; ঘোর মায়াবিনী
ও কামিনী, কহিলাম তোমারে নিশ্চয়।”
চলিলা সদর্পে মুণ্ড দৃঢ়পাদ ক্ষেপে,
ধ্বনিতে লাগিল অঙ্গে গুরু অস্ত্র সাজ।
কহিলা উমারে আসি;—"থাম তেজস্বিনি,
না থামে যে হাত দেখি বাণ বরিষণে।
এস দেখি একবার দেখি তব বল।
একাকিনী তুমি, এস আমিও একাকী
যুঝিতেছি তব সাথে; না ধরিবে অস্ত্র
সৈন্যগণ কেহ, অস্ত্র না ধারবে চণ্ড,
বীরত্ব অনল শিখা, দেবের আতঙ্গ।
"সকলে ধরুক অস্ত্র কিম্বা ধর তুমি
একাকী, (কহিলা গেীরী) সমান সকলি
মোর, ধনুর্দ্দণ্ডে যবে হলো ধরিবারে।
এস তবে বীরবর দেখি বীরপণা!"
ধরিলা ধনুক দোঁহে বীর দর্প ভরে;
বাজিল বিঘোর যুদ্ধ; যথা নিদাঘেতে
মেঘআড়ম্বরে মেঘ যুঝে পরস্পর,
তাড়িত আয়ূধ বর্ষি এ উহার প্রতি,
স্তনিত নিনাদে ঘোর পূরিয়া সংসার,
আঁধারে আকুলি দিক; যুঝিতে লাগিলা
প্রভূত প্রভাবে দোঁহে দেখায়ে আঁধার,
বর্ষি অস্ত্র পরস্পর বিজলিত বিভা,
ঘোর হুহুঙ্কারে দিক আকুল করিয়া।
অস্থির হইল দোঁহে দোঁহাকার বাণে।
বিস্ময় মানিয়া মুণ্ড তবে গৌরী তেজে,
কহিতে লাগিলা মনে;—"ধন্য নারীকুল।
এবে, ধন্য ছিল সেই লোক, যে লোকেতে
এ ললনা ছিল পরলোকে; ধন্য পুনঃ
হবে সেইজন, যারে প্রেম আলিঙ্গনে
তোষিবে এ সুহাসিনী মধুর সম্ভাষে।
আমাকেও ধন্য বলি, হেরিলাম চোখে
হেন বীর্য্যবতী নারী, রূপের গৌরব।
ধিক্কার আমাকে পুনঃ, নিবাতে উদ্যত
আমি, জগতের মনঅভিরাম আলো,
বিলোপিতে ধরণীর অধরের হাসি,
বধিতে উদ্যত আমি হেন মহিলারে।
যাহোক দেখাতে হলো ইহারে বারেক
অসুর কুলের বল; হেলা করি আর
অস্ত্রের আঘাত অঙ্গে সহিতে না পারি।”
বর্ষিতে লাগিলা বীর অনর্গল বাণ,
বাণের নির্ঝর যেন ঝরায়ে ছিলায়।
কভু বা ত্যজিয়া ধনু ছেড়ে মহারোষে
শেল, শূল, জাঠা, জাঠি, মুশল মুদ্গর।
কভু বা প্রস্তর খণ্ড, কভু গিরি চূড়া,
কভু হানে মহীরুহ সমূলে উপাড়ি,
প্রলয়ের ঝড় সম যুঝে বীর বর।
অধীরা হইলা গৌরী, অবসন্ন তেজ,
মরি, মুণ্ডের প্রভাবে! আকুল নয়নে
চাহে চারিদিগে তবে, নিবারিত নারি
কোন মতে অস্ত্রাঘাত; বহিতে লাগিল
কাঁপায়ে বিশাল বক্ষ, সঘনে নিশ্বাস।
উথলিল স্বেদ মুখে, খসিয়া পড়িল
বাম ভুজ হতে ধনু; রহিল অমনি
দক্ষিণ হাতেতে বাণ, হাতেতেই ধরা।
দেখিয়া উমার ভাব হাসিলা অন্তরে,
মুণ্ড; ধীরে ধীরে আসি তবে হাসি হাসি
মুখে আরম্ভিলা;—"ধনি, একি দেখি ভাব?—
আকুল নয়নে কেন চাহ চারিদিকে?—
মৃত্যুর কি পদ শব্দ পাইছ শুনিতে?
সঘনে বহিছে শ্বাস কেন বিনোদিনী?—
এখনও কি মিটে নাই যুদ্ধের পিয়াস?
স্বেদসিক্ত কেন দেখি ওচন্দ্র বদন?—
দেবগণ সুধাবৃষ্টি করেছে কি তব
বীর পণা দেখি? কোথা ধনু ভীম ভুজে?—
ধরারে কি পুরস্কার করিয়াছ উহা?
হাতের যে বাণ দেখি রহিয়াছে হাতে;
ধরেছ কি জয় ধ্বজ আপনি, আপন?—
বালে! যুদ্ধ কি মুখের কথা, একি তুমি
পেয়েছ ধূম্রলোচনে, বৃদ্ধ জরা জীর্ণ,
হেলায় বধিবে তাই?—পাইলে খদ্যোত
তমময়ী নিশীথিনী মৃদু মৃদু জ্বলে;
কোথা রহে সে আলোক উদিলে ভাস্কর?—
কোথা রৈল তব তেজ এবে মোর আগে?
গর্ব্ব ভরে ভাল পণ করেছিলে মরি;—
সমরে জিনিবে যেই বরিবা তাহারে।
কোথায় সে গর্ব্ব এবে, কোথায় সে পণ?—
গর্ব্বেরে জিনেছে লজ্জা, পণে মোর বাহু।
এস গরবিণী তবে এস মোর সাথে;
ভাবিলে এখন আর কি হবে উপায়?—
ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন।”
লজ্জায় বদন হেট করি কাত্যায়নী
তবে ভাবেন অন্তরে;—"কি করি উপায়?
নিবারিতে নারি বুঝি অনিবার্য্য তেজ,
মুণ্ডের; দনুজবর ঘোর পরাক্রম।
দেবগণ মনোবাঞ্ছা পূর্ণিবারে বুঝি
নারিলাম; হলো বুঝি দিকদশ কাল
অপযশে মোর; এবে না দেখি উপায়!"
স্তব্ধ ভাবে থাকি ক্ষণ মনে মনে সতী
স্মরিলা পদ্মারে তবে, প্রিয় সহচরী।
"কোথা পদ্মে, প্রিয়সখী এস একবার
এসময়, দেহ মোরে উপদেশ আসি,
কেমনে দুর্ম্মদ দৈত্যে জিনি এ সমরে,
কেমনে বা রক্ষা করি বল নিজ মান।
অস্থির হয়েছি সখি দৈত্যের প্রভাবে।”
অবনত মুখে সতী ছাড়িলা নিশ্বাস!
চঞ্চল হইল মন কৈলাসে পদ্মার,
মরি সে নিশ্বাসে যেন!—চঞ্চল যেমন
অনিল হিল্লোলে সরে কমল কৌমুদী।
বুঝিলা অন্তরে সাধ্বী উমার বিপদ।
আলোক ছটার গতি অমনি সত্বরে
আসি দেখা দিলা ধনী একাকিনী যথা
রণস্থলে ম্লান মুখে ভাবেন ভবানী।
মহামায়া মায়াবলে কেহ না পাইল
দেখিতে নয়নে তাঁরে, কেবল শুনিল
মধুর শিঞ্জন বোল শ্রুতি অভিরাম।
কহিতে লাগিলা পদ্মা সমরে কাতরা
দেখি শৈলজারে;—"কেন এ দুর্গতি দুর্গে!
আহা মরি, জর জর কোমল শরীর,
তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতে, রক্তে ভাসিতেছে তনু।
কমনীয় কলেবর, অনুপম শোভা,
ধরেছ কি সখি দৈত্যকুল বিনাশিতে?—
ধরেছ মৃণাল দণ্ড, ভাঙ্গিতে আমরি
পাষাণ! সামান্য বীর, নহে চণ্ড মুণ্ড।
প্রভাব আপনি, দৈত্যকুলে অবতীর্ণ
যেন দুই ভাগে। দেখ তেজরশ্মি যেন
বাহিরিছে দোঁহাকার লোমকূপ দিয়া।
সাধে কি ত্রিদিববাসী অমর যাহারা
মানিয়াছে পরাভব? দিয়াছে ছাড়িয়া
সুখের সদন নিজ ত্রিদশ আলয়?
ত্যেজ হররমে, হেন মনলোভা রূপ।
ধর উগ্রচণ্ডা মূর্ত্তি; কাট লৌহ ধারে
লৌহ। কোমল বাহুর বলে মরিবে না
কভু বিক্রম কেশরী বীর চণ্ড মুণ্ড।
যাই আমি ইন্দ্রালয়ে, পাঠাইগে তবে
ইন্দ্রে দেবগণ সহ, তোমার সহায়ে।
সকলের চেষ্টা বলে অবশ্য মরিবে
রণে, শক্তির আধার ভাই দুই জন।
একাকিনী তুমি কেন সহ হেন ক্লেশ।”
"যাও তুমি তবে পদ্মে, (কহিলা অম্বিকা)
পাঠাওগে দেব রাজে দেবগণ সহ;
উগ্রচণ্ডা মূর্ত্তি আমি ধরি ততক্ষণ।”
বিদায় হইলা পদ্মা নমি গিরিজায়।
অন্তর্হিতা হৈলা গোরী সহসা অমনি;
নিবিলা সহসা যেন গৃহের প্রদীপ;—
নিষ্প্রভ হইল মরি হিমাচল দেশ!
বিস্মিত হইয়া মুণ্ড কহে তবে মনে;—
"কোথা গেল বামা, ছিল এখনি যে হেথা?
উঠিলা পর্ব্বতে ত্বরা; চাহিতে লাগিলা
চারিদিকে; না পাইলা দেখিতে কিছুই।
কহে মনে মনে তবে;—"মায়াবিনী সত্য,
হবে বুঝি এ ভামিনী, নৈলে গেল চলি
ইহারি মধ্যেতে কোথা; সংসার হতেছে
দৃষ্টি মোর। কি বলিব, শুধিবে আমারে
যবে দৈত্যকুলপতি—দেখি বীরবর,
কি ফল লভিলা করি যুদ্ধ আড়ম্বর।
কি বলিব তবে আমি?—হারায়েছি তারে?—
চোখে ধূলি দিয়ে মোর পলায়েছে বামা?—
হাসিবে যে দৈত্যকুল, হাসিবে বাসব
সমস্ত দেবের সহ; হাসিবে জগৎ!
বিষাদে বদন হেট করিলা বলীন্দ্র।
শুনিলা অমনি রব ঘোর স্বন্ স্বন্
আসিছে প্রলয় ঝড় যেন তোড় পাড়ে।
তুলিয়া বদন ত্বরা দেখিলা বিস্ময়ে
করাল বিকট বেশে দাড়ায়ে সে ধনী
সম্মুখে; কোথা বা সেই মনোলোভা হাব,
কসিত কাঞ্চন বর্ণ, কমনীয় কায়;
অবার রজনী যেন মেঘ আড়ম্বরে
বিদ্যমান!—কলেবর নীলাম্বরপ্রভ,
ঘোর ঘন ঘটা তাহে বিকীর্ণ মূর্দ্ধজা,
আঁখির লোহিতরাগ, বিদ্যুৎ ঝলক,
জীমূত নির্ঘোস ঘোর ঘন হুহুঙ্কার।
দেখি ভয়ঙ্করা মূর্ত্তি ভাবে মুণ্ড মনে;—
"সত্য ভেবেছেন যাহা দৈত্যরাজ শুম্ভ,
ভাই চণ্ড মোর। সত্য বটে দেখি এবে,
মায়াবিনী মহামায়া দেবগণ লাগি
পাতিয়াছে মায়াজাল। এইত কালিকা
মূর্ত্তি, ত্রিলোচনা বটে, ত্রিলোচন আর
কার আছে এ সংসারে রুদ্র গোষ্ঠি বিনা।
যাহোক না ডরি আমি ত্রিভুবনে করে।
দেখি উগ্র চণ্ডা শক্তি কতই প্রবলা।”
এবে যথা দিনাঘেতে প্রদোষে পশ্চিমে
সহসা লাগিলে মেঘ ঘোর আড়ম্বরে
এক খানি, যুটে আমি চারি দিক হতে,
স্তনিত নিনাদে তার কত শত মেঘ;
যুটিতে লাগিল ক্রমে অযুত অযুত,
পিচাশ রাক্ষস দল, মাতৃগণ কত,
সে তেত্রিশ কোটি দেব বজ্রধর সহ,
হুহুঙ্কার রব ঘন শুনি কালিকার।
পূরিল সে ক্ষেত্র ক্ষণে, ত্রিদিব সৈন্যেতে।
চমকিত মনে মুণ্ড দেখে সে ব্যাপার।
ধীরে ধীরে আসি তবে কহে সে চণ্ডেরে;—
"ভাই! দেখ একবার মহামায়া মায়া!
নাহি আর মনোলোভা সে সুন্দর বেশ,
নহে আর একাকিনী সহায় বিহীনা
বামা; যুটিতেছে দেখ, দেব, মাতৃগণ,
পিচাশ, রাক্ষস দল অযুত অযুত।
দেহ ভাই অনুমতি, ধরি গিয়া তবে
উগ্রচণ্ডা বল আগে দৈত্যকুল বল—
ধরিগে প্রদীপ আগে প্রদীপ্ত ভাস্কর।”
কহিলা মুণ্ডেরে চণ্ড;—"চল ভাই যাই,
দুই ভায়ে যুঝি গিয়া। একাকী তোমারে,
পাঠাতে সাহস মোর না হয় অন্তরে
কালিকার সহ রণে; দেবগণ তাহে
সহায় আবার তার। চল তবে যাই,
দুভায়ে ধরিগে ধনু; কারমাধ্য তবে
দাঁড়াবে মোদের আগে তিষ্ঠি ক্ষণ কাল।
সরোষে কহিলা মুণ্ড;—"আমার সনেতে
যুদ্ধ হতেছে চণ্ডীর; তুমি কেন তাহে
দিবা হাত? দৈত্যকুল নহেক নিস্তেজ,
কাতর এখন মুণ্ড হয় নাই রণে।
কেন বা লইব বল সাহায্য তোমার,
দিতির নির্ম্মল গর্ব্ভে দিইতে কি কালি?
দেবকুলে কালি যথা দিলা হৈমবতী,
একাকী যুঝিব বলি ডাকি দেবগণে?
থাকুক বা যাক্ প্রাণ, কি চিন্তা তাহার;
দেখ আগে মোর বল পরে যুঝ তুমি।”
নিস্তব্ধ হইলা চণ্ড, আর না বলিলা
কিছু; প্রেম আলিঙ্গনে শিরচুম্বি তবে
বিদাইলা ভায়ে (মরি জনমের মত),
কহি, যাও তবে যুঝগিয়া সাবধানে,
মঙ্গল তোমার ভাই করুন বিধাতা।
সাপটি ধরিয়া ধনু, ঝাড়ি কেশজাল,
উদ্যত একাকী মুণ্ড যুঝিবার তরে
অমর সৈন্যের সহ, অসংখ্য অপার।
চলিলা সদর্পে বীর, উড়িতে লাগিল
প্রভাব পতাকা সম উষ্ণীসের শিখা
শিরে; অবহেলে অসি দুলিতে লাগিল।
গণিতে লাগিল ধরা প্রতি পাদক্ষেপে
রসাতল; দেবগণ আগত বিপদ।
কতক্ষণে তবে বীর আসি দেখা দিলা
অমর ব্যূহের আগে। হেরিলা সে ব্যূহ
ফিরায়ে লোহিত আঁখি; উম্মোচিলা বাণ
তূণীহতে, দপ্দপে জ্বলিল ফলক,
সহস্র আঁখির আঁখি চমকিয়া মরি!
মহা রোষে বজ্রধর টঙ্কারিলা ধনু;
গুড়গুড় রবে, অভিনন্দিলা সে রবে
ঐরাবত; দেব বক্ষ উৎসাহে ফুলিল।
যুটিলা আসিয়া ত্বরা স্বন স্বনে বায়ু,
ধক্ ধক্ ধকে অগ্নি, কলকলে পাশী;
যক্ষ রক্ষ মাতৃগণ যুটিল সকলে,
যুটিলা আসিয়া পুনঃ অমরের আশা
ভীমা ভয়ঙ্করা কালী, উলাঙ্গিয়া অসি।
যুটিল অমর বল আমি এক কালে
মুণ্ড আগে, বীরবর একাকী দাঁড়ায়ে
(দূরে নিজ দলবল) অরিদল আগে,
অসংখ্য অপার; যথা প্রদোষ সময়ে
সাগরের আগে ররি ত্যজিয়া উদয়!
অগ্রসরি তবে বলী কহে কালিকারে;—
"একি দেখি রূপ ধনি, একি দেখি ভাব,
একি অপরূপ সাজ? বল দেখি শুনি
হেন মনোলোভা সাজে কে সাজালে তোমা?
লজ্জারি একায বটে, নৈলে আর কার;
সুবর্ণ গঞ্জিত গণ্ডে মাখায়েছে কালি!
এলায়েছ মরি কেশ বারিদ বরণে,
মেঘের আগেতে মেঘ উদয়িয়া পুনঃ!
ত্রিলোচন কেন দেখি ও চন্দ্রবদনে?—
দুনয়নে স্থান বুঝি হলো না লজ্জার?
ঘুচাইয়া মনোলোভা রূপের চরম,
এহেন ভীষণ মূর্ত্তি? এস তবে এস
ধর ধনু ভীম ভুজে; দেখি দেখি তব
ভীষণ মূর্ত্তির বল কেমন ভীষণ।”
"ধরিব না ধনু আর, (কহিলা মৃলাণী)
কি কাজ ধনুকে? আছে করবার করে,
ভীষণ মূর্ত্তির বল ইহাতেই দেখ।”
বাঝিল বিষম যুদ্ধ; ঘোর পরাক্রমে
আরম্ভিলা দেবগণ তুমুল সংগ্রাম।
উজলি অম্বর দেশ অগ্নি বৃষ্টিসম,
খর বিভা অস্ত্র জাল বর্ষিতে লাগিল,
অবনী আকাশ মাঝে সৃজিয়া আমরি,
মুকুর আকাশ পুনঃ। দ্বন্দ্বিতে লাগিল
অস্ত্র বিভা সহ রশ্মি, অস্ত্রসহ অস্ত্র,
অমর প্রভাব সহ মুণ্ডের প্রভাব।
সংসার দ্বন্দ্বেতে মত্ত লক্ষিত লইল।
কেবল অলস এবে চণ্ডের সে ঠাট,
দূরে ভূমে হানি শেল দাঁড়ায়ে নীরবে,
অধীর উন্মত্তকারী করবার করে।
ধৈর্য্যের ফাটক কিন্তু ভাঙ্গি তাহাদের
বিনিগত প্রতি হিংসা আঁখি দ্বয় দিয়া;
কম্পিত শরীরযন্ত্র শোণিত উচ্ছ্বাসে।
এবে দেবগণ তবে প্রভূত সাহসে,
জর জর করি মুণ্ডে বিন্ধিতে লাগিল।
কাতর শূরেশ মরি, নিবারিতে নারি
অজশ্র অস্ত্রের ধারা। ক্রোধানলে তবে
জ্বলিয়া উঠিয়া বলী; জ্বলিল ভূধর
যেন অগ্নি উদ্গীরণে;—ঝলিল রোষাগ্নি
লোহিত লোচন দ্বয়ে; ঘন ঘন শ্বাসে,
বিনির্গত ধূম পুঞ্জ; হুহুঙ্কার রবে
প্রতিধ্বনিত দিগ্দশ; পদ ভরে ঘন
কাঁপিতে লাগিল ধরা। আঁধারিয়া দিক,
প্রচণ্ড প্রবেগে বীর যা পায় সম্মুখে
ছোড়ে দুই হাতে। কেবা জানে শেল শূল
গিরিচূড়া, গণ্ডশৈল, মহীরুহ আদি;
কন্দুক খেলিতে যেন লাগিলা বলীন্দ্র
খণ্ড খণ্ড করি সৃষ্টি। অবসন্ন ক্রমে
মরি, অমরের বল মুণ্ডের প্রভাবে!
হেন কালে দেখা দিল বিঘোর বদনা
বিভাবরী, রশ্মি জাল পলাইল ত্বরা;
(অমর সৈন্যেরে যেন দৃষ্টান্ত দেখায়ে)।
পলাইল দেব সৈন্য ছাড়ি কালিকায়;
হিমাচল আগে গিয়া মুছিতে লাগিল
সঘন নিশ্বাসে সবে ললাটের ঘাম।
হেথা একাকিনী মাত্র রহিলা রুদ্রাণী,
স্তব্ধ প্রায় হয়ে মুণ্ড প্রচণ্ড প্রভাবে;
ভগ্ন শাখা তরু যেন প্রান্তর মাঝারে।
কহিতে লাগিলা মনে;—"কি আশ্চর্য্য হেন,
অদ্ভূত শকতি ধরে অসুরের বাহু?—
অস্থির করিল মোর উগ্রচণ্ডা শক্তি?
দেবগণ কে কোথায় পলাইল ত্রাসে।
রজনী আগত এবে; অসুরের বল
শত গুণে বাড়ে রাতে; নিশার সমরে
মুণ্ডের নিধন আশা দুরাশা কেবল।
সাহসে করিয়া ভর রাত্রিকালে যদি
না ছাড়ি সমরক্ষেত্র মোরা, দিবাগমে
অবশ্য মরিবে দৈত্য নাহিক সংশয়,
অবিশ্রান্ত রণশ্রান্তে কাতর হইয়া।
কিন্তু যদি ছাড়ি ক্ষেত্র, নিশার বিরামে,
নব রাগ ভরে যথা দেখা দিবে রবি,
দেখা দিবে দৈত্যবর নব অনুরাগে।
কি করি উপায় এবে;—ডাকি তবে সবে।
ডাকিতে লাগিলা কালী অমর নিকরে;—
"এস ইন্দ্র, রণ ক্ষেত্র ছাড়ি পলায়ে না,
বৃত্রহন্, জম্ভভেদী, বজ্রধর তুমি,
অমর ঈশ্বর তাহে অমর আবার!
তোমারে কি রণ ক্ষেত্র ছাড়া হে উচিত?
এস অগ্নি, সর্ব্বভুক, প্রভঞ্জন বায়ু,
এস পাশধারী পাশী, কৃতান্ত শমন,
যক্ষঃ রক্ষ মাতৃগণ পিচাশ নিকর,
এস, সবে মিলি যুঝি পুনঃ; দেখি দেখি,
মুণ্ডের প্রচণ্ড তেজ টুটে কিনা টুটে;
প্লাবনের মুখে শৈল ভাসে কিনা ভাসে।”
আসে সে জোয়ার যথা, চন্দ্রিকা প্রভাবে;
দেখা দিল দেব সৈন্য পুনঃ রণ স্থলে,
কালিকার মুখচন্দ্র বাণীর প্রভাবে।
আবার ঘেরিল মার, অমরের বল
শুক্রশিষ্যরত্নে! ঘোরা রজনী ক্রমশঃ
না উদিল শশী তবু, মুণ্ড ভয়ে যেন।
কম্পিত তারকা দল নীরবে আকাশে।
মেঘ কুল ইতস্ততঃ ধাইতে লাগিল।
যথা সিংহ বনভূমে গভীর নিশায়,
বিকট নিনাদ ভরে, আস্ফালিয়া লেজ,
তাড়ায় সে পশুপালে, এ দিক ও দিক,
তাড়াতে লাগিলা মুণ্ড আস্ফালিয়া আসি,
যক্ষ রক্ষ মাতৃগণ দেবগণে আর।
ছিন্ন ভিন্ন শাখা পত্র যাবৎ উপড়ি,
নাহি যায় গড়াগড়ি ভূমে তরুশ্রেণী,
সহে যথা প্রভঞ্জন ভীষণ আক্রম,
সহিতে লাগিল দেব যক্ষ রক্ষগণে,
সারা রাত্রি অসুরের ঘোর পরাক্রম;
ক্ষত বিক্ষত শরীর, তথাপি না ছাড়ি
কোন মতে রণক্ষেত্র, অবসন্ন তনু,
যাবৎ না পড়ি ভূমে গেল গড়াগড়ি।
কতক্ষণে তবে ঊষা অমরের আশা,
আসি দেখা দিল, মন্দ মন্দ পাদক্ষেপে।
সূর্য্যোদয় তিন যেন হেরিল সংসার!—
উদয় অচলে এক, হিমগিরি আগে
দ্বিতীয় উদয় সম মুণ্ডের ললাটে,
(অরুণ বিপক্ষ রক্তে বিলোহিত যাহা
জ্বলে রক্ত আঁখি দ্বয় বিকীর্ণ করিয়া
যুগল ভাস্কর সম, রোষ রশ্মি জাল।
কতক্ষণ ঔর্ব্বানল জ্বলে অব্ধি মাঝে?
কতক্ষণ বীরতেজ না টুটিয়া আর
রহিবে মুণ্ডের, অরিপারাবার মাঝে।
ক্রমে ক্রমে হীন বীর্য্য মরি বীর বর!
ক্রমে ক্রমে অরিদল চাপিতে লাগিল;
অন্ধকার কুল যথা চাপে প্রভাকরে,
প্রদোষে হেরিয়া তাঁর মন্দীভূত কর।
ভূধরে বেড়িয়া যথা বর্ষে ধারা মেঘ,
অগ্রসরি তবে কালী দেবগণে লয়ে,
মহাতেজে অস্ত্র জাল বর্ষিতে লাগিলা।
অস্থির হইলা বলী নিবারিতে নারি
কোন মতে অবিরত অস্ত্রের প্রপাত।
ফাঁফর হইয়া তবে নিলা ভীম গদা,
ত্যজি শরাসন শর। ক্ষণে বিমুক্তিলা,
ঘুরায়ে সে ভীম গদা দেব প্রহরণ।
ঘোরতর যুদ্ধ পুনঃ করিতে লাগিলা।
হুহুঙ্কারে আসি ত্বরা অসির আঘাতে,
কাটিলা সে গদা, চণ্ডী; রিক্ত হস্তে পুনঃ
যুঝিতে লাগিলা বীর প্রভূত সাহসে;
শুণ্ড মাত্র লয়ে যথা যুঝে মত্ত করি।—
মুষ্ঠির আঘাতে কার গুড়া করে শির,
চপেট আঘাতে করে আঁধার দেখায়;
কাহারে ধরিয়া মারে ভূমেতে আছাড়,
ত্রাসেতে অমর সৈন্য পুনঃ ভঙ্গোদ্যত।
বাতাসে বাতাসে যথা জ্বলয়ে অনল,
মুণ্ডের অটুট বলে জুলিয়া উঠিলা
ক্রোধে করালিনী তবে; কম্পিত অধর,
লোহিত লোচনত্রয় চঞ্চল শরীর।
লট্টপট্ট কেশ জাল অনিবার্য্য তেজে,
গর্জ্জিয়া হানিলা শেল, আসি মুণ্ড হৃদে।
আঁধার নয়নে বীর দেখিলা তখন;
তথাপি সজোরে শেল ডানি হাতে ধরি,
উপাড়িয়া মহা জোরে দন্তেতে চিবায়ে,
গুড়া করি দিল ফেলি। শোণিত প্রবাহে,
দিলা অঙ্গ ঢালি বীর তখন কাতরে।
উঠিল দনুজ সৈন্যে হাহাকার রব।
চমকি উঠিয়া চণ্ড কাতর নয়নে
দেখিলা প্রাণের ভাই নয়নের মণি,
পড়িয়া ভূতলে তার। অমনি ফেলিয়া
ধনু, বক্ষে কর হানি, ঊর্দ্ধশ্বাসে আসি
ধরিলা ভায়ের গ্রীবা। অঙ্গে অঙ্গ ঢালি
মুখে রগড়িয়া মুখ ভাসাইলা তনু,
মরি, নয়নের জলে! ঘোর আর্ত্তনাদে
পুরিলা সংসার! ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসে
উঠাইলা শোক ঝড়। ঊর্দ্ধ দৃষ্টে তবে,
কহিতে লাগিলা বীর, খেদে;—"হা বিধাতঃ!
কি করিলে ডুবাইলে, অতল সলিলে
বীরত্বের চূড়া? মরি, নিবাইলে মোর
সুখখনির আলোক, অভিভূত আহা,
করিয়া আমায় ঘোর শোকঅন্ধ কূপে।
আচ্ছাদিলে কেন মোর সুখের প্রত্যূষে
চির দুঃখ কুয়াসায়। আহা মরি কেন,
লুকালে আমার সেই পূর্ণ শশধরে,
কাল মেঘ আড়ে। উঠ ভাই, কথা কও,
ডাক উঠি মোরে প্রিয় ভ্রাতৃ সম্বোধনে;
যুড়াক তাপিত প্রাণ শুনে তব রব।
ভাই! মাতৃ গর্ভে, সে সঙ্কোচ কারাগারে,
ছিলাম দুজনে সুখে, একত্রে; জনমি
দুই ভায়ে দুই স্তন করিয়াছি পান,
জননীর, পরস্পর মুখচন্দ্র হেরে
আনন্দ সাগরে ভাসি। খেলিয়াছি দোঁহে
বাল্য খেলা। এবে কেন যৌবন প্রারম্ভে,
সুখের সময়ে ভাই ঘটাইলে হেন
অনন্ত বিচ্ছেদ! খেদে প্রাণ যায়, হেরি
নীরব রসনা তব বাগ্বাণির বীণা,
বাজিত নিয়ত যাহা সুমধুর বোলে।
মুদিয়া নয়ন কেন পড়ে ধরাসনে,
অভিমান করিয়া কি আমার উপরে?
হেন অপরাধ আমি কি করেছি ভাই,—
হেরিবে না মুখ মোর করিলে যে পণ।
কোথা সে মধুর হাসি? কেন তব হেরি
মলিন বদন আজ্? কাতর কি তুমি,
রণে? উঠ তবে উঠ, এস বক্ষে মোর,
সান্ত্বনা করি তোমারে শান্ত হই আমি,
আলিঙ্গনে বাঁধি হৃদে অভিন্ন হৃদয়ে।
মেল এক বার আঁখি, মেলি দেখ দেখি,
নিমেষে বধিছি আমি তব শত্রুগণে।—
দেহ মোরে বল ভাই, ঈষৎ হাসিয়া,
ভ্রাতৃ সম্বোধনে। রঙ্গে দলি দেবগণে,
ঘোর দাবানল যথা বনস্পতি কুলে।
ভাই, ঘুচাইলে মোর বাহু বল; মরি
ঘুচাইলে দৈত্যকুল আশা! নাহি আর
ধরিব জীবন আমি তোমার বিহনে।
ধরিব না অস্ত্র আর দেব বিপরীতে;
এড়াই শোকের হাত ত্যজি এ জীবন!"
ভাঙ্গিয়া পড়িছে পদ, অবসন্ন কায়
দারুণ শোকের ভরে, ধীরে ধীরে তবে,
আসি গেীরী পাশে বীর কহিতে লাগিলা;—
"হে চণ্ডিকে! মহা শক্তি লোকে বলে তোমা:
এই কি শক্তির কাজ? করেছিলে পণ,
যুঝিবে যে একাকিনী? তবে কেন পুনঃ
লইলে দেবের শক্তি? কি বীরত্ব ইথে,
প্রকাশ হইল তব? সবে মিলি যুটি,
সে তেত্রিশ কোটি দেব যক্ষ রক্ষ কত
গণিত অতীত, মরি, বধিলে আমার
প্রাণের সোদরে। ভদ্রে, সূক্ষ্ম বালু কণা,
রাশি রাশি উড়ি আসি অনায়াসে পারে,
প্রোথিতে প্রসাদ চূড়ে গগণ বিহারী।
যা করিলে ভাল কাজ করিলে সে ভাল,
এড়ালে চণ্ডের হাত—কৃতান্তের হাত।
ধরিব না অস্ত্র আর শুন বীরাঙ্গনে,
না করিব চেষ্টা আর রক্ষিতে জীবন।
নির্ভয়ে বিদর হিয়া, বিদরিত প্রায়,
করিয়াছ যাহা তুমি ভ্রাতৃ শোক শেলে।
হান বক্ষে শেল দেবি, বিলম্বে কি ফল,
ডুবাও আমারে ত্বরা শোণিত সাগরে,
নিবুক সে শোকানল জুড়াক শরীর।”
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি নীরবিল বলী।
শুনিয়া চণ্ডের খেদ, লাজে অনুতাপে,
মনে মনে তবে সতী কহিতে লাগিলা;—
"কি কুকর্ম্ম করিলাম; হায় কেন আমি
দেবগণ লাগি অস্ত্র ধরি অকারণে
বধিলাম দৈত্যবরে; বীরত্ব রতনে
ফেলিলাম কাল অন্ধকূপে; কাটিলাম
শক্তি রথচক্র; মরি, ভাঙ্গিলাম পুনঃ
সে সাহস ধ্বজ, ঘোরতর যুদ্ধঝড়ে!
হায়, নিবাতে উদ্যত আমি দীপাবলি
সংসারের!—দৈত্যকুল সৃষ্টির আলোক।
কি করি এখন; যাই রণস্থল ছাড়ি
কৈলাসেতে; দেবভাগ্যে যা থাকে তা হোক।
চণ্ডের কাতর ভাব দেখিতে না পারি
আর; ভায়ের বিহনে, আহামরি বীর,
উদাস মুরতি যেন শ্মশানের প্রায়!"
স্তব্ধ প্রায় হয়ে সতী রহিলা দাঁড়ায়ে।
দেখিয়া উমার ভাব প্রমাদ গণিলা
ইন্দ্র। ভাবিলা অন্তরে, সর্ব্বনাশ হলো;
দয়া উপজিল বুঝি করুণাময়ীর
চণ্ডের বিলাপে। এবে না দেখি উপায়।
বিরস বদনে বীর চাহে চারিদিকে।
সাগর ভেদিয়া যথা জ্বলে ঔব্বানল;
শোকের সাগর ভেদি জ্বলিয়া উঠিল
সহসা, ক্রোধের অগ্নি চণ্ডের মানসে।
অধীরা হইয়া বীর কহে কালিকারে;—
"কি ভাবিছ ভগবতি?—কিসের জাহাজ
ডুবেছে তোমার, মরি, ডুবাইয়া মোর
জীবন তরণী কাল অম্বুরাশি তলে!
ধর অসি শীঘ্রগতি; ডুবাই তোমার
ভ্রম কূপে, ষড়বিধ ঐশ্বর্য্য নিকর;
নিবারি মনের ক্ষোভ শস্তিয়া তোমায়।
হুহুঙ্কারে বীরবর ঘোর মুষ্ট্যাঘাত
করিলা চণ্ডীর শিরে; মূর্চ্ছিতা হইয়া
আলু থালু অঙ্গ দেবী পড়িলা ভূতলে;
ভাঙ্গিয়া পড়িল মরি রূপভাণ্ড যেন!
সাহসে নির্ভর করি আসি তবে ইন্দ্র
দিলা হানা চণ্ড আগে ভীম বজ্রকরে,
রক্ষিতে কালীর দেহ। দেবগণে লয়ে
আরম্ভিলা ঘোর যুদ্ধ। অস্থির করিলা,
চণ্ডে; হুহুঙ্কার রবে এড়িলা দম্ভোলি;
ইরন্মদে ঝলি আঁখি কড়কড় রবে
আমি অস্ত্র চণ্ড শিরে পড়িতে উদ্যত।
অমনি ধরিলা বজ্র বাম কর দিয়া,
করীন্দ্র যেমন ধরে নলিনী গেণ্ডুক,
বীরেন্দ্র কেশরী বীর। কহিলা বাসবে;—
"ক্ষান্ত হও দেবরাজ, জ্বালাতন আর,
করো নাক মোরে; নাহি চাহি যুঝিবারে
তোমাদের সহ; রণ সাধ মিটিয়াছে মোর
তোমাদের সহ রণে; নাহি ভয়, আমি
বধিব না কালিকারে মুর্চ্ছিতাবস্থায়,
বীর ধর্ম্ম দৈত্য কুল প্রাণীপেক্ষা প্রিয়,
না প্রহারি অস্ত্র মোরা অচেতন জনে।
নীরবিলা চণ্ড, ফেলি দূরেতে কুলিশ।
কতক্ষণে সচেতন ভীমা ভয়ঙ্করা,
রৌদ্ররূপা; মহাক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলা
দেবী চণ্ডের প্রহারে; জ্বলিল অনল,
দ্বিগুণ উত্তাপে যেন থাকি ক্ষণ কাল
অভিভূত, তৃণ রাশি চাপে। তীক্ষ্ণ অসি
আস্ফালিয়া ঘোর রাবা, ভয়ঙ্কর নাদে,
আক্রমিলা চণ্ডে; অসি উত্তরিল শিরে।
ধরিয়া কালীর হাত অমনি বীরেশ;
কহিলা; “মরিতে সত্য আছিগো উদ্যত,
চণ্ডী, তাহাই কি তুমি বধিতে পারবে
মোরে অপমান করি—ছিন্ন করি শির?
বিদর এ বক্ষ দেবি, হানি তীক্ষ্ণ শেল,
কিম্বা এড় অন্য অস্ত্র যাহে তব রুচি।
শ্রীভ্রষ্ট করিতে কিন্তু দিব না এ কায়।
ছাড়িলাম হাত; ছাড়ি দিলা হাত বীর।”
ছাড়ি অসি তীক্ষ্ণ শেল লইলা শঙ্করী।
কহিলা;—"বধিব তোরে করিয়াছি পণ,
দৈত্য, মর তবে যাহে তব অভিরুচি;
আসন্ন কালের বাঞ্ছা পূরাণ উচিত।”
হানিলা সে শেল বজ্রবক্ষে মহাকালী।
ভেদিলা ফলক মর্ম্ম, প্রবেশি হৃদয়ে।
পড়িলা ভূতলে বীর;—পড়িল পাহাড়!
ভঙ্গ দিল দৈত্য সৈন্য। জয়োল্লাস তবে
আরম্ভিলা মহামার অমর নিকর।
ইতি দানব দলন কাব্যে চণ্ডমুণ্ড বধো নামক চতুর্থ সর্গ।