পঞ্চম সর্গ।

ঊর্দ্ধশ্বাসে আসি দূত, সাহসী সুগ্রীব
দাঁড়াইল রাজ আগে, মলিন বদন,
আকুল নয়ন যুগ, চঞ্চল শরীর,
ফুলিছে নাসার রন্ধ, ঘন ঘনশ্বাসে,
অবাক!—অবাক শুম্ভ দেখি তার ভাব!
স্তব্ধ প্রায় থাকি ক্ষণ জিজ্ঞাসিলা তারে;—
"কেনরে এমন ভাব দেখি তোর আজ

দূত! কি ঘটিল বল?—কোথা চণ্ডমুণ্ড?
চণ্ডমুণ্ড যবে রণে কি ভয় তোদের?”
সম্বরিয়া শ্বাস তবে কাতরে সুগ্রীব
কহিল;—"রাজন, সত্য কি ভয় মোদের
চণ্ডমুণ্ড যবে রণে। চণ্ডমুণ্ড প্রভো,
কোথা এবে?—দুই ভাই ত্যজেছে সংসার,
দেবগণ সহ রণে রুদ্রাণীর শেলে;
ভেঙ্গেছে দক্ষিণ বাহু আমাদের দেব।”
নত কৈল মুখ দূত সজল নয়নে।
বাড়ব অনল যেন জ্বলিল সাগরে;
জ্বলিয়া উঠিল কোপ শুম্ভের মানসে
শুনি রুদ্রাণীর নাম, দেবতাগণের।
ফুলিয়া উঠিল বুক, কাঁপিল অধর,
কুটিল হইল ভ্রূ; রোষে সিংহাসনে
চপেট আঘাত করি উঠি দাঁড়াইলা।
ঈষৎ নাড়িয়া ঘাড় লাগিলা কহিতে;—
"কি বলিলি, রে সুগ্রীব,—মৃত চণ্ডমুণ্ড?
বটে বটে তাই বটে, ভেবেছিলাম যা,
নৈলে, কেনবা পড়িবে, সে ধূম্রলোচন,
সামান্য নারীর করে। শঙ্করীরই ছল
বটে; দেবগণে লয়ে এসেছেন বুঝি
চণ্ডী দেখাইতে মোরে দানব-দলন-

শক্তি। বেড়েছে সাহস বধিয়া সমরে
বুঝি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈত্যগণে। সে সাহস
এখনি ডুবাব আমি ত্রাসের অতলে;
নিবাব নামের যশ খদ্যোতিকা আলো
বিচ্ছিন্নিব রণ ঝড়ে দেব আশা মেঘ।
"সাজাও রে রথ ত্বরা” গু কহিলা গম্ভীরে।
উলাঙ্গিলা অসি বীর ঝনঝন রবে।
উঠিলা নিশুম্ভ তবে; জলধর শ্যাম,
সুদীর্ঘ শরীর বীর গম্ভীর স্বভাব,
জঠরাগ্নি রাজকার্য্যে, দাবাগ্নি সমরে।
বিনীত বচনে শুম্ভে কহিলা শূরেশ?—
"ভাই! জনম তোমার আগে, ক্লেশে সদা
অগ্রগতি হবে মোর; বিরাম তোমার
আমি বিদ্যমানে; বিধি অগ্রজের মান
দিয়াছেন ইহা; তবে কি হেতু রাজন্‌,
আমি বিদ্যমানে তুমি যাইবে সমরে?
দেহ আজ্ঞা ভূপ, বসি রাজসিংহাসনে,
তব আজ্ঞা প্রতিঘাত হয়ে অসিধারে
মোর, সাধুক তোমার সাধ; লৌহাঘাত
প্রস্তর উপরে পড়ি ঝলুক আগুন।
দেহ আজ্ঞা দৈত্যরাজ ধরি করবার।”
সহসা উঠিয়া তবে কহে রক্তবীজ;—

তাম্র মূর্ত্তি বীরবর, লোহিত লোচন,
আপিঙ্গ মূর্দ্ধজা জাল ঝাড়ি মাথা নাড়ি।
"প্রভো, দেহ আজ্ঞা মোরে, রক্তবীজ আমি,
রক্তবীজ একবার বপি এসংসারে।
মাথায় পড়িতে ঘা হস্ত তাহা রাখে,
আমরা থাকিতে দেব আপনি সংগ্রামে,
দনুজ কুলের শির? ভাঙ্গিতে কি হবে
চণ্ডীকার রণতৃষা আপনার স্বেদে?
হাসিবে যে স্বর্গ মত্ত, হাসিবে সংসার।”
দোঁহাকার মুখ পানে চাহিলা দৈত্যেন্দ্র।
গম্ভীর ভাবেতে তবে বসি সিংহাসনে
কহিলা সুগ্রীবে;—"দূত, বল দেখি শুনি,
কি কৌশলে চণ্ডমুণ্ডে বধিলা সমরে
চণ্ডী, দেবগণে লয়ে। বীরেন্দ্র কেশরী
আছিলা দুভাই। কার সাধ্য কে বা বধে
ন্যায় যুদ্ধে দোঁহে, যক্ষ রক্ষ দেবমাঝে।
"তুলি ঘাড় করযোড়ে পুনঃ কছে দূত;—
"সত্য, দেব, কার সাধ্য ন্যায় যুদ্ধে বধে
ত্রিলোক বিজয়ী বীর চণ্ডমুণ্ড দোঁহে।
সংক্ষেপে বিবরি তবে ঘোর যুদ্ধ কথা;—
মায়াবিনী মহামায়া একাকিনী রণ
করিবে, করিল পর্ণ প্রথমতঃ, মুণ্ড

কহিলা তাহারে “ধনি, একাকিনী রণ
করিবারে চাহ যদি যুঝ মোর সাথে।
আমিও তোমার সাথে করিলাম পণ,
একাকী করিব যুদ্ধ। না ধরিবে অস্ত্র
সৈন্যগণ কেহ; অস্ত্র না ধরিবে চণ্ড,
বীরত্ব অনল শিখা, দেবের আতঙ্গ।”
সম্মত হইলা চণ্ডী মুণ্ডের কথায়।
বাজিল বিঘোর যুদ্ধ তবে দুই জনে।
আগুন উঠিয়া যেন গেল বসুধায়
দোঁহাকার পরাক্রমে। বুজিল আকাশ
নিবিড় শরের জালে; হুহুঙ্কার রবে,
বায়ুপারাবারে ঘোর বহিল তুফান।
ভীষণ সংগ্রাম হেন হলো কত কাল।
পরে পরাভূত চণ্ডী হয়ে মুণ্ড তেজে,
দাঁড়াইলা রণস্থলে, ম্রিয়মাণা মুখী।
বিদ্রূপে কতই লজ্জা দিলা মুণ্ড তারে।
স্তব্ধ প্রায় থাকি ক্ষণ সহসা কোথায়
অন্তর্হিতা হলো সতী; যেন লজ্জাতপে,
দ্রবীভূত হয়ে ধনী মিশাল উহায়।
অবাক হলাম মোরা, দেখি হেন ভাব!
বুঝিলাম তবে সত্য, মায়াবিনা বামা।
হত জ্ঞান হয়ে মুণ্ড চাহিলা চৌদিকে।

উঠিলা পর্ব্বত চুড়ে, হেরিলা সংসার।
দেখিতে না পেলা কিছু; লজ্জায় তখন,
অধোমুখে বীরবর রহিলা দাঁড়ায়ে।
কি বলিব দৈত্যরাজ, বিস্ময় ব্যাপার,
সহসা উদয়ে মেঘ যথা গিরি আগে,
চকিত নয়নে দেখি সেই প্রমদ্বরা,
ভীষণ মূরতি ধরি আসিয়াছে এবে।
মনোলোভা হাব ভাব, সুবর্ণ বরণ
নাহি আর; ঘোর শ্যাম স্থূল দীর্ঘকায়,
বিকট দশনাবলি লক্‌লকি জিহ্বা,
রুক্ষ মুক্ত কেশজাল আরক্ত নয়ন।
চিনিলাম কালী মূর্ত্তি; বুঝিলাম তবে
মহামায়া মায়া। কালী একাকিনী নহে,
দেখিলাম সাথে সে তেত্রিশ কোটি দেব,
যক্ষ রক্ষ মাতৃগণ অসংখ্য অপার।
ভয়ঙ্করা মূর্ত্তি মুণ্ড, দেখালা চণ্ডেরে;
সমরে যাইতে আজ্ঞা চাহিলা ভায়ের।
নিষেধিলা মুণ্ডে, চণ্ড, একাকী যুঝিতে।
কহিলা, সসৈন্যে গিয়া যুঝিতে দুজনে।
রোষিয়া কহিলা মুণ্ড; 'আমার সনেতে,
যুদ্ধ হতেছে চণ্ডীর, তুমি কেন তাহে
দিবে হাত? দৈত্যকুল নহেক নিস্তেজ,

কাতর এখন মুণ্ড হয় নাই রণে,
কেন বা লইব বল, সাহায্য তোমার?
আর না বলিলা কিছু তারে তবে চণ্ড।
প্রেম আলিঙ্গনে রণে বিদাইলা ভায়ে।
টঙ্কারিয়া ধনু তবে অগ্রসরি বীর
আরম্ভিলা রণ। কালী মহারৌন্দ্রারূপী
হইলা দেবের বলে। ভীষণ সংগ্রাম
হইতে লাগিল। মোরা সবিস্ময়ে দেখি,
ভ্রমিছে বীরেন্দ্র বীর দৈত্যকুল শ্লাঘা
সে সমরানলে একা, শান্তি নিরাপদে;
ভ্রমে অগ্নিগোধা যথা পাবক রাশিতে।
কতক্ষণে বীরবর হয়ে জ্বালাতন
অজস্র দেবের বাণে, রোষিয়া উঠিলা।
মহামার মূর্ত্তি বলী ধরিলা তখন।—
কভু লয়ে ভীমগদা, কভু ধনুর্ব্বাণ,
কভু তীক্ষ্ণ অসি, কভু বা ত্যজিয়া অস্ত্র,
রিক্ত হস্তে বীর, ঘোর ঘূর্ণাবায়ুসম
ঘুরি রণ স্থলে দর্পে, যুঝিতে লাগিলা।
ভঙ্গ দিল দেবগণ যক্ষ রক্ষ ত্রাসে।
একাকিনী রণ ভূমে রহিলা ভৈরবী;
নীরব সে রব এবে চকিত নয়ন।
অস্ত গেল দিবাকর, এল নিশীথিনী।

উৎসাহ বচনে তবে ডাকিতে লাগিলা
ইন্দ্রাদি অমরগণে, যক্ষ রক্ষে কালী।
সাহসে করিয়া ভর, চণ্ডীর বচনে
পুনরপি দেব সৈন্য আসি দিল হানা।
প্রাণ পণে যুদ্ধ সবে লাগিল করিতে।
ঘোর পরাক্রমে মুণ্ড যুঝিতে লাগিলা।
ছিন্ন ভিন্ন হলো ঠাট অমর গণের।
কতক্ষণে তবে নিশা হলো অবসান;
অবসান করি মরি মো সবার আশা।
কি বলিব ভূপ, বুক বিদরে বলিতে,
পড়ে যথা পুনঃ পূনঃ কুঠার অঘাতে
ক্ষীণ-মূল হয়ে তরু, পড়িলা বীরেন্দ্র
পুনঃ পূনঃ দেবগণ ভীষণ আক্রমে
হয়ে ক্ষীণ বল, সারা দিবা রাত্রি যুঝি,
প্রভাতে, কালীর শেলে। উচ্চৈঃস্বরে চণ্ড
ধরিয়া ভায়ের গ্রীবা কত যে কাঁদিলা
কেমনে বর্ণিব দেব। শুনি সে বিলাপ
নীরবিল পাখি কুল, নিস্পন্দ মরুত,
মৌনভাবে হিমাচল রহিল বিষাদে!—
সংসার হইল মৌন যেন তার দুঃখে।
করিলা প্রতিজ্ঞা চণ্ড মহা শোক ভরে;
'না করিব চেষ্টা আর রক্ষিতে জীবন,

ধরিব না অস্ত্র আর দেব বিপরীতে।'
আপনার নাশ হেতু নিশ্চেষ্ট হইয়া
ভ্রমিতে লাগিলা বীর রণভূমে। কালী
বধিলা তাঁহারে তবে, বক্ষে হানি শেল;
পাইলে নরম মাটী হানে যথা শৃঙ্গ,
বৃষবর।” নীরবিল দীর্ঘশ্বাসে দূত।
শেল বিদ্ধ মনে শুম্ভ কহিলা নিশুম্ভে!—
"দেখ ভাই, মহামায়া পাতি মায়াজাল
দেবগণে লয়ে, দৈত্য কুলের প্রদীপ
বধিয়াছে চণ্ডমুণ্ডে অন্যায় সমরে।
ধৈর্য্যে নিবারিতে নারি ক্রোধের উচ্ছ্বাস;
ধরিতে না থামে কর, করবারোৎসরু
প্রতিবিধানিতে এর। ক্ষান্ত আমি রণে
তোমাদের কথামতে। (রক্তবীজ পানে
চাহি কহে) উঠ উঠ রক্তবীজ, তোমা
বরিলাম আমি, ভাই নিশুম্ভের সহ,
দৈত্য সেনাপতি পদে; রাখ কুল মান,
ছিন্ন করি দেব কুল বক্ষ রক্ষ আর।”
নীরবি চাহিলা বীর দোহাকার পানে।
"বৃথা গর্ব্ব করি রণে না যাব ভূপাল,
(কহিলা সে রক্তবীজ উঠি দাঁড়াইয়া;)
কার্য্যেতে প্রকাশ হবে বীরত্ব যেমন।”

ঘাড় নাড়ি তাহে সায় দিলেক নিশুম্ভ।
মাতিলা অমনি দোহে রণ আড়ম্বরে;
ঘন আড়ম্বরে যেন মাতিল পরাহ্ন
বৈশাখের। কোলাহল উঠিল বিঘোর।
আকাশ ভাঙ্গিয়া রবে বাজিয়া উঠিল
দুন্দুভি। দনুজ সৈন্য কাতারে কাতারে
বেরুতে লাগিল; অশ্ব রথ গজ শ্রেণী
অগণন; চতুরঙ্গে আচ্ছাদিল ধরা।
নীলিমা সংসার যেন লক্ষিত হইল;—
আকাশ বিস্তার নীল, নীল অম্বুনিধি,
বসুধা হইল নীল অসুরের শিরে।
প্রবল পবনে যথা জলধির জল,
কিম্বা পাত্রপূর্ণ বারি অনল উত্তাপে,
আলোড়িত ধরাহৃদ হইতে লাগিল,
অসুর কুলের ঘোর দর্প সঞ্চালনে—
কেহ চড়ে অশ্বে, কেহ গর্জ্জি গজবরে,
কেহ ধায় অস্ত্র আশে, ঘুরে কেহ বৃথা,
নাহি থামে পদ যেন উৎসাহের তেজে।
এবে যথা মরুভূমে প্রলয়ের ঝড়ে
উড়ি চলে বালু রাশি আঁধারিয়া দিক,
চলিল দনুজ সৈন্য আচ্ছাদিয়া ধরা
প্রচণ্ড প্রতাপে, দিক আকুলি রৌরবে—

চলিল সংসার যেন আর কোন স্থানে!
কতক্ষণে দেখা দিল লে বিষম ব্যূহ
হিমাচল আগে, খর্ব্বি শৈলরাজ গর্ব্ব—
বিশাল বিস্তার মহা দিগন্ত ব্যাপিয়া,
ভুঙ্গতর শৃঙ্গ যাহে নিশুম্ভের শির।
দাঁড়াইল সৈন্যগণ গভীর নীরবে,
চিত্রপট চিত্রসম স্পন্দন রহিত।
বিজলী ঝলক সম ঝলিতে লাগিল
খর অস্ত্র বিভা তাহে, চমকিয়া আঁখি।
সঞ্চলে অনল শিখা ধূম পুঞ্জে যথা,
ফিরিতে লাগিলা দর্পে সে বিষম ব্যূহে
নিশুম্ভ, উজ্জ্বল ধ্বজ উড়ায়ে রথের,
প্রখর তুরঙ্গোপরে বীর রক্ত বীজ।—
বিজলিতবিভা বর্ম্ম অঙ্গে দোঁহাকার,
সমুন্নত শিরোপরে উজ্জ্বল মুকুট;
সারসনে দৃঢ় কটি আঁটা সযতনে,
ঝোলে তীক্ষ্ণ অসি তাহে কালের রসনা;
দীপে খর দীর্ঘ শূল ভীম ভুঝবরে,
ক্রোধের লোচন সম পৃষ্ঠেতে ফলক।
এদিকে দেবের বুক বেড়েছে দ্বিগুণ
চণ্ড মুণ্ডে বধি। নাহি আর সে আকাশ
উচ; হাতেতে মিলিছে স্বর্গ রুদ্রাণীর

বলে—শিখা উড়াইয়া অগ্নি ভ্রমে রঙ্গে
রণভূমে; পবনের আস্ফালনরব
স্বন স্বনে, বরুণের রব কল কলে
কে পাতিতে পারে কাণ। যমের মহিষ,
সদর্পে তুলিয়া ক্ষুরে ফেলিতেছে দূরে,
রণক্ষেত্র মাটি। তৃণ জ্ঞান করি যেন,
ঐরাবত, অসুরের বলে, শুঁড়ে করি
ছিটায়ে ফেলিছে ধূলি। আর সকলের
গর্ব্বিত লোচন পানে তাকান না যায়।
গম্ভীর ভাবেতে তবে অগ্রসরি কালী
কহিলা অমর কুলে;” দেখ দেবগণ,
দেখ হে বজ্র পাণিন্‌, কালান্তক কাল,
দণ্ডধর; পাশধর তাপদ বর্হ্নিন,
আর দেবগণ যত, যক্ষ, রক্ষ, সবে;
দেখি দেখি একবার (মত্ত জয়োল্লাসে),
দেখ দেখি চেয়ে, আজি কেমন ভীষণ,
ঘোর আড়ম্বরে দিল হানা দৈত্যকুল;
দেখি নাই শুনি নাই কভু কোন কালে,
প্রাণী সমবেত হেন; দেখেছি শরদে,
পত্রেতে আচ্ছন্ন ধরা; অমার রজনী
ঘোরা, নিবিড় আঁধারে। দেখি নাই কভু,
এহেন বিঘোর ভাব; ঘোরতর আরো,

যাহা, দেখ দর্প রাগে। নিশুম্ভ আপনি,
বীর রক্তবীজ সহ, সৈন্য অধিপতি।
অগাধ ব্যূহের মাঝে উন্নত দুজনে,
সাগরের মাঝে যেন যুগ্ম জলস্তম্ভ।
ত্যজ বৃথা মত্ত ভাব, ভাব এবে কিসে
রক্ষা হবে কুলমান, অমর কুলের।”
নীরব হইলা চণ্ডী এতেক কহিয়া।
পড়িল মানের ঘা কালীর বচন,
যেন সুখ নাচনীয় ত্রিদশগণের।
স্তম্ভিত অমনি বাত, অনলের সহ;
নীরব প্রচেতা; ঊর্দ্ধমুখে চারিদিকে
চাহে যমের মহিষ; নত ক্রমে ক্রমে
ঐরাবত ঊর্দ্ধ শুণ্ড; স্থির আর সবে।
বিনীত বচনে তবে কহিলা বাসব;—
"মাতঃ, বাস্পের প্রভাবে, উন্নত আকাশে
উঠে যথা ব্যোমযান, তোমার প্রভাবে,
পাইব আমরা পুনঃ সে সুখ সদন,
অমর নিবাস। গতি, রোধিব মেঘের
অচল হইয়া মোরা আজি তব বলে।
আর কি হারাই দিক, এ রণসাগরে,
কাণ্ডারী যখন নিজে আপনি মোদের?
কেননা করিব রঙ্গ এ সমরে মোরা?”

পুলকে নাড়িয়া ঘাড় তবে করালিনী;
"বীর বাক্য এই ইন্দ্র, ইহাইত চাই;
অমর যেমন মোরা, অটল যদ্যপি
হই রণে, তবে বল, কে আঁটে মোদের?
ধর সবে অস্ত্র, আর বিলম্বে কি ফল?”
আস্তে ব্যস্তে দেবগণ অমনি ধরিল
নিজ নিজ অস্ত্র; ঠনঠন অস্ত্র রব,
ধ্বনিল অমনি, এক প্রান্ত হতে আর,
অমর ব্যূহের; কেহ উলাঙ্গিল অসি,
কেহ টঙ্কারিয়া ধনু উন্মোচিল বাণ,
কেহবা প্রখর শেল আস্ফালিল রোষে।
এবে যথা মহাগ্রহ ব্রহ্মাণ্ডের পথে,
প্রতিঘাত পেলে দুই, ভীষণ নিনাদে
উছলি কালাগ্নি ঘোর, আকুলি আকাশ
চূর্ণমার হয় শেষে; দৈত্যকুল ঠাট
আক্রমিল দেব ঠাটে মহাপরাক্রমে,
অমর কুলের ঠাট নিল সে আক্রম।
জ্বলিল সমর অগ্নি প্রলয় মূরতি,
বিকট রৌরবে দিক্‌ আকুল হইল।
ছিন্ন ভিন্ন হলো ব্যূহ উভয় কুলের।
উড়িল বিষম ধূলি আঁধারিয়া সৃষ্টি,
যেন সূর্য্যদেব মার, আবরিল মুখ,

সাক্ষী না হইতে হেন বিষম কাণ্ডের!
যুঝিতে লাগিল সবে অটুট উত্তেজে
বিরাম ন লভি ক্ষণ, বিরাম যাবৎ
নাহি লভিছে অনন্ত। প্রত্যেক সৈন্যের।
পড়িছে মাথার ঘাম পদযুগ বহি;
উত্তেজিত বক্ষস্থল প্রতি হিংসা লাগি;
জ্বলিছে আঁখিতে কোপ, ভ্রূকুটে প্রতাপ।
করবারে করি পথ, পশে সবে ক্রমে,
গভীর সমর যথা, উচ্চতর করি
পথ, শবরাশি দ্বারা, যাবৎ না পড়ি
ভূমে, আপনি হতেছে পথ অপরের।
অশ্ব আক্রমিছে অশ্বে, কভু গজবরে,
গজ আক্রমিছে গজে, কভু শুণ্ডাঘাতে,
ভাঙ্গিছে রথের ধ্বজ, অশ্বের পাঁজর।
অমার রজনী যথা ঘোরা ক্রমে ক্রমে;
রণ দৃশ্য ঘোর ক্রমে হইতে লাগিল।
ডুবিল সংসার যেন কাল অন্ধ কূপে!
এহেন বিঘোর ঘোল হলো অবশেষে,
বিপক্ষ স্বপক্ষ কেহ চিনিতে না পারি
বধিতে লাগিল প্রিয় বান্ধবে বান্ধব,
দেব সেনা অনুগত দৈত্য অধ্যক্ষের,
দেব অধ্যক্ষের আজ্ঞা পালিছে অসুর।

কতক্ষণে তবে কালী বিঘোর বদনা
হেরিলা সে রণ ক্ষেত্র ফিরাইয়া আঁখি;
নয়নের রোষ রাগ চমকিল যেন
বিদ্যুৎ, অরির মনে। দূরে ভয়ঙ্করী,
হেরিলা সে রক্তবীজে, যুঝিতেছে বীর
নিদাঘ অনল সম প্রভূত প্রভাবে।
ঝঞ্ঝাবাত তোড়ে আসি আক্রমিলা তারে
তবে চণ্ডী; মহাযুদ্ধ বাজিল দুজনে।
স্তম্ভিত সংসার হলো উভয়ের দাপে।
উভয়ের অস্ত্রাঘাত উভয়ে বারিতে
লাগিলা ফলকে; ক্রোধে অধীরা দুজনে।
হানিলা প্রখর শর গর্জ্জি তবে ভীমা,
রক্তবীজ ডানি করে; ছাড়িলা অমনি
অর্দ্ধ আকর্ষিত ছিলা কাতরে বীরেশ।
মহা ক্রোধানলে তবে জ্বলিয়া উঠিলা,
লোহিত হইল গাঢ় সে তাম্র বরণ;
প্রবাল অচল যেন বালার্ক কিরণে।
লোহিত হইল গাড় সে তাম্র বরণ;
থর থর করি অঙ্গ কাঁপিতে লাগিল।
বিকট চিৎকার তবে করি বীরবর,
প্রহারিলা ভীম গদা চামুণ্ডার হৃদে;
মূর্চ্ছিতা হইয়া সতী পড়িলা ভূতলে,

দর দর রক্তধারা বহিতে লাগিল
কুচযুগ ফাটি; মরি, সরস দাড়িম
ফাটিল সহসা যেন, কিম্বা যুগ শৈল,
উদ্গীরিতে প্রস্রবণ লাগিল রক্তের।
কতক্ষণে সচেতন সহসা আপনি
ভীমা; আলোড়িত তনু মহাক্রোধ ভরে
দুলিতে লাগিল ঘন মুক্তকেশ জাল।
ধরি অসি পুনঃ শ্যামা আক্রমিলা রোষে
রক্তবীজে; ক্ষণে মাত্রে, জর জর অঙ্গ
করিলা শূরের রক্তে, ভাসাইয়া ধরা।
কিন্তু কি আশ্চর্য্য! তেজ বাড়িতে লাগিল
অসুরের, যত রক্ত পড়ে বসুধায়,
পুনঃ পুনঃ কালিকার প্রচণ্ড আক্রমে;
নির্ব্বাণ না হয়ে অগ্নি জ্বলে যথা আরো
বায়ুর আক্রমে। অবসন্ন তবে কালী,
দাঁড়াইলা রণে; দিক্‌ দেখিতে লাগিলা
রক্তবীজ ময় যেন; এক এক বিন্দু
রক্ত পড়ি যেন ভূমে দনুজ শ্রেষ্ঠের,
প্রসবিছে কোটি কোটি নূতন অসুর
সতেজ শরীর। দেরী অবাক হইলা।
গণিতে লাগিলা মনে বিষম বিপদ।
তমময়ী যবনিকা হেন কালে নিশা

ফেলিলা সহসা হেন মৃত্যু রঙ্গ ভূমে;
যেন সেই ঘোর যুদ্ধ ঘোরতর ক্রমে
হইতে হইতে হলো ঘোরতমময়!
বাড়িল দনুজ বল রজনী আগমে।
ভঙ্গ দিয়া দেব সৈন্য পলাইয়া ত্রাসে
হিমাদ্রি শেখরে গিয়া লইল আশ্রয়;
মূলেতে আশ্রয় যথা লয় বৃক্ষ ছায়া,
মধ্যাহ্নে রবির কর প্রখর নিরথি।
হেথা রণভূমে চণ্ডী একাকিনী মাত্র,
বিবর্ণাবরণী সতী স্বদল বিচ্ছেদে;
বিবর্ণ যেমন বারি পৃথকিলে কিছু
অম্বুরাশি অম্বু হতে। একাকিনী আর
বৃথা রণ ভূমে ভীমা থাকিতে না পারি
দেখা দিলা ধীরে ধীরে যথা দেবগণ।
সসন্ত্রমে উঠি সবে প্রণমিলা তাঁরে।
বসিলা শৈলেশ বালা শিলাপট্টোপরি;
বসিল অমর সৈন্য পরে একে একে
নীরবে, নীরবে যথা বসে খগকুল
নিশীথে বিটপে; মরি, লজ্জার তন্ত্রায়
অবসন্ন হয়ে যেন!—কেহ হেটমুখে,
কেহ দিয়া গালে হাত, কেহ তাকাইয়া
অনন্য মানসে এক দিকে। কতক্ষণে

উঠি তবে হৈমবতী কহিতে লাগিলা;
"বল, ওহে অস্ত্রিকূল, অস্ত্র ধরি যাঁরা
সমবেত এবে হেথা ত্রিদিব রাজ্যের,
নানা অন্তরাল হতে, কৃত কল্প হয়ে
অসুর বিনাশে, বল অসীম তেজস্বী,
সে অসুর কুল হবে কেমনে বিনাশ!—
কেমনে নিবিবে ঘোর রৌরব অনল?
দেখ চেয়ে মোর পানে;—(দেখাইলা সতী,
হেরিয়া আপন অঙ্গ আপনি, সকলে)
দেখ রক্তে স্নাত আমি অসুরগণের।
কেমন ভীষণ শক্তি প্রকাশিয়া আজি
যুঝিয়া ছিলাম, সবে করেছ প্রত্যক্ষ।
দেখেছিও আমি, তোমা সবে প্রকাশিতে
অসীম সাহস; কিন্তু দেখ কি আশ্চর্য্য!
না টুটি অসুর বল, বাড়িছে ক্রমশঃ
অগণ্য শোণিত পাত, মোদের প্রভাবে
হতেছে ধরায় যত; অনল প্রতাপে
না কমি বুদবুদ কুল বাড়ে যথা জলে।
দেহ উপদেশ মোরে, কি সৎ ইহার?”
বিস্ময় গম্ভীর ভাবে কহে তবে ইন্দ্র,
গভীর চিন্তায় ভারি সহস্রলোচন;—
"মাতঃ! কি আর বলিব? অবাক হয়েছি

মোরা, দেখি রক্তবীজ প্রচণ্ড প্রভাব!
কেমন তেজস্বী রক্ত বহে তার শীরে,
বলিতে না পারি; বিন্দুমাত্র ভূমে যাহা
পড়িতে পড়িতে, কত অগণ্য অসুর
সমতেজী, প্রসবিছে প্রত্যেক অণুতে—
না জানি সম্বন্ধ কিবা আছয়ে বিশেষ,
রক্তবীজ রক্ত সহ বসুধার। রক্ত,
ভূমে নাহি পড়ি যাহে মরে দৈত্যবর,
এহেন উপায় কোন করগো জননি।”
উঠি স্বন স্বনে তবে কহিলা পবন;—
"কি চিন্তা তাহার? যদি মরে রক্তবীজ,
যত পড়ে রক্ত আমি সব উড়াইব
অসীম আকাশে। সখা মোর সর্ব্বভুক;
ভক্ষিবেন বসি সুখে শোণিতের রাশি।”
ধক্‌ধকে তবে অগ্নি ভাষিলা বিনয়ে;—
"মাতঃ! সর্ব্বভুক আমি, বসে বসে পারি
ভক্ষিতে সংসার, যদি বিঘ্ন নাহি ঘটে।
বরুণের সহ মোর না বনে কখন,
কিম্বা, সখার আমার। বরুণ যদ্যপি
না যান সমরে, মোরা অবশ্য সাধিব
দুরুহ সাধন; কিন্তু তাও বলি মাতঃ!
সম্মুখ সমরে মোরা তিষ্ঠিতে নারিব,

দনুজের; বল তার কি হবে উপায়?”
"জঠরে আমার তুমি থেকো নিরাপদে
বহ্নি; (কহিলা ঈশানী) থাকিবেন বায়ু
বিকীর্ণ মূর্দ্ধজা জাল অভ্যন্তরে মোর।
না চাহি বরুণে মোরা আর কোনজনে
আজি। যুঝুন তাঁহারা, ইন্দ্র আদি সবে
প্রাণপণে ক্ষণকাল নিশুম্ভের সহ,
যে তক না বধি মোরা রণে রক্তবীজে।
পড়িলে সে রক্তবীজ সবে মেলি যুটি
বধিব নিশুম্ভে; নৈলে যদি দুই বীর
যুঝে একযোগে, জয় হইবে সন্দেহ।
কেমন বাসব তুমি কি বল ইহার?”
(কহিলা ভবানী চাহি শক্র মুখ পানে)।
কর যোড়ে সবিনয়ে উত্তরিলা ইন্দ্র;—
"তব আজ্ঞা অনুবর্ত্তী মোরা চিরকাল,
জননি, অবশ্য মোরা নিশা অবসানে
আক্রমিব দৈত্যবরে প্রভূত সাহসে।
চেতন থাকিতে তারে নাদিব কদাচ
সহায়িতে রক্তবীজে, যা থাক ললাটে।”
"তাহাই হইবে ইন্দ্র, হইল নিশ্চয়
(কহিলা শঙ্করী) এবে পান ভোজনেতে
শ্রান্তি দূরি লভ সবে বিশ্রাম; ঐ দেখ,

ঝিল্লীরবে গায় নিশা বিরাম সঙ্গীত।”
খুলিতে লাগিল সবে বীর আভরণ,
শীর্ষক, কঞ্চুক, চর্ম্ম সারসন আদি।
ছাড়িলা ধনুর মুষ্ঠি, উন্মোচিলা তূণী।
পূত প্রস্রবণ জলে মার্জ্জি কলেবর
সুখ সেব্য পেয় ভোজ্য ভুঞ্জি মহাসুখে
বিনিদ্র হইল ত্বরা হিমাচল শিরে।
এদিকে অসুর কুল জয়োল্লাস রঙ্গ
পরিহরি তবে, রণক্ষেত্র মাঝে ক্রমে
লভিল বিরাম; মরি শান্তির চাদর
বিছাইল যেন কেহ ধরণী উপরে।
কতক্ষণে তবে উষা আসি দেখা দিল,
বিচিত্র সুচিত্র পট দুকরে দুখানি;—
বিরাম রঙ্গেতে লেখা বামকর পট,
দক্ষিণ করের খানি অনুরাগ রঙে।—
বিরাগে লিখিছে ধনী;—যাইছে চন্দ্রমা
অস্তাচলে, তারা দলে লয়ে; অবসন্ন,
বিবর্ণ বরণ নিশা পতির বিয়োগে;
সম্বরিছে সুখ লীলা সজল নয়নে,
মরি, কুমুদিনী কুল! পশিছে শ্বাপদ,
দুরাচার, ধীরে ধীরে নিভৃত নিবাসে।
অনুরাগে যথা;—রবি সহস্রাশু, পুনঃ

প্রাপ্ত স্বর্গরাজ্য, ব্যোমচর জয়োল্লাসে;
সুখে সরজিনীমুখ প্রফুল্ল হতেছে;
নিরীহ যতেক জীব নিশাভোর দেখি
ত্যজিয়া অলস ভার গাত্র ঝাড়া দিয়া,
নির্ভয়ে নির্গত এবে বিচরণ আশে।
লইলা প্রথম পট সে দিনের লাগি
দৈত্যকুল; সুরকুল দ্বিতীয় ফলক।
বাজিল দুন্দুভি পুনঃ আর বাদ্য যত,
নাচিল তাহার তালে সেনাকুল বুক।
অজস্র অমর সৈন্য নির্ঝরের প্রায়
অধিত্যকা দেশ হতে নামিতে লাগিল;
নানা পথবহি। নানা দেশ দিয়া যথা,
বহি তরঙ্গিণী কুল, অগাধ সলিলে
শেষে হয় পরিণত, বিষম সমষ্ঠি,
ত্রিদিব সৈন্যের হলো রণক্ষেত্র মাঝে।
এদিকে অসুর কুল নিদ্রা ত্যজি এবে
দাঁড়ায়ে উদ্যত অস্ত্রে সমরের আশে,
অধৈর্য্য উত্তেজে বক্ষ বাজে দর দর।
কতক্ষণে বজ্রনাদে নিশুম্ভ আদেশ
অসুর ব্যূহের কর্ণে ধ্বনিত হইল।—
মিশাওরে বীররণ মিশাও রে ত্বরা,
অনল প্রভাব তব, অমর কুলের,

তৃণসমক্ষীণ বলে; উকাসম ছুটি
পড়, পড় রক্তবীজ, আতস বাজীর
কাচ, দেবগণ এই ব্যূহ রচনায়;
দেখাওসে রণ রঙ্গ রঙ্গে কালিকায়।
টলিল বিকট ঠাট; ঘোর ভূকম্পনে,
টলিল সহস্র চূড় শৃঙ্গধর যেন।
মড় মড় রবে সৈন্য চলিল ধাইয়া।
এদিকে অমর ব্যূহ অটল সাহসে,
প্রস্তুত আস্ফালি অস্ত্র লইতে দৈত্যের,
ভীষণ আক্রম, অঙ্গ অধীর ক্রোধেতে।
এবে যথা দাবানল লাগিলে দুদিকে
গহন কাননে, উল্কারাশি ছুটি পড়ে
ইহার উহাতে বেগে, বহু দূর থেকে,
ক্রমে যদি সেই অগ্নি মিশে পরস্পর
প্রচণ্ড অনল শিখা তর তর তরে
পরশে গগণ, ধূমে আঁধারে সংসার,
ঘোর চট্‌পট্‌ নাদে পূরে দিক্‌দশ,
আকুল পরাণ, ত্রাসে ছুটে বনচর,
তেমতি উভয় দল খর শর জাল
প্রজ্বলিত বিভা, আগে ছাইল গগণ
দূর হতে, পরে যবে মিশিল দুদলে,
বিষম সমরানল জ্বলিয়া উঠিল।

ধূমাকারে ধূলি উড়ি আঁধার আকাশ,
মৃত্যুর চিৎকার রবে পূরিল সংসার;
ত্রাসেতে পলায় প্রাণী সংসার ছাড়িয়া।
যথা প্রলয়ের ঝড়ে নিবিড় কানন,
বিরল পল্লব পত্র, বিরল অনীক
হইল তেমনি ক্রমে সে সমর ক্ষেত্র।
কর্দ্দমিত হলো ধরা শোণিত স্রোতেতে।
আর না উড়িল ধূলি গগন আঁধারি,
দেখিল জগৎ তবে ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি,
সে সমর বিষ ফল! মুদিত নয়নে
পড়েছে অগণ্য বীর তীক্ষ্ণ শেলাঘাতে,
বাহির করিয়া জিহ্বা; কাহার ভেঙ্গেছে
শির; ঘোর দণ্ডাঘাতে রক্তধারা বহি
ভেসেছে কপোল বক্ষ; ছিন্ন মুণ্ডকার
গড়াগড়ি পাড়ি; মাখি রক্তের কর্দ্দম
হয়েছে ভীষণ; কেহ সাংঘাতিকাঘাতে
ত্যজিছে পরাণ, তবু জ্বলিছে নয়ন
ক্রোধে; জ্বলে যথা বহ্নি, ফুরালে সমিধ
ক্ষণকাল, ঝল মলে পাইতে নির্ব্বাণ।
যুঝে যারা এবে, যুঝে যেন তারা সবে
মৃত্যু মূর্ত্তিমান হয়ে;—কুটিল ললাট,
আলু থালু দীর্ঘকেশ, জ্বলে রক্ত আঁখি;

বিকট দশনে চাপা কম্পিত অধর,
রক্ত সিক্ত কলেবর ভীষণ দর্শন।
কত ক্ষণে পরে ইন্দ্র ফিরাইয়া আঁখি
হেরিলা নিশুম্ভশূরে, নিজ দলে লয়ে
দেবদলে দলে বীর প্রমত্ত বারণ।
ব্যথিত অন্তরে বলী, নিশুম্ভ উদ্দেশে,
ঐরাবত কুম্ভ দেশে হানিলা অঙ্কুশ।
ঊর্দ্ধশুণ্ড গজবর চিৎকার নিনাদে
ছুটিল উঠায়ে ঝড় মর্থব্যথা পেয়ে;
অন্তর আগুনে যথা বিকট নিনাদে
ছুটে বাস্প যান, বেগে, ঊর্দ্ধ ধূম নল।
ধাইলা তাহার সাথে কালান্তক কাল
দণ্ডধর, তাড়াইয়া ভীষণ মহিষ।
উজ্জ্বল পুষ্পক ধ্বজ উড়ায়ে বিমানে,
চলিলা তাহার পিছে পৌলস্ত কুবের;
চলিলা বরুণ, পাশী, আর দেব যত
যুটিলা অমর বল যে যে খানে ছিল
এক কালে আসি, বীর নিশুম্ভের আগে।
যেমতি নাবিক কোন অকূত সাহস,
তাচ্ছল্যি প্রবল বাত্যা উড়ায়ে বাদাম,
চালায় তরণী রঙ্গে, কাটি ঊর্ম্মিকুলে,
সহসা মসিনাজল দেখিলে সম্মুখে,

বিস্ময়ে ফেলিয়া পালি, দাঁড়ায় অবাক;
দাঁড়াল নিশুম্ভ শূর থামাইয়া রথ,
অমর সেনানী কুলে দেখিয়া সম্মুখে,
সমর তরঙ্গ রঙ্গ ক্ষণ পরি হরি।
ফিরাইয়া আঁখি বীর নিমিষে হেরিলা,
সকলের মুখ; চিত্রকর চিত্রাগার
চিত্রাবলি যথা হেরে কোন আগন্তুক!
ধরিলা ধনুক বীর তবে দর্প ভরে,
ধরিলা অমর কুল নিজ নিজ অস্ত্র।
বাজিল তুমুল যুদ্ধ হেথায় নূতন।
ওদিকে ভৈরবী ভীমা হুহুঙ্কার নাদে,
অগ্নি, বায়ু, যক্ষ, রক্ষ, মাতৃগণে লয়ে
পশিলা অসুর ব্যূহে রক্তবীজ যথা।
গভীর গরজে মহা বিঘোর কল্লোলে,
উথলিল রণ সিন্ধু; ফেলিল মুখস,
হইল অশ্বের ত্বরা; ঝর ঝরে মদ,
ঝরিল মাতঙ্গ শুণ্ডে; টস্‌ টসে শ্বেদ
গলিল সৈন্যের দেহে; প্লাবিত ধরণী
হইল শোণিত পাতে; ভাসিল সংসার,
মরি, আঁখি নীরে যেন হেন উৎপীড়নে!
কত ক্ষণ পরে তবে চাহিয়া চামুণ্ডা
হেরিলা সে রক্তবীজে; প্রলয়ের প্রায়

আসিছে বিনাশি বীর বিপক্ষ সমূহে।
ছাড়িয়া অশ্বের বল্‌গা দুকরে দুখান,
চালাইছে করবার, পড়িছে লাফায়ে
পদের আঘাতে অশ্ব, কভু আগে, কভু
বামে, কভু বা দক্ষিণে; অযুত সৈন্যের
স্থান যুড়ি বীরবর করিছে সমর।
আস্ফালিয়া অসি চণ্ডী আক্রমিলা তারে।
বাজিল দুজনে যুদ্ধ প্রলয মূরতি।
নিদাঘ মধ্যাহ্নে যেন লাগিল আগুন।
ফাটিয়া যাইতে মরি লাগিলা মেদিনী
উভরের পরাক্রমে; ফাটিল আকাশ,
বিকট চিৎকার রবে; ছিন্ন ভিন্ন বায়ু;
ঘন অস্ত্র সঞ্চালনে; তিতিলা উভয়ে,
উভয়ের অস্ত্রাঘাতে শোণিত ধারায়।
গর্জ্জি মহারোষে তবে আসি রক্ত বীজ
প্রহারিলা ভীম গদা চামুণ্ডার করে;
খসিয়া পড়িল আসি ভূমে হাত হতে
কাঁপি থর থরে; নত কৈলা হাত দেবী
কাতরে ক্ষণেক। ক্রোধ প্রজ্বলিত চোখে
হেরিলা বিকট ভাবে তবে রক্ত বীজে।
নিমেষে অমনি তুলি লয়ে করবার
প্রবল বাত্যার সম নাহি মানি রোধ,

কাটিয়া পাড়িলা মুণ্ড আসি দনুজের;
অনলের শিখা যেন বিভা জল ঝড়ে;—
বিচ্যুত মস্তক দেহ পড়িল ভূতলে।
আস্তে ব্যস্তে বৃকোদরী করে ধরি মুণ্ড
পীয়িতে লাগিলা রক্ত, পাছে সে শোণিত
ভূমে পড়ি পুনঃ জন্মে অসংখ্য অসুর।
যক্ষ রক্ষ মাতৃগণে হুলাহুলি দিয়া
দেহের শোণিত মেধ লাগিল ভক্ষিতে।
ভঙ্গ দিল দৈত্য সৈন্য ত্রাসে ইতস্ততঃ।
এদিকে সহস্র আঁখি আকুল পরাণ,
দেবদল সহ, বীর নিশুম্ভ প্রভাবে।
চাহে পুনঃ পুনঃ ফিরি কালিকার পানে।
যথা কোন মহা সিংহী বধি ঘোর রণে
ভীষণ মহিষে, মুখে লয়ে তারে পশে
শাবকসমূহ যথা নিবিড় গহনে;
ভয়ঙ্করা বেশে কালী আসি দেখা দিলা
দেবদল মাঝে, করে রক্তবীজ মুণ্ড,
শোণিত ধারায় স্নাত আলু থালু কেশ,
রক্তিম নয়নত্রয় চড়েছে হত্যায়।
কাতরে নিশুম্ভ মরি হেরিলা তাকায়ে
রক্তবীজ ছিন্নমুণ্ড করে কালিকার।
অন্তর আগুনে বলী ছাড়িলা নিশ্বাস।

কহিলা নামায়ে মুখ, খেদে;—"রে বিধাতঃ
তুই (বুঝিলাম এবে মনে) বিনাশিবি
দৈত্যকুল, এই তার প্রত্যক্ষ সে ফল।”
নীরব হইয়া বীর রহিলা ক্ষণেক।
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি তুলি তবে ঘাড়,
নিরখিলা চারি দিক; দেখিলা বিস্ময়ে
নাহি নিজ বল কেহ, পলায়েছে সবে
দেখি কালিকার সেই করাল মূরতি।
দুর্ভাগ্যে ঈষৎ বীর হাসিলা অন্তরে।
আঁটিয়া বসন যথা পরে কোন পান্থ,
অসীম সাহস, হতে পার সন্তরণে,
বিশাল বিস্তৃতা খর কল্লোলিনী নদী,
সাপটি ধরিলা ধনু তবে বীর দর্পে,
অসংখ্য অমরসহ যুঝিতে একাকী।
টঙ্কারিয়া ধনু রোষে আরম্ভিলা রণ।
গূঢ় অগ্নি তাপে যথা উষ্ণ প্রস্রবণ
ঊর্দ্ধেতে উৎক্ষিপে বারি আর চতুর্দ্দিকে,
আচ্ছাদিয়া কুণ্ড, রণক্ষেত্র ছায়ি বীর
অজস্র অস্ত্রের জল বর্ষিতে লাগিলা,
ঘোর মন দুখানলে উত্তেজিত হয়ে।
ত্রাসেতে অমরকুল ঘেরি চতুর্দ্দিক
রহিলা দাঁড়ায়ে, দূরে; সাহস না হলো

কার আসিতে নিকটে। ঘোর যুদ্ধ হেন
করিলা যাবৎ বীর, প্রদোষে। ওদিকে
রবির প্রখর কর মন্দীভূত ক্রমে,
এদিকে নিশুম্ভ তেজ অবসন্ন মরি,
সারাদিন রণশ্রান্তে। যুগল ভাস্কর
তদা অস্তোদ্যত যেন হেরিলা সংসার;—
একটি হিমাদ্রি ক্রোড়ে অন্য অস্তচূড়ে।
হানিলা বিষম শেল আসি তবে কালী
রণ রঙ্গে হুহুঙ্কারে নিশুম্ভ ললাটে।
ঝর ঝর রক্ত ধারা বহিল প্রবেগে;
নির্গত শতদ্রু যেন হিমকুট হতে।
কাতরে আচ্ছাদি বীর বামকরে ক্ষত
ধীরে ধীরে বাম হাটু পাড়িয়া ধরায়,
অনন্ত আঁধারে পূর্ণ দেখিলা জগৎ!
জয়োল্লাসে দিক্‌দশ পূরিলা অমর;
দৈত্যকুল আঁখি নীরে তিতিল মেদিনী।

ইতি দানবদলন কাব্যে রক্ত বীজ নিশুম্ভ বধোনামক পঞ্চম সর্গ।