দিল্লী চলো/বাহাদুর শাহের সমাধি-ক্ষেত্রে
বাহাদুর শাহের সমাধি-ক্ষেত্রে
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামে অর্থাৎ ১৮৫৭ অব্দের বিপ্লবে যিনি আমাদের নেতা ছিলেন, সেই সম্রাট বাহাদুর শাহের স্মৃতিস্তম্ভের নিচে এইখানে আমরা গত বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ করেছিলাম। স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে গত বৎসরের সে উৎসবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল; আজাদ-হিন্দ বাহিনীর যে সব দল তখন এখানে ছিল, তারা কুচকাওয়াজে অংশ গ্রহণ করেছিল।
উৎসব ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল একথা আমি বলছি এই জন্যে যে ১৮৫৭ অব্দের পর ভারতের নূতন বিপ্লবী বাহিনী সেই প্রথম ভারতের প্রথম বিপ্লবী বাহিনীর অধিনায়কের আত্মার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাল। গত সেপ্টেম্বরের কুচকাওয়াজে আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম, সবাই শপথ গ্রহণ করেছি, সম্রাট বাহাদুর শাহের আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে; বৃটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে হবে। আজকে আনন্দ ও গর্ব্বের সঙ্গে আমি বলতে পারছি, আংশিকভাবে আমরা সে শপথের মর্য্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি। সেদিন সেনাবাহিনীর যাঁরা এ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এখন রণাঙ্গণে যুদ্ধ-রত। ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করে আজাদ-হিন্দ ফৌজ এখন মাতৃভূমির মাটির উপর লড়াই করছে।
এ বৎসর একটা দৈবনির্দ্দিষ্ট যোগাযোগ ঘটেছে—সম্রাট বাহাদুর শাহের মৃত্যুবার্ষিকী এবং নেতাজী সপ্তাহ একই সময় পড়েছে। এই সময়ে সমগ্র পূর্ব্ব-এশিয়ার ভারতীয়রা স্বাধীনতা না পাওয়া পর্য্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে নতুন করে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভারতের প্রথম মুক্তি সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি যে স্থানে তাঁর দেহ রক্ষা করেছিলেন, সেই স্থানই আজ ভারতের শেষ মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে—এর মধ্যেও আমি দৈবের অঙ্গুলিনির্দ্দেশ দেখতে পাচ্ছি। এই পবিত্র স্থান থেকে আমাদের সৈন্যরা আজ মাতৃভূমির দিকে এগিয়ে চলেছে। আজাদ-হিন্দ ফৌজের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ উপলক্ষে তাই আমরা এখানেই পুনর্মিলিত হয়েছি—সেই মহান দেশপ্রেমিক ও নেতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে, আমাদের গত বৎসরের প্রতিশ্রুতির আংশিক পরিপূরণে আনন্দ প্রকাশ করতে এবং অবাঞ্ছিত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে পূণ্যভূমি ভারতবর্ষকে মুক্ত না করতে পারা পর্য্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সঙ্কল্প পুনর্গ্রহণ করতে।
১৮৫৭ অব্দের ঘটনাবলী সম্বন্ধে কিছু বলা আমার কর্ত্তব্য। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা প্রচার করেছেন, ১৮৫৭ অব্দের যুদ্ধ বৃটিশের অধীনস্থ ভারতীয় সিপাহীদের বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিবরণ সত্য নয়। বস্তুতঃ ১৮৫৭ অব্দের বিপ্লব জাতীয় বিপ্লব; তাতে ভারতীয় সৈন্যরা এবং অসামরিক অধিবাসীরা অংশ গ্রহণ করেছিল। ভারতের দেশীয় নৃপতিদের মধ্যে অনেকে সেই দেশব্যাপী বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন—যদিও দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁদের কেউ কেউ এর থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলেনও। সেই যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় আমরা বিজয়ের পর বিজয় লাভ করেছিলাম; শুধু শেষের দিকেই আমরা শক্তিহীন হয়ে পরাজিত হয়েছিলাম। বিপ্লবের ইতিহাসে এটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিপ্লবের উদাহরণ খুব কমই দেখা যায়, যেক্ষেত্রে প্রথম সংগ্রামেই সাফল্য লাভ হয়েছে। “স্বাধীনতার যুদ্ধ একবার সুরু হলে সব সময় পিতার থেকে পুত্রের হাতে তার উত্তরাধিকার চলে আসে।” বিপ্লব সাময়িকভাবে ব্যর্থ ও দমিত হলেও পশ্চাতে সে তার শিক্ষা রেখে যায়। পরবর্ত্তী যুগের লোকেরা সেই সব শিক্ষা লাভ করে এবং উন্নততর আয়োজন করে আরও কার্য্যকরী উপায়ে নূতনভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করে। আমরা ১৮৫৭ অব্দের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা লাভ করেছি, এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত হয়েছি। এই সংগ্রামই ভারতের শেষ স্বাধীনতা-সংগ্রাম।
১৮৫৭ অব্দে ভারতীয় জনগণ হঠাৎ একদিন বৃটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করল—এমন কথা মনে করলে ভুল করা হবে। এমন আকস্মিক রূপে কোন বিপ্লবই অনুষ্ঠিত হয় না। ১৮৫৭ অব্দে আমাদের নেতারা যুদ্ধের জন্যে সর্ব্বপ্রকার আয়োজন করার প্রাণপণ প্রয়াস পেয়েছিলেন— যদিও পরে দেখা গেল, তাঁদের সে আয়োজন যথেষ্ট ছিল না। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, নানা সাহেবের কথা—যিনি সেই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান নায়ক। তিনি বিদেশ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা পাবার আশায় সারা ইউরোপে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৫৭ অব্দে যখন বিপ্লব আরম্ভ হল, তখন বৃটেনের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের মৈত্রী-সম্পর্ক ছিল এবং বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্যে বৃটিশ সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য নিয়োগ করতে পেরেছিল।
ভারতের অভ্যন্তরে জনগণ ও সৈন্যদের মধ্যে কিছুকাল বিচক্ষণতা ও কৌশলের সঙ্গে প্রচারকার্য্য চালানো হয়েছিল। ফলে, বিপ্লবের ইঙ্গিত দেওয়া মাত্রই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল। বিজয়ের পর বিজয় লাভ করা হল। উত্তর-ভারতের উল্লেখযোগ্য সব সহর বৃটিশদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল এবং বিপ্লবী সৈন্যদল সগৌরবে ভারতের রাজধানীতে প্রবেশ করল। অভিযানের প্রথম পর্য্যায়ে বিপ্লবীরা প্রায় সর্ব্বত্রই বিজয় লাভ করল। অভিযানের দ্বিতীয় পর্য্যায়ে বৃটিশ যখন প্রত্যাক্রমণ সুরু করল, তখন আমাদের লোকেরা আত্মরক্ষা করতে পারল না। তখন বিপ্লবীদের দেশব্যাপী সমর-কৌশল দেখা গেল; কিন্তু সে সমর কৌশলের সমন্বয়-সাধনের জন্যে তেজস্বী নেতার অভাব হল। তা ছাড়া, কোন কোন অঞ্চলে দেশীয় নৃপতিরা নিষ্ক্রিয় এবং উদাসীন হয়ে রইলেন। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাহাদুর শাহ্ জয়পুর, যোধপুর, বিকানীর, আলোয়ার প্রভৃতি রাজ্যের রাজাদের কাছে নিম্ন লিখিতরূপ পত্র লিখেছিলেন:—
“সর্ব্বপ্রকারে এবং যে কোন মূল্যে ইংরেজদের হিন্দুস্থান থেকে বিতাড়িত হতে দেখাই আমার একাগ্র ইচ্ছা। আমার একান্ত ইচ্ছা, সমগ্র হিন্দুস্থান যেন স্বাধীন হয়। এই উদ্দেশ্যে যে বিপ্লব আরম্ভ হয়েছে তা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না—যদি এমন কোন লোক এসে না দাঁড়ান যিনি জাতির বিভিন্ন শত্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ ও সংহত করতে পারেন, সমস্ত আন্দোলনের ঝুঁকি নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারেন এবং সমগ্র জনসমাজকে নিজের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করে এই আন্দোলনকে চালিয়ে নিতে পারেন। ইংরেজ-বিতাড়নের পর নিজ লাভের জন্যে ভারত-শাসনের কোন ইচ্ছাই আমার মনে নেই। আপনারা সমস্ত রাজা যদি স্বাধীনতার জন্যে অসি কোষমুক্ত করতে প্রস্তুত থাকেন, তবে আমি সম্রাটের ক্ষমতা ত্যাগ করে নির্ব্বাচিত ভারতীয় রাজাদের একটি সঙ্ঘের হাতে শাসন-শক্তি ন্যস্ত করতে সম্মত আছি।”
বাহাদুর শাহের নিজহাতে লেখা এই চিঠির মধ্যে যে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রকাশ পেয়েছে তার সামনে স্বাধীনতাকামী ভারতীয় মাত্রেরই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে।
বৃদ্ধ এবং দুর্ব্বল বাহাদুর শাহ্ অনুভব করেছিলেন, নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কাজেই তিনি সমগ্র অভিযান পরিচালনার জন্যে ছয় জনের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটিতে ছিলেন তিনজন সেনাপতি এবং তিনজন অসামরিক ব্যক্তি। কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল—হয়তো তখন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার সময় সমাগত হয়নি বলেই।
এই প্রবীণ নেতার মধ্যে যে বিপ্লবী মনোবৃত্তি ও অনুপ্রেরণা ছিল, আর একটি ঘটনা থেকেও তার প্রমাণ মেলে। যুক্তপ্রদেশে বেরিলির দেওয়ালে দেওয়ালে যে রক্ত-ঘোষণা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বাহাদুর শাহ্ বলেছিলেন:—
“আমাদের সেনাবাহিনীতে ছোট এবং বড়র ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া হবে; সমতাই হবে নিয়ম। এই পবিত্র যুদ্ধে যারা অস্ত্র-ধারণ করেছে, তারা সবাই সমান গৌরবের অধিকারী। তারা সবাই ভাই ভাই— তাদের মধ্যে পদমর্য্যাদার বিভেদ নেই। ভারতীয় ভ্রাতৃবৃন্দের নিকট আমি আমার নিবেদন জানাচ্ছি—ওঠ, এই দৈবনির্দ্দিষ্ট মহৎ কর্ত্তব্য পালনের জন্যে সংগ্রাম-ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়।”
এসব ঘটনার উল্লেখ করে আমি এই কথা প্রমাণ করতে চাই যে, আমাদের এই অজাদ-হিন্দ ফৌজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুদূর ১৮৫৭ অব্দে। এই শেষ স্বাধীনতা-সংগ্রামে আমাদের সামনে আছে ১৮৫৭ অব্দের প্রথম সংগ্রামের শিক্ষা এবং তার ব্যর্থতার শিক্ষা।
এবার নিয়তি আমাদের পক্ষে। কয়েকটি রণাঙ্গনে আমাদের বিপক্ষীয়রা জীবন-মরণ সংগ্রামে নিযুক্ত। স্বদেশে আমাদের দেশবাসীরাও সম্পূর্ণ সজাগ। আজাদ-হিন্দ ফৌজের শক্তি অমোঘ; এই সেনাবাহিনীর সকল সদস্য নিজ দেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধ। পূর্ণ বিজয় লাভ না করা পর্য্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো সাধারণ সমর-কৌশল আমাদের আছে। আমাদের ঘাঁটি যথোচিত ভাবে সুসংবদ্ধ। এই বীরকার্যে অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্যে রয়েছে মহিমময় বাহাদুর শাহের স্মৃতি এবং আদর্শ। শেষ বিজয় আমাদের হবেই, এতে সন্দেহ থাকতে পারে না। ১৮৫৭ অব্দের ঘটনাবলী যখন আমি পড়ি এবং বিপ্লবের ব্যর্থতার পর বৃটিশরা যে ব্যবহার করেছিল তার কথা যখন আমি ভাবি, তখন আমার রক্তে যেন আগুন ধরে যায়। শুধু যুদ্ধকালেই নয়, তার পরেও নির্দ্দোষ স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের রক্তপাত হয়েছে; অমানুষিক ভাবে তারা নির্য্যাতিত হয়েছে। তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। দেশবাসীরা অতিমানব-সুলভ সাহস এবং বীরত্বের পরিচয় দেবে এটা যদি আপনাদের কাম্য হয়, তবে তাদের শুধু দেশকে ভালবাসতে শিখলেই চলবে না, বিপক্ষীয়দের নিষ্ঠুরতাও স্মরণ রাখতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ম্মপন্থা হচ্ছে রক্তদান। এই যুদ্ধে আমাদের বীরদের রক্তদান আমাদের অতীত পাপকে ধুয়ে মুছে দেবে। আমাদের স্বাধীনতার মূল্য হবে বীরদের রক্তপাত। ভারতের জনগণ অত্যাচারীদের উপর যে প্রতিশোধ নিতে চায়, আমাদের বীরদের রক্ত—তাদের বীরত্ব এবং তাদের সাহস—সেই প্রতিশোধ-গ্রহণের ব্যবস্থা করবে।
পরাজয়ের পরে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন:
“গাজীয়োঁ মেঁ বু রহেগি, যব তলক ইমানকি
থক্ত লণ্ডন তক্ চলেগি, থেগ হিন্দুস্থান কি।”
“যতদিন পর্য্যন্ত আমাদের স্বাধীনতার সৈনিকদের হৃদয়ে বিশ্বাস থাকবে, ততদিন পর্য্যন্ত ভারতের খড়্গ লণ্ডনের হৃদয় বিদ্ধ করবে।” তিনি ঠিকই বলেছিলেন। ভারতের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়ে যাবে।
সম্রাট বাহাদুর শাহের স্মৃতিস্তম্ভের নিচে আনুষ্ঠানিক কুচ-কাওয়াজ উপলক্ষে: ১১ জুলাই, ১৯৪৪