দীর্ঘকেশী/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।


 এবার আমাদিগের সর্বপ্রধান কার্য্য হইল সেই চামড়াওয়ালাকে গ্রেপ্তার করা। তাহার সেই বাড়ীর ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা, ও সেই বাড়ীতে যে সকল দাস-দাসী ও দারোয়ান ছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে বাহির করা। এই সকল কার্য্য যত শীঘ্র সম্পন্ন করা যাইতে পারিবে, কার্য্যের পক্ষে ততই সুবিধা হইবে, সুতরাং অপরাপর কর্মচারীর এই কার্যের নিমিত্ত সাহায্য গ্রহণ করা কর্ত্তব্য হইয়া পড়িল। উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীকে এই সমস্ত অবস্থার বিষয় তখনই সংবাদ প্রদান করিতে হইল ও তাঁহার আদেশক্রমে অপরাপর যে সকল কর্মচারীগণ ইতিপূর্ব্বে এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাহাদিগের সকলেই এই মোকর্দ্দমায় আমাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 চামড়ওয়ালা ধৃত হইল। যে ঘরভাড়া করিয়া চামড়াওয়ালা ঐ স্ত্রীলোকটীকে রাখিয়াছিল, সেই ঘরের তালা খুলিয়া সেই ঘরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তাহার ভিতর আমাদিগের প্রয়োজন উপযোগী কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। সেই সময় ঐ ঘর একেবারে শূন্য অবস্থায় ছিল, উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই ছিল না, অধিকন্তু উহা দেখিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, চারি পাঁচ দিবসের মধ্যে ঐ ঘর উত্তমরূপে ধৌত করা হইয়াছে, ও দেওয়ালে নূতন কলিচুন ফিরান হইয়াছে। ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মনে আরও সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, সেই ঘরেই ঐ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছিল, ও স্থানে স্থানে বোধ হয় রক্তের চিহ্ন লাগিয়া ছিল বলিয়া নূতন করিয়া উহাতে চুন ফিরান হইয়াছে।

 চামড়ওয়ালা ঐ স্ত্রীলোকটাকে যে রাখিয়াছিল, তাহা সে স্বীকার করিল। আরও কহিল, সে ঐ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার পর সে তাহার কিছুমাত্র অনুসন্ধান করে নাই, কারণ প্রথমতঃ সে ভাবিয়াছিল যে, সে তাহার পিতা-মাতার নিকটই গমন করিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ ঐ স্ত্রীলোকটীকে রাখিবার কিছু দিবস পর হইতেই তাহার স্ত্রী এই সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছিল, ও সেই সময় হইতে তাহার স্ত্রী তাহার সহিত সদাসর্ব্বদা কলহ করিত, সুতরাং সে মনে করিয়াছিল, আপন স্ত্রীর সহিত মনোবিবাদ করা অপেক্ষা যদি তাহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকটা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় যাউক, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। তাহার মনের ভাব এইরূপ ছিল বলিয়াই সামান্য কারণে যখন সে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, তখন সে তাহার আর কোনরূপ অনুসন্ধানই করিল। যাহার ঘর সে ভাড়া লইয়াছিল, তাহার সহিত তাহার এইরূপ কথা ছিল যে, যখনই সে ঘর পরিত্যাগ করিবে, সেই সময়ই তাহাকে ঐ ঘরে চুন ফিরাইয়া দিতে হইবে, এই নিমিত্তই সে ঐ ঘরে নুতন চুন ফিরাইয়াছিল, মাস শেষ হইলেই ঐ ঘর সে ছাড়িয়া দিবে। আর যাহার নিমিত্ত সে দাস-দাসী ও দারোয়ান রাখিয়াছিল, সে যখন চলিয়া গেল, তখন ঐ সমস্ত লোকের আর তাহার কোনরূপ প্রয়োজন রহিল না। সুতরাং সে তাহাদিগকে কার্য্য হইতে অপসারিত করিয়া দিয়াছিল, ও তাহার যে কে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সে অবগত নহে।

 চামড়াওয়ালা আমাদিগকে এইরূপ কহিল সত্য কিন্তু তাহার কথায় আমরা কিছুমাত্র বিশ্বাস করিলাম না। অধিকন্তু যে সকল চাকয় তাহার ঐ বাড়ীতে কার্য্য করিত, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ এক এরু করিয়া তাহাদিগের সকলকেই অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন।

 ঐ সমস্ত লোক প্রাপ্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের সমস্ত অবস্থা বাহির হইয়া পড়িতে লাগিল। তখন সকলেই জানিতে পারিলেন যে, ঐ স্ত্রীলোকটা যদিও চামড়ওয়ালা কর্তৃক রক্ষিতা ছিল, তথাপি দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের অভাব যেরূপ কিছুতেই পরিবর্ত্তিত হয় না, সেইরূপ তাহার স্বভাবেরও কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন হইয়াছিল না। চামড়াওয়ালা তাহাকে বিশেষরূপ যত্ন করিত, তাহার নিমিত্ত বিস্তর অর্থ ব্যয় করিত, তথাপি সে তাহার অভাবের গুণে গুপ্তভাবে অপর লোককে তাহার ঘরে চামড়া ওয়ালার অবর্ত্তমানে স্থান প্রদান করিত। অর্থে না হয় কি? সেই অর্থের গুণে দাস-দাসী ও দরোয়ান প্রভৃতির মুখ বন্ধ করিত, চামড়ওয়ালার কাণে কোন কথা প্রবেশ করিত না। কিন্তু দৈবের ঘটনা কেহ কখন রোধ করিতে পারে না। হঠাৎ একদিবস যে সময় সেই লোকটা সেই স্ত্রীলোকের ঘরে উপবেশন করিয়া আমোদ-প্রমোদে নিযুক্ত ছিল, অথচ সেই সময় ঐ চামড়াওয়ালার সেই স্থানে আসিবার কোন কারণই ছিল না, সেই সময় কোন কার্য্য উপলক্ষে সেই চামড়ওয়ালা সেই স্থানে হঠাৎ উপস্থিত হইল ও সমস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখিতে পাইল। চামড়ওয়ালা যখন সেই স্থানে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সময় ঐ বাড়ীর চাকর চাকরাণী ও দারোয়ান এরূপ ভাবে অন্যমনস্ক ছিল যে, তাহার আগমন সংবাদ কোনরূপেই সেই স্ত্রীলোকটীকে প্রদান করিতে পারিল না, চামড়া ওয়ালা একেবারে গিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল কিন্তু সেই অপরিচিত লোকটা পলায়ন করিয়া যদি আপন প্রাণ রক্ষা করিল, ঐ স্ত্রীলোকটা তাহার হস্ত হইতে আর কোনরূপেই পরিত্রাণ পাইল না, ইহজীবনের নিমিত্ত তাহার ইহলীলা সেইখানেই শেষ হইয়া গেল।

 চামড়াওয়ালার লোকজনের অভাব ছিল না, সুতরাং রাত্রিকালে ঐ মৃতদেহ দুইভাগে বিভক্ত হইল, ও যেরূপ দীঘির জলের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, সেইরূপ ভাবে উহা সেই স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল।

 চামড়াওয়ালা ও তাহার সাহায্যকারী সমস্ত লোকই ধৃত হইল, কিন্তু উহার অনেক অর্থের জোর ছিল, সাক্ষ্যগণ অনেকেই ক্রমে তাহার হস্তগত হইয়া পড়িল, ও হাইকোর্টের প্রধান প্রধান কৌন্সিলিগণের বুদ্ধিবলে ও সাক্ষীগণের মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করায় সকলেই সে যাত্রা বিচারালয় হইত নিষ্কৃতি লাভ করিল।


শ্রাবণ মাসের সংখ্যা
“উভয় সঙ্কট।”
যন্ত্রস্থ।