দীর্ঘকেশী/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বৃদ্ধ ইহুদি আমার কথা শুনিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি আমার কন্যা সম্বন্ধে কোন বিষয় অবগত আছেন কি?”
আমি। বোধ হয় কিছু অবগত আছি।
বৃদ্ধ। কি অবগত আছেন মহাশয়?
আমি। তোমার সেই কন্যা দেখিতে খুব সুন্দরী।
বৃদ্ধ। তাহা ত সকলেই জানে, আমার এই কন্যা অপেক্ষাও অনেকে তাহাকে সুন্দরী কহিয়া থাকে।
অমি। তাহার মস্তকের চুলের খুব বাহার আছে, ও খুব দীর্ঘ।
বৃদ্ধ। তাহার মাতার ও তাহার ভগ্নীর চুলরাশি যেরূপ দেখিতেছেন, উহার চুলও ঠিক সেইরূপ। এ সকল বিষয় তো সকলেই অবগত আছেন, কিন্তু আমার সেই কন্যা যে এখন কোথায়, তাহার কিছু আপনি অবগত আছেন কি?
আমি। ঠিক অবগত না থাকিলেও বোধ হয় আমি তাহার কিছু সন্ধান আপনাকে বলিয়া দিতে পারি। কিন্তু আমি যে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া আপনাকে এই কথা বলিতেছি তাহা যে কতদূর সত্য তাহা আমি বলিতে পারি না; অথচ কোন বিষয় বিশেষরূপ অবগত না হইয়াও কাহাকে কোনরূপ অপ্রিয় সংবাদ দেওয়া কর্ত্তব্য নহে।
বৃদ্ধ। অপ্রিয় সংবাদ! কি অপ্রিয় সংবাদ?
আমি। আজ কয়েক দিবস অতীত হইল, কলুটোলার নিকটবর্ত্তী দীঘির ভিতর হইতে একটী স্ত্রীলোকের মস্তক ও পরিশেষে মস্তকবিহীন একটী স্ত্রীলোকের দেহ পাওয়া যায়, একথা আপনি বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে শুনিয়া থাকিবেন?
বৃদ্ধ। না, আমি তাহা শুনি নাই। কোথায় উহা পাওয়া গিয়াছে বলিলেন?
আমি। কলুটোলার কিছুদূর পূর্ব্বে যে একটী প্রকাণ্ড পুরাতন দীঘি আছে, তাহারই মধ্যে।
বৃদ্ধ। আমি ঐ দীঘি জানি, যে স্থানে চামড়াওয়ালা আমার কন্যাকে রাখিয়াছিল, সেই স্থান হইতে ঐ দীঘি বহুদূরবর্ত্তী নহে। যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহা কি আপনি দেখিয়াছেন?
আমি। দেখিয়াছি।
বৃদ্ধ। উহাকে দেখিতে আমার এই কন্যাটীর ন্যায় কি?
আমি। ঐ মৃতদেহ পচিয়া যাইবার পর আমি দেখিয়াছি, সেই অবস্থায় দেখিয়াও বোধ হয় সে দেখিতে আপনার এই কন্যাটীর ন্যায়ই ছিল।
বৃদ্ধ। উহার মস্তকের চুল ছিল কিরূপ?
আমি। আপনার এই কন্যার চুলের ন্যায়। চুল সমেত মস্তক এখনও রক্ষিত আছে, আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি উহা আপনাকে দেখাইতে পারি।
আমার এই শেষ কথা শুনিবামাত্র সেই বৃদ্ধ, তাহার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে সেইস্থানে আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিতে দিল না, উহাদিগের নিজের গাড়ী ছিল, তৎক্ষণাৎ সেই গাড়ী আনিয়া সেইস্থানে উপস্থিত করিল, ও আমাকে তাহাদিগের গাড়ীতে লইয়া যে স্থানে ঐ মস্তক রক্ষিত ছিল সেই স্থানে যাইতে কহিল।
যে কার্য্য আমাকে করিতেই হইত, যে কার্যের নিমিত্ত উহারা অসম্মত হইলে যে কোন উপায়ে হউক উহাদিগকে লইয়া যাইতেই হইত, সেই কার্য্যের নিমিত্ত আমাকে আর কোনরূপ কষ্টই করিতে হইল না, উহারাই বিশেষ আগ্রহের সহিত আমাকে লইয়া যাইতে লাগিল।
যে স্থানে ডাক্তার সাহেব ঐ মস্তক রাখিয়াছিলেন, আমি উহাদিগের তিনজনকেই সেইস্থানে লইয়া গেলাম, ও ঐ মস্তক উহাদিগকে দেখাইলাম। ঐ মস্তক যদিচ সেই সময় বিকৃত অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল, তথাপি উহা দেখিবামাত্র উহারা একেবারে চীৎকার করিয়া উঠিল। উহাদিগের চীৎকার শুনিয়াই আমি যেন বুঝিতে পারিলাম যে, ঐ মস্তক ঐ বৃদ্ধ ইহুদির জ্যেষ্ঠ কন্যা ভিন্ন অপর কাহারও নহে। কিছুক্ষণ আর্ত্তনাদ করিবার পর উহারা একটু স্থির হইল। তখন আমি উহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। উহারা কহিল, ঐ মস্তক তাহাদের কন্যার মস্তক, আরও কহিল, সেই চামড়াওয়ালাই উহাকে কোন কারণে হত্যা করিয়া উহার মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করতঃ দীঘির জলে নিক্ষেপ করিয়াছে।
এত দিবস পরে দেখিলাম, আজ আমাদিগের কার্য্য সিদ্ধি হইবার উপায় হইল। যখন মৃতদেহ সনাক্ত হইল, তখন এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে আর বাকি থাকিল না। যে স্থান হইতে এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, এখন তাহাও যেন বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, বৃদ্ধ যাহা কহিতেছে, তাহাই প্রকৃত। চামড়াওয়ালা যখন উহাকে এত যত্ন করিয়া রাখিয়াছিল, যাহার নিমিত্ত এতদিন অকাতরে ব্যয় করিতেছিল, সেই যখন সামান্য ঝগড়া করিয়া তাহার বাড়ী পরিত্যাগ করিল, তখন ইহার নিমিত্ত সে একবার অনুসন্ধানও করি না, বা তাহার পিতা-মাতাকে কোনরূপ সংবাদও প্রদান করিল না, ইহা কি নিতান্ত সন্দেহের কারণ নহে? যাহার নিমিত্ত চামড়াওয়ালা ঘর ভাড়া করিয়া দাস-দাসীর বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিল, যাহার দরজায় বসিয়া বোয়ানে পাহারা দিত, সে যখন ক্রোধভরে ঘর পরিত্যাগ করিল, অমনি দাস-দাসীর জবাব হইল, দরোয়ান স্থানান্তরিত হইল, সদর দরজায় তালা পড়িল, ইহাও কি বিশেষ সন্দেহের কারণ নহে। মনে মনে এইরূপ ভানিয়া সাহসের উপর ভর ও ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া, পুনরায় কার্য্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইলাম।