দীর্ঘকেশী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 আমার সেই দোকানদার বন্ধুর দোকানে প্রায় এক ঘণ্টাকাল বসিয়া থাকিবার পর সেই বৃদ্ধ ইহুদি একাকী প্রত্যাগমন করিল। তাহাকে দেখিয়া আমার বন্ধু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিয়াছেন!”

 বৃদ্ধ। হাঁ মহাশয়।

 বন্ধু। আপনার কন্যার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছে?

 বৃদ্ধ। না।

 বন্ধু। কেন সাক্ষাৎ হইল না?

 বৃদ্ধ। তিনি বাড়ীতে নাই।

 বন্ধু। কোথায় গিয়াছেন?

 বৃদ্ধ। তাহা কেহ বলিতে পারিল না।

 বন্ধু। এ কিরূপ কথা হইল?

 বৃদ্ধ। ইহা যে কিরূপ কথা তাহা আমিও বুঝিতে পারিতেছি না।

 বন্ধু। চামড়ার সওদাগরের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?

 বৃদ্ধ। হইয়াছিল।

 বন্ধু। তিনি কি কহিলেন?

 বৃদ্ধ। তাহার কথা শুনিয়া আমার মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছে, আমি ভাল মন্দ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 বন্ধু। সে কেমন কথা?

 বৃদ্ধ। তিনি কহিলেন, আজ কয়েক দিবস হইল তাহার সহিত আমার কন্যার কোন একটী সামান্য কথা লইয়া একটু মনোবিবাদ হয়। এই কারণে রাগ করিয়া রাত্রিযোগে তিনি কোথায় চলিয়া গিয়াছেন, তিনিও রাগ করিয়া তাহার আর কোন সন্ধান করেন নাই, কারণ তিনিও ভাবিয়াছেন যে, আমার কন্যা আমারই বাড়ীতে আসিয়াছে।

 বন্ধু। এ সংবাদ তো আপনাকে দেওয়া তাহার উচিত ছিল?

 বৃদ্ধ। ছিল বৈ কি, কিন্তু তিনি তাহা দেন নাই।

 বন্ধু। তাহা হইলে সে এখন কোথায় গমন করিল?

 বৃদ্ধ। আমি তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না ও আমার মনেরও এখন কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার স্ত্রীকে এই সংবাদটী প্রদান করিয়া এখনই আপনার নিকট আগমন করিতেছি।

 এই বলিয়া বৃদ্ধ ইহুদি দ্রুতবেগে তাহার বাড়ীতে প্রবেশ করিল।

 যে স্ত্রীলোকদ্বয়ের চুলের বাহার দূর হইতে দেখিতেছিলাম, কিয়ৎক্ষণ পরে তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই বৃদ্ধ ইহুদী আমার বন্ধুর দোকানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় আমি উহাদিগের চুলগুচ্ছ বিশেষরূপে দর্শন করিলাম, ও বুঝিলাম, এই চুলের সহিত সেই ছিন্নমস্তকের চুলের কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। তখন বুঝিলাম, আমার উদ্দেশ্য অনেকদূর সফল হইয়াছে; ঐ মৃতদেহ এই বৃদ্ধ ইহুদীর জ্যেষ্ঠ কন্যার দেহ ভিন্ন অপর কাহারও নহে।

 বৃদ্ধ। আপনারা আমার কন্যা সম্বন্ধে কোন বিষয় অবগত আছেন কি?

 বন্ধু। না।

 বৃদ্ধ। তবে তাহার সহিত কি নিমিত্ত সাক্ষাৎ করিতে চাহিতেছিলেন?

 বন্ধু। একটা প্রয়োজন ছিল বলিয়া।

 বৃদ্ধ। কি প্রয়োজন তাহা জানিতে পারি কি?

 বন্ধু। আমার নিজের কোন প্রয়োজন ছিল না।

 বৃদ্ধ। কাহার প্রয়োজন ছিল?

 বন্ধু। আমার এই বন্ধুটীর।

 বৃদ্ধ। আপনার কি প্রয়োজন ছিল মহাশয়?

 আমি। যে প্রয়োজন, তাহা বলিবার সময় এখন নাই।

 বৃদ্ধ। কেন মহাশয়?

 আমি। কারণ আপনার সহিত আমার পরিচয় নাই।

 বৃদ্ধ। আমার কন্যার সহিত কি আপনার পরিচয় আছে?

 আমি। না, পরিচয় না থাকিলেও তাহার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা করিতেছিলাম।

 বৃদ্ধ। কেন মহাশয়, তাহার সহিত কি প্রয়োজন ছিল, তাহা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?

 আমি। পারেন?

 বৃদ্ধ। তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলুন না মহাশয়?

 আমি। বলিতেছি, কিন্তু বলিবার পূর্ব্বে, আমি আপনাকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, যদি অনুগ্রহ করিয়া আপনি তাহার উত্তর প্রদান করেন।

 বৃদ্ধ। জিজ্ঞাসা করুন, আমি যাহা কিছু অবগত আছি তাহার উত্তর এখনই প্রদান করিতেছি।

 আমি। যে মুসলমানটীর নিকট আপনার কন্যা ছিলেন, তিনি কি কর্ম্ম করিয়া থাকেন।

 বৃদ্ধ। তিনি চামড়ার ব্যবসা করিয়া থাকেন। তিনি খুব বড় মানুষ, অনেক টাকাকড়ি আছে, ও বড় মানুষেরা যেরূপ ভাবে থাকে তিনিও সেই রকমভাবে দিনযাপন করিয়া থাকেন।

 আমি। তাহা হইলে আপনার কন্যা কি মুসলমান ধর্মগ্রহণ করিয়াছেন।

 বৃদ্ধ। না, তিনি আমাদিগের ধর্মেই আছেন।

 আমি। তাহা হইলে আপনার কন্যার সহিত ঐ চামড়াওয়ালার বিবাহ, বা নিকা প্রভৃতি কিছুই হয় নাই?

 বৃদ্ধ। না।

 আমি। ঐ চামড়াওয়ালার বিবাহিতা স্ত্রীও বোধ হয় আছেন।

 বৃদ্ধ। আছেন।

 আমি। তিনি যে বাড়ীতে বাস করিয়া থাকেন, আপনার কন্যাও বোধ হয় সেই বাড়ীতে বাস করিতেন।

 বৃদ্ধ। না। চামড়াওয়ালা তাহাকে আলাহিদা বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন।

 আমি। সে বাড়ীতে অন্য কে থাকিত?

 বৃদ্ধ। চাকর চাকরাণী ব্যতীত আর কেহই সে বাড়ীতে থাকিত না। তবে রাত্রির অধিকাংশই চামড়াওয়ালা সেই স্থানে অবস্থিতি করিতেন।

 আমি। ঐ বাড়ীতে কয়টী চাকর থাকিত?

 বৃদ্ধ। দুইটী দরয়ান, একটী দাই, ও একটী বাবুর্চিকেই প্রায় সর্ব্বদা দেখিতে পাইতাম।

 আমি। চাকরগণ কোন জাতীয় ছিল?

 বৃদ্ধ। তাহারা সকলেই মুসলমান।

 আমি। দরোয়ান দুইজন?

 বৃদ্ধ। তাহারাও মুসলমান।

 আমি। এখন তুমি তো সেই স্থানে গিয়াছিলে?

 বৃদ্ধ। হাঁ—সেই বাড়ীতেই গিয়াছিলাম।

 আমি। ঐ সমস্ত চাকরদিগের সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?

 বৃদ্ধ। না, কোন চাকরকেই দেখিতে পাই নাই।

 আমি। তুমি বাড়ীর মধ্যে গিয়াছিলে?

 বৃদ্ধ। না, বাহির হইতে দেখিলাম, দরজায় তালাবন্ধ।

 আমি। তাহা হইলে চামড়ওয়ালার সহিত তোমায় কি রূপে ও কোথায় সাক্ষাৎ হইল?

 বৃদ্ধ। যখন ঐ বাড়ী তালাবন্ধ আছে দেখিলাম, তখন আমি তাহার চামড়ার আড়তে গমন করি। সেই স্থানে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, ও সেই সময় জানিতে পারি যে, আমার কন্যা রাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

 আমি। তোমার কন্যা উহার আশ্রয়ে কত দিবস হইতে বাস করিতেছে?

 বৃদ্ধ। প্রায় ৫/৬ মাস হইতে।

 আমি। সে উহাকে কি প্রদান করিত।

 বৃদ্ধ। সমস্ত খরচ পত্র বাদে ফি মাসে উহাকে পাঁচ শত টাকা করিয়া দিবার কথা ছিল।

 আমি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কত করিয়া দিত।

 বৃদ্ধ। তাহা আমি বলিতে পারি না।

 আমি। তোমার কন্যা এই কয়মাসের মধ্যে তোমাকে কখন কিছু টাকা দিয়াছে?

 বৃদ্ধ। দুইবারে চারিশত করিয়া আটশত টাকা সে আমাকে দিয়াছিল।

 আমি। সে কত দিবস হইল?

 বৃদ্ধ। প্রথম ও তৃতীয় মাসে।

 আমি। তাহার পর আর কখন কিছু দেয় নাই?

 বৃদ্ধ। না।

 আমি। ঐ বাড়ীতে যে সকল চাকর ছিল, তুমি তাহাদিগের নাম জান?

 বৃদ্ধ। না।

 আমি। দেখিলে চিনিতে পারিবে?

 বৃদ্ধ। তা পারিব, আমার এই স্ত্রী ও এই কন্যাও উহাদিগকে দেখিলে চিনিতে পারিবে।

 আমি। তাহা হইলে ইহারাও উহাদিগকে দেখিয়াছে?

 বৃদ্ধ। অনেকবার দেখিয়াছে।

 আমি। আজ যখন তুমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলে, সেই সময় উহাদিগের মধ্যে কাহার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়া ছিল কি?

 বৃদ্ধ। না, আজ আমি তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।

 আমি। আমার যাহা কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, তাহার সমস্তই প্রায় একরূপ আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। এখন আপনি কি জানিতে চাহেন, আমাকে বলিতে পারেন।