দীর্ঘকেশী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যে দিবস ঐ মস্তক পাওয়া গিয়াছিল, সেই দিবস ও তাহার পর তিন দিবস ঐরূপ গোলযোগে কাটিয়া গেল; পঞ্চম দিবস প্রত্যুষে সংবাদ পাইলাম যে, পূর্ব্বকথিত পুষ্করিণীর মধ্যে কি একটা ভাসিতেছে। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া পুনরায় সেইস্থানে গমন করিলাম ও তীর হইতে দেখিলাম, প্রায় পঞ্চাশ ফুট ব্যবধানে জলের মধ্যে কি যেন একটা দেখা যাইতেছে, কিন্তু উহা যে কি, তাহা অনুমান করিতে পারিলাম না।
এই কলিকাতা সহরের গতি, পাঠকগণ বিশেষরূপ অবগত আছেন, কোন পুলিশ-কর্ম্মচারী কোন কার্য্য উপলক্ষে কোনস্থানে দণ্ডায়মান হইলে বিনা উদ্দেশ্যে শত শত লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য, আমি সেই পুষ্করিণীর ধারে গমন করিলে শত শত লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহার মধ্যে সকল প্রকার লোককেই দেখিতে পাইলাম। বালক, বৃদ্ধ, যুবক, স্ত্রীলোক প্রভৃতি অনেকেই আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল; ভদ্রলোক হইতে অতি নীচ শ্রেণীর লোকদিগকে সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম। জলের মধ্যে ঐ পদার্থটীকে দেখিয়া তাহাদিগের মধ্যে কেহই স্থির করিতে পারিল না যে উহা কি, কিন্তু সকলেরই বিশ্বাস হইল যে, কোন একটী পদার্থ ঐ স্থানে রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমি সেই সমস্ত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, তোমাদিগের মধ্যে এরূপ কোন এক সাহসী ব্যক্তি আছে, যে সাঁতার দিয়া ঐস্থানে গিয়া দেখিয়া আসিতে পার, ঐ পদার্থটি কি?
আমার কথার উত্তরে দুইজন নিম্নশ্রেণী মুসলমান যুবক কহিল, আদেশ পাইলে আমরা এখনি গিয়া দেখিয়া আসিতে পারি, উহা কি?
তাহাদিগের কথা শুনিয়া আমি তাহাদিগকে ঐস্থানে যাইতে কহিলাম, তাহারাও সন্তরণ দিয়া ক্রমে সেইদিকে অগ্রসর হইতে লাগিল, কিন্তু উহার সন্নিকটবর্ত্তী না হইয়া প্রায় দশ ফিট ব্যবধান হইতে উভয়েই প্রত্যাগমন করিল ও কহিল, আমরা উহার নিকটে যাইতে পারিলাম না ও বুঝিতে পারিলাম না যে, উহা কি? অমুমানহইল, দূর হইতে আমাদিগকে দেখিয়াই উহা যেন তাহার হস্ত পদ সঞ্চালন করিয়া আমাদিগকে ধরিতে আসিতেছে। আমাদিগের ভয় হইল, সুতরাং প্রাণ লইয়া আমরা সেইস্থান হইতে পলাইয়া আসিলাম।
ঐ অবস্থা দেখিয়া ও মুসলমান যুবকদ্বয়ের কথা শুনিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম, যাহার ছিন্নমস্তক আমরা পূর্ব্বে প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহারই দেহ ঐস্থানে ঐরূপ অবস্থায় ভাসিতেছে; আরও মনে করিয়াছিলাম যে, ঐ মৃতদেহ ঐ পুষ্করিণীর গভীর গর্ভে নিমগ্ন ছিল, ধীবরগণ কর্ত্তৃক স্থানচ্যুত হইয়া ক্রমে ভাসিয়া উঠিতেছে; কিন্তু এখন মুসলমান যুবকদ্বয়ের কথা অনুসারে জানিতে পারা যাইতেছে যে, ঐ পদার্থটী তাহার হস্ত-পদ নাড়িয়া উহাদিগকে ধরিতে আসিতেছিল। এরূপ অবস্থায় এখন কি করা যাইতে পারে?—যদি আমার পূর্ব্বের অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে মুসলমান যুবকদ্বয় ভীত হইয়া ঐরূপ কথা বলিতেছে; আর যদি উহাদিগের কথা সত্য হয়, তাহা হইলে আমার অনুমান যে সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দুইজন ডুবারিকে আনিবার নিমিত্ত একটী লোক পাঠাইয়া দিলাম।
প্রায় দুই ঘণ্টা পরে দুইজন ডুবারির সহিত সে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঐ দুইজন ডুবারিকে ঐ পদার্থটিকে দেখাইয়া দিলাম ও কহিলাম, তোমরা ঐস্থানে গমন করিয়া দেখ, উহা কি? যদি উহা তীরে আনিবার উপযুক্ত হয়, তাহা হইলে যে প্রকারে হউক, উহাকে তীরে আনয়ন কর।
আমার কথা শুনিয়া ডুবারিদ্বয় সন্তরণ দিয়া যেস্থানে ঐ পদার্থটী দেখা যাইতেছিল, সেইস্থানে গমন করিল, ও ডুব দিল। প্রায় পাঁচ মিনিটকাল আর উহাদিগকে দেখিতে পাইলাম না বা জলের ভিতর উহারা কি করিতেছে, তাহাও কিছু বুঝিতে পারিলাম না।
প্রায় পাঁচ মিনিট পরে উহারা আমাদিগের অতি নিকটবর্ত্তী স্থানে আসিয়া জল হইতে উত্থিত হইল। উহারা উত্থিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে স্থানের জল কর্দ্দমময় হইয়া গেল, সুতরাং ঐস্থানে যে কি আছে, তাহার কিছুই দেখিতে পাইলাম না। উহাদিগকে জল হইতে উঠিতে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, যে পদার্থটী আমি তোমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিলাম, তাহা তোমরা দেখিতে পাইয়াছ কি?
ডুবারি। হাঁ মহাশয়, পাইয়াছি।
আমি। উহা কি পদার্থ বলিয়া অনুমান হয়?
ডুবারি। বোধ হইতেছে উহা মৃতদেহ।
আমি। মৃতদেহ হইলে তোমরা অনায়াসেই উহা ভাসাইয়া আনিতে পারিতে।
ডুবারি। আমরা ভাসাইয়া আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু উহাকে কোন প্রকারেই ভাসাইতে পারি নাই।
আমি। কেন উহাকে ভাসাইতে পারিলে না?
ডুবারি। বোধ হইতেছে, কোনরূপ ভারি দ্রব্য উহার সহিত বাঁধা আছে।
আমি। তাহা হইলে ঐ স্থান হইতে উহা কি কোন প্রকারেই এখানে আনা যাইবে না?
ডুবারি। আমরা উহা টানিয়া আনিয়াছি। এই স্থানের জল ঘোলা হইয়া গিয়াছে বলিয়া আপনারা উহা দেখিতে পাইতেছেন না, একটু অপেক্ষা করুন, কোন গতিকে আমরা উহা তীরে উঠাইয়া দিতেছি।
আমি। বিশেষ সাবধানের সহিত তীরে উঠাইবার চেষ্টা কর, যে ভারি দ্রব্যের সহিত উহা বাঁধা আছে, তাহার সহিত উঠাইতে পারিলে ভাল হয়।