দীর্ঘকেশী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 আমার কথা শুনিয়া ডুবারিদ্বয় বহুকষ্টে ঐ মৃতদেহটা জল হইতে তীরে উঠইয়া দিল। দেখিলাম, উহা একটী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ, কিন্তু বিবর্জ্জিত মস্তক। আরও দেখিলাম, ঐ মস্তকহীন মৃতদেহের সহিত তিনটী জলপূর্ণ বৃহৎ কলসি রজ্জু দ্বারা তিন স্থানে বাঁধা আছে, কিন্তু মৃতদেহটী এরূপভাবে পচিয়া গিয়াছে যে, তাহার যেস্থানে হস্ত স্পর্শিত হইতেছে, সেইস্থানের মাংস গলিয়া পড়িতেছে; ও উহা হইতে এরূপ দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে যে, সেইস্থানে ক্ষণকালের জন্য অবস্থান করিতে পারে কাহার সাধ্য।

 পূর্ব্বে আমরা এই পুষ্করিণীতে দেহবিহীন স্ত্রীমুণ্ড প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, এখন মস্তকবিহীন স্ত্রীদেহ প্রাপ্ত হইয়া বুঝিতে পারিলাম, যাহার মস্তক প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, এ তাহারই দেহ। সুতরাং এ সম্বন্ধে নূতন করিয়া আর আমাদিগকে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইল না; কারণ আমরা পূর্ব্ব হইতেই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম।

 ঐ স্থানে ঐ মৃতদেহটী যখন আমরা উত্তমরূপে অবলোকন করিতেছি, সেই সময়ে আমাদিগের একজন ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, পূর্ব্বে এই পুষ্করিণীতেই দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের মস্তক পাওয়া গিয়াছিল না?

 আমি। হাঁ।

ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী। এ মস্তকহীন দেহটীও স্ত্রীলোকের দেখিতেছি।

 আমি। হাঁ, ইহা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ।

 ঊ-ক। ইহাকে বিবস্ত্র অবস্থায় রাখা হইয়াছে কেন?

 আমি। ইহাকে এইরূপ বিবস্ত্র অবস্থাতেই পাওয়া গিয়াছে নিকটে বস্ত্র প্রাপ্ত না হওয়ায়, বাধ্য হইয়া বিবস্ত্র অবস্থায় রাখিতে হইয়াছে। একখানি বস্ত্র কিনিয়া আনিবার নিমিত্ত আমি একজন লোককে পাঠাইয়া দিয়াছি, আশা করি, সে এখনই প্রত্যাগমন করিবে।

 ঊ-ক। পূর্ব্বে যে মস্তক পাওয়া গিয়াছে, তাহা কি ইহারই মস্তক বলিয়া অনুমান হয়?

 আমি। অনুমান কেন, উহা যে ইহারই মস্তক, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 ঊ-ক। এই মৃতদেহের সহিত এরূপ জলপূর্ণ কলসী বাঁধিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?

 আমি। যাহাতে মৃতদেহটী সহজে ভাসিয়া উঠিতে না পারে, তাহার জন্যই উহার সহিত এইরূপে জলপূর্ণ কলসী বাঁধিয়া দিয়াছে।

 ঊ-ক। এ কার্য্য একজনের দ্বারা কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না।

 আমি। না, ইহা একজনের কার্য্য নহে, দুই বা ততোধিক ব্যক্তির দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে।

 ঊ-ক। যে রজ্জুর দ্বারা কলসীত্রয় বাঁধা আছে, উহা কিরূপ রজ্জু বলিয়া অনুমান হয়?

 আমি। বাজারে যে সকল রজ্জু সদাসর্ব্বদা বিক্রয় হইয়া থাকে, ইহা সেই রজ্জু, ও দেখিয়া অনুমান হইতেছে, নূতন রজ্জু দ্বারাই এই সকল কলসী বাঁধা হইয়াছে।

 ঊ-ক। রজ্জু সম্বন্ধে বোধ হয় একটু অনুসন্ধান করা আবশ্যক।

 আমি। খুব আবশ্যক, উহা আমাদিগকে করিতেই হইবে।

 আমাদিগের সহিত এইরূপ কথাবার্ত্তা হইবার পর ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, আমরাও ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিয়া আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম।

 আমরা আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম সত্য কিন্তু এখন কোন্ পথ অবলম্বন করিলে আমরা যে আমাদিগের কার্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইব, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। যে উপায় অবলম্বন করিয়া আমরা এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, সেই উপায়ে আমরা কিছুমাত্র কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই, কেবলমাত্র কয়েকদিবস বৃথা নষ্ট হইয়াচ্ছে। যে মৃতদেহ পাওয়া যায়, উহা কাহার মৃতদেহ, তাহা জানিতে না পারিলে হত্যা মকর্দ্দমার প্রায়ই কিনারা হয় না। সেই নিমিত্ত উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা জানিবার জন্যই আমরা এই কয়দিবস চেষ্টা করিতেছিলাম, কিন্তু আমাদিগের সে চেষ্টা বিফল হইয়া গিয়াছে। দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকটী যে কে, এ পর্য্যন্ত আমরা তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই।