দুই বোন/ঊর্মিমালা
ঊর্মিমালা
নীরদ রিসার্চের যে কাজ নিয়েছিল সেটা সমাপ্ত হােলো। য়ুরােপের কোনাে বৈজ্ঞানিকসমাজে লেখাটা পাঠিয়ে দিলে। তারা প্রশংসা করলে তার সঙ্গে সঙ্গে একটা স্কলারশিপ জুটল,— স্থির করলে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি নেবার জন্যে সমুদ্রে পাড়ি দেবে।
বিদায় নেবার সময় কোনাে করুণ আলাপ হােলো না। কেবল এই কথাটাই বারবার ক’রে বললে যে, “আমি চলে যাচ্ছি, এখন তােমার কর্তব্য সাধনে শৈথিল্য করবে এই আমার আশঙ্কা।” ঊর্মি বললে, “কোনাে ভয় করবেন না।” নীরদ বললে, “কী রকম ভাবে চলতে হবে, পড়াশুনাে করতে হবে তার একটা বিস্তৃত নােট দিয়ে যাচ্ছি।”
ঊর্মি বললে, “আমি ঠিক সেই অনুসারেই চলব।”
“তােমার ঐ আলমারির বইগুলি কিন্তু আমি আমার বাসায় নিয়ে গিয়ে বন্ধ ক’রে রাখতে চাই।”
“নিয়ে যান” বলে ঊর্মি চাবি দিল তার হাতে। সেতারটার দিকে একবার নীরদের চোখ পড়েছিল। দ্বিধা ক’রে থেমে গেল।
অবশেষে নিতান্তই কর্তব্যের অনুরোধে নীরদকে বলতে হোলো, “আমার কেবল একটা ভয় আছে, শশাঙ্কবাবুদের ওখানে আবার যদি তোমার যাতায়াত ঘন ঘন হোতে থাকে তাহলে তোমার নিষ্ঠা যাবে দুর্বল হয়ে, কোনো সন্দেহ নেই। মনে কোরো না, আমি শশাঙ্কবাবুকে নিন্দা করি। উনি খুবই ভালো লোক। ব্যবসায়ে ও-রকম উৎসাহ ও-রকম বুদ্ধি কম বাঙালীর মধ্যেই দেখেছি। ওঁর একমাত্র দোষ এই যে, উনি কোনো আইডিয়ালকেই মানেন না। সত্যি বলছি, ওঁর জন্যে অনেক সময়ই আমার ভয় হয়।”
এর থেকে শশাঙ্কের অনেক দোষের কথাই উঠল এবং যেসব দোষ আজ ঢাকা পড়ে আছে সেগুলো বয়সের সঙ্গে একে একে প্রবল আকারে প্রকাশ হয়ে পড়বে এই অত্যন্ত শোচনীয় দুর্ভাবনার কথা নীরদ চেপে রাখতে পারল না। কিন্তু তা হোক, তবু উনি যে খুব ভালো লোক সে-কথা ও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে চায়। সেই সঙ্গে এ-কথাও বলতে চায় ওর সঙ্গদোষ থেকে ওদের বাড়ির আবহাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানো ঊর্মির পক্ষে বিশেষ দরকার। ঊর্মির মন ওদের সমভূমিতে যদি নেবে যায় সেটা হবে অধঃপতন।
উমি বললে, “আপনি কেন এত বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন।”
“কেন হচ্ছি শুনবে? রাগ করবে না?”
“সত্য কথা শােনবার শক্তি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। জানি সহজ নয় তবু সহ্য করতে পারি।”
“তবে বলি শােনাে। তােমার স্বভাবের সঙ্গে শশাঙ্কবাবুর স্বভাবের একটা মিল আছে এ আমি লক্ষ্য ক’রে দেখেছি। তাঁর মনটা একেবারে হালকা। সেইটেই তােমাকে ভালো লাগে, ঠিক কিনা বলো।”
ঊর্মি ভাবে, লােকটা সর্বজ্ঞ নাকি। ভগ্নীপতিকে ওর খুব ভালাে লাগে সন্দেহ নেই। তার প্রধান কারণ, শশাঙ্ক হো হাে ক’রে হাসতে পারে, উৎপাত করতে জানে, ঠাট্টা করে। আর ঠিকটি জানে ঊর্মি কোন্ ফুল ভালােবাসে আর কোন্ রঙের শাড়ি।
ঊর্মি বললে, “হাঁ, আমার ভালাে লাগে, সে-কথা সত্যি।” নীরদ বললে, “শর্মিলাদিদির ভালােবাসা স্নিগ্ধগম্ভীর, তাঁর সেবা যেন একটা পুণ্যকর্ম, কখনাে কর্তব্য থেকে ছুটি নেন না। তারি প্রভাবে শশাঙ্কবাবু একমনে কাজ করতে শিখেছেন। কিন্তু যেদিন তুমি ভবানীপুরে যাও সেইদিনই ওঁর যেন মুখােশ খ’সে পড়ে, তােমার সঙ্গে ঝুটোপুটি বেধে যায়, চুলের কাঁটা তুলে নিয়ে খোঁপা এলিয়ে দেন, হাতে তােমার পড়বার বই দেখলে আলমারির মাথার উপর রাখেন তুলে। টেনিস খেলবার শখ হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে, হাতে কাজ থাকলেও।”
ঊর্মিকে মনে মনে মানতেই হােলো যে শশাঙ্কদা এই রকম দৌরাত্ম্য করেন ব’লেই তাঁকে ওর এত ভালো লাগে। ওর নিজের ছেলেমানুষি তাঁর কাছে এসে ঢেউ খেলিয়ে ওঠে। সেও তাঁর ’পরে কম অত্যাচার করে না। দিদি ওদের দুজনের এই দুরন্তপনা দেখে তাঁর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি হাসেন। কখনাে বা মৃদু তিরস্কারও করেন কিন্তু সেটা তিরস্কারের ভান।
নীরদ উপসংহারে বললে, “যেখানে তােমার নিজের স্বভাব প্রশ্রয় না পায় সেইখানেই তােমার থাকা চাই। আমি কাছে থাকলে ভাবনা থাকত না, কেননা আমার স্বভাব একেবারে তােমার বিপরীত। তােমার মন রক্ষে করতে গিয়ে তােমার মনকে মাটি করা এ আমার দ্বারা কখনােই হােতে পারত না।”
ঊর্মি মাথা নিচু করে বললে, “আপনার কথা আমি সর্বদাই স্মরণ রাখব।”
নীরদ বললে, “আমি কতকগুলাে বই তােমার জন্যে রেখে যাচ্ছি। তার যেসব চ্যাপ্টারে দাগ দিয়েছি সেইগুলাে বিশেষ ক’রে পােড়ো, এর পরে কাজে লাগবে।”
ঊর্মির পক্ষে এই সাহায্যের দরকার ছিল। কেননা ইদানীং মাঝে মাঝে তার মনে কেবলি সন্দেহ আসছিল, ভাবছিল হয়তাে প্রথম উৎসাহের মুখে ভুল করেছি। হয়তো ডাক্তারি আমার ধাতের সঙ্গে মিলবে না।
নীরদের দাগ-দেওয়া বইগুলো ওর পক্ষে শক্ত বাঁধনের কাজ করবে, ওকে টেনে নিয়ে চলতে পারবে উজানপথে।
নীরদ চলে গেলে ঊর্মি নিজের প্রতি আরাে কঠিন অত্যাচার করলে শুরু। কলেজে যায়, আর বাকি সময় নিজেকে যেন একেবামে জেনেনার মধ্যে বদ্ধ করে রাখে। সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে এসে যতই তার শান্ত মন ছুটি পেতে চায় ততই সে নিষ্ঠুরভাবে তাকে অধ্যয়নের শিকল জড়িয়ে আটকে রাখে। পড়া এগােয় না, একই পাতার উপর বার বার করে মন বৃথা ঘুরে বেড়ায় তবু হার মানতে চায় না। নীরদ উপস্থিত নেই বলেই তার দূরবর্তী ইচ্ছাশক্তি ওর প্রতি অধিক ক’রে কাজ করতে লাগল।
নিজের উপর সবচেয়ে ধিক্কার হয় যখন কাজ করতে করতে আগেকার দিনের কথা কেবলি ফিরে ফিরে মনে আসে। যুবকদলের মধ্যে ওর ভক্ত ছিল অনেক। সেদিন তাদের কাউকে বা উপেক্ষা করেছে, কারাে প্রতি ওর মনের টানও হয়েছিল। ভালােবাসা পরিণত হয়নি কিন্তু ভালােবাসার ইচ্ছেটাই তখন মৃদুমন্দ বসন্তের হাওয়ার মতাে মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াত। তাই আপন মনে গান গাইত গুন্ গুন্ ক’রে, পছন্দসই কবিতা কপি ক’রে রাখত খাতায়। মন অত্যন্ত উতলা হােলে বাজাত সেতার। আজকাল এক-একদিন সন্ধেবেলায় বইয়ের পাতায় যখন চোখ আছে তখন হঠাৎ চমকে উঠে’ জানতে পারে যে, তার মনে ঘুরছে এমন কোনােদিনের এমন কোনো মানুষের ছবি যে-দিনকে যে-মানুষকে পূর্বে সে কখনােই বিশেষভাবে আমল দেয়নি। এমন কি, সে-মানুষের অবিশ্রাম আগ্রহে সেদিন তাকে বিরক্ত করেছিল। আজ বুঝি তার সেই আগ্রহটাই নিজের ভিতরকার অতৃপ্তির বেদনাকে স্পর্শ ক’রে ক’রে যাচ্ছে। প্রজাপতির ক্ষণিক হালকা ডানা ফুলকে যেমন বসন্তের স্পর্শ দিয়ে যায়।
এসব চিন্তাকে যত বেগে সে মন থেকে দূর করতে চায় সেই বেগের প্রতিঘাতই চিন্তাগুলিকে ততই ওর মনে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। নীরদের একখানা ফোটোগ্রাফ রেখেছে ডেস্কের উপর। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে, আগ্রহের চিহ্ন নেই। সে ওকে ডাকে না, তবে ওর প্রাণ সাড়া দেবে কা’কে। মনে মনে কেবলি জপ করে, কী প্রতিভা, কী তপস্যা, কী নির্মল চরিত্র, কী আমার অভাবনীয় সৌভাগ্য।
একটা বিষয়ে নীরদের-জিত হয়েছে সে-কথাটাও বলা দরকার। নীরদের সঙ্গে ঊর্মির বিবাহের সম্বন্ধ হােলে শশাঙ্ক এবং সন্দিগ্ধমনা আরাে দশজন বিদ্রূপ ক’রে হেসেছিল। বলেছিল, রাজারামবাবু সাদা লােক, ঠাউরে বসেছেন নীরদ আইডিয়ালিস্ট। ওর আইডিয়ালিজ্ম্ যে গােপনে ডিম পাড়ছে ঊর্মির টাকার থলির মধ্যে, এ-কথাটা কি লম্বা লম্বা সাধুবাক্য দিয়ে ঢাকা যায়। আপনাকে স্যাক্রিফাইস করেছে বই কি, কিন্তু যে-দেবতার কাছে, তাঁর মন্দিরটা ইম্পীরিয়াল ব্যাঙ্কে। আমরা সোজাসুজি শ্বশুরকে জানিয়ে থাকি, টাকার দরকার আছে, আর সে-টাকা জলে পড়বে না, তাঁরই মেয়ের সেবায় লাগবে। ইনি মহৎ লোক, বলেন মহৎ উদ্দেশ্যের খাতিরেই বিয়ে করবেন। তার পরে সেই উদ্দেশ্যটাকে দিনে দিনে তর্জমা করবেন শ্বশুরের চেকবইয়ের খাতায়।
নীরদ জানত এইরকম কথাবার্তা অপরিহার্য। ঊর্মিকে বললে, আমার বিয়ে করার একটা শর্ত আছে; তোমার টাকা থেকে এক পয়সা নেব না, নিজের উপার্জন আমার একমাত্র অবলম্বন হবে। শ্বশুর ওকে য়ুরোপে পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন, ও কিছুতেই রাজি হোলো না। সেজন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করতেও হোলো। রাজারামবাবুকে জানিয়েছিল, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উপলক্ষ্যে যত টাকা দিতে চান সমস্তই দেবেন আপনার মেয়ের নামে। আমি যখন সেই হাসপাতালের ভার নেব তার থেকে কোনো বৃত্তি নেব না। আমি ডাক্তার, জীবিকার জন্যে আমার ভাবনা নেই।
এই একান্ত নিঃস্পৃহতা দেখে ওর ’পরে রাজারামের ভক্তি দৃঢ় হোলো, আর ঊর্মি খুব গর্ব অনুভব করলে। এই গর্বের ন্যায্য কারণ ঘটাতেই শর্মিলার মন নীরদের ’পরে একেবারে বিরূপ হয়ে গেল। বললে, “ঈস্, দেখব দেমাক কতদিন টেঁকে।” তার পর থেকে নীরদ যখন অভ্যাসমতাে অত্যন্ত গভীরভাবে কথা কইত শর্মিলা আলাপের মাঝখানে হঠাৎ উঠে’ প’ড়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যেত। কিছুদূর পর্যন্ত শােনা যেত তার পায়ের শব্দ। ঊর্মির খাতিরে কিছু বলত না কিন্তু তার না-বলার ব্যঞ্জনা যথেষ্ট তেজোত্তপ্ত ছিল।
প্রথম প্রথম নীরদ প্রতি মেলে চিঠিপত্রে চার-পাঁচ পাতা ধ’রে বিস্তারিত উপদেশ দিয়ে এসেছে। কিছুদিন পরে চমক লাগিয়ে দিলে টেলিগ্রাম। বড়াে অঙ্কের টাকার জরুরী দাবি, অধ্যয়নের প্রয়ােজনে। যে গর্ব এতদিন ঊর্মির প্রধান সম্বল ছিল তাতে যথেষ্ট ঘা লাগল বটে কিন্তু মনে একটু সান্ত্বনাও পেলে। যত দিন যায়, এবং নীরদের অনুপস্থিতি দীর্ঘ হয়ে ওঠে, ততই উর্মির পূর্ব স্বভাবটা কর্তব্যের বেড়ার মধ্যে ফাঁক খুঁজে বেড়ায়। নিজেকে নানাছলে ফাঁকিও দেয় অনুতাপও করে। এইরকম আত্মগ্লানির সময় নীরদকে অর্থসাহায্য ওর পরিতপ্ত মনের সান্ত্বনাজনক।
ঊর্মি টেলিগ্রামটা ম্যানেজারের হাতে দিয়ে সসংকোচে বলে, “কাকাবাবু, টাকাটা—”
ম্যানেজারবাবু বলেন, “ধাঁধা লাগছে। আমরা তো জানতুম টাকাটা ও-পক্ষে অস্পৃশ্য ছিল।” ম্যানেজার নীরদকে পছন্দ করতেন না।
ঊর্মি বলে, “কিন্তু বিদেশে—” কথাটা শেষ করে না।
কাকাবাবু বলেন, “এদেশের স্বভাব বিদেশের মাটিতে বদলে যেতে পারে সে জানি—কিন্তু আমরা তার সঙ্গে তাল রাখব কী ক’রে।”
ঊর্মি বলে, “টাকাটা না পেলে হয়তাে বিপদে পড়তে পারেন।”
“আচ্ছা বেশ, পাঠাচ্ছি মা, তুমি বেশি ভেবো না। ব’লে রাখছি এই শুরু হােলাে কিন্তু এই শেষ নয়।”
শেষ যে নয় অনতিকাল পরেই আরাে বড়ো অঙ্কে তার প্রমাণ হােলো। এবার প্রয়ােজন স্বাস্থ্যের। ম্যানেজার গম্ভীরমুখে বললেন, “শশাঙ্কবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করা ভালাে।”
উর্মি শশব্যস্ত হয়ে বললে, “আর যাই করাে, দিদিরা এ-খবরটা যেন না পান।”
“একলা এই দায়িত্ব নিতে ভালাে লাগছে না।”
“একদিন তো টাকা তাঁর হাতেই পড়বে।”
“পড়বার আগে দেখতে হবে যেন জলে না পড়ে।”
“কিন্তু ওঁর স্বাস্থ্যের কথা তাে ভাবতে হবে।”
“অস্বাস্থ্য নানা জাতের আছে, এটা ঠিক কোন্ জাতের বুঝে উঠতে পারছিনে। এখানে ফিরে এলে হয়তাে হাওয়ার বদলে সুস্থ হতে পারেন। ফিরতি প্যাসেজের ব্যবস্থা ক’রে পাঠানাে যাক।”
ফেরবার প্রস্তাবে ঊর্মি এত যে বেশি বিচলিত হয়ে উঠল ও নিজে ভাবলে তার কারণ পাছে নীরদের উচ্চ উদ্দেশ্য মাঝখানে বাধা পায়।
কাকা বললেন, “এবারকার মতাে টাকা পাঠাচ্ছি কিন্তু মনে হচ্ছে এতে ডাক্তারবাবুর স্বাস্থ্য আরাে বিগড়ে যাবে।”
রাধাগােবিন্দ ঊর্মির অনতিদূর সম্পর্কের আত্মীয়। কাকার কথাটার ইঙ্গিত ওকে বাজল। সন্দেহ এল মনে। ভাবতে লাগল, “দিদিকে হয়তাে বলতে হবে।” এদিকে নিজেকে ধাক্কা দিয়ে বার বার প্রশ্ন করছে, “যথােচিত দুঃখ হচ্ছে না কেন।”
এই সময়ে শর্মিলার রােগটা নিয়ে ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের কথা মনে পড়িয়ে ভয় লাগিয়ে দেয়। নানা ডাক্তার লাগল নানাদিক থেকে ব্যাধির আবাসগুহাটা খুঁজে বের করতে। শর্মিলা ক্লান্ত হাসি হেসে বললে, “সি. আই. ডি.দের হাতে অপরাধী যাবে ফসকে, খোঁচা খেয়ে মরবে নিরপরাধ।”
শশাঙ্ক চিন্তিতমুখে বললে, “দেহটার খানাতল্লাসি চলুক শাস্ত্রমতেই, কিন্তু খোঁচাটা কিছুতেই নয়।”
এই সময়টাতেই শশাঙ্কর হাতে দুটো ভারি কাজ এসেছিল। একটা গঙ্গার ধারে পাটকলে, আর একটা টালিগঞ্জের দিকে, মীরপুরের জমিদারদের নূতন বাগানবাড়িতে। পাটকলের কুলিবস্তির কাজটা শেষ ক’রে দেবার মেয়াদ ছিল তিন মাসের। গােটাকতক টিউবওয়েলেরও কাজ ছিল নানা জায়গায়। শশাঙ্কর একটুও ফুরসুত ছিল না। শমিলার ব্যামােটা নিয়ে প্রায় তাকে আটকা পড়তে হয় অথচ উৎকণ্ঠা থাকে কাজের জন্যে।
এতদিন ওদের বিবাহ হয়েছে কিন্তু এমন কোনাে ব্যামাে শর্মিলার হয়নি যা নিয়ে শশাঙ্ককে কখনাে বিশেষ ক’রে ভাবতে হয়েছে। তাই এবারকার এই রােগটার উদ্বেগে ছেলেমানুষের মতাে ছটফট করছে ওর মন। কাজ কামাই ক’রে ঘুরে ফিরে বিছানার কাছে নিরুপায়ভাবে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছ। তখনি শর্মিলা উত্তর দেয়, “তুমি মিথ্যে ভেবো না, আমি ভালোই আছি।” সেটা বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু বিশ্বাস করতে একান্ত ইচ্ছা ব’লেই শশাঙ্ক অবিলম্বে বিশ্বাস করে ছুটি পায়।
শশাঙ্ক বললে, “ঢেঙ্কানলের রাজার একটা বড়ো কাজ আমার হাতে এসেছে। প্ল্যানটা নিয়ে দেওয়ানের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। যত শীঘ্র পারি ফিরে আসব ডাক্তার আসবার আগেই।”
শর্মিলা অনুযোগ ক’রে বললে, “আমার মাথার দিব্যি রইল তাড়াতাড়ি ক’রে কাজ নষ্ট করতে পারবে না। বুঝতে পারছি ওদের দেশে তোমার যাবার দরকার আছে। নিশ্চয় যেয়ো, না গেলে আমি ভালো থাকব না। আমাকে দেখবার লোক ঢের আছে।”
প্রকাণ্ড একটা ঐশ্বর্য গড়ে তোেলবার সংকল্প দিনরাত জাগছে শশাঙ্কের মনে। তার আকর্ষণ ঐশ্বর্যে নয়, বড়োত্বে। বড়ো কিছুকে গড়ে তোলাতেই পুরুষের দায়িত্ব। অর্থ জিনিসটাকে তুচ্ছ ব’লে অবজ্ঞা করা চলে তখনি, যখন তাতে দিনপাত হয় মাত্র। যখন তার চূড়াকে সমুচ্চ ক’রে তোলা যায় তখনি সর্বসাধারণে তাকে শ্রদ্ধা করে। উপকার পায় ব’লে নয়, বড়ােত্ব দেখাটাতেই চিত্তস্ফূর্তি। শর্মিলার শিয়রে ব’সে শশাঙ্কর মনে যখন উদ্বেগ চলছে সেই মুহূর্তেই সে না ভেবে থাকতে পারে না তার কাজের সৃষ্টিতে অনিষ্টের আশঙ্কা ঘটছে কোন্খানে। শর্মিলা জানে শশাঙ্কের এই ভাবনা কৃপণের ভাবনা নয়, নিজের অবস্থার নিম্নতল হতে জয়স্তম্ভ ঊর্ধ্বে গেঁথে তােলবার জন্যে পুরুষকারের ভাবনা। শশাঙ্কের এই গৌরবে শর্মিলা গৌরবান্বিত। তাই স্বামী যে ওর রােগের সেবা নিয়ে কাজে ঢিল দেবে এ তার পক্ষে সুখের হােলেও ভালােই লাগে না। ওকে বারবার ফিরে পাঠায় তার কাজে।
এদিকে নিজের কর্তব্য নিয়ে শমিলার উৎকণ্ঠার সীমা নেই। সে রইল বিছানায় প’ড়ে, ঠাকুর-চাকররা কী কাণ্ড করছে কে জানে। মনে সন্দেহ নেই যে রান্নায় ঘি দিচ্ছে খারাপ, নাবার ঘরে যথাসময়ে গরমজল দিতে ভুলেছে, বিছানার চাদর বদল করা হয়নি, নর্দমাগুলােতে মেথরের ঝাঁটা নিয়মিত পড়ছে না। ওদিকে ধােবাবাড়ির কাপড় ফর্দ মিলিয়ে বুঝে না নিলে কী রকম উলােটপালট হয় সে তাে জানা আছে। থাকতে পারে না, লুকিয়ে বিছানা ছেড়ে তদন্ত করতে যায়, বেদনা বেড়ে ওঠে, জ্বর যায় চড়ে, ডাক্তার ভেবে পায় না, এ কী হােলো।
অবশেষে ঊর্মিমালাকে তার দিদি ডেকে পাঠালে। বললে, “কিছুদিন তাের কলেজ থাক্, আমার সংসারটাকে রক্ষা কর্ বােন। নইলে নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারছিনে।”
এই ইতিহাসটা যাঁরা পড়ছেন এই জায়গাটাতে এসে মুচকে হেসে বলবেন, বুঝেছি। বুঝতে অত্যন্ত বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। যা ঘটবার তা-ই ঘটে, আর তা-ই যথেষ্ট। এমনাে মনে করবার হেতু নেই ভাগ্যের খেলা চলবে তাসের কাগজ গােপন ক’রে, শর্মিলারই চোখে ধুলাে দিয়ে।
দিদির সেবা করতে চলেছি ব’লে ঊর্মির মনে খুবই একটা উৎসাহ হােলাে। এই কর্তব্যের খাতিরে অন্য সমস্ত কাজকে সরিয়ে রাখতেই হবে। উপায় নেই। তা ছাড়া এই শুশ্রূষার কাজটা ওর ভাবীকালের ডাক্তারি কাজেরই সংলগ্ন, এ-তর্কও তার মনে এসেছে।
ঘটা ক’রে একটা চামড়া-বাঁধানাে নােটবই নিলে। তার মধ্যে রােগের দৈনিক জোয়ারভাঁটার পরিমাণটাকে রেখাঙ্কিত করবার ছক কাটা আছে। ডাক্তার পাছে অনভিজ্ঞ ব’লে অবজ্ঞা করে এইজন্যে স্থির করলে দিদির রোগ সম্বন্ধে যেখানে যা পাওয়া যায় প’ড়ে নেবে। ওর এম. এস.সি. পরীক্ষার একটা বিষয় শারীরতত্ত্ব, এইজন্যে রোগতত্ত্বের পারিভাষিক বুঝতে ওর কষ্ট হবে না।অর্থাৎ দিদির সেবার উপলক্ষ্যে ওর কর্তব্যসূত্র যে ছিন্ন হবে না বরঞ্চ আরো বেশি একান্তমনে কঠিনতর চেষ্টায় তারই অনুসরণ করা হবে এ-কথাটা মনে সে নিশ্চিত ক’রে নিয়ে ওর পড়বার বই আর খাতাপত্র ব্যাগে পুরে ভবানীপুরের বাড়িতে এসে উপস্থিত হোলো। দিদির ব্যামোটা নিয়ে রোগতত্ত্বসম্বন্ধে মোটা বইটা নাড়াচাড়া করবার সুযোগ ঘটল না। কেননা বিশেষজ্ঞেরাও রোগের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারলে না।
উর্মি ভাবলে, সে শাসনকর্তার কাজ পেয়েছে। তাই সে গম্ভীরমুখে দিদিকে বললে, “ডাক্তারের কথা যাতে খাটে তাই দেখবার ভার আমার উপর, আমার কথা কিন্তু মেনে চলতে হবে আমি তোমাকে ব’লে রাখছি।”
দিদি ওর দায়িত্বের আড়ম্বর দেখে হেসে বললে, “তাই তো, হঠাৎ এত গম্ভীর হোতে শিখলি কোন্ গুরুর কাছে। নতুন দীক্ষা ব’লেই এত বেশি উৎসাহ। আমারই কথা মেনে চলবি ব’লেই তােকে আমি ডেকেছি। তাের হাসপাতাল তাে এখনাে তৈরি হয়নি, আমার ঘরকন্না তৈরি হয়েই আছে। আপাতত সেই ভারটা নে, তাের দিদি একটু ছুটি পাক।”
রোগশয্যার কাছ থেকে ঊর্মিকে জোর ক’রেই দিদি সরিয়ে দিলে।
আজ দিদির গৃহরাজ্যে প্রতিনিধিপদ ওর। সেখানে অরাজকতা ঘটছে, আশু তার প্রতিবিধান চাই সংসারের সর্বোচ্চ শিখরে একটিমাত্র যে পুরুষ বিরাজ করছেন তাঁর সেবায় সামান্য কোনাে ত্রুটি না হয়, এই মহৎ উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ত্যাগস্বীকার এই ঘরের ছােটোবড়ো সমস্ত অধিবাসীর একটিমাত্র সাধনার বিষয়। মানুষটি নিরতিশয় নিরুপায় দেহযাত্রানির্বাহে শােচনীয়ভাবে অকর্মণ্য এই সংস্কার কোনােমতেই শমিলার মন থেকে ঘুচতে চায় না। হাসিও পায় অথচ মনটা স্নেহসিক্ত হয়ে ওঠে যখন দেখে চুরটের আগুনে ভদ্রলােকের আস্তিন খানিকটা পুড়েছে অথচ লক্ষ্যই নেই। ভােরবেলায় মুখ ধুয়ে শােবার ঘরের কোণের কলটা খুলে রেখে এঞ্জিনিয়র কাজের তাড়ায় দৌড় দিয়েছে বাইরে, ফিরে এসে দেখে মেজে জলে থৈ থৈ করছে, নষ্ট হয়ে গেল কার্পেটটা। এই জায়গায় কলটা বসাবার সময়ে গােড়াতেই আপত্তি করেছিল শর্মিলা। জানত এই পুরুষটির হাতে বিছানার অদূরে ঐ কোণাটাতে প্রতিদিন জলেস্থলে একটা পঙ্কিল অনাসৃষ্টি বাধবে। কিন্তু মস্ত এঞ্জিনিয়র, বৈজ্ঞানিক সুবিধার দোহাই দিয়ে যতরকম অসুবিধাকে জটিল ক’রে তুলতেই ওর উৎসাহ। খামকা কী মাথায় এল একবার নিজের সম্পূর্ণ ওরিজিনাল প্ল্যানে একটা স্টোভ বানিয়ে বসল। তার এদিকে দরজা, ওদিকে দরজা, এদিকে একটা চোঙ ওদিকে আরেকটা, একদিকে আগুনের অপব্যয়হীন উদ্দীপন, আর একদিকে ঢালু পথে ছাইয়ের নিঃশেষে অধঃপতন—তার পরে সেঁকবার ভাজবার সিদ্ধ করবার জল-গরমের নানা আকারের খােপখাপ গুহাগহ্বর কলকৌশল। কলটাকে উৎসাহের ভঙ্গিতে ও ভাষাতেই মেনে নিতে হয়েছিল, ব্যবহারের জন্যে নয়, শান্তি ও সদ্ভাবরক্ষার জন্যে। প্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের এই খেলা! বাধা দিলে অনর্থ বাধে, অথচ দুদিনেই যায় ভুলে। চিরদিনের বাঁধা ব্যবস্থায় মন যায় না, উদ্ভট একটা-কিছু সৃষ্টি করে, আর স্ত্রীদের দায়িত্ব হচ্ছে, মুখে ওদের মতে সায় দেওয়া এবং কাজে নিজের মতে চলা। এই স্বামীপালনের দায় এতদিন আনন্দে বহন করে এসেছে শমিলা।
এতকাল তো কাটল। নিজেকে বিবর্জিত ক’রে শশাঙ্কের জগৎকে শর্মিলা কল্পনাই করতে পারে না। আজ ভয় হচ্ছে মৃত্যুর দূত এসে জগৎ আর জগদ্ধাত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় বুঝি বা। এমন কি ওর আশঙ্কা যে, মৃত্যুর পরেও শশাঙ্কের দৈহিক অযত্ন শর্মিলার বিদেহী আত্মাকে শান্তিহীন করে রাখবে। ভাগ্যে ঊর্মি ছিল। সে ওর মতো শান্ত নয়। তবু ওর হয়ে কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছে। সে-কাজও তো মেয়েদের হাতের কাজ। ঐ স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ না থাকলে পুরুষদের প্রতিদিনের জীবনের প্রয়োজনে রস থাকে না যে, সমস্তই যে কী রকম শ্রীহীন হয়ে যায়। তাই ঊর্মি যখন তার সুন্দর হাতে ছুরি নিয়ে আপেলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে রাখে, কমলালেবুর কোওয়াগুলিকে গুছিয়ে রাখে সাদা পাথরের থালার একপাশে, বেদানা ভেঙে তার দানাগুলিকে যত্ন ক’রে সাজিয়ে দেয় তখন শর্মিলা তার বোনের মধ্যে যেন নিজেকেই উপলব্ধি করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকে সর্বদাই কাজের ফরমাশ করছে—
ওর সিগারেট-কেস্টা ভরে দে না ঊর্মি;
দেখছিসনে ময়লা রুমালটা বদলাবার খেয়াল নেই;
ঐ দেখ, জুতােটা সিমেণ্টে বালিতে জমে নিরেট হয়ে রয়েছে। বেহারাকে সাফ করতে হুকুম করবে তার হুঁশ নেই;
বালিশের ওয়াড়গুলাে বদলে দে না ভাই;
ফেলে দে ঐ ছেঁড়া কাগজগুলাে ঝুড়ির মধ্যে;
একবার আপিসঘরটা দেখে আসিস তাে ঊর্মি, আমি নিশ্চয় বলছি, ওঁর ক্যাশবাক্সের চাবিটা ডেক্সের উপর ফেলে রেখে বেরিয়ে গেছেন।
ফুলকোপির চারাগুলি তুলে পোঁতবার সময় হােলো মনে থাকে যেন;
মালীকে বলিস, গােলাপের ডালগুলো ছেঁটে দিতে;
ঐ দেখ্ কোটের পিঠেতে চুন লেগেছে—এত তাড়া কিসের, একটু দাড়াও না—ঊর্মি, দে তো বােন, বুরুশ ক’রে।
ঊর্মি বই-পড়া মেয়ে, কাজ-করা মেয়ে নয়, তবু ভারি মজা লাগছে। যে কড়া নিয়মের মধ্যে সে ছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসে কাজকর্ম সমস্তই ওর কাছে অনিয়মের মতােই ঠেকছে। এই সংসারের কর্মধারার ভিতরে ভিতরে যে উদ্বেগ আছে, সাধনা আছে সে তাে ওর মনে নেই; সেই চিন্তার সূত্রটি আছে ওর দিদির মধ্যে। তাই ওর কাছে এই কাজগুলাে খেলা, একরকম ছুটি, উদ্দেশ্যবিবর্জিত উদ্যোগ। ও যেখানে এতদিন ছিল, এ তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জগৎ, এখানে ওর সম্মুখে কোনাে লক্ষ্য তর্জনী তুলে নেই, অথচ দিনগুলাে কাজ দিয়ে পূর্ণ, সে কাজ বিচিত্র। ভুল হয়, ত্রুটি হয়, তার জন্যে কঠিন জবাবদিহি নেই। যদি বা দিদি একটু তিরস্কার করতে চেষ্টা করে, শশাঙ্ক হেসে উড়িয়ে দেয়, যেন ঊর্মির ভুলটাতেই বিশেষ একটা রস আছে। বস্তুত আজকাল ওদের ঘরকন্নাতে দায়িত্বের গাম্ভীর্য চলে গেছে, ভুলচুকে কিছু আসে যায় না এমন একটা আলগা অবস্থা ঘটেছে; এইটেই শশাঙ্কের কাছে ভারি আরামের ও কৌতুকের। মনে হচ্ছে যেন পিক্নিক্ চলছে। আর ঊর্মি যে কিছুতেই চিন্তিত নয়, দুঃখিত নয়, লজ্জিত নয়, সব-তাতেই উচ্ছ্বসিত, এতে শশাঙ্কের নিজের মন থেকে তার গুরুভার কর্মের পীড়নকে লঘু করে দেয়। কাজ শেষ হােলেই, এমন কি, না হােলেও বাড়িতে ফিরে আসবার জন্যে ওর মন উৎসুক হয়ে ওঠে।
এ-কথা মানতেই হবে ঊর্মি কাজে পটু নয়। তবু একটা জিনিস লক্ষ্য ক’রে দেখা গেল কাজ দিয়ে না হোক, নিজেকে দিয়েই, এ বাড়ির অনেকদিনের মস্ত একটা অভাব পূরণ করেছে, সেই অভাবটা ঠিক যে কী তা নির্দিষ্ট ভাষায় বলা যায় না। তাই শশাঙ্ক যখন বাড়িতে আসে তখন সেখানকার হাওয়ায় খেলানো একটা ছুটির হিল্লোল অনুভব করে। সেই ছুটি কেবল ঘরের সেবায় নয়, কেবল অবকাশমাত্রে নয়, তার একটা রসময় স্বরূপ আছে। বস্তুত ঊর্মির নিজের ছুটির আনন্দ এখানকার সমস্ত শূন্যকে পূর্ণ করেছে, দিনরাত্রিকে চঞ্চল করে রেখেছে। সেই নিরন্তর চাঞ্চল্য কর্মক্লান্ত শশাঙ্কের রক্তকে দোলায়িত করে তোলে। অপর পক্ষে শশাঙ্ক ঊর্মিকে নিয়ে আনন্দিত, সেই প্রত্যক্ষ উপলব্ধিই ঊর্মিকে আনন্দ দেয়। এতকাল সেই সুখটাই ঊর্মি পায়নি। সে যে আপনার অস্তিত্বমাত্র দিয়ে কাউকে খুশি করতে পারে এই তথ্যটি অনেকদিন তার কাছে চাপা পড়ে গিয়েছিল এতেই তার যথার্থ গৌরবহানি হয়েছিল।
শশাঙ্কের খাওয়াপরা অভ্যাসমতে চলছে কি না, ঠিকসময়ে ঠিক জিনিসের জোগান হােলো কি হােলো না, সেটা এ বাড়ির প্রভুর মনে গৌণ হয়েছে আজ; অমনিতেই অকারণেই আছে প্রসন্ন। শর্মিলাকে সে বলে, “তুমি খুঁটিনাটি নিয়ে অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন। অভ্যাসের একটু হেরফের হোলে তো অসুবিধে হয় না, সে তো ভালােই লাগে।”
শশাঙ্কর মনটা এখন জোয়ার ভাঁটার মাঝখানকার নদীর মতাে। কাজের বেগটা থমথমে হয়ে এসেছে। একটু কোনো দেরিতেই বা বাধাতেই মুশকিল হবে লোকসান হবে এমনতরো উদ্বেগের কথা সদাসর্বদা শােনা যায় না। সে-রকম কিছু প্রকাশ হোলে ঊর্মি তার গাম্ভীর্য ভেঙে দেয়, হেসে ওঠে,—মুখের ভাবখানা দেখে বলে, “আজ তোমার জুজু এসেছিল বুঝি, সেই সবুজ পাগড়ি-পর কোন্-দেশী দালাল—ভয় দেখিয়ে গেছে বুঝি।”
শশাঙ্ক বিস্মিত হয়ে বলে, “তুমি তাকে জানলে কী ক’রে।” “আমি তাকে খুব চিনি। তুমি সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিলে, ও একলা বারান্দায় বসে ছিল। আমিই তাকে নানা কথা ব’লে ভুলিয়ে রেখেছিলুম। তারি বাড়ি বিকানীয়রে, তার স্ত্রী মরেছে মশারিতে আগুন লেগে, আর একটা বিয়ের সন্ধানে আছে।”
“তাহলে এখন থেকে হিসেব ক’রে সে রোজ আসবে যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। দিন স্ত্রীর ঠিকানা না মেলে ততদিন তার স্বপ্নটা জমবে।”
“আমাকে বলে যেয়ো ওর কাছ থেকে কী কাজ আদায় করতে হবে। ভাব দেখে বোধ হয় আমি পারব।”
আজকাল শশাঙ্কর মুনফার খাতায় নিরেনব্বইয়ের ওপারে যে মোটা অঙ্কগুলো চলৎ অবস্থায়, তারা মাঝে মাঝে যদি একটু সবুর করে সেটাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠবার মতো চাঞ্চল্য দেখা যায় না। সন্ধ্যাবেলায় রেডিয়োর কাছে কান পাতবার জন্যে শশাঙ্ক মজুমদারের উৎসাহ এতকাল অনভিব্যক্ত ছিল। আজকাল ঊর্মি যখন তাকে টেনে আনে তখন ব্যাপারটাকে তুচ্ছ এবং সময়টাকে ব্যর্থ মনে হয় না। এরোপ্লেন-ওড়া দেখবার জন্যে একদিন ভোরবেলা দমদম পর্যন্ত যেতে হোলো, বৈজ্ঞানিক কৌতুহল তার প্রধান আকর্ষণ নয়। নিউ মার্কেটে শপিং করতে এই তার প্রথম হাতে-খড়ি। এর আগে শর্মিলা মাঝে মাঝে মাছমাংস ফলমূল শাকসবজি কিনতে সেখানে যেত। সে জানত এ কাজটা বিশেষভাবে তারই বিভাগের। এখানে শশাঙ্ক যে তার সহযােগিতা করবে এমন কথা সে কখনাে মনেও করেনি ইচ্ছেও করেনি। কিন্তু ঊর্মি তো কিনতে যায় না, কেবল জিনিসপত্র উলটে পালটে দেখে বেড়ায়, ঘেঁটে বেড়ায়, দর করে। শশাঙ্ক যদি কিনে দিতে চায় তার টাকার ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে নিজের ব্যাগে হাজতে রাখে।
শশাঙ্কর কাজের দরদ ঊর্মি একটুও বােঝে না। কখনাে কখনাে অত্যন্ত বাধা দেওয়ায় শশাঙ্কর কাছে তিরস্কার পেয়েছে। তার ফল এমন শােকাবহ হয়েছিল যে তার শােচনীয়তা অপসারণ করবার জন্যে শশাঙ্ককে দ্বিগুণ সময় দিতে হয়েছে। একদিকে ঊর্মির চোখে বাম্পসঞ্চার অন্যদিকে অপরিহার্য কাজের তাড়া। তাই সংকটে প’ড়ে অবশেষে বাড়ির বাইরে চেম্বারেই ওর সমস্ত কাজকর্ম সেরে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু অপরাহ্ণ পেরলেই সেখানে থাকা দুঃসহ হয়ে ওঠে। কোনাে কারণে যেদিন বিশেষ দেরি করে সেদিন ঊর্মির অভিমান দুর্ভেদ্য মৌনের অন্তরালে দুরভিভব হয়ে ওঠে। এই রুদ্ধ অশ্রুতে কুহেলিকাচ্ছন্ন অভিমানটা ভিতরে ভিতরে শশাঙ্ককে আনন্দ দেয়। ভালাে মানুষটির মতাে বলে, “ঊর্মি, কথা কইবে না এ সত্যাগ্রহ রক্ষা করাই উচিত কিন্তু দোহাই ধর্ম, খেলবে না এমন পণ তো ছিল না।” তারপরে টেনিস-ব্যাট হাতে করে চলে আসে। খেলায় শশাঙ্ক জিতের কাছাকাছি এসে ইচ্ছে ক’রেই হারে। নষ্ট সময়ের জন্যে আবার পরের দিন সকালে উঠেই অনুতাপ করতে থাকে।
কোনাে একটা ছুটির দিনে বিকেলবেলায় শশাঙ্ক যখন ডানহাতে লাল-নীল পেনসিল নিয়ে বাঁ আঙুল গুলাে দিয়ে অকারণে চুল উসকোখুসকো করতে করতে আপিসের ডেস্কে বসে কোনাে একটা দুঃসাধ্য কাজের উপর ঝুঁকে পড়েছে, ঊর্মি এসে বলে, “তােমার সেই দালালের সঙ্গে ঠিক করেছি আজ আমাকে পরেশনাথের মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে। চলাে আমার সঙ্গে।
শশাঙ্ক মিনতি ক’রে বলে, “না ভাই, আজ না, এখন আমার ওঠবার জো নেই।”
কাজের গুরুত্বে ঊর্মি একটুও ভয় পায় না। বলে, “অবলা রমণীকে অরক্ষিত অবস্থায় সবুজ পাগড়িধারীর হাতে সমর্পণ করে দিতে সংকোচ নেই এই বুঝি তােমার শিভলরি।”
শেষকালে ওর টানাটানিতে শশাঙ্ক কাজ ফেলে যায় মােটর হাঁকিয়ে। এইরকম উৎপাত চলছে টের পেলে শর্মিলা বিষম বিরক্ত হয়। কেননা ওর মতে পুরুষের সাধনার ক্ষেত্রে মেয়েদের অনধিকার প্রবেশ কোনােমতেই মার্জনীয় নয়। ঊর্মিকে শর্মি লা বরাবর ছেলেমানুষ ব’লেই জেনেছে। আজো সেই ধারণাটা ওর মনে আছে। তা হােক, তাই ব’লে আপিসঘর তো ছেলেখেলার জায়গা নয়। তাই ঊর্মিকে ডেকে যথেষ্ট কঠিনভাবেই তিরস্কার করে। সে তিরস্কারের নিশ্চিত ফল হােতে পারত, কিন্তু স্ত্রীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে শশাঙ্ক স্বয়ং দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ঊর্মিকে আশ্বাস দিয়ে চোখ টিপতে থাকে। তাসের প্যাক দেখিয়ে ইশারা করে, ভাবখানা এই যে, “চলে এসাে, আপিসঘরে বসে তােমাকে পােকার খেলা শেখাব।” এখন খেলার সময় একেবারেই নয়, এবং খেলবার কথা মনে আনবারও সময় ও অভিপ্রায় ওর ছিল না। কিন্তু দিদির কঠোর ভর্ৎসনায় ঊর্মির মনে বেদনা লাগছে এটা তাকে যেন ঊর্মির চেয়েও বেশি বাজে। ও নিজেই তাকে অনুনয়, এমন কি ঈষৎ তিরস্কার ক’রে কাজের ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রাখতে পারত কিন্তু শর্মিলা যে এই নিয়ে ঊর্মিকে শাসন করবে এইটে সহ্য করা ওর পক্ষে বড়াে কঠিন।
শর্মিলা শশাঙ্ককে ডেকে বলে, “তুমি ওর সব আবদার এমন ক’রে শুনলে চলবে কেন। সময় নেই, অসময় নেই, তােমার কাজের লােকসান হয় যে।”
শশাঙ্ক বলে, “আহা ছেলেমানুষ, এখানে ওর সঙ্গী নেই কেউ, একটু খেলাধুলাে না পেলে বাঁচবে কেন।”
এই তো গেল নানাপ্রকার ছেলেমানুষি। ওদিকে শশাঙ্ক যখন বাড়ি তৈরির প্ল্যান নিয়ে পড়ে, ও তার পাশে চৌকি টেনে নিয়ে এসে বলে, বুঝিয়ে দাও। সহজেই বােঝে, গাণিতিক নিয়মগুলো জটিল ঠেকে না। শশাঙ্ক ভারি খুশি হয়ে উঠে ওকে প্রব্লেম দেয়, ও কষে নিয়ে আসে। জুট্ কোম্পানীর স্টীমলঞ্চে শশাঙ্ক কাজ তদন্ত করতে যায়, ও ধ’রে বসে, আমিও যাব। শুধু যায় তা নয়, মাপজোখের হিসাব নিয়ে তর্ক করে, শশাঙ্ক পুলকিত হয়ে ওঠে। ভরপুর কবিত্বের চেয়ে এর রস বেশি। এখন তাই চেম্বারের কাজ যখন বাড়িতে নিয়ে আসে তা নিয়ে ওর মনে আশঙ্কা থাকে না। লাইন টানা আঁক কষার কাজে তার সঙ্গী জুটেছে। ঊর্মিকে পাশে নিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কাজ এগােয়। খুব দ্রুতবেগে এগােয় না বটে, কিন্তু সময়ের দীর্ঘতাকে সার্থক মনে হয়।
এইখানটাতে শর্মিলাকে রীতিমতাে ধাক্কা দেয়। ঊর্মির ছেলেমানুষিও সে বােঝে, তার গৃহিণীপনার ত্রুটিও সস্নেহে সহ্য করে, কিন্তু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীবুদ্ধির দূরত্বকে স্বয়ং অনিবার্য ব’লে মেনে নিয়েছিল সেখানে ঊর্মির অবাধে গতিবিধি ওর একটুও ভালাে লাগে না। ওটা নিতান্তই স্পর্ধা। আপন আপন সীমা মেনে চলাকেই গীতা বলেন স্বধর্ম।
মনে মনে অত্যন্ত অধীর হয়েই একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা ঊর্মি, তাের কি ঐসব আঁকা জোখা আঁক কষা ট্রেস করা সত্যই ভালো লাগে।”
“আমার ভারি ভালাে লাগে দিদি।”
শর্মিলা অবিশ্বাসের সুরে বললে, “হাঁঃ, ভালাে লাগে। ওকে খুশি করবার জন্যেই দেখাস যেন ভালাে লাগে।”
না হয় তাই হােলাে। খাওয়ানােপরানাে সেবাযত্নে শশাঙ্ককে খুশি করাটা তাে শর্মিলার মনঃপূত। কিন্তু এই জাতের খুশিটা ওর নিজের খুশির জাতের সঙ্গে মেলে না।
শশাঙ্ককে বারবার ডেকে বলে, “ওকে নিয়ে সময় নষ্ট করাে কেন। ওতে যে তােমার কাজের ক্ষতি হয়। ও ছেলেমানুষ, এসব কী বুঝবে।”
শশাঙ্ক বলে, “আমার চেয়ে কম বােঝে না।”
মনে করে এই প্রশংসায় দিদিকে বুঝি আনন্দ দেওয়াই হােলো। নির্বোধ।
নিজের কাজের গৌরবে শশাঙ্ক যখন আপন স্ত্রীর প্রতি মনোেযােগকে খাটো করেছিল, তখন শর্মিলা সেটা যে শুধু অগত্যা মেনে নিয়েছিল তা নয়, তাতে সে গর্ব বােধ করত। তাই ইদানীং আপন সেবাপরায়ণ হৃদয়ের দাবি অনেক পরিমাণেই কমিয়ে এনেছে। ও বলত, পুরুষমানুষ রাজার জাত, দুঃসাধ্য কর্মের অধিকার ওদের নিয়তই প্রশস্ত করতে হবে। নইলে তারা মেয়েদের চেয়েও নীচু হয়ে যায়। কেননা মেয়েরা আপন স্বাভাবিক মাধুর্যে ভালােবাসার জন্মগত ঐশ্বর্যেই সংসারে প্রতিদিন আপন আসনকে সহজেই সার্থক করে। কিন্তু পুরুষের নিজেকে সার্থক করতে হয় প্রত্যহ যুদ্ধের দ্বারা। সেকালে রাজারা বিনা প্রয়ােজনেই রাজ্যবিস্তার করতে বেরােত। রাজ্যলােভের জন্যে নয়, নূতন ক’রে পৌরুষের গৌরব প্রমাণের জন্যে। এই গৌরবে মেয়েরা যেন বাধা না দেয়। শর্মিলা বাধা দেয়নি, ইচ্ছা ক’রেই শশাঙ্ককে তার লক্ষ্যসাধনায় সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিয়েছে। একসময়ে তাকে ওর সেবাজালে জড়িয়ে ফেলেছিল, মনে দুঃখ পেলেও সেই জালকে ক্রমশ খর্ব করে এনেছে। এখনাে সেবা যথেষ্ট করে অদৃশ্যে নেপথ্যে।
হায় রে, আজ ওর স্বামীর এ কী পরাভব দিনে দিনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। রােগশয্যা থেকে সব ও দেখতে পায় না, কিন্তু যথেষ্ট আভাস পায়। শশাঙ্কের মুখ দেখলেই বুঝতে পারে সে যেন সর্বদাই কেমন আবিষ্ট হয়ে আছে। ঐ একরত্তি মেয়েটা এসে অল্প এই কদিনেই এতবড় সাধনার আসন থেকে ঐ কর্মকঠিন পুরুষকে বিচলিত করে দিলে। আজ স্বামীর এই অশ্রদ্ধেয়তা শর্মিলাকে রােগের বেদনার চেয়েও বেশি করে বাজছে।
শশাঙ্কের আহারবিহার বেশবাসের চিরাচরিত ব্যবস্থায় নানারকম ত্রুটি হচ্ছে সন্দেহ নেই। যে পথ্যটা তার বিশেষ রুচিকর, সেটাই খাবার সময় হঠাৎ দেখা যায় অবর্তমান। তার কৈফিয়ত মেলে, কিন্তু কোনাে কৈফিয়তকে এ সংসার এতদিন আমল দেয়নি। এসব অনবধানতা ছিল অমার্জনীয়, কঠোর শাসনের যােগ্য; সেই বিধিবদ্ধ সংসারে আজ এতবড়ো যুগান্তর ঘটেছে যে গুরুতর ত্রুটিগুলােও প্রহসনের মতো হয়ে উঠল দোষ দেব কা’কে। দিদির নির্দেশমতাে ঊর্মি যখন রান্নাঘরে বেতের মােড়ার উপর বসে পাক প্রণালীর পরিচালনকার্যে নিযুক্ত, সঙ্গে সঙ্গে পাচক ঠাকরুনের পূর্বজীবনের বিবরণগুলির পর্যালােচনাও চলছে, এমন সময় শশাঙ্ক হঠাৎ এসে বলে, “ওসব এখন থাক্।”
“কেন কী করতে হবে।”
“আমার এবেলা ছুটি আছে, চলো, ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়ালের বিল্ডিংটা দেখবে। ওটার গুমর দেখলে হাসি পায় কেন তােমাকে বুঝিয়ে দেব।”
এতবড়াে প্রলোভনে কর্তব্যে ফাকি দিতে ঊর্মির মনও তৎক্ষণাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। শর্মিলা জানে পাকশালা থেকে তার সহােদরার অন্তর্ধানে আহার্যের উৎকর্ষসাধনে কোনাে ব্যত্যয় ঘটবে না, তবু স্নিগ্ধ হৃদয়ের যত্নটুকু শশাঙ্কের আরামকে অলংকৃত করে। কিন্তু আরামের কথা তুলে কী হবে, যখন প্রতিদিনই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, আরামটা সামান্য হয়ে গেছে, স্বামী হয়েছে খুশি।
এইদিক থেকে শর্মিলার মনে এল অশান্তি। রােগশয্যায় এপাশ-ওপাশ ফিরতে ফিরতে নিজেকে বার বার ক’রে বলছে, “মরবার আগে ঐ কথাটুকু বুঝে গেলুম; আর সবই করেছি, কেবল খুশি করতে পারিনি। ভেবেছিলুম ঊর্মিমালার মধ্যে নিজেকেই দেখতে পাব, কিন্তু ও তাে আমি নয়, ও যে সম্পূর্ণ আর এক মেয়ে।” জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, “আমার জায়গা ও নেয়নি, ওর জায়গা আমি নিতে পারব না। আমি চলে গেলে ক্ষতি হবে কিন্তু ও চলে গেলে সব শূন্য হবে।”
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, শীতের দিন আসছে, গরম কাপড়গুলো রােদ্দুরে দেওয়া চাই। ঊর্মি তখন শশাঙ্কর সঙ্গে পিং পং খেলছিল, ডেকে পাঠালে।
বললে, “ঊর্মি, এই নে চাবি। গরম কাপড়গুলাে ছাদের উপর রােদে মেলে দে গে।”
ঊর্মি আলমারিতে চাবি সবেমাত্র লাগিয়েছে এমন সময় শশাঙ্ক এসে বললে, “ওসব পরে হবে, ঢের সময় আছে। খেলাটা শেষ করে যাও।”
“কিন্তু দিদি—
“আচ্ছা, দিদির কাছে ছুটি নিয়ে আসছি।”
দিদি ছুটি দিলে, সেই সঙ্গে বড়ো একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।
দাসীকে ডেকে বললে, “দে তাে আমার মাথায় ঠাণ্ডাজলের পটি।”
যদিও অনেকদিন পরে হঠাৎ ঊর্মি ছাড়া পেয়ে যেন আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল, তবু সহসা এক-একদিন মনে পড়ত ওর জীবনের কঠিন দায়িত্ব। ও তাে স্বাধীন নয়, ও যে বাঁধা ওর ব্রতের সঙ্গে। তারি সঙ্গে মিলিয়ে যে-বাঁধন ওকে ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বেঁধেছে তার অনুশাসন আছে ওর ’পরে। ওর দৈনিক কর্তব্যের খুঁটিনাটি সেই তো স্থির করে দিয়েছে। ওর জীবনের ’পরে তার চিরকালের অধিকার এ-কথা ঊর্মি কোনােমতে অস্বীকার করতে পারে না। যখন নীরদ উপস্থিত ছিল স্বীকার করা সহজ ছিল, জোর পেত মনে। এখন ওর ইচ্ছে একেবারেই বিমুখ হয়ে গেছে অথচ কর্তব্যবুদ্ধি তাড়া দিচ্ছে। কর্তব্যবুদ্ধির অত্যাচারেই মন আরো যাচ্ছে বিগড়িয়ে। নিজের অপরাধ ক্ষমা করা কঠিন হয়ে উঠল ব’লেই অপরাধ প্রশ্রয় পেতে লাগল। বেদনায় আফিমের প্রলেপ দেবার জন্যে শশাঙ্কের সঙ্গে খেলায় আমোদে নিজেকে সর্বক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। বলে, যখন সময় আসবে তখন আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন যে-কয়দিন ছুটি ওসব কথা থাক্। আবার হঠাৎ এক-একদিন মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বই খাতা ট্রাঙ্কের থেকে বের করে তার উপরে মাথা গুঁজে বসে। তখন শশাঙ্কর পালা। বইগুলো টেনে নিয়ে পুনরায় বাক্সজাত ক’রে সেই বাক্সর উপর সে চেপে বসে। ঊর্মি বলে, “শশাঙ্কদা, ভারি অন্যায়। আমার সময় নষ্ট কোরো না।”
শশাঙ্ক বলে, “তোমার সময় নষ্ট করতে গেলে আমারো সময় নষ্ট। অতএব শোধবোধ।”
তারপরে খানিকক্ষণ কাড়াকাড়ির চেষ্টা ক’রে অবশেষে ঊর্মি হার মানে। সেটা যে ওর পক্ষে নিতান্ত আপত্তিজনক তা মনে হয় না। এইরকম বাধা পেলেও কর্তব্যবুদ্ধির পীড়ন দিনপাঁচ-ছয় একাদিক্রমে চলে, তারপরে আবার তার জোর কমে যায়। বলে, “শশাঙ্কদা, আমাকে দুর্বল মনে কোরো না। মনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করেই রেখেছি।”
“অর্থাৎ?”
“অর্থাৎ এখানে ডিগ্রি নিয়ে য়ুরােপে যাব ডাক্তারি শিখতে।”
“তার পরে?”
“তার পরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তার ভার নেব।”
“আর কার ভার নেবে। ঐ যে নীরদ মুখুজ্জে ব’লে একটা ইনসাফারেবল্”—
শশাঙ্কের মুখ চাপা দিয়ে ঊর্মি বলে “চুপ করাে। এই সব কথা বলো যদি তােমার সঙ্গে একেবারে ঝগড়া হয়ে যাবে।”
নিজেকে ঊর্মি খুব কঠিন ক’রে বলে, সত্য হােতে হবে আমাকে সত্য হােতে হবে। নীরদের সঙ্গে ওর যে-সম্বন্ধ বাবা স্বয়ং স্থির করে দিয়েছেন তার প্রতি খাঁটি না হােতে পারাকে ও অসতীত্ব ব’লে মনে করে।
কিন্তু মুশকিল এই যে, অপর পক্ষ থেকে কোনাে জোর পায় না। উর্মি যেন এমন একটি গাছ যা মাটিকে আঁকড়ে আছে কিন্তু আকাশের আলাে থেকে বঞ্চিত পাতাগুলাে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে আসে। এক-একসময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, মনে মনে ভাবে, এ মানুষটা চিঠির মতো চিঠি লিখতে পারে না কেন।
ঊর্মি অনেক কাল কনভেণ্টে পড়েছে। আর কিছু হােক ইংরেজিতে ওর বিদ্যে পাকা। সে-কথা নীরদের জানা ছিল। সেইজন্যেই ইংরেজি লিখে নীরদ ওকে অভিভূত করবে এই ছিল তার পণ। বাংলায় চিঠি লিখলে বিপদ বাঁচত কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বেচারা জানে না যে, সে ইংরেজি জানে না। ভারি ভারি শব্দ জুটিয়ে এনে, পুঁথিগত দীর্ঘপ্রস্থ বচন যােজনা ক’রে ওর বাক্যগুলােকে করে তুলত বস্তাবােঝাই গােরুর গাড়ির মতাে। ঊর্মির হাসি আসত, কিন্তু হাসতে সে লজ্জা পেত, নিজেকে তিরস্কার ক’রে বলত বাঙালীর ইংরেজিতে ত্রুটি হলে তা নিয়ে দোষ ধরা স্নবিশ্।
দেশে থাকতে মােকাবিলায় যখন নীরদ ক্ষণে ক্ষণে সদুপদেশ দিয়েছে তখন ওর রকম-সকমে সেগুলাে গভীর হয়ে উঠেছে গৌরবে। যতটা কানে শােনা যেত তার চেয়ে আন্দাজে তার ওজন হােত বেশি।
লম্বা চিঠিতে আন্দাজের জায়গা থাকে না। কোমর-বাঁধা ভারি ভারি কথা হালকা হয়ে যায়, মােটা মােটা আওয়াজেই ধরা পড়ে বলবার বিষয়ের কমতি।
নীরদের যে ভাবটা কাছে থাকতে ও সয়ে গিয়েছিল সেইটে দূরের থেকে ওকে সবচেয়ে বাজে। লােকটা একেবারেই হাসতে জানে না। চিঠিতে সবচেয়ে প্রকাশ পায় সেই অভাবটা। এই নিয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে তুলনা ওর মনে আপনিই এসে পড়ে।
তুলনার একটা উপলক্ষ্য এই সেদিন হঠাৎ ঘটেছে। কাপড় খুঁজতে গিয়ে বাক্সের তলা থেকে বেরােল পশমে-বােনা একপাটি অসমাপ্ত জুতো। মনে পড়ে গেল চার বছর আগেকার কথা। তখন হেমন্ত ছিল বেঁচে। ওরা সকলে মিলে গিয়েছিল দার্জিলিঙে। আমােদের অন্ত ছিল না। হেমন্তে আর শশাঙ্কে মিলে ঠাট্টাতামাশার পাগলা-ঝােরা বইয়ে দিয়েছিল। ঊর্মি তার এক মাসির কাছ থেকে পশমের কাজ নতুন শিখেছে। জন্মদিনে দাদাকে দেবে ব’লে একজোড়া জুতাে বুনছিল। তা নিয়ে শশাঙ্ক ওকে কেবলই ঠাট্টা করত, বলত, “দাদাকে আর যাই দাও, জুতো নয়, ভগবান মনু বলেছেন ওতে গুরুজনের অসম্মান হয়।” ঊর্মি কটাক্ষ ক’রে বলেছিল, “ভগবান মনু তবে কাকে প্রয়োেগ করতে বলেন।”
শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে বললে, “অসম্মানের সনাতন অধিকার ভগ্নীপতির। আমার পাওনা আছে। সেটা সুদে ভারি হয়ে উঠল।”
“মনে তাে পড়ছে না।”
“পড়বার কথা নয়। তখন ছিলে নিতান্ত নাবালিকা। সেই কারণেই তােমার দিদির সঙ্গে শুভলগ্নে যেদিন এই সৌভাগ্যবানের বিবাহ হয়, সেদিন বাসর-রজনীর কর্ণধারপদ গ্রহণ করতে পারোনি। আজ সেই কোমল করপল্লবের অরচিত কানমলাটাই রূপ গ্রহণ করছে সেই করপল্লবরচিত জুতােযুগলে। ওটার প্রতি আমার দাবি রইল জানিয়ে রেখে দিলুম।”
দাবি শােধ হয়নি, সে-জুতো যথাসময়ে প্রণামীরূপে নিবেদিত হয়েছিল দাদার চরণে। তারপর কিছুকাল পরে শশাঙ্কর কাছ থেকে ঊর্মি একখানি চিঠি পেল। পেয়ে খুব হেসেছে সে। সেই চিঠি আজও তার বাক্সে আছে। আজ খুলে সে আবার পড়লে:
“কাল তাে তুমি চলে গেলে। তােমার স্মৃতি পুরাতন হােতে না হােতে তােমার নামে একটা কলঙ্ক রটনা হয়েছে সেটা তােমার কাছে গোপন করা অকর্তব্য মনে করি।
আমার পায়ে একজোড়া তালতলীয় চটি অনেকেই লক্ষ্য করেছে। কিন্তু তার চেয়ে লক্ষ্য করেছে তার ছিদ্রভেদ ক’রে আমার চরণনখরপংক্তি মেঘমুক্ত চন্দ্রমালার মতো। (ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল দ্রষ্টব্য। উপমার যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ ঘটলে তোমার দিদির কাছে মীমাংসনীয়।) আজ সকালে আমার আপিসের বৃন্দাবন নন্দী যখন আমার সপাদুক চরণ স্পর্শ ক’রে প্রণাম করলে তখন আমার পদমর্যাদায় যে বিদীর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে তারি অগৌরব মনে আন্দোলিত হোলাে। সেবককে জিজ্ঞাসা করলেম, “মহেশ, আমার সেই অন্য নূতন চটি জোড়াটা গতিলাভ করেছে অন্য কোন্ অনধিকারীর শ্রীচরণে।” সে মাথা চুলকিয়ে বললে, “ও-বাড়ির ঊর্মি মাসিদের সঙ্গে আপনি যখন দার্জিলিঙ যান সেই সময়ে চটিজোড়াটাও গিয়েছিল। আপনি ফিরে এসেছেন সেই সঙ্গে ফিরে এসেছে তার একপাটি, আর এক পাটি—” তার মুখ লাল হয়ে উঠল। আমি এক ধমক দিয়ে বললুম, “বাস, চুপ।” সেখানে অনেক লােক ছিল। চটিজুতাে-হরণ হীনকায। কিন্তু মানুষের মন দুর্বল, লােভ দুর্দম, এমন কাজ করে ফেলে, ঈশ্বর বােধ করি ক্ষমা করেন। তবু অপহরণকাজে বুদ্ধির পরিচয় থাকলে দুষ্কার্যের গ্লানি অনেকটা কাটে। কিন্তু একপাটি চটি!!! ধিক্!!!
যে এ-কাজ করেছে, যথাসাধ্য তার নাম আমি উহ্য রেখেছি। সে যদি তার স্বভাবসিদ্ধ মুখরতার সঙ্গে এই নিয়ে অনর্থক চেঁচামেচি করে তাহলে কথাটা ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে যাবে। চটি নিযে চটাচটি সেইখানেই খাটে যেখানে মন খাঁটি। মহেশেব মতো নিন্দুকের মুখবন্ধ এখনি করতে পারাে একজোড়া শিল্পকাযখচিত চটির সাহায্যে। যেমন তার আস্পর্ধা। পায়ের মাপ এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি।”
চিঠিখানা পেয়ে ঊর্মি স্মিতমুখে পশমের জুতাে বুনতে বসেছিল কিন্তু শেষ করেনি। পশমের কাজে আর তার উৎসাহ ছিল না। আজ এটা আবিষ্কার ক’রে স্থির করলে এই অসমাপ্ত জুতোটাই দেবে শশাঙ্ককে সেই দার্জিলিঙ যাত্রার সাম্বৎসরিক দিনে। সে-দিন আর কয়েক সপ্তাহ পরেই আসছে। গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল— হায় রে কোথায় সেই হাস্যোজ্জ্বল আকাশে হালকাপাখায় উড়ে-যাওয়া দিনগুলি! এখন থেকে সামনে প্রসারিত নিরবকাশ কর্তব্যকঠোর মরুজীবন।
আজ ২৬শে ফাল্গুন। হােলিখেলার দিন। মফস্বলের কাজে এ-খেলায় শশাঙ্কের সময় ছিল না, এ-দিনের কথা তারা ভুলেই গেছে। ঊর্মি আজ তার শয্যাগত দিদির পায়ে আবিরের টিপ দিয়ে প্রণাম করেছে। তারপরে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলে শশাঙ্ক আপিসঘরের ডেস্কে ঝুঁকে প’ড়ে একমনে কাজ করছে। পিছন থেকে গিয়ে দিলে তার মাথায় আবির মাখিয়ে, রাঙিয়ে উঠল তার কাগজপত্র। মাতামাতির পালা পড়ে গেল। ডেস্কে ছিল দোয়াতে লাল কালি, শশাঙ্ক দিলে ঊর্মির শাড়িতে ঢেলে। হাত চেপে ধ’রে তার আঁচল থেকে ফাগ কেড়ে নিয়ে ঊর্মির মুখে দিলে ঘ’যে, তারপরে দৌড়াদৌড়ি ঠেলাঠেলি চেঁচামেচি। বেলা যায় চলে, স্নানাহারের সময় যায় পিছিয়ে, ঊর্মির উচ্চহাসির স্বরােচ্ছ্বাসে সমস্ত বাড়ি মুখরিত। শেষকালে শশাঙ্কের অস্বাস্থ্য আশঙ্কায় দূতের পরে দূত পাঠিয়ে শর্মিলা এদের নিবৃত্ত করলে।
দিন গেছে। রাত্রি হয়েছে অনেক। পুষ্পিত কৃষ্ণচূড়ার শাখাজাল ছাড়িয়ে পূর্ণচাঁদ উঠেছে অনাবৃত আকাশে। হঠাৎ ফাল্গুনের দমকা হাওয়ায় ঝর্ঝর শব্দে দোলাদুলি ক’রে উঠেছে বাগানের সমস্ত গাছপালা, তলাকার ছায়ার জাল তার সঙ্গে যােগ দিয়েছে। জানলার কাছে ঊর্মি চুপ ক’রে ব’সে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। বুকের মধ্যে রক্তের দোলা শান্ত হয়নি। আমের বােলের গন্ধে মন উঠেছে ভরে। আজ বসন্তে মাধবীলতার মজ্জায় মজ্জায় যে ফুল ফোটাবার বেদনা সেই বেদনা যেন ঊর্মির সমস্ত দেহকে ভিতর থেকে উৎসুক করেছে। পাশের নাবার ঘরে গিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে, গা মুছলে ভিজে তােয়ালে দিয়ে। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে কিছুক্ষণ পরে স্বপ্নজড়িত ঘুমে আবিষ্ট হয়ে পড়ল।
রাত্রি তিনটের সময় ঘুম ভেঙেছে। চাঁদ তখন জানলার সামনে নেই। ঘরে অন্ধকার, বাইরে আলােয় ছায়ায় জড়িত সুপারিগাছের বীথিকা। ঊর্মির বুক ফেটে কান্না এল, কিছুতে থামতে চায় না। উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগল। প্রাণের এই কান্না, ভাষায় এর শব্দ নেই, অর্থ নেই। প্রশ্ন করলে ও কি বলতে পারে কোথা থেকে এই বেদনার জোয়ার উদ্বেলিত হয়ে ওঠে ওর দেহে মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনের কর্মতালিকা, রাত্রের সুখনিদ্রা।
সকালে ঊর্মি যখন ঘুম ভেঙে উঠল তখন ঘরের মধ্যে রৌদ্র এসে পড়েছে। সকালবেলাকার কাজে ফাঁক পড়ল, ক্লান্তির কথা মনে ক’রে শর্মিলা ওকে ক্ষমা করেছে। কিসের অনুতাপে ঊর্মি আজ অবসন্ন। কেন মনে হচ্ছে ওর হার হােতে চলল। দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তো তােমার কোনাে কাজ করতেই পারিনে—বলো তো বাড়ি ফিরে যাই।”
আজ তাে শর্মিলা বলতে পারলে না, “না যাসনে।” বললে, “আচ্ছা যা তুই। তাের পড়াশুনাের ক্ষতি হচ্ছে। যখন মাঝে মাঝে সময় পাবি দেখে শুনে যাস।”
শশাঙ্ক তখন কাজে বেরিয়ে গেছে। সেই অবকাশে সেইদিনই ঊর্মি বাড়ি চলে গেল।
শশাঙ্ক সে-দিন যান্ত্রিক ছবি আঁকার এক সেট সরঞ্জাম কিনে বাড়ি ফিরলে। ঊর্মিকে দেবে, কথা ছিল তাকে এই বিদ্যেটা শেখাবে। ফিরে এসে তাকে যথাস্থানে না দেখতে পেয়ে শর্মিলার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল, “ঊর্মি গেল কোথায়।”
শর্মিলা বললে, “এখানে তার পড়াশুনাের অসুবিধে হচ্ছে ব’লে সে বাড়ি চলে গেছে।”
“কিছুদিন অসুবিধে করবে ব’লে সে তো প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। অসুবিধের কথা হঠাৎ আজই মনে উঠল কেন।”
কথার সুর শুনে শর্মিলা বুঝলে শশাঙ্ক তাকেই সন্দেহ করছে। সে-সম্বন্ধে কোনাে বৃথা তর্ক না করে বললে, “আমার নাম ক’রে তুমি তাকে ডেকে নিয়ে এসো, নিশ্চয় কোনাে আপত্তি করবে না।”
ঊর্মি বাড়িতে ফিরে এসে দেখলে অনেকদিন পরে বিলেত থেকে ওর নামে নীরদের চিঠি এসে অপেক্ষা করছে। ভয়ে খুলতেই পারছিল না। মনে জানে নিজের তরফে অপরাধ জমা হয়ে উঠেছে। নিয়মভঙ্গের কৈফিয়ত স্বরূপ এর আগে দিদির রােগের উল্লেখ করেছিল। কিছুদিন থেকে কৈফিয়তটা প্রায় এসেছে মিথ্যে হয়ে। শশাঙ্ক বিশেষ জেদ ক’রে শর্মিলার জন্যে দিনে একজন রাত্রে একজন নার্স নিযুক্ত করে দিয়েছে। ডাক্তারের বিধানমতে রােগীর ঘরে সর্বদা আত্মীয়দের আনাগােনা তারা রােধ করে। ঊর্মি মনে জানে নীরদ দিদির রােগের কৈফিয়তটাকেও গুরুতর মনে করবে না, বলবে, “ওটা কোনাে কাজের কথা নয়।” বস্তুতই কাজের কথা নয়। আমাকে তাে দরকার হচ্ছে না। অনুতপ্তচিত্তে স্থির করলে এবারে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইব। বলব আর কখনাে ত্রুটি হবে না, কিছুতে নিয়মভঙ্গ করব না।
চিঠি খােলবার আগে অনেকদিন পরে আবার বের করলে সেই ফোটোগ্রাফখানা। টেবিলের উপর রেখে দিলে। জানে ঐ ছবিটা দেখলে শশাঙ্ক খুব বিদ্রূপ করবে। তবু ঊর্মি কিছুতেই কুণ্ঠিত হবে না তার বিদ্রূপে; এই তার প্রায়শ্চিত্ত। নীরদের সঙ্গে ওর বিবাহ হবে এই প্রসঙ্গটা দিদিদের বাড়িতে ও চাপা দিত। অন্যেরাও তুলত না কেননা এ প্রসঙ্গটা ওখানকার সকলের অপ্রিয়। আজ হাত মুঠো ক’রে ঊর্মি স্থির করলে—ওর সকল ব্যবহারেই এই সংবাদটা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করবে। কিছুদিন থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এনগেজমেণ্ট আঙটি। সেটা বের ক’রে পরলে। আঙটিটা নিতান্তই কম দামের,—নীরদ আপন অনেস্ট গরিবিয়ানার গর্বের দ্বারাই ঐ সস্তা আঙটির দাম হীরের চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ভাবখানা এই যে, “আঙ্টির দামেই আমার দাম নয় আমার দামেই আঙটির দাম।”
নিজেকে যথাসাধ্য শোধন করে নিয়ে ঊর্মি অতি ধীরে লেফাফাটা খুললে।
চিঠিখানা প’ড়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছা করল নাচতে, কিন্তু নাচ ওর অভ্যেস নেই। সেতারটা ছিল বিছানার উপর, সেটা তুলে নিয়ে সুর না বেঁধেই ঝনাঝন ঝংকার দিয়ে যা-তা বাজাতে লাগল।
ঠিক এমন সময়ে শশাঙ্ক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলে, “ব্যাপারখানা কী। বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেল বুঝি?”
“হাঁ শশাঙ্কদা, স্থির হয়ে গেছে।”
“কিছুতেই নড়চড় হবে না?”
“কিছুতেই না।”
“তাহলে এইবেলা সানাই বায়না দিই, আর ভীমনাগের সন্দেশ?”
“তােমাকে কোনাে চেষ্টা করতে হবে না।”
“নিজেই সব করবে? ধন্য বীরাঙ্গনা। আর কনেকে আশীর্বাদ?”
“সে-আশীর্বাদের টাকাটা আমার নিজের পকেট থেকেই গেছে।”
“মাছের তেলেই মাছভাজা? ভালাে বােঝা গেল না।”
“এই নাও বুঝে দেখো।”
ব’লে চিঠিখানা ওর হাতে দিলে।
পড়ে শশাঙ্ক হাে হো করে হেসে উঠল।
লিখছে, যে-রিসার্চের দুরূহ কাজে নীরদ আত্মনিবেদন করতে চায়, ভারতবর্ষে তা সম্ভব নয়। সেই জন্যেই ওর জীবনে আর একটা মস্ত স্যাক্রিফাইস মেনে নিতে হােলো। ঊর্মির সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন না করলে উপায় নেই। একজন য়ুরােপীয় মহিলা ওকে বিবাহ ক’রে ওর কাজে আত্মদান করতে সম্মত। কিন্তু কাজটা সেই একই, ভারতবর্ষেই করা হােক আর এখানেই। রাজারামবাবু যে-কাজের জন্য অর্থ দিতে চেয়েছিলেন, তার কিয়দংশ সেখানে নিযুক্ত করলে অন্যায় হবে না। তাতে মৃতব্যক্তির ’পরে সম্মান করাই হবে।
শশাঙ্ক বললে, “জীবিত ব্যক্তিটাকে কিছু কিছু দিয়ে যদি সেই দূরদেশেই দীর্ঘকাল জিইয়ে রাখতে পারাে তাে মন্দ হয় না। টাকা বন্ধ করলে পাছে খিদের জ্বালায় মরিয়া হয়ে এখানে দৌড়ে আসে এই ভয় আছে।”
ঊর্মি হেসে বললে, “সে-ভয় যদি তােমার মনে থাকে, টাকা তুমিই দিয়ো, আমি এক পয়সাও দেব না।”
শশাঙ্ক বললে, “আবার তাে মন বদল হবে না। মানিনীর অভিমান তো অটল থাকবে।”
“বদল হোলে তােমার তাতে কী শশাঙ্কদা।”
“প্রশ্নের সত্য উত্তর দিলে অহংকার বেড়ে যাবে, অতএব তােমার হিতের জন্যে চুপ করে রইলুম। কিন্তু ভাবছি, লোকটার গণ্ডদেশ তো কম নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে চীক্।”
ঊর্মির মনের মধ্যে থেকে প্রকাণ্ড একটা ভার নেমে গেল—বহুদিনের ভার। মুক্তির আনন্দে ও কী যে করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। ওর সেই কাজের ফর্দটা ছিঁড়ে ফেলে দিলে। গলিতে ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইছিল, জানালা থেকে আঙটিটা ছুঁড়ে ফেললে তার দিকে।
জিজ্ঞাসা করলে, “এই পেনসিলের দাগ দেওয়া মোটা বইগুলো কি কোনো হকার কিনবে।”
“নাই যদি কেনে, তার ফলাফলটা কী আগে শুনি।”
“যদি ওর মধ্যে সাবেককালের ভূতটা বাসা করে। মাঝে মাঝে অর্ধেক রাত্রে তর্জনী তুলে আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়।”
“সে আশঙ্কা যদি থাকে হকারের অপেক্ষা করব না, আমি নিজেই কিনব।”
“কিনে কী করবে।”
“হিন্দুশাস্ত্রমতে অন্ত্যেষ্টিসৎকার। গয়া পর্যন্ত যেতে রাজি, তাতে যদি তোমার মন সান্ত্বনা পায়।”
“না, অতটা বাড়াবাড়ি সইবে না।”
“আচ্ছা, আমার লাইব্রেরির কোণে পিরামিড বানিয়ে ওদের মামি করে রেখে দেব।”
“আজ কিন্তু তুমি কাজে বেরােতে পাবে না।”
“সমস্ত দিন?”
“সমস্ত দিনই।”
“কী করতে হবে।”
“মােটরে ক’রে উধাও হয়ে যাব।”
“দিদির কাছে ছুটি নিয়ে এসে গে।”
“না, ফিরে এসে দিদিকে বলব, তখন খুব বকুনি খাব। সে-বকুনি সইবে।”
“আচ্ছা, আমিও তােমার দিদির বকুনি হজম করতে রাজি, টায়ার যদি ফাটে দুঃখিত হব না, ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইল বেগে দুটো-চারটে মানুষ চাপা দিয়ে একেবারে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছতে আপত্তি নেই কিন্তু তিন সত্যি দাও যে মােটর-রথযাত্রা সাঙ্গ ক’রে আমাদেরি বাড়িতে তুমি ফিরে আসবে।”
“আসব, আসব, আসব।”
মােটরযাত্রার শেষে ভবানীপুরের বাড়িতে দুজনে এল, কিন্তু ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইলের বেগ রক্ত থেকে এখনো কিছুতেই থামতে চায় না। সংসারের সমস্ত দাবি সমস্ত ভয় লজ্জা এই বেগের কাছে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
কয়দিন শশাঙ্কের সব কাজ গেল ঘুলিয়ে। মনের ভিতরে ভিতরে সে বুঝেছে যে, এটা ভালো হচ্ছে না। কাজের ক্ষতি খুব গুরুতর হওয়াও অসম্ভব নয়। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুর্ভাবনায় দুঃসম্ভাবনাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখে। কিন্তু পরের দিনে আবার সে স্বাধিকারপ্রমত্ত, মেঘদূতের যক্ষের মতন। মদ একবার খেলে তার পরিতাপ ঢাকতে আবার খেতে হয়।