দুই বোন/শশাঙ্ক
শশাঙ্ক
কিছুকাল এই রকম যায়। লাগল চোখে ঘাের, মন উঠল আবিল হয়ে।
নিজেকে সুস্পষ্ট বুঝতে ঊর্মির সময় লেগেছে, কিন্তু একদিন হঠাৎ চমকে উঠে বুঝলে।
মথুরদাদাকে ঊর্মি কী জানি কেন ভয় করত, এড়িয়ে বেড়াত তাকে। সেদিন মথুর সকালে দিদির ঘরে এসে বেলা দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে গেল।
তারপরে দিদি ঊর্মিকে ডেকে পাঠালে। মুখ তার কঠোর অথচ শান্ত। বললে, “প্রতিদিন ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে কী কাণ্ড করেছিস জানিস তা।”
ঊর্মি ভয় পেয়ে গেল। বললে, “কী হয়েছে দিদি।” দিদি বললে, “মথুরদাদা জানিয়ে গেল, কিছুদিন ধরে তাের ভগ্নীপতি নিজে কাজ একেবারে দেখেননি। জহরলালের উপরে ভার দিয়েছিলেন সে মালমসলায় দুহাত চালিয়ে চুরি করেছে, বড়ো বড়ো গুদামঘরের ছাদ একেবারে ঝাঁজরা, সেদিনকার বৃষ্টিতে ধরা পড়েছে, মাল যাচ্ছে নষ্ট হয়ে। আমাদের কোম্পানির মস্ত নাম, তাই ওরা পরীক্ষা করেনি, এখন মস্ত অখ্যাতি এবং লোকসানের দায় পড়েছে ঘাড়ে। মথুরদাদা স্বতন্ত্র হবেন।”
ঊর্মির বুক ধক্ করে উঠল, মুখ হয়ে গেল পাঁশের মতো। এক মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় আপন মনের প্রচ্ছন্ন রহস্য প্রকাশ পেলে। স্পষ্ট বুঝলে, কখন অজ্ঞাতসারে তার মনের ভিতরটা উঠেছিল মাতাল হয়ে, —ভালোমন্দ কিছুই বিচার করতে পারেনি। শশাঙ্কর কাজটাই যেন ছিল তার প্রতিযোগী, তারি সঙ্গে ওর আড়াআড়ি। কাজের থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে সর্বদা সম্পূর্ণ কাছে পাবার জন্যে ঊর্মি কেবল ভিতরে ভিতরে ছটফট করত। কতদিন এমন ঘটেছে, শশাঙ্ক যখন স্নানে, এমন সময় কাজের কথা নিয়ে লোক এসেছে; ঊর্মি কিছু না ভেবে ব’লে পাঠিয়েছে “বল্গে এখন দেখা হবে না।”
ভয়, পাছে স্নান ক’রে এসেই শশাঙ্ক আর অবকাশ না পায়, পাছে এমন ক’রে কাজে জড়িয়ে পড়ে যে, ঊর্মির দিনটা হয় ব্যর্থ। তার দুরন্ত নেশার সাংঘাতিক ছবিটা সম্পূর্ণ চোখে জেগে উঠল। তৎক্ষণাৎ দিদির পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল। বারবার ক’রে রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলতে লাগল, “তাড়িয়ে দাও তোমাদের ঘর থেকে আমাকে। এখনি দূর করে তাড়িয়ে দাও।”
আজ দিদি নিশ্চিত স্থির করে বসেছিল কিছুতেই ঊর্মিকে ক্ষমা করবে না। মন গেল গলে।
আস্তে আস্তে ঊর্মিমালার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “কিছু ভাবিসনে, যা হয় একটা উপায় হবে।”
ঊর্মি উঠে বসল। বললে, “দিদি তোমাদেরই বা কেন লোকসান হবে। আমারো তো টাকা আছে।”
শর্মিলা বললে, “পাগল হয়েছিস? আমার বুঝি কিছু নেই। মথুরদাদাকে বলেছি, এই নিয়ে তিনি যেন কিছু গোল না করেন। লোকসান আমি পুরিয়ে দেব। আর তোকেও বলছি, আমি যে কিছু জানতে পেরেছি এ-কথা যেন তোর ভগ্নীপতি না টের পান।”
“মাপ করো, দিদি, আমাকে মাপ করো” এই ব’লে ঊর্মি আবার দিদির পায়ের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল।
শর্মিলা চোখের জল মুছে ক্লান্ত সুরে বললে, “কে কাকে মাপ করবে বোন। সংসারটা বড় জটিল। যা মনে করি, তা হয় না, যার জন্যে প্রাণপণ করি তা যায় ফেঁসে।”
দিদিকে ছেড়ে ঊর্মি একমুহূর্ত নড়তে চায় না। ওষুধপত্র দেওয়া, নাওয়ানো খাওয়ানাে শোওয়ানাে সমস্ত খুঁটিনাটি নিজের হাতে। আবার বই পড়তে আরম্ভ করেছে, সেও দিদির বিছানার পাশে ব’সে। নিজেকেও আর বিশ্বাস করে না, শশাঙ্ককেও না।
ফল হােলাে এই যে, শশাঙ্ক বারবার আসে রােগীর ঘরে। পুরুষমানুষের অন্ধতাবশতই বুঝতে পারে না ছটফটানির তাৎপর্য স্ত্রীর কাছে পড়ছে ধরা, লজ্জায় মরছে ঊর্মি। শশাঙ্ক আসে মােহনবাগান ফুটবল ম্যাচের প্রলােভন নিয়ে, ব্যর্থ হয়। পেনসিলের দাগ দেওয়া খবরের কাগজ মেলে দেখায় বিজ্ঞাপনে চার্লি চ্যাপলিনের নাম। ফল হয় না কিছুই। ঊর্মি যখন দুর্লভ ছিল না তখনও বাধার ভিতর দিয়ে শশাঙ্ক কাজকর্ম চালাতে চেষ্টা করত। এখন অসম্ভব হয়ে এল।
হতভাগার এই নিরর্থক নিপীড়নে প্রথম প্রথম শর্মিলা বড় দুঃখেও সুখ পেত। কিন্তু ক্রমে দেখলে ওর যন্ত্রণা উঠছে প্রবল হয়ে, মুখ গেছে শুকিয়ে, চোখের নিচে পড়ছে কালি। ঊর্মি খাওয়ার সময় কাছে বসে না, সেজন্য শশাঙ্কর খাওয়ার উৎসাহ এবং পরিমাণ কমে যাচ্ছে তা ওকে দেখলেই বােঝা যায়। সম্প্রতি হঠাৎ এ বাড়িতে আনন্দের যে বান ডেকে এসেছিল সেটা গেছে সম্পূর্ণ ভাঁটিয়ে, অথচ পূর্বে ওদের যে-একটা সহজ দিনযাত্রা ছিল সেও রইল না।
একদা শশাঙ্ক নিজের চেহারার চর্চায় উদাসীন ছিল। নাপিতকে দিয়ে চুল ছাঁটাত প্রায় ন্যাড়া ক’রে। আঁচড়াবার প্রয়োজন ঠেকেছিল সিকির সিকিতে। শর্মিলা তাই নিয়ে অনেকবার প্রবল বাগবিতণ্ডা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ইদানীং ঊর্মির উচ্চহাস্যসংযুক্ত সংক্ষিপ্ত আপত্তি নিষ্ফল হয়নি। নূতন সংস্করণের কেশোদ্গমের সঙ্গে সুগন্ধি তৈলের সংযোগ-সাধন শশাঙ্কর মাথায় এই প্রথম ঘটল। কিন্তু তার পর আজকাল কেশোন্নতিবিধানের অনাদরেই ধরা পড়ছে অন্তর্বেদনা। এতটা বেশি যে, এ নিয়ে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য তীব্র হাসি আর চলে না। শর্মিলার উৎকণ্ঠা তার ক্ষোভকে ছাড়িয়ে গেল। স্বামীর প্রতি করুণায় ও নিজের প্রতি ধিক্কারে তার বুকের মধ্যে টন্টন্ করে উঠছে, রোগের ব্যথাকে দিচ্ছে এগিয়ে।
ময়দানে হবে কেল্লার ফৌজদারের যুদ্ধের খেলা। শশাঙ্ক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে এল, “যাবে ঊর্মি, দেখতে। ভালো জায়গা ঠিক করে রেখেছি।”
ঊর্মি কোনো উত্তর দেবার পূর্বেই শর্মিলা ব’লে উঠল, “যাবে বই কি। নিশ্চয় যাবে। একটু বাইরে ঘুরে আসবার জন্যে ও যে ছটফট করছে।”
প্রশ্রয় পেয়ে দুদিন না যেতেই জিজ্ঞাসা করলে, “সার্কাস?”
এ প্রস্তাবে ঊর্মিমালার উৎসাহই দেখা গেল।
তারপরে, “বোটানিকাল গার্ডেন?”
এইটেতে একটু বাধল। দিদিকে ফেলে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে ঊর্মির মন সায় দিচ্ছে না।
দিদি স্বয়ং পক্ষ নিল শশাঙ্কর। রাজ্যের রাজমজুরদের সঙ্গে দিনে দুপুরে ঘুরে ঘুরে খেটে খেটে মানুষটা যে হয়রান হোলো, সারাদিন কেবল কাটছে ধুলোবালির মধ্যে। হাওয়া না খেয়ে এলে শরীর যে পড়বে ভেঙে।
এই একই যুক্তি অনুসারে স্টীমারে ক’রে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ঘুরে আসা অসংগত হোলো না।
শর্মিলা মনে মনে বলে, যার জন্যে কাজ খোয়াতে ওর ভাবনা নেই তাকে সুদ্ধ খোয়ানো ওর সইবে না।
শশাঙ্ককে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলেনি বটে কিন্তু চারিদিক থেকেই সে একটা অব্যক্ত সমর্থন পাচ্ছে। শশাঙ্ক একরকম ঠিক করে নিয়েছে, শর্মিলার মনে বিশেষ কোনাে ব্যথা নেই, ওদের দুজনকে একত্র মিলিয়ে খুশি দেখেই সে খুশি। সাধারণ মেয়ের পক্ষে এটা সম্ভব হােতে পারত না কিন্তু শর্মিলা যে অসাধারণ। শশাঙ্কর চাকরির আমলে একজন আর্টিস্ট রঙিন পেনসিল দিয়ে শর্মিলার একটা ছবি এঁকেছিল। এতদিন সেটা ছিল পাের্টফোলিয়াের মধ্যে। সেইটেকে বের করে বিলিতি দোকানে খুব দামি ফ্যাশানে বাঁধিয়ে নিয়ে আপিসঘরে যেখানে বসে ঠিক তার সমুখে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলে। সামনের ফুলদানিতে রোজ মালী ফুল দিয়ে যায়।
অবশেষে একদিন শশাঙ্ক বাগানে সূর্যমুখী কী রকম ফুটেছে দেখাতে দেখাতে হঠাৎ ঊর্মির হাত চেপে ধরে বললে, “তুমি নিশ্চয় জানাে, তােমাকে আমি ভালােবাসি। আর তােমার দিদি, তিনি তাে দেবী। তাঁকে যত ভক্তি করি জীবনে আর কাউকে তেমন করিনে। তিনি পৃথিবীর মানুষ নন, তিনি আমাদের অনেক উপরে।”
এ-কথা দিদি বারবার ক’রে ঊর্মিকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার অবর্তমানে সবচেয়ে যেটা সান্ত্বনার বিষয় সে ঊর্মিকে নিয়েই। এ সংসারে অন্য কোনাে মেয়ের আবির্ভাব কল্পনা করতেও দিদিকে বাজত, অথচ শশাঙ্ককে যত্ন করবার জন্যে কোনাে মেয়েই থাকবে না এমন লক্ষ্মীছাড়া অবস্থাও দিদি মনে মনে সইতে পারত না। ব্যবসার কথাও দিদি ওকে বুঝিয়েছে, বলেছে, যদি ভালােবাসায় বাধা পায় তাহলে সেই ধাক্কায় ওর কাজকর্ম সব যাবে নষ্ট হয়ে। ওর মন যখন তৃপ্ত হবে তখনি আবার কাজকর্মে আপনি আসবে শৃঙ্খলা।
শশাঙ্কের মন উঠেছে মেতে। ও এমন একটা চন্দ্রলােকে আছে যেখানে সংসারের সব দায়িত্ব সুখতন্দ্রায় লীন। আজকাল রবিবার-পালনে বিশুদ্ধ খ্রীস্টানের মতােই ওর অস্খলিত নিষ্ঠা। একদিন শর্মিলাকে গিয়ে বললে, “দেখাে, পাটের সাহেবদের কাছে তাদের স্টীমলঞ্চ পাওয়া গেছে,— আজ রবিবার, মনে করছি ভােরে ঊর্মিকে নিয়ে ডায়মণ্ডহার্বারের কাছে যাব, সন্ধ্যার আগেই আসব ফিরে।”
শর্মিলার বুকের শিরাগুলাে কে যেন দিলে মুচড়ে, বেদনায় কপালের চামড়া উঠল কুঞ্চিত হয়ে। শশাঙ্কের চোখেই পড়ল না। শর্মিলা কেবল একবার জিজ্ঞাসা করলে, “খাওয়াদাওয়ার কী হবে।” শশাঙ্ক বললে, “হোটেলের সঙ্গে ঠিক করে রেখেছি।”
একদিন এইসমস্ত ঠিক করবার ভার যখন ছিল শর্মিলার উপর, তখন শশাঙ্ক ছিল উদাসীন। আজ সমস্ত উলটপালট হয়ে গেল।
যেমনি শর্মিলা বললে, “আচ্ছা, তা যেয়ো” অম্নি মুহূর্ত অপেক্ষা না করে শশাঙ্ক বেরিয়ে গেল ছুটে। শর্মিলার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করল। বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে বারবার করে বলতে লাগল, “আর কেন আছি বেঁচে।”
কাল রবিবারে ছিল ওদের বিবাহের সাম্বৎসরিক। আজ পর্যন্ত এ অনুষ্ঠানে কোনোদিন ছেদ পড়েনি। এবারেও স্বামীকে না ব’লে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমস্ত আয়োজন করছিল। আর কিছুই নয়, বিয়ের দিন শশাঙ্ক যে লাল বেনারসির জোড় পরেছিল সেইটে ওকে পরাবে, নিজে পরবে বিয়ের চেলি, স্বামীর গলায় মালা পরিয়ে ওকে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে, জ্বালাবে ধূপবাতি, পাশের ঘরে গ্রামোফোনে বাজবে সানাই। অন্যান্য বছর শশাঙ্ক ওকে আগে থাকতে না জানিয়ে একটা কিছু শখের জিনিস কিনে দিত। শর্মিলা ভেবেছিল এবারেও নিশ্চয় দেবে, কাল পাব জানতে।
আজ ও আর কিছুই সহ্য করতে পারছে না। ঘরে যখন কেউ নেই তখন কেবলি ব’লে ব’লে উঠছে, “মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে, কী হবে এই খেলায়।”
রাত্রে ঘুম হােলাে না। ভােরবেলা শুনতে পেলে মােটরগাড়ি দরজার কাছ থেকে চলে গেল। শর্মিলা ফুঁপিয়ে উঠে কেঁদে বললে, “ঠাকুর, তুমি মিথ্যে।”
এখন থেকে বােগ দ্রুত বেড়ে চলল। দুর্লক্ষণ যেদিন অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে সেদিন শর্মিলা ডেকে পাঠালে স্বামীকে। সন্ধ্যেবেলা, ক্ষীণ আলাে ঘরে, নার্সকে সংকেত করলে, চলে যেতে। স্বামীকে পাশে বসিয়ে হাতে ধরে বললে, “জীবনে আমি যে-বর পেয়ে ছিলুম ভগবানের কাছে, সে তুমি। তার যােগ্য শক্তি আমাকে দেননি। সাধ্যে যা ছিল করেছি। ত্রুটি অনেক হয়েছে, মাপ করো আমাকে।”
শশাঙ্ক কী বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে বললে,—“না, কিছু বােলো না। ঊর্মিকে দিয়ে গেলুম তােমার হাতে। সে আমার আপন বােন। তার মধ্যে আমাকেই পাবে, আরাে অনেক বেশি পাবে যা আমার মধ্যে পাওনি। না, চুপ করাে, কিছু বােলো না। মরবার কালেই আমার সৌভাগ্য পূর্ণ হােলো তােমাকে সুখী করতে পারলুম।”
নার্স বাইরে থেকে বললে, “ডাক্তারবাবু এসেছেন।”
শর্মিলা বললে, “ডেকে দাও।”
কথাটা বন্ধ হয়ে গেল।
শর্মিলার মামা যত রকম অশাস্ত্রীয় চিকিৎসার সন্ধানে উৎসাহী। সম্প্রতি এক সন্ন্যাসীর সেবায় তিনি নিযুক্ত। যখন ডাক্তাররা বললে আর কিছু করবার নেই তখন তিনি ধরে পড়লেন, হিমালয়ের ফেরত বাবাজীর ওষুধ পরীক্ষা করতে হবে। কোন্ তিব্বতী শিকড়ের গুঁড়াে, আর প্রচুর পরিমাণে দুধ এই হচ্ছে উপকরণ।
শশাঙ্ক কোনােরকম হাতুড়েদের সহ্য করতে পারত না। সে আপত্তি করলে। শর্মিলা বললে, “আর কোনাে ফল হবে না, অন্তত মামা সান্ত্বনা পাবেন।”
দেখতে দেখতে ফল হােলাে। নিশ্বাসের কষ্ট কমেছে, রক্ত ওঠা গেল বন্ধ হয়ে।
সাত দিন যায়, পনেরাে দিন যায়, শর্মিলা উঠে বসল। ডাক্তার বললে, মৃত্যুর ধাক্কাতেই অনেক সময় শরীর মরিয়া হয়ে উঠে শেষ-ঠেলায় আপনাকে আপনি বাঁচিয়ে তােলে।
শর্মিলা বেঁচে উঠল।
তখন সে ভাবতে লাগল, “এ কী আপদ, কী করি। শেষকালে বেঁচে ওঠাই কি মরার বাড়া হয়ে দাঁড়াবে।” ওদিকে ঊর্মি জিনিসপত্র গােছাচ্ছে। এখানে তার পালা শেষ হােলাে।
দিদি এসে বললে, “তুই যেতে পারবিনে।”
“সে কী কথা।”
“হিন্দুসমাজে বােন-সতিনের ঘর কি কোনাে মেয়ে কোনােদিন করেনি।”
“ছিঃ।”
“লােকনিন্দা! বিধির বিধানের চেয়ে বড়ো হবে লােকের মুখের কথা!”
শশাঙ্ককে ডাকিয়ে বললে, “চলো আমরা যাই নেপালে। সেখানে রাজ-দরবারে তােমার কাজ পাবার কথা হয়েছিল— চেষ্টা করলেই পাবে। সে দেশে কোনাে কথা উঠবে না।”
শর্মিলা কাউকে দ্বিধা করবার অবকাশ দিল না। যাবার আয়ােজন চলছে। ঊর্মি তবু বিমর্ষ হয়ে কোণে কোণে লুকিয়ে বেড়ায়।
শশাঙ্ক তাকে বললে, “আজ যদি তুমি আমাকে ছেড়ে যাও তাহলে কী দশা হবে ভেবে দেখাে।”
ঊর্মি বললে, “আমি কিছু ভাবতে পারিনে। তােমরা দু-জনে যা ঠিক করবে তাই হবে।”
গুছিয়ে নিতে কিছুদিন লাগল। তারপর সময় যখন কাছে এসেছে, ঊর্মি বললে, “আর দিন সাতেক অপেক্ষা করো, কাকাবাবুর সঙ্গে কাজের কথা শেষ করে আসি গে।”
চলে গেল ঊর্মি।
এই সময়ে মথুর এল শর্মিলার কাছে মুখ ভার ক’রে। বললে, “তােমরা চলে যাচ্ছ ঠিক সময়েই। তােমার সঙ্গে কথাবার্তা স্থির হয়ে যাবার পরেই আমি আপসে শশাঙ্কের জন্যে কাজ বিভাগ করে দিয়েছিলেম। আমার সঙ্গে ওর লাভ-লোকসানের দায় জড়িয়ে রাখিনি। সম্প্রতি কাজ গুটিয়ে নেবার উপলক্ষ্যে শশাঙ্ক কদিন ধরে হিসাব বুঝে নিচ্ছিল। দেখা গেল তোমার টাকা সম্পূর্ণ ডুবেছে। তা ছাপিয়েও যা দেনা জমেছে তাতে বোধ হয় বাড়ি বিক্রি করতে হবে।”
শমি জিজ্ঞাসা করলে, “সর্বনাশ এতদূর এগিয়ে চলেছিল। উনি জানতে পারেননি?”
মথুর বললে, “সর্বনাশ জিনিসটা অনেক সময় বাজপড়ার মতো, যে মুহূর্তে মারে তার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ জানান দেয় না। ও বুঝেছিল ওর লোকসান হয়েছে। তখনো অল্পেই সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু দুর্বদ্ধি ঘটল; ব্যবসার গলদ তাড়াতাড়ি শুধরে নেবে মনে ক’রে আমাকে লুকিয়ে পাথুরে কয়লার হাটে তেজিমন্দি খেলা শুরু করলে। চড়ার বাজারে যা কিনেছে সস্তার বাজারে তাই বেচে দিতে হোলো। হঠাৎ আজ দেখলে হাউয়ের মতো ওর সব গেছে উড়ে-পুড়ে, বাকি রইল ছাই। এখন ভগবানের কৃপায় নেপালে কাজ পেলে তোমাদের ভাবতে হবে না।”
শমিলা দৈন্যকে ভয় করে না। বরঞ্চ ও জানে অভাবের দিনে স্বামীর সংসারে ওর স্থান আরাে বেড়ে যাবে। দারিদ্র্যের কঠোরতাকে যথাসম্ভব মৃদু ক’রে এনে দিন চালাতে পারবে এ বিশ্বাস ওর আছে। বিশেষত গয়না যা হাতে রইল তা নিয়ে এখনাে কিছু কাল বিশেষ দুঃখ পেতে হবে না। এ-কথাটাও সসংকোচে মনে উঁকি মেরেছে যে, ঊর্মির সঙ্গে বিয়ে হােলে তার সম্পত্তিও তো স্বামীরই হবে। কিন্তু শুধু জীবনযাত্রাই তাে যথেষ্ট নয়। এতদিন ধ’রে নিজের শক্তিতে নিজের হাতে স্বামী যে সম্পদ সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার খাতিরে আপন হৃদয়ের অনেক প্রবল দাবিকেও শর্মিলা ইচ্ছে ক’রে দিনে দিনে ঠেকিয়ে রেখেছে, সেই ওদের উভয়ের সম্মিলিত জীবনের মূর্তিমান আশা আজ মরীচিকার মতাে মিলিয়ে গেল এরই অগৌরব ওকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে। মনে মনে বলতে লাগল, তখনি যদি মরতুম তাহলে তাে এই ধিককারটা বাঁচত আমার। আমার ভাগ্যে যা ছিল, তা তাে হােলাে কিন্তু দৈন্য-অপমানের এই নিদারুণ শূন্যতা একদিন কি পরিতাপ আনবে না ওঁর মনে। যার মােহে অভিভূত হয়ে এটা ঘটতে পারল একদিন হয়তাে তাকে মাপ করতে পারবেন না, তার দেওয়া অন্ন ওঁর মুখে বিষ ঠেকবে। নিজের মাতলামির ফল দেখে লজ্জা পাবেন কিন্তু দোষ দেবেন মদিরাকে। যদি অবশেষে ঊর্মির সম্পত্তির উপর নির্ভর করা অবশ্য হয়ে ওঠে তাহলে সেই আত্মাবমাননার ক্ষোভে ঊর্মিকে মুহূর্তে মুহূর্তে জ্বালিয়ে মারবেন।
এদিকে মথুরের সঙ্গে সমস্ত হিসেবপত্র শােধ করতে গিয়ে শশাঙ্ক হঠাৎ জানতে পেরেছে যে শর্মিলার সমস্ত টাকা ডুবেছে তার ব্যবসায়ে। এ-কথা শর্মিলা এতদিন তাকে জানায়নি, মিটমাট ক’রে নিয়েছিল মথুরের সঙ্গে।
শশাঙ্কের মনে পড়ল, চাকরির অন্তে সে একদিন শর্মিলার টাকা ধার নিয়েই গড়ে তুলেছিল তার ব্যবসা। আজ নষ্ট ব্যবসার অন্তে সেই শর্মিলারই ঋণ মাথায় ক’রে চলেছে সে চাকরিতে। এ ঋণ তাে আর নামাতে পারবে না। চাকরির মাইনে দিয়ে কোনােকালে শােধ হবার রাস্তা কই।
আর দিন দশেক বাকি আছে নেপাল যাত্রার। সমস্ত রাত ঘুমতে পারেনি। ভোরবেলায় শশাঙ্ক ধড়ফড় ক’রে বিছানা থেকে উঠেই আয়নার টেবিলের উপরে হঠাৎ সবলে মুষ্টিঘাত করে বলে উঠল, “যাব না নেপাল।” দৃঢ় পণ করলে, “আমরা দু-জনে ঊর্মিকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকব—ভ্রুকুটিকুটিল সমাজের ক্রূর দৃষ্টির সামনেই। আর এইখানেই ভাঙা ব্যবসাকে আর একবার গড়ে তুলব এই কলকাতাতেই ব’সে।”
যে-যে জিনিস সঙ্গে যাবে, যা রেখে যেতে হবে, শর্মিলা বসে বসে তারি ফর্দ করছিল একটা খাতায়। ডাক শুনতে পেলে “শর্মিলা, শর্মিলা।” তাড়াতাড়ি খাতা ফেলে ছুটে গেল স্বামীর ঘরে। অকস্মাৎ অনিষ্টের আশঙ্কা ক’রে কম্পিত হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে।”
বললে, “যাব না নেপালে। গ্রাহ্য করব না সমাজকে। থাকব এইখানেই।”
শর্মিলা জিজ্ঞাসা করলে, “কেন, কী হয়েছে।”
শশাঙ্ক বললে, “কাজ আছে।”
সেই পুরাতন কথা। কাজ আছে। শর্মিলার বুক দুরু দুরু করে উঠল। “শমি, ভেবো না। আমি কাপুরুষ। দায়িত্ব ফেলে পালাব আমি, এত অধঃপতন কল্পনা করতেও পারো?”
শর্মিলা। কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললে, “কী হয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলো।” শশাঙ্ক বললে, “আবার ঋণ করেছি তোমার কাছে, সে-কথা ঢাকা দিয়ো না।”
শর্মিলা বললে, “আচ্ছা বেশ।”
শশাঙ্ক বললে, “সেইদিনকার মতোই আজ থেকে আবার ঋণ শোধ করতে বসলুম। যা ডুবিয়েছি আবার তাকে টেনে তুলবই এই রইল কথা, শুনে রাখো। একদিন যেমন তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে তেমনি আবার আমাকে বিশ্বাস করো।”
শর্মিলা স্বামীর বুকের উপর মাথা রেখে বললে, “তুমিও আমাকে বিশ্বাস কোরো। কাজ বুঝিয়ে দিয়ো আমাকে, তৈরি করে নিয়ো আমাকে, তোমার কাজের যোগ্য যাতে হোতে পারি সেই শিক্ষা আজ থেকে আমাকে দাও।”
বাইরে থেকে আওয়াজ এল “চিঠি”।
ঊর্মির হাতের অক্ষরে দু-খানা চিঠি। একখানি শশাঙ্কের নামে—
আমি এখন বোম্বাইয়ের রাস্তায়। চলেছি বিলেতে। বাবার আদেশমতো ডাক্তারি শিখে আসব। ছয়-সাত বছর লাগার কথা। তোমাদের সংসারে এসে যা ভাঙচুর করে গলুম ইতিমধ্যে কালের হাতে আপনিই তা জোড়া লাগবে। আমার জন্যে ভেবো না, তোমার জন্যই ভাবনা রইল মনে।
শৰ্মিলার চিঠি-
দিদি, শত সহস্ৰ প্রণাম তোমার পায়ে। অজ্ঞানে অপরাধ করেছি, মাপ করো। যদি সেটা অপরাধ না হয়, তবে তাই জেনেই সুখী হ’ব। তার চেয়ে সুখী হবার আশা রাখব না মনে। কিসে সুখ তাই বা নিশ্চিত কী জানি। আর সুখ যদি না হয় তো নাই হোলো। ভুল করতে ভয় করি।