দুই শিষ্য/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
কিছুক্ষণ পরে মনোহরগিরি অতি বিষণ্ণবদনে পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার শিষ্যগণ সকলেই তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন এবং আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন।
আমি তখন অতি বিনীতভাবে মনোহরগিরিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার শিষ্যগণ কি সকলেই প্রত্যাগমন করিয়াছেন?”
ম। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু কোন ফল হইল না। উহাদের সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হইল।
আ। তবে সহসা সেই কলরব উঠিল কেন?
ম। আমার অপরাপর শিষ্যগণ ভাবিয়াছিল, বুঝি বেহারীও ফিরিয়া আসিতেছে।
আ। যাঁহারা বেহারীর সন্ধানে গিয়াছিলেন, তাঁহারা কি কোন সংবাই পান নাই?
ম। একজন বলিতেছেন যে, তাঁহার পরিচিত কোন লোক আজ বেলা একটার সময় বেহারীকে অপর এক সংসারী লোকের সহিত যাইতে দেখিয়াছেন।
আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কোথায়?
মনোহর আমার কথা শুনিয়া তখনই ‘বলদেব’ ‘বলদেব’ বলিয়া চীৎকার করিলেন। একজন গৈরিক বসনধারী পশ্চিম দেশবাসী যুবক তখনই আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পরে অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “আমি নিকটেই আছি গুরুদেব!”
মনোহর নিজে কোন কথা না বলিয়া আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি তখন বলদেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার সহিত বেহারীগিরির সদ্ভাব আছে?”
বলদেব অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে বিশেষ সম্ভাব। যখন আমরা এক গুরুদেবের শিষ্য, তখন আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃস্নেহ রহিয়াছে। বিশেষতঃ আমরা সংসারের সমস্ত মায়াযর বন্ধন ছিন্ন করিয়া গুরুদেবের আশ্রয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। সংসার ত্যাগ করা, আর মায়ার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা এই উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। আমরা সংসার ত্যাগ করিয়াছি বটে, কিন্তু মায়ার হাত হইতে অব্যাহতি পাই নাই। গুরুদেবের নিকট আসিয়া অবধি তাঁহার অপরাপর শিষ্যগণের সহিত আমার বিশেষ সদ্ভাব হইল। বিশেষতঃ বেহারীর উদার স্বভাব, অমায়িক ভাব ও সরল এবং অকৃত্রিম আচরণে সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট। তাহা না হইলে আজ তাহার বিহনে মন্দিরের সকলেই অনাহারে থাকিবেন কেন?
আমি বলদেবের কথায় আন্তরিক প্রীত হইলাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ বেলা একটার সময় বেহারীর সহিত কাহার দেখা হইয়াছিল?”
ব। আজ্ঞে আমার কোন পরিচিত লোকের।
আ। তাঁহার বাড়ী কোথায়?
ব। এখান হইতে অর্দ্ধক্রোশ দূরে।
আ। নাম কি?
ব। হৃষীকেশ চট্টোপাধ্যায়।
আ। —তিনি কি বেহারীগিরিকে চিনিতেন?
ব। আজ্ঞে হ্যাঁ।
আ। কোন্ সূত্রে তাঁহার সহিত বেহারীর আলাপ হইল? বেহারী একজন সংসার-বিরাগী পুরুষ, গৃহীর সহিত তাঁহার সংশ্রব কেমন করিয়া হইল?
ব। হৃষীকেশ বড় ধর্ম্মভীরু লোক। ধর্ম্মে তাঁহার বিশেষ আস্থা আছে। যেখানে ধর্ম্ম কথা হয়, ধর্ম্ম চর্চা হয়, সেইখানেই হৃষীকেশ থাকিতে ভালবাসেন। তিনি এখানেও অনেকবার আসিয়াছিলেন এবং এখনও আসিয়া থাকেন। গুরুদেবের মুখে ধর্ম্ম-কথা বা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনিতে তাঁহার বড় অগ্রহ।
আ। বেহারীগিরির কথা তিনি কি বলিয়াছিলেন? কেমন করিয়া আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল?
ব। বেলা নয়টার পূর্ব্বেই আমি মন্দির হইতে বাহির হইয়া বেহারীর অন্বেষণ করিতে আরম্ভ করি। যেখানে যেখানে বেহারী যাইত, প্রথমে সেই সেই স্থানেই গমন করিয়াছিলাম। বেহারী কখনও কখনও হৃষীকেশের নিকট গমন করিত। সেই জন্য আমি তাঁহার বাড়ীতে গিয়া বেহারীর সন্ধান লই।
আ। কখন আপনি তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলেন?
ব। তখন বেলা প্রায় তিনটা।
আ। তিনি কি স্বয়ং বেহারীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন?
ব। আজ্ঞে হাঁ।
আ। বেলা একটার সময়?
ব। হৃষীকেশের মুখে ঐ কথাই শুনিয়াছি।
আ। বেহারী কি একা যাইতেছিলেন?
বলদেব কোন উত্তর করিলেন না। তিনি মস্তক অবনত করিয়া আমার সম্মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া সলজ্জ ভাবে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। হৃষীকেশও আমায় সে বিষয়ে কোন কথা বলেন নাই।”
আমি বলদেবের কথায় সন্তুষ্ট হইলাম না। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইতে পারেন? তাঁহার মুখের কথা না শুনিয়া আমি কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিব না।”
আমার কথায় বলদেব তখনই সম্মত হইলেন। তিনি বলিলেন, “আমি এখনই প্রস্তুত আছি, যাহাতে বেহারীর সন্ধান হয়, আমি প্রাণপণে তাহার সাহায্য করিব।”
যে সময়ে বলদেব এই কথা বলিল, তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল। সেই রাত্রে সেখান হইতে আরও অর্দ্ধক্রোশ পথ গিয়া একজন সংসারী লোককে বিরক্ত করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। বলদেবকে বলিলাম, “আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে। এমন সময় আর কোন কার্য্য হওয়া অসম্ভব। কাল প্রত্যুষে আপনি আমার নিকট যাইবেন। সেখান হইতে উভয়ে একত্রে হৃষীকেশের নিকট গমন করিব।”
এই বলিয়া মনোহরগিরির দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আজ চলিলাম। আমার বোধ হয়, ভিতরে কোন ভয়ানক গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। নতুবা বেহারীগিরি বালক নহেন যে, পথ ভুলিয়া আর কোথাও গিয়া পড়িবেন। আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না।
এই বলিয়া আমি গাত্রোথান করিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনোহরগিরিও উঠিলেন এবং আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মন্দিরের দ্বারদেশ পর্য্যন্ত আগমন করিলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলাম, একখানি সেকেণ্ড ক্লাসের ভাড়াটীয়া গাড়ী অপেক্ষা করিতেছে। মনোহর আমাকে তাহাতে আরোহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। পরে বলিলেন, “এখন আপনিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। যাহাতে বেহারীর সন্ধান হয়, তাহা আপনিই করিবেন। অর্থের অভাব বিবেচনা করিবেন না। যদি ইহার ভিতর কোন প্রকার চাতুরি কি প্রতারণা দেখিতে পান, তাহা হইলে প্রতারক যাহাতে আইন অনুসারে দণ্ডনীয় হয়, সে বিষয়ে আপনি মনোযোগ করিবেন। আমরা অনেক দিন সংসার ত্যাগ করিয়াছি। সংসারের কুটিলত। অনেক কাল ভুলিয়া গিয়াছি। আপনারা যতদূর বুঝিতে পারিবেন, আমরা সেরূপ পারিব না। অধিক বলা বাহুল্য মাত্র।”
মনোহরগিরি এই কথা বলিয়া এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, তিনি বেহারীর শোকে কাতর হইয়া পড়িয়াছেন। মিষ্ট বাক্যে তাঁহাকে সান্ত্বনা করিলাম। বলিলাম, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। যাহাতে দোষী উচিত মত শাস্তি পায়, তাহার উপায় করিব।
আমার কথায় তিনি কিছু আশ্বস্ত হইলে আমি কোচমানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। দুষ্পাঠ্য প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় থানায় ফিরিয়া আসিলাম।