দুই শিষ্য/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যতক্ষণ গাড়ীতে ছিলাম, ততক্ষণ মনোহরগিরি তাঁহার শিষ্য সম্বন্ধীয় কোন কথা কহেন নাই। আমিও সে বিষয়ে তাঁহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, গাড়ীখানি তৃতীয় শ্রেণীর, ঘোড়া দুইটী দেখিতে অতি শীর্ণ—অস্থি চর্ম্ম সার বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু চালকের হট্হট্ শব্দে ও গাড়ীর ঝন্ ঝন্ শব্দ শুনিয়া অখ দুইটী পুচ্ছদ্বয় উর্দ্ধে উত্তোলন করিল এবং প্রায় এক ঘণ্টার পর কালভৈরবের মন্দিরের দ্বারে উপস্থিত হইল।
গাড়ীখানি স্থির হইলে মনোহরগিরি অগ্রেই অবতরণ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িলাম।
গাড়ীর শব্দে মন্দিরের অভ্যন্তর হইতে কয়েক জন গৈরিক বসন-ধারী পুরুষ সত্বর দ্বারদেশে আগমন করিলেন এবং মনোহর গিরির সহিত আমাকে দেখিতে পাইয়া কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া ধীরভাবে গুরুর আদেশ জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
মনোহরগিরি উপস্থিত শিষ্যগণের মধ্যে একজনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সঙ্কেত দ্বারা নিকটে আহ্বান করিলেন এবং তিনি নিকটে আসিলে, কোচমানকে ভাড়া মিটাইয়া দিতে আদেশ করিয়া, আমাকে লইয়া মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন।
যখন আমরা মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন রাত্রি প্রায় আট্টা। মন্দিরটী পূর্ব্বেই দেখিয়াছিলাম। দুই একবার ভিতরেও প্রবেশ করিয়াছিলাম। কিন্তু সে বহুদিন পূর্ব্বে সে রাত্রে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। মন্দিরটী প্রকাণ্ড, ভিতরে কালভৈরব মূর্ত্তি। মন্দিরের ঠিক দক্ষিণে একটী নাটমন্দির। সেখানে অনেক দীন দরিদ্র ভিক্ষুক শয়ন করিয়াছিল। মন্দিরের পূর্ব্বদিকে একটা অট্টালিকা ছিল। মনোহর গিরি আমাকে লইয়া সেই অট্টালিকায় প্রবেশ করিলেন।
বাড়ীখানি দ্বিতল। মনোহরগিরি আমাকে লইয়া উপরে আরোহণ করিলেন এবং একখানি প্রশস্ত গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ঘরখানি বড় বটে, কিন্তু আসবাবের কিছুই পারিপাট্য ছিল না। ঘরের মেঝের উপর একখানি ব্যাঘ্রচর্ম্ম পাতা ছিল। মনোহরগিরি স্বয়ং সেই আসনে উপবেশন করিলেন এবং আমাকে তাঁহার সম্মুখে বসিতে অনুরোধ করিলেন।
যোগীপুরুষের সহিত একাসনে উপবেশন করিতে আমার ইচ্ছা ছিল না। সেই কারণে তিনি উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলেও, আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা না করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
মনোহরগিরি আমার মনোভাব বুঝিতে পারিলেন। তিনি বলিলেন, “আমাদের এখানে আপনার উপযুক্ত আসন নাই। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমিই এই মন্দিরের সেবায়েত। কালভৈরবের মাসিক আয়ও যথেষ্ট। আমিই তাহা ব্যয় করিয়া থাকি, অর্থাৎ আমারই আদেশে তাহা ব্যয় করা হয়। কিন্তু তাহা হইলেও কেবল আমার বা আমার শিষ্যগণের সুখ-স্বচ্ছন্দের জন্য সে অর্থ ব্যয় করিতে পারি না। যাহার জন্য এই অর্থ সঞ্চিত আছে, আমাকে তাহারই জন্য উহা ব্যয় করিতে হয়। এইজন্য আমাদের এখানে অনাবশ্যকীয় কোন আসবাব দেখিতে পাইবেন না। বিশেযত, আমরা সকলেই সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী মাত্র। ঈশ্বরোপাসনাই আমাদের কার্য্য এবং আত্মার উৎকর্ষ লাভই আমাদের অভিপ্রেত। তাই বলিতেছি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপরই উপবেশন করুন।”
সেবায়েত মনোহরগিরির কথায় আমি লজ্জিত হইলাম। তাঁহার কথায় প্রথমে ভাবিয়াছিলাম, তিনি হয়ত আমার মনোগত অভিপ্রায় বুঝতে পারিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার সকল কথা শুনিয়া আমার বড় দুঃখ হইল। তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি বুঝি অবজ্ঞা করিয়াই ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর উপবেশন করিতেছি না।
এই মনে করিয়া আমি লজ্জিতভাবে উত্তর করিলাম, “আমি সে জন্য দাঁড়াইয়া নহি। আপনার সহিত কেমন করিয়া একাসনে উপবেশন করিব তাহাই ভাবিতেছি।”
বাধা দিয়া মনোহরগিরি বলিলেন “সে কি কথা? আপনি আমাপেক্ষা নিকৃষ্ট কিসে?”
এই বলিয়া তখনই গাত্রোখান করিলেন এবং আমার হস্ত ধারণ করিয়া ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর টানিয়া লইলেন এবং অগ্রে আমাকে বসাইয়া পরে আমার পার্শ্বে উপবেশন করিলেন।
কিছুক্ষণ পরে তিনি বলিলেন, “আপনি ব্রাহ্মণ, আমার নমস্য। আমার সহিত একাসনে বসিবার আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।”
আমি কোন উত্তর করিলাম না, ঈষৎ হাসিলাম মাত্র। পরে তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আপনার অপরাপর শিষ্যগণের মুখ দেখিয়া স্পষ্টই বোঝা যাইতেছে যে, বেহারীগিরি এখনও প্রত্যাগমন করেন নাই।”
এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মনোহরগিরি উত্তর করিলেন, “আপনার অনুমান সত্য। যদি বেহারী ফিরিয়া আসিত, তাহা হইলে কি এ মন্দির আজ এত নীরব থাকিত? বেহারী অভাবে আমার আর আর সকল শিষ্যই যেন মর্ম্মাহত হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা মুখে কোন কথা না বলিলেও তাহাদের হৃদয় যে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তাহাদের বাহিক অবস্থা দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়।”
তাঁহার কথা শেষ হতে না হইতে দুইজন গৈরিকবসনধারী যুবক সেই গৃহে প্রবেশ করিল। মনোহর তাহাদিগকে নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এই দুইজনেই তাহার বিশেষ বন্ধু। ইহার। যেন মৃতপ্রায় হইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
আমি মনে করিলাম, কেবল গৈরিকবসন পরিধান আর সংসার ত্যাগ করিতে পারিলেই যদি মায়ার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা যাইত, তাহা হইলে পৃথিবীতে এত কষ্ট থাকিবে কেন? কিন্তু মুখে কোন কথা প্রকাশ করিলাম না।
আগন্তুক দুইজনের মধ্যে একজন মনোহরের দিকে চাহিয়া অতি বিনীতভাবে বেহারীর সংবাদ জিজ্ঞাসা করিল।
মনোহর আমার পরিচয় দিয়া বলিলেন, “এখন ইহাঁরই উপর আমাদের ভরসা, গৌরীলাল।”
দেখিতে দেখিতে আরও কয়েক জন শিষ্য তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি তথন গৌরীলালকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ বেহারীর সহিত কি আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?”
গৌরীলাল সম্মতিসূচক উত্তর দিলে আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, কোন্ সময়ে আপনার সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল?
গৌরীলাল কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “আজ প্রাতে যখন আমি মন্দির হইতে বাহির হইতেছিলাম, সেই সময় বেহারীগিরিকে একজন অপরিচিত লোকের সহিত কথা কহিতে দেখি, আমি তখন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া বেহারীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি নাই।”
আ। তথন বেলা কত?
গৌ। প্রায় সাড়ে সাতটা।
আ। তাহা হইলে আপনার গুরুদেবের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইবার পর আপনার সহিত দেখা হইয়াছিল—কেমন?
গৌরীলাল সহসা কোন উত্তর করিলেন না। তিনি একবার মনোহরগিরির দিকে চাহিয়া, কিছুক্ষণ কি ভাবিলেন। পরে বলিলেন, “আজ্ঞে আমি ত সে কথা বলিতে পারিলাম না। গুরুদেবের সহিত বেহারীর কখন দেখা হইয়াছিল?”
আ। বেলা সাতটার সময়।
গৌ। তাহা হইলে আপনার অনুমান যথার্থ।
আ। আপনাদের মধ্যে আর কেহ কি বেহারীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন?
গৌ। আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না। আমরা সকলেই বেহারীকে বড় ভালবাসি। তাহার সহসা অন্তর্ধান হওয়ায় সকলেই আন্তরিক দুঃখিত হইয়াছি। আজ কাহারও আহার পর্য্যন্ত হয় নাই। এখনও সকলে মন্দিরে ফিরিয়া আইসেন নাই।
আমি আর গৌরীলালকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তাঁহার গুরুদেবের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, তিনি একমনে আমাদের কথোপকথন শুনিতেছেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনার শিষ্যগণ কখন প্রত্যাগমন করিবেন বলিতে পারেন? যাঁহারা বেহারীর অন্বেষণে বাহির হইয়াছেন, তাঁহাদের কথা না শুনিয়া আমি কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারিতেছি না।”
আমার কথা শেষ হতে না হইতে এক মহা কলরব আমার কর্ণগোচর হইল। আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, বুঝি বেহারী ফিবিয়! আসিয়াছেন। মনোহরগিরি আর নিশ্চিন্ত ভাবে বসিয়া থাকতে পারলেন না। কলরবের কারণ জানিবার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং শশব্যস্ত হইয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। আমি উৎকণ্ঠিতভাবে তথায় বসিয়া রহিলাম। আমার নিকট এতক্ষণ যে সকল শিষ্য দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহাদের গুরুদেবের অনুসরণ করিলেন।