দুই শিষ্য/প্রথম পরিচ্ছেদ

দুই শিষ্য।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে দৈনিক কার্য্য শেষ করিয়া মৃদুমন্দ মলয়মারুত সেবন করিতে করিতে অফিসের বারান্দায় পায়চারি করিতেছিলাম, এমন সময়ে একখানি তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়াটীয়া গাড়ী অফিসের ফটকের নিকট আসিয়া স্থির হইল।

 কিছুক্ষণ পরেই একজন কনষ্টেবলের সহিত এক যোগীপুরুষ আমার নিকটবর্ত্তী হইল। কনষ্টেবল অঙ্গুলি নির্দ্দেশ দ্বারা আমাকে প্রদর্শন করিয়া, যোগীপুরুষকে তথায় রাখিয়া প্রস্থান করিল। আমি তখন তাঁহার নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ন্যায় সাধুব্যক্তির এরূপ স্থানে আসিবার প্রয়োজন কি? বলুন, আপনার কোন কার্য্যে সাহায্য করিব?”

 আগন্তুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে দিব্য গৌরবর্ণ ও হৃষ্টপুষ্ট। অঙ্গের মাংস শিথিল হয় নাই। তাঁহার ললাট উন্নত ও প্রশস্ত, মস্তকে কেশ নাই—মুণ্ডিত, চক্ষুদ্বয় আকর্ণবিস্তৃত ও উজ্জ্বল। মুখশ্রী গম্ভীর অথচ সদাই প্রসন্ন। তাঁহার পরিধানে একখানি গৈরিক বস্ত্র, গাত্রে একখানি গৈরিক উত্তরীয়, পায়ে কাষ্ঠপাদুকা, গলায় কতকগুলি রুদ্রাক্ষামালা।

 আমার প্রশ্ন শুনিয়া তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আপনার অনুমান যথার্থ। আমার ন্যায় সন্ন্যাসীর সহিত পুলিসের কোনরূপ সংস্পর্শ থাকা কর্ত্তব্য নহে; এ সকল কার্য্য গৃহীরই শোভা পায়। কিন্তু কি করিব? আমায় বাধ্য হইয়া আজ এই সায়ংকালে ঈশ্বরারাধনা ত্যাগ করিয়া আপনার আশ্রয়ে আসতে হইয়াছে। শুনিয়াছি, আপনার দ্বারা এরূপ অনেক কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে।”

 আমি আগন্তুকের কথা তালরূপ বুঝিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কি হইয়াছে বলুন? কিসে আপনার সাহায্য করিতে পারি বলিয়া দিন?”

 আগন্তুক পুনরায় আমার দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিলেন; আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে কি ভাবিয়া বলিলেন, “আমার নাম মনোহরগিরি। আমি কাল-ভৈরবের মন্দিরের সেবায়েত।”

 কলিকাতার দক্ষিণে কোন এক গ্রামে কালভৈরবের এক মন্দির আছে। শুনিয়াছিলাম, তাঁহার সেবার জন্য মাসিক এক সহস্র মুদ্রা নির্দ্দষ্ট আছে। মনোহরগিরি যে তাহার তৎকালীন সেবাযেত তাহাও আমার জানা ছিল। কিন্তু এ পর্য্যন্ত আমি সেবায়েতকে স্বচক্ষে দেখি নাই, কিন্তু তাঁহার সহিত কোনরূপ সংস্রবে আসি নাই। আগন্তুককে কালভৈরবের সেবায়েত জানিয়া তাঁহার প্রতি আমার ভক্তি শত গুণে বর্দ্ধিত হইল। আমি অতি বিনীতভাবে বলিলাম, “আপনার নাম এ অঞ্চলের অনেকেই অবগত আছেন। দুঃখের বিষয়, এতকাল আপনার সহিত আমার পরিচয় ছিল না। যাহা হউক, এখন কি হইয়াছে বলুন? আমি সাধ্যমত আপনার সাহায্য করিব।”

 যোগীপুরুষ পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আজ প্রাতঃকাল হইতে আমার প্রধান শিষ্য বেহারীগিরিকে দেখিতে পাইতেছি না। আপনি চেষ্টা করিয়া তাহার সন্ধান বলিয়া দিন।”

 মনোহরগিরির কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। বেহারীগিরি তাঁহার শিষ্য, সুতরাং তিনিও একজন সংসার-বিরাগী ব্যক্তি। তাহার জন্য তাঁহার গুরুদেব এত চিন্তিত কেন? বেহারীগিরি হয়ত কোন কারণ বশতঃ অন্য কোথাও গিয়া থাকিবেন, হয়ত কোন পরিচিত লোকের সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া ঈশ্বরাধনায় নিযুক্ত আছেন। তাঁহার ন্যায় জ্ঞানীব্যক্তির জন্য মনোহরগিরির মত একজন ধীর সংযমীলোকের এত উৎকণ্ঠা কেন?

 এই ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার শিষ্যটীর বয়স কত?”

 মনোহরগিরি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর।”

 আ। কতদিন তিনি আপনার শিষ্যত্ব লাভ করিয়াছেন?

 ম। প্রায় দশ বৎসর।

 আ। এই দশবৎসর কালই কি তিনি আপনার নিকটে বসবাস করিতেছেন?

 ম। আজ্ঞে হাঁ। —বেহারীর পিতার সহিত আমার অত্যন্ত সম্ভাব ছিল। তিনি সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরাধনা করিতেন। শোনা যায়, তাঁহার ন্যায় ক্রিয়াবান পুরুষ সে অঞ্চলে আর কেহ ছিলেন না। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, আমি তাঁহার পুত্রকে শিষ্য করি। বেহারী নিজেও অতি সচ্চরিত্র সাধু ও সংযমী পুরুষ। এই সকল কারণেই আমি তাহাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং আমার নিকট রাখিয়া যথারীতি শিক্ষা দিতেছিলাম।

 আ। আর কখনও এরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল?

 ম। কই আমার ত স্মরণ হয় না।

 আ। আজ প্রাতে কখন আপনার সহিত বেহারীগিরির শেষ দেখা হইয়াছিল?

 ম। বেলা সাতটার পর আর আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই।

 আমি কিছুক্ষণ ভাবিয়া পুনরায় অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার কয়জন শিষ্য?”

 মনোহরগিরি ঈষৎ সিয়া উত্তর করিলেন, “পূর্ব্বে অনেক গুলি ছিল কিন্তু এখন সর্ব্বশুদ্ধ পনের জন মাত্র।”

 আ। সকলেই কি আপনার সহিত একত্রে বাস করিতেছেন?

 ম। আজ্ঞে।

 আ। আপনার কিম্বা বেহারীগিরির কোন শত্রু আছে?

 মনোহরগিরি আমার প্রশ্ন শুনিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমরা সংসারী লোক নহি। সংসারের সহিত আমাদের বিশেষ কোন সংস্পর্শ নাই। দুই বৎসর পূর্ব্বে বেহারীগিরির মাতা ঠাকুরাণীর গঙ্গালাত হইয়াছে। সেই অবধি বেহারীরও সংসার-বন্ধন খুলিয়া গিয়াছে। আমাদের আবার শক্র কে?”

 মনোহরগিরি যেভাবে পূর্বোক্ত কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম না। তিনি মুখে কোন শত্রু নাই বলিলেও তাঁহার কথার ভাবে সেরূপ বুঝিতে পারিলাম না। আমার বোধ হইল, তিনি যেন আমার নিকট কোন কথা গোপন করিতেছেন। কিন্তু আমি সে কথা প্রকাশ করিতে সাহস করিলাম না। বরং ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “যদি তাহাই হয়, তবে আর বেহারীগিরির জন্য এত চিন্তিত হইতেছেন কেন? যদি আপনাদের কোন শত্রু না থাকে, তাহা হইলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—আপনার শিষ্য শীঘ্রই প্রত্যাগমন করিবেন।”

 আমার উত্তরে মনোহরগিরি সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আপনার অনুমান বাস্তবিকই সত্য। কিন্তু কি জান কেন আমার মনকে প্রবোধ দিতে পারিতেছি না। যতই আমি বেহারীর কথা ভাবিতেছি, ততই যেন আমার প্রাণ, কাঁদিয়া উঠিতেছে। কেন এমন হয়? আর কখন। ত এরূপ হয় নাই?

 আমি হাসিয়া বলিলাম, “আপনি বেহারীগিরিকে বোধ হয় পুত্রাধিক স্নেহ করেন। সেই কারণেই আপনার মনে সদাই, তাঁহার প্রাণের আশঙ্কা হইতেছে। যিনি যাহাকে স্নেহ করেন, তাহাকে দেখিতে না পাইলে তাঁহার মনে স্বতঃই একটা কুচিন্তার উদয় হয়। আপনারও সেইরূপ হইয়াছে।”

 মনোহরগিরি লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “আপনার অনুমান যথার্থ। বেহারীকে আমি বড় ভালবাসি, আমার অবর্ত্তমানে তাহাকেই সেবায়েত করিব এই আমার অভিপ্রায়। হয়ত সেই কারনেই আমার এত চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়াছে।”

 আ। আমারও সেইরূপ বোধ হয়। এতক্ষণ হয়ত তিনি মন্দিরে প্রত্যাগমন করিয়াছেন।

 ম। আর যদি মা ফিরিয়া থাকে?

 আমি সহসা কোন উত্তর করিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলাম, “চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাইতেছি। যদি তিনি ফিরিয়া থাকেন, মঙ্গল। আর যদি বাস্তবিকই না আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে এখনই তাঁহার সন্ধানের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করা যাইবে।”

 আমার কথায় মনোহরগিরির মুখ প্রসন্ন হইল। তিনি তখনই হৃষ্টচিত্তে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং আমাকে লইয়া সেই ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আরোহণ করিলেন। চালক সময় বুঝিয়া শকট চালনা করিল।