দুই শিষ্য/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 যখন হৃষীকেশের বাড়ীর সদর দ্বারে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা আটটা বাজিয়াছিল। হৃষীকেশের বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল এবং বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ীতে যেন মুর্ত্তিমতী শান্তি বিরাজমান। বাড়ীখনির অবস্থা দেখিয়া আমি বড়ই প্রীত হইলাম।

 আমাকে সদর দ্বারে অপেক্ষা করিতে বলিয়া বলদেব ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই একজন প্রৌঢ়কে সঙ্গে লইয়া পুনরায় আমার নিকটে আগমন করিলেন। পরে বলিলেন, ইহাঁরই নাম হৃষীকেশ চট্টোপাধ্যায়।”

 আমাকে পুলিস কর্ম্মচারী দেখিয়া হৃষীকেশ যেন আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। কিন্তু সে কেবল অল্পক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই আমার দিকে চাহিয়া সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলদেবের মুখে শুনিলাম, আপনি কোন সংবাদ জানিবার জন্য কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন অনুমতি করুন, কি জানিতে ইচ্ছা করেন? আমি অতি সামান্য লোক, আপনার ন্যায় লোকের আদর অভ্যর্থনা করিবার সামর্থ্য নাই।”

 হৃষীকেশকে দেখিতে বেশ সুপুরুষ। তাঁহার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর। দেহ হৃষ্টপুষ্ট, দেখিতে গৌরবর্ণ। শরীরের লাবণ্য দেখিয়া আশ্চর্য্যাম্বিত হইলাম। বিশেষতঃ তাঁহার সরল কথায় আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। পরে বলিলাম, “আমার মত সামান্য লোকের জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই। আপনাদের সহিত তুলনায় আমি অতি সামান্য লোক।”

 হৃষীকেশ আমার কথায় ঈষৎ হাস্য করিলেন। পরে অতি যত্নের সহিত একতলার একটী প্রশস্ত গৃহে লইয়া গেলেন। বলদেবও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিলেন।

 ঘরের মেঝের উপর টানা বিছানা ছিল। আমরা তিনজনে তথায় উপবেশন করিলাম। কিছুক্ষণ এইরূপে অতীত হইলে পর আমি হৃষীকেশের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বেহারী, গিরির সহিত আপনার সদ্ভাব আছে কি?

 হৃষীকেশ অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ— তাঁহার ন্যায় সাধু সচ্চরিত্র লোকের সঙ্গই আমি প্রার্থনা করিয়া থাকি। আপনার কথা শুনিয়া বোধ হইতেছে, তিনি এখনও মন্দিরে ফিরিয়া যান নাই।”

 আ। আজ্ঞে না—আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য। শুনিলাম, কাল না কি আপনার সহিত বেহারীর দেখা হইয়াছিল। সেই জন্যই আমরা আপনার নিকট আসিয়াছি।

 হৃ। আজ্ঞে হাঁ—বেহারীগিরির সহিত কাল বেলা প্রায় একটার সময় আমার দেখা হইয়াছিল।

 আ। কোথায়?

 হৃ। এই গ্রামের কিছু উত্তরে একটা প্রকাণ্ড মাঠ আছে; সেই মাঠের পার্শ্ব দিয়া সরকারী পথ। আমি বেহারীগিরিকে সেই পথ দিয়া যাইতে দেখিয়াছিলাম।

 আ। তিনি কি একাই ছিলেন?

 হৃ। আজ্ঞে হাঁ; একাই যাইতেছিলেন।

 আ। তখন সে পথে লোক সমাগম কেমন?

 হৃ। বড় অধিক লোক ছিল না। তবে আরও একজন। পরিচিত ব্যক্তির সহিত আমার দেখা হইয়াছিল।

 আমার কেমন সন্দেহ হইল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার সেই পরিচিত ব্যক্তির সহিত কি বেহারী গিরির পরিচয় আছে বলিয়া বোধ হয়?

 হৃষীকেশ অতি সরল ব্যক্তি, তিনি আমার কথায় তখনই বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ—আছে বই কি? কেদারনাথের সহিত বেহারীগিরির পরিচয় আছে। তবে সদ্ভাব নাই।

 আমার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইল দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “উভয়ের মধ্যে কতখানি পথ ব্যবধান ছিল?”

 হৃষীকেশ আমার কথায় যেন সন্দিগ্ধ হইলেন। আমি যে কেন তন্ন তন্ন করিয়া এত কথা বিজ্ঞাসা করিতেছি, তিনি ভাল বুঝিতে পারিলেন না। আমার মুখের দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, “বড় বেশী নয়। আপনার কথায় আমার যেন মনে পড়িতেছে, বেহারীগিরি একবার কেদারের দিকে চাহিয়া ছিলেন। কেদারনাথ কি যেন সঙ্কেত করায় বেহারী সত্বর সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার কোনরূপ সন্দেহ হইল না? আপনিও জানিতেন যে কেদারনাথের সহিত বেহারীগিরির সম্ভাব নাই। তবুও যখন আপনি কেদারনাথকে সঙ্কেত করিতে দেখিলেন, তখন আপনার কি কিছুই মনে হইল না?”

 হৃষীকেশ আমার কথায় নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। কোনরূপ উত্তর কিন্তু প্রতিবাদ করিলেন না। তাঁহার মলিন মুখ দেখিয়া আমি তাঁহাকে আর কোন কথা না বলিয়া বলদেবের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “আমি যেরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম, ঠিক সেইরূপই হইয়াছে। আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না। যখন বেহারীর অতীব শত্রুর সহিত তাঁহাকে শেষ দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, তখন বেহারীর অদৃষ্টে কি হইয়াছে বলিতে পারি না। এখন আপনাদের কাহারও সেই কেদারনাথের বাড়ী জানা আছে কি?”

 বলদেব আমার কথায় দুঃখিত হইলেন। তিনি বিষয় বদনে উত্তর করিলেন, “আমি তাঁহার পূর্ব্বের বাসস্থান জানি। কিন্তু সেটা তাঁহার নিজের বাড়ী নয়। যদি তিনি ইতিমধ্যে আর কোথাও গিয়া থাকেন তাহা হইলে আমি সে ঠিকানা জানি না।”

 হৃষীকেশ বলিলেন, “আমি তাঁহার কোন বাড়ীই জানি না। তিনি যখন মধ্যে মধ্যে আপনাদের মন্দিরে যাইতেন সেই সময়ে তাঁহার সহিত আমার আলাপ হয় কিন্তু তাঁহার প্রকৃতি বড় উগ্র বলিয়া আমি তাঁহার সহিত বিশেষ সংস্রব রাখিতাম না।”

 আমি কোন উত্তর করিলাম না। দেখিতে দেখিতে বেলা দশটা বাজিয়া গেল দেখিয়া সেখানে আর সময় নষ্ট করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। সত্বর হৃষীকেশের নিকট বিদায় লইয়া বলদেবের সহিত বাহিরে আসিলাম এবং পুনরায় উভয়ে শকটে আরোহণ করিয়া কেদারনাথের বাড়ীর দিকে যাইতে লাগিলাম।