দুই শিষ্য/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 প্রায় এগারটার সময় একখানি কুটিরের সম্মুখে আমাদের গাড়ী স্থির হইল, বলদেব তখনই গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন এবং সেই কুটারের দ্বারে গিয়া কেদারনাথকে ডাকিতে লাগিলেন।

 কিছুক্ষণ পরে একটি বালক দৌড়িতে দৌড়িতে বাহিরে অসিল ও বলদেবকে কহিল, “আপনি কাহাকে ডাকিতেছেন?”

 বলদেব বলিলেন, “এখানে কেদারনাথ নামে কোন ব্রাহ্মণ বাস করেন?”

 বালক হাসিতে হাসিতে বলিল, “তিনিই ত আমার পিতাঠাকুর। এই বাড়ীতেই তিনি থাকেন।”

 বালকটীর বয়স প্রায় পনের বৎসর। দেখিতে শ্যামবর্ণ হইলে ও তাহার মুখশ্রী অতি সুন্দর। কথাবার্ত্ত য় চতুর বলিয়া বোধ হইল। বালকের মুখে যে সকল কথা শুনিতে পাইলাম, তাহাতে আমি আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। তখনই শকট হইতে অবতরণ করিয়া সেই কুটীরদ্বারে বলদেবের নিকট গমন করিলাম।

 বালক এতক্ষণ বলদেবের সহিত বেশ কথা কহিতেছিল। কিন্তু আমাকে পুলিশ-কর্মচারী দেখিয়াই হউক কিম্বা আর কোন কারণেই হউক, সে আর কোন কথা কহিল না।

 বালকের কার্য্য দেখিয়া আমি বিস্মিত হইলাম এবং অতি মিষ্ট কথায় তাহাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি বাবা?”

 আমার কথায় বালকের ভয় দূর হইল, সে অতি ধীরে ধীরে আমার নিকটে আগমন করিল এবং আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আমার নাম সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

 আ। তুমি কি কাজ কর?

 সু। এখনও লেখাপড়া করি।

 আ। কোন্ শ্রেণীতে পড় বাবা?

 সু। আজ্ঞে—দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আর বৎসর প্রবেশিক পরীক্ষা দিব।

 আ। তোমার পিতা কোথায় বলিতে পার?

 সুরেন্দ্রনাথ সহসা কোন উত্তর করিল না। কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া বলিল, “আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না।”

 বালকের কথায় আমি স্তম্ভিত হইলাম। মনে করিলাম, বোধ হয় কেদারনাথ পূর্ব্ব হইতেই পুত্রকে সাবধান করিয়া দিয়া থাকিবেন। কিন্তু মুখে সে সকল কথা না বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কি কথা! তোমার পিতা কোথায় তুমি বলিতে পারিতেছ না? এ বড় লজ্জার কথা।”

 আমার কথায় বালক কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না। সে হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমি ত বাড়ীতে ছিলাম না। আজ প্রাতে আসিয়াছি মাত্র।”

 আ। কোথায় গিয়াছিলে?

 সু। মাতুলালয়ে।

 আ। কবে?

 সু। আজ চারি দিন হইল।

 আ। কি জন্য?

 সুরেন্দ্রনাথ আমার শেষ প্রশ্নে যেন বিরক্ত হইল। সে কর্কশ স্বরে বলিল, “এমন কিছু কারণ ছিল না। তবে আমার দিদিমার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ হইয়াছে। সেই উপলক্ষে জনকয়েক ব্রাহ্মণভোজনও হইয়াছিল। আমিও সেইজন্য গিয়াছিলাম।

 আ। তোমার পিতা গিয়াছিলেন কি?

 সু। আজ্ঞে না— তাঁহার এখানে কি জরুরি কাজ ছিল, সেই জন্য আমার সহিত সেখানে যাইতে পারেন নাই।

 আমি কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলাম, “তোমার পিতার সংবাদ তুমি না জানিতে পার, কিন্তু বাড়ীর লোকে ত জানে। একবার ভিতরে গিয়া সংবাদটী আন দেখি।”

 সুরেন্দ্রনাথ আমার কথায় ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “কাল বৈকালে তিনি এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়াছেন, এখনও আইসেন নাই।”

 সুরেন্দ্রনাথ যেরূপ করিয়া ঐ কথাগুলি বলিল, তাহাতে আমার বিশ্বাস হইল না। আমার বোধ হইল, কেদারনাথ বাড়ীতেই আছেন। তিনিই তাঁহার পুত্রকে যে ঐরূপ শিখাইয়া দিয়াছেন, তাহাও আমার বুঝিতে বাকি রহিল না। আমি সুরেন্দ্রকে আর কোন কথা বললাম না। বলদেবকে সঙ্গে লইয়া তখনই তথা হইতে বাহির হইলাম এবং শকটারোহণে কিছুদুর প্রত্যাগমন করিলাম।

 কেদারনাথের বাড়ী হইতে প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ দূরে আসিয়া, আমি কোচমানকে গাড়ী থামাইতে আদেশ করিলাম। গাড়ী স্থগিত হইলে, আমি বলদেবকে সেই স্থানে রাখিয়া স্বয়ং নিকটস্থ থানায় গমন করিলাম এবং সেখানকার দারোগাবাবুর নিকট হইতে আবশ্যকীয় ছদ্মবেশ সংগ্রহ করিয়া সেইখানেই পরিধান করিলাম।

 যখন সেই ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া গাড়ীতে বলদেবের নিকট আগমন করিলাম, তখন তিনি আমায় চিনিতে পারিলেন না। আমি গাড়ীতে উঠিতে যাইতেছি দেখিয়া, তিনি অতি মিষ্ট কথায় নিষেধ করিলেন। বলিলেন, “এখনি একজন পুলিশ কর্ম্মচারীর গাড়ী। তিনি আমাকে রাখিয়া নিকটে কোথাও গিয়াছেন। নিশ্চয়ই শীঘ্র ফিরিয়া আসিবেন।”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া গাড়ীতে উঠিয়া বসিলাম। আমার পরিধানে বলদেবের মত গৈরিক বসন, গৈরিক উত্তরীয়, পায়ে খড়ম্, হস্তে এক গাছি লাঠী, গলায় ও হস্তে কতক গুলি রুদ্রাক্ষের মালা তখন আমাকে দেখিতে ঠিক সন্ন্যাসীর মতই হইয়াছিল।

 আমাকে তাঁহার বাক্য অবহেলা করিতে দেখিয়া, বলদেব বিরক্ত হইলেন। তিনি কৃত্রিম কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক বলিলেন, “মহাশয়, আমার কোন অপরাধ লইবেন না; দারোগাবাবু এখানে আসিয়া যখন আপনাকে গাড়ীর উপর দেখিতে পাইবেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি রাগান্বিত হইবেন এবং আপনাকে তিরস্কার করিবেন।

 আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “আপনার কোন চিন্তা নাই। আমি তাঁহার পরিচিত।

 আমার কণ্ঠস্বরে বলদেব চমকিত হইলেন। তিনি ভাল করিয়া আমার মুখের দিকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আমি আপনাকে চিনিতে পারি নাই? এমন অদ্ভুত ছদ্মবেশ আর কখনও দেখি নাই। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এ বেশে কি করিবেন?”

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আবার কেদারনাথের বাড়া যাইব। তাহার পুত্রের মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহা বিশ্বাস হইল না। আমার বোধ হয়, কেদারনাথ এখনও বাড়ীতে আছেন। পাছে পুলিসের বেশ দেখিয়া তিনি কিম্বা তাঁহার বাড়ীর লোক ভীত হয়, এইজন্যই আমার এই ছদ্মবেশ। এ বেশে যাইলে কেদারনাথ হয়ত সাক্ষাৎ করিতে অসম্মত হইবেন না।”

 বলদেব হাসিয়া বলিলেন, “আপনার অনুমান সত্য। যোগী, ঋষি ও সন্ন্যাসীর উপর কেদারনাথের বড় ভক্তি। আপনার ন্যায় সন্ন্যাসীকে দেখিলে তিনি নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ করিবেন। কিন্তু যদি আপনি গাড়ী করিয়া আবার সেখানে যান, তাহা হইলে হয়ত সেই বালকের সন্দেহ হইতে পারে। তাহাতে আপনার কার্য্যসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটিবে।”

 আ। আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি অধিকদুর গাড়ীতে যাইব না। কেদারনাথের বাড়ী হইতে কিছুদুরে আপনাকে গাড়ীতে রাখিয়া আমি একাই পদব্রজে তাঁহার বাড়ীতে যাইব।

 ব। অতি উত্তম সংকল্প।

 আমি তখন আর কোন কথা না বলিয়া কোচমানকে পুনরায় কেদারনাথের বাড়ীর দিকে যাইতে আদেশ করিলাম। শকট চালিত হইল।