দুনিয়ার দেনা/পথের মানুষ
পথের মানুষ
১
খালি পা, গায়ে ছেঁড়া চাদর জড়ান, কতকটা সাধু সন্ন্যাসীর কতকটা ভিখারীর সাজ, একটি মানুষকে কিছুদিন থেকে নগরের দুয়ারে দুয়ারে ফিরতে দেখা যায়। সে কারো কাছে কিছু চায় না, কেবল দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ায়। যদি কেউ বসতে বলে ত বসে, খেতে দিলে খায়, কেউ কিছু না বলে ত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে চলে যায়। কাউকে ত্যক্ত করে না, কাউকে ব্যস্ত করে না, শুধু সে যায় আর আসে।
এই ভাবে তার পথে পথে কত বছর কেটেছে, কেউ জানে না। সে নিজেও জানেনা, রাস্তায় তার কত বছর কাটল। সে সাল মাস গোণে না, আজ কাল ভাবে না। যখন আছে, কেবল সেইক্ষণটুকুতেই যেন জানে, যেখানে আছে কেবল সেই জায়গাটুকুকেই যেন চেনে, এই রকমের তার ভাবখানা।
লোকটা নিজের মনেই উদাসী কি কোন দলভুক্ত সন্ন্যাসী, পেটের অন্নের জন্যে নিজের পরেই ভরসা, কি ভিক্ষা করা ব্যবসা, বোঝা দায়। আসল কথা লোকটাকে ধরা যায় না। কোনোদিন দেখা যায় রাস্তায় পড়ে ঘুমোচ্ছে, কোনদিন নদীর ধরে শুয়ে আছে, কোনদিন খোলামাঠে হাত পা ছড়িয়ে সটান লম্বা হয়ে পড়ে আছে।
আর যাই হোক, লোকটা কিন্তু পাগল নয়। কথা যা কয়, তাতে পাগলামীর কোনই চিহ্ন নেই, যদিও কথা খুব কমই কয়, আর গলার আওয়াজটাও কিছু মৃদু।
ছেঁড়া চাদরখানা মুড়ি দিয়ে ভোর রাত্রে একদিন সে গঙ্গার তীরে পড়ে আছে। মেয়েরা দুচার জন চলেছে গঙ্গাস্নানে। তাড়াতাড়ি চলতে গিয়ে হঠাৎ একজন স্ত্রীলোকের পা লোকটার গায়ে গেল ঠেকে, স্ত্রীলোকটি ব’লে উঠল “কে শুয়ে গো, ছি ছি পা ঠেকে গেল গায়ে, তুমি কে বাবা”?
লোকটা বল্লে “আমি মানুষ”।
স্ত্রী। এখানে কেন শুয়ে, তোমার কি ঘর নেই?
লো। এই তো আমার ঘর, এই পৃথিবী আর এই মাটি। মাটি দিয়েই তো লোকে ঘর গড়ে?
স্ত্রী। এমন খোলা জায়গায় পড়ে আছ, বাছা!
লো। কেন এই তো এত বড় আকাশ আমাকে ঢেকে রয়েছে।
স্ত্রী। জল ঝড় রোদ্দুর গায়ে লাগে না, তাদের কাছ থেকে বাঁচ কেমন করে?
লো। তুমি কেমন করে কাপড় পরে থাক?
স্ত্রী। সে যে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
লো। এদেরও আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, এরা আমার পোষাক।
কথা শুনে স্ত্রীলোকটির মনে বড় কৌতূহল জন্মাল কথা আরো শুনতে। জিজ্ঞাসা করলে “তুমি খাও কোথা”?
লো। যেথা পাই।
স্ত্রী। কর কি?
লো। কিছুই না।
স্ত্রী। তোমার কোনই কাজ নেই?
লো। আছে, ঘুরে বেড়ান।
স্ত্রী। তাতে হয় কি?
লো। খুসী হই।
স্ত্রী। খুসী হয়েই বেঁচে আছ?
লো। হাঁ।
স্ত্রী। তোমার কে আছে?
লো। জানি না, আমি কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি, তারা কেউ আমার কি না! তাই আমি জানি না, আমার কে আছে।
স্ত্রী। তোমার বাপ মা নেই?
লো। মনে পড়ে না।
স্ত্রী। তোমার নাম কি?
লো। জানি না, বাপ মাকে তো মনে নেই, নাম বলবে কে?
স্ত্রী। এই ভাবে তুমি বেশ সুখে আছ?
লো। সুখ ছাড়া আর কিছুই আমার নেই।
স্ত্রী। তুমি এক নূতনতর মানুষ দেখছি।
লো। সৃষ্টিকর্ত্তা আমাকে এমনি করেই সৃষ্টি করেছেন।
স্ত্রী। তুমি বাপ মাকে জান না সৃষ্টিকর্ত্তাকে জানলে কেমন করে?
লো। হয় বাপ মা আছেন, নয় সৃষ্টিকর্ত্তা আছেন, একটা তো বলতে হবে? বাপ মা বল্লে লোকে দেখতে চায়, নাম জিজ্ঞাসা করে, সৃষ্টিকর্ত্তা বল্লে কোন গোল নেই, কেউ দেখতেও চায় না, নামও জিজ্ঞাসা করে না, এক কথায় মিটে যায়।
স্ত্রীলোকটির কৌতূহল বাড়তে লাগল। সে বল্লে “তোমাকে আমার বাড়ী যেতে হবে। কোন কষ্ট হবে না, আমি তোমাকে যত্নে রাখব; চল আমার বাড়ী।”
লো। আমাকে নিয়ে গিয়ে কি করবে, আমার দ্বারা তো কোন কাজ হবে না।
স্ত্রী। কাজ চাই না, শুধু কথা শুনবো।
লোকটি বল্ল, “চল”।
দুজনে পথ ধরে বাড়ীর মুখে চলল। সে দিন আর স্ত্রীলোকটির গঙ্গা স্নান হল না।
২
সকাল হয়েছে। রাস্তায় লোক চলা-ফেরা করছে। স্ত্রীলোকটি আগে আগে, ছেঁড়া চাদর পরা মানুষটি তার পিছে পিছে চলছে। কিছু ক্ষণ পরে একটা মস্ত বড় বাড়ীর সামনে এসে স্ত্রীলোকটী থেমে দাঁড়ল। বল্লে “এই আমার বাড়ী, এস বাবা ভিতরে।” বাড়ীখানার দিকে চেয়ে দেখে লোকটা বল্লে, এ জায়গাটা যে চারিদিক থেকে চাপা, আসবাব-পত্র দিয়ে, লোক-লস্কর দিয়ে, সোনা-দানা দিয়ে, আশা দিয়ে, নেশা দিয়ে একেবারে ঠেসে চাপা! এর ভিতর ঢুকতে গেলে আমি হাঁপিয়ে মারা যাব।
স্ত্রীলোকটি একটু লজ্জিত হয়ে বল্লে, “কাছেই আমার একটা বাগান পড়ে আছে, তাতে ঘর বাড়ী কিছুই নেই, তুমি অনায়াসে তাতে থাকতে পারবে। চল, সেখানে তোমাকে নিয়ে যাই।” এই বলে, বাড়ী না ঢুকেই লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে, সে আবার চলতে আরম্ভ করল!
একটুখানি গিয়েই বাগান। কতকগুলো সার বাঁধা সুপুরি ও নারকেল গাছ, ঘেঁসাঘেসি বসানো কতকগুলো আম গাছের জঙ্গল, দুটো চারটে বেল, তাল, পেয়ারা গাছ এদিক ওদিক ছড়িয়ে, কিনারায় কতকগুলো বাঁশ ঝাড় আর মাঝখানে দুটো পুকুর। পুকুর দুটো একটা ডোবা বল্লেই হয়, পানায় ঢাকা এঁদো পড়া, একটার জল ভালো, তাতে একটা বাঁধানো ঘাটও আছে। পাড়া-প্রতিবেশী আট দশ ঘর হাড়ি মুচি ও চাঁড়াল। ক্রোশ খানেকের মধ্যে ভদ্রলোকের বাস নেই বল্লেই হয়। ক্বচিৎ যদি দু’একঘর দেখা যায়।
বাগানটা বহুকালের পোড়ো, কেউ কখনো তাতে বাস করেিন। হাড়ি মুচিদের মেয়েরা, দিনের বেলা, দু-চার কলসী জল নিতে বাগানের মধ্যে যাওয়া-আসা করে—পুকুরটার জল ভাল ব’লে, সন্ধ্যার পর সেদিকে জনমানবের চলাচল নেই। লোকটা বাগানের মধ্যে ঢুকেই বল্লে, “হাঁ, এখানে আমি থাকতে পারব”। তাকে সেইখানে রেখে স্ত্রীলোকটি বাড়ী ফিরে গেল।
কিছুক্ষণ পরে ফল, মিষ্টান্ন বোঝাই একটা চাঙ্গারী মাথায় একজন মুটে এসে বাগানে ঢুকূল। চাঙ্গারীর উপর গায়ে দেবার নূতন একখানা চাদর। মানুষটির সামনে চাঙ্গারী নামিয়ে মুটে বল্লে “মা ঠাকরুণ আপনার জন্যে পাঠিয়েছেন”। ব’লে, চাঙ্গারীটা রেখে মুটে চলে গেল।
বেলা যখন দুপুর পাড়ার ছোট জাতের মেয়েরা এসেছে পুকুরে জল নিতে। লোকটা তাদের ডেকে বল্লে, “তোরা এসব নিয়ে যা, ভাগ করে নিস্, দেখিস্ যেন সবাই পায়। গায়ে যার মোটেই কাপড় নেই চাদরখানা তাকেই দিস্।” এই বলে চাদর সুদ্ধ চাঙ্গারীখানা লোকটা তাদের একজনের মাথায় তুলে দিলে। মেয়েরা তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে চাঙ্গারী মাথায় নিয়ে চলে গেল।
বৈকালে স্ত্রীলোকটি এসে দেখ্ল, লোকটা চুপচাপ পড়ে রয়েছে; চেঁড়া চাদর গায়ে যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে, ফল মিষ্টির একটুকরোও কোনখানে পড়ে নাই। কি হয়েছে, কিছু বুঝতে না পেরে, দুচারটি কথা কয়েই সেদিনকার মত সে চলে গেল।
পরদিন আবার এক চাঙ্গারী খাবার এল মুটের মাথায়। দুপুরে মেয়েরা এসে আবার সে গুলি সব নিয়ে গেল। ক্রমে এটা দৈনিক হয়ে দাঁড়াল।
রোজ এই রকম খাবার পেতে পেতে লোকটির কাছে মেয়েদের ভয় সঙ্কোচ কমে আসতে লাগল। এখন তারা দাঁড়িয়ে দুচারটে কথা তার সঙ্গে কয়।
একদিন একজন বল্লে,“জাননা এটা যে ভূতের বাগান। তুমি রাতে একলা এখানে থাক কেমন করে? ভয় করে না?”
লো। না?
মেঃ। ভূতকে বুঝি তুমি ভয় কর না?
লো। মোটেই না।
মে। যদি ভূত এসে পড়ে, তখন কি করবে?
লো। মেরে তাড়াব।
মে। ওমা! তুমি ভূতকে মারতে পার? তুমি বুঝি ভূতের রোজা!
লো। না, আমি রোজা নই, কিন্তু জোর করে ভূত তেড়ে এলে, মেরে তাড়াব। একবার ভয় পেলে, ভূত আর কখনো আসবে না।
মে। ভূত কি কাউকে ভয় করে? ভূতকেই তো সবাই ভয় পায়।
লো। সেইজন্যেই তো ভূতও সবাইকে চেপে ধরে। একবার তাকে ভয় দেখাতে পারলে, আর কেউ তাকে ভয় করবে না।
মে। ওমা ভূতকে বুঝি আবার কেউ ভয় দেখাতে পারে? তুমি বুঝি ভূতকে ভয় দেখাতে পার?
লো। তোমরাও পার।
মে। ও বাবা আমরা ভূতকে বড্ড ভয় করি।
লো। আর ভয় করতে হবে না, এইবার ভূত তোমাদের দেখলেই পালাবে।
মে! কেমন করে গা?
লো। দেখতেই পাবে।
তারা অবাক্ হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া চা-ই করতে লাগল ও নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করতে করতে চলে গেল।
৩
এদিকে স্ত্রীলোকটি ভাবে রোজ আমি এত খাবার পাঠাই সে সব খায় কে? দেখতে হবে ব্যাপারটা কি? একদিন দুপুরে চুপিচুপি এসে বাগানের ধারে সে দাঁড়িয়ে আছে। দেখল, লোকটা স্নান করে, বাগানের গাছ থেকে একটা পাকা বেল পেড়ে, খেয়ে খানিকটা জল খেলে। কিছুক্ষণ পরে একটা মুচির মেয়ে এল জল নিতে। জল নিয়ে সে লোকটার কাছে এসে বল্লে, “আমার ছোট্ট ভাইটি খিঁচ্চে, তাকে ভূতে পেয়েছে। মা বলে, তোমাকে ডেকে নিয়ে যেতে; তোমার পায়ে পড়ি বাবা, আমার ভাইটাকে তুমি ভূতের গরাস থেকে বাঁচিয়া দাও।”
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে বল্ল, “আচ্ছা চল।” খাবারের চাঙ্গারীটা মেয়ের মাথায় তুলে দিয়ে লোকটি তার পিছু পিছু চলতে লাগল, মেয়েটি আগে আগে।
কিছু দূরে গা-ঢাকা হয়ে, তাদের পিছনে পিছনে স্ত্রীলোকটিও চলছে।
একটি দুবছরের ছেলে মাটির ঘরের দাওয়ায় পড়ে হাত পা খিঁচচে, দেখা গেল। কাছেই একরাশ তুলসীগাছের একটা ঝোপ। কতকগুলো তার পাতা তুলে ছেঁচে রস করে তাড়াতাড়ি গরম করে খাওয়ান মাত্র ছেলেটির খেঁচুনি বন্ধ হয়ে গেল, ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠল।
ছেলের মা লোকটার পায়ের উপর প’ড়ে, “ভূত তাড়িয়ে তুমিই আমার ছেলেকে বাঁচলে, বাবা! তুমিই বাঁচালে!” ব’লে বারম্বার আকুলি বিকুলি করে, তার কাছে নিজের কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল।
লোকটি বল্লে, “বাড়ী ঘর বিছানা পত্র খাবার জিনিষ শরীর কোন কিছু যদি অপরিষ্কার রাখিস্, আর পচা মাছ, পচা মাংস খাস্, তাহলে আবার ভূত এসে চাপবে, আর আমি বাঁচতে পারব না। দেখিস্ সাবধান, এখন থেকে খুব পরিষ্কার থাকবি চারিদিক খুব পরিষ্কার রাখবি।”
তারা সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, “পরিষ্কার হলেই ভূত পালাবে?”
লোকটি বল্ল, “হাঁ পরিষ্কার হলেই ভূত একবারে পালাবে, আর কখনো আসবে না।”
সেই থেকে তারা, ঘর, বাড়ী খাবার জিনিষ শরীর সব পরিষ্কার রাখতে আরম্ভ করল। তার পর থেকে সে রকম রোগও আর কখনো তাদের মধ্যে দেখা দেয়নি!
স্ত্রীলোকটি গোপনে দাঁড়িয়ে সব দেখল এবং সেদিন আর তার সঙ্গে দেখা না ক’রে, সেইখান থেকেই বাড়ী ফিরে গেল। তার মনের মধ্যে নানা রকম তোলপাড় হতে লাগল।
পরদিন দুপুরে আবার সে লুকিয়ে এসেছে। দেখে, যার ছেলে রোগমুক্ত হয়েছে, সেই মুচিনী, একটু কি খাবার নিয়ে এসে লোকটার সামনে ধরে বল্লে “বাবা একটু খাও।” তৎক্ষণাৎ লোকটি তার খাবার নিয়ে খেয়ে ফেললে। খাবারটা আর কিছু নয় কাঁচা চিঁড়ে গুড়ের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে লাড়ু তৈরী করা।
পরদিন সকালে স্ত্রীলোকটি, মুটের মাথায় এক ঝাঁকা খাবার দিয়ে, তাকে সঙ্গে করে এনে, বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে, অল্প কিছু খাবার হাতে লোকটার সামনে গিয়ে বল্লে “বাবা, আমার দেওয়া এইটুকু খাবার আজ তোমাকে খেতেই হবে। তুমি এক দিনও আমার খাবার খাও না, আমি নিজের চোখে দেখেছি। কাল মুচির মেয়ে খাবার টুকু দিলে, তুমি কত খুসী হয়ে খেয়েছ, তাও আমি দেখলুম। আমার খাবার কেন খাবে না, এ খাবার কি ভাল নয়?
“খুব ভাল, তাই জন্যেইতো সকল লোক তোমার খাবার খেতে ইচ্ছা করে। সকলের খাওয়াটা যে ঢের বড় কথা! তোমার খাবারে তাই রোজ খুব বড় কাজ হয়। মুচির মেয়ের খাবার তো কেউ খেতে ভাল বাসবে না, কিন্তু সেটাও তো কোন একজনের খাওয়া চাই তাই আমিই সেটা খেয়েছি।”
এই মানুষটির কথা সে যখনই শোনে, তখনই তার তার মনের মধ্যে কেমন একরকম নাড়া দেয়। আজকের কথাতেও তার মনটা খুব নাড়া দিয়ে উঠল। সে বল্লে আমার মনে বাবা! একটুও সুখ নেই, আমি কি করে সুখ পাব, তা বল, আমার আর সব আছে, কেবল সুখ নেই। তোমার আর কিছুই নেই, কেবল সুখ আছে। তোমাতে আমাতে কি তফাৎ! আমি কেমন করে সুখ পাব, আমাকে বলে দাও।
মা। সুখ তো কোন জিনিষ নয়, যে সেই জিনিষটা পেলেই সুখকে পাবে। সুখ মনের একটা সহজ অবস্থা। কিছুকাল ধরে মনটাকে সহজ ভাবের মধ্যে ফেলে রাখতে পারলে, সুখ তার ভিতর থেকে আপনিই জেগে ওঠে।
স্ত্রী। কেমন করে সহজ হব, কেমন করে সহজ ভাবের মধ্যে মনটা রাখব, আমাকে বলে দাও।
মা। এই এদের মধ্যে থাক, এই সব হাঁড়ি, মুচি চণ্ডালের মধ্যে, এদের খাওয়াও, বাঁচাও, টেনে তোল, সুখ আপনি আসবে।”
স্ত্রী। বাবা আমার ইচ্ছা করে নিজের বাড়ী নিয়ে ওদের আমি খুব করে খাওয়াই, কিন্তু ওরা তো আমার বাড়ী যাবে না। ওরা আমাকে ঘৃণা করে। আমি পতিতা।
মা। পথে বেরিয়ে পড়তে পারলে পতিতা অপতিতা সব এক হয়ে যাবে, কেউ আলাদা থাকবে না। পথে কি আর কেউ কারো পরিচয় নেয়? বেরিয়ে পড়, পথে বেরিয়ে পড়, আকাশে কর ঘর বাতাসে কর ভর দুনিয়াকে কর দেশ, সহজে হবে শেষ।
কথা শুনে স্ত্রীলোকটি অবাক্ হয়ে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার মাথার চারিদিকটা যেন খোলা বোধ হতে লাগল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আমার নাম ধাম যে বদলাতে হবে বাবা আমাকে যে সবাই চেনে।
মা। নামে কি দরকার? নাম নিয়েই তো যত ল্যাটা। নাম ছেড়ে দাও অনেক গোল মিটে যাবে। আর ধাম? কেউ জিজ্ঞাসা করলে, দেখিয়ে দিও, ঐ হাড়িনী আর চামারনিদের ঘর।
স্ত্রী। দেখিয়ে দাও, বাবা! আমাকে পথ দেখিয়ে দাও। কেমন করে এ পথে চল্ব ভালো করে বুঝিয়ে দাও।
মা। এ পথ কাউকে দেখিয়ে দিতে হয় না, নিজেই জানা যায়; যার পথ সে নিজেই চিনে চলতে পারে ঘরে যাও, ঘরে বসেই পথ দেখতে পাবে।
স্ত্রীলোকটি নিজের অন্তরের মধ্য থেকে কেমন যেন একটা সাড়া পেতে লাগল; খানিক স্তব্ধ হয়ে ব’সে সে উঠে আস্তে আস্তে বাড়ীর দিকে চল্ল।
স্ত্রীলোকটি পথ দিয়ে যায়, আজ আর পথের কোন কিছু তার চোখে পড়ে না। সব যেন ধোঁয়া, সব যেন ছায়া। আজ সে কি অন্যমনস্ক: মাথার ভিতর তার কেবলই ঘুরছে, “বেরিয়ে পড়, পথে বেরিয়ে পড়।” সে জানে না, কোথায় বেরবে, কোন পথে যাবে; জানে না, সে পথের আরম্ভ কোথায়।
মানুষটি তাকে বলেছে ঘরে বসে পথ দেখতে পাবে। আজ তো তার ঘর বলে কিছু নেই। ঘরে তার কে আছে? যারা আছে তারা তো তার কেউ নয়! তারা তো পথের মানুষ নয়! তবে সেখানে সে কার কাছে যাবে? কতকটা স্পষ্ট কতকটা অস্পষ্ট ভাবে এই রকম নানা কথা এলো মেলো হয়ে তার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল।
কতক্ষণ সে নিজের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জানে না। সন্ধ্যা তখন উত্তীর্ণ। বাড়ীটার দিকে চাওয়া মাত্র মনে হল পৃথিবী যেন তার পায়ে নীচে থেকে সরে যাচ্ছে, পায়ের নীচে যেন মস্ত একটা গহ্বর তার মধ্যে সে যেন আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে, চোখের সামনে বাড়ীখানা দুলছে এখুনি ভেঙ্গে তার মাথার উপর পড়ে তাকে সেইখানে কবরস্থ করবে। তার মাথাটা ঘুরে গিয়ে সেইখানে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
যখন ঢোক মেল্ল, দেখে একটা মাঠের মধ্যে সে শুয়ে চারিদিক অন্ধকার, মাথার উপর খোলা আকাশ, তার বুকে এক রাশ তারা জ্বল্ছে; কিছু দূরে সেই লোকটা নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লোকটাকে বাগানে এনে রাখার পর থেকে দিনের বেলায় তাকে পথে ঘুরে বেড়াতে কেউ কোন দিন দেখেনি, কিন্তু রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে তাকে অনেকেই দেখেছে।
ইদানীং সবাই তাকে চিনেছিল, কেউ আর এতে কিছু ভাবতো না। জানতো, লোকটার এই রকমই স্বভাব।
দূরে মাঠের মধ্যে লোকটাকে দেখে স্ত্রীলোকটির বুকের ভেতর আজ বড্ড নাড়া দিয়ে উঠল। সেই যেন তাকে টেনে নিয়ে কোথায় চলেছে। আপনাতে সে আপনি যেন নেই।
উঠে সে দাঁড়াল, পা টলছে, কোন রকমে এগিয়ে লোকটার দিকে চল্ল। কাছে গিয়ে বলে উঠল, “বাবা, এ আমি কোথায় এসেছি?”
লো। এই যে এখানে, বাইরে।
স্ত্রী। এখানে কি আছে?
লো। সব আছে, যা চাও।
স্ত্রী। কই, আমি তো কিছু পাচ্ছি নে”।
লো। এই তো সবে মাত্র বেরিয়ে এসেছ! একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও, তবে ত পাবে।
স্ত্রী। আমি তো দেখছি, এসব খালি।
লো। না, এর কিছুই খালি নয়, সব ভরা, আগাগোড়া ভরা,—প্রাণ দিয়ে, চেতনা দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, রস দিয়ে, আনন্দ দিয়ে এর সমস্তটা ভরা,—একেবারে নিরেট করে ভরা, একবিন্দুও ফাঁক নেই”।
স্ত্রী। এটা নেবার শক্তি বোধ হয় আমার নেই, বাবা! আমি এর কিছুই তো নিতে পারছি নে!
লো। সময় লাগবে, সময় লাগবে। কিছুদিন এটার মধ্যে নিজেকে ফেলে রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে থাকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বাইরে তো কখনো এস নাই;—তাই এদের সঙ্গে পরিচয় নেই! ক্রমে সব সহজ হয়ে আসবে!
স্ত্রীলোকটি শাস্ত হয়ে লোকটার পায়ের কাছে পড়ে রইল।
৬
সকাল হয়েছে, মাঠে জনপ্রাণী নেই, স্ত্রীলোকটি একলা। দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ভাবল কোনদিকে যায়, শেষে মুচিপাড়ার দিকেই চল্ল।
হাড়ি চামার চাঁড়ালের বউঝিরা তখন সবে মাত্র ঘরের কাজ সুরু করেছে। চুপটি করে একপাশে একজন মেয়ে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল “তুমি কে গা?”
স্ত্রী। আমি স্ত্রীলোক!
মে। কোথা থেকে আসছ?
স্ত্রী। মাঠ থেকে।
মে। কি চাও?
স্ত্রী। এখানে থাকব।
মে। তুমি কি জাত?
স্ত্রী। আমার জাত নেই।
মে। এখানে থেকে কি করবে?
স্ত্রী। তোমাদের কাজ করব।
মে। কি কাজ?
স্ত্রী। যা তোমরা বলবে।
মে। আমাদের কাজ করে তোমার কি হবে?
স্ত্রী। সুখ হবে।
মে। তুমি বুঝি সুখ চাও?
স্ত্রী। হাঁ, আমার সব ছিল কেবল সুখ ছিল না; তাই তোমাদের কাছে সুখ নিতে এসেছি।
মে। আমাদের কাছে বুঝি সুখ আছে?
স্ত্রী। হাঁ।
মে। কই, আমরা তো জানিনি!
স্ত্রী। তোমরা জাননা, কিন্তু আমি জানি।
মে। জান তো নাও, থাক তবে ঐখানে।
এই বলে, কাছেই এক চামারের বাড়ী পড়ে ছিল, কয়েক দিন হল তারা অন্য গাঁয়ে উঠে গেছে, সেই বাড়ীটা সে দেখিয়ে দিল।
বাড়ী দেখে স্ত্রীলোকটি খুব খুসী হয়ে বল্ল,—
বাড়ীটা পেয়ে বড় খুসী হলুম, তুমি সুখে থাক বাছা।
মে। তোমার নামটি কি?
স্ত্রী। আমাকে তোমরা “খুসী” বলেই ডেক।
মে। বাঃ!বেশ তো নামটি, আমাদের সঙ্গে বেশ মিশ খেয়ে যাবে।
স্ত্রী। তোমাদের সঙ্গে মিশ খেয়ে গেলে, আমিও খুসী হবো।
৭
সেই লোকটাকে তার পরে আর সে পাড়ায় কেউ দেখেনি। একদিন ভোরের সময় দেখা গেল, ছেঁড়া চাদর পরা লোকটার শরীর গঙ্গার জলে ভাসছে। চাদরখানা তখনো তেমনি ভাবেই গায়ে জড়ান। দাঁড়িয়ে যারা দেখছিল, শ্মশানের একজন মুর্দ্দাফরাস তাদের বল্ল, মশায় আমি দেখেচি কাল রাতে লোকটা এসে, সটান লম্বা হয়ে জলের উপর শুয়ে পড়ল নড়ল না চড়ল না, একবার ডুবলও না, শুয়েই অমনি সহজভাবে ভাসতে লাগল। এখনো ঠিক তেমনি ভাবেই ভাসছে, অবিকল সেই রকম!
মুর্দ্দাফরাসের কথায় কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না।
এদিকে দেখতে দেখতে গঙ্গায় জোয়ার এসে শরীরটাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।
দর্শকেরা ফিরল। পথে যেতে যেতে একজন বলে “স্নান করতে গিয়ে লোকটা গঙ্গায় ডুবে গিয়ে থাকবে।”
আর একজন বলে, “তা হতেই পারে।
১ম। লোকটা কিন্তু অসাধারণ ছিল, হে!
২য়। তা আর বলতে।