দুনিয়ার দেনা/কাপালিকের কপাল

কাপালিকের কপাল

 শীতকাল, রাত্রি তিনটা। তখনও ভোরের আলোর আভাটুকুও দেখা দেয়নি। ঘোর অন্ধকারে চারদিক ঢাকা। পথে মানুষের চলাচল দূরে থাক্‌ শেয়াল কুকুরের সাড়াটি পর্য্যন্ত নেই। গভীর নিস্তব্ধতা ঘন হয়ে চারিদিককে যেন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে; কোথাও একটুকু শব্দ হলেই অমনি তাকে চেপে মারবে, নিজের অটল গাম্ভীর্য্যকে মুহূর্ত্তের জন্য ও ভাঙ্গতে দেবে না, এমনিতর ভাব।

 সেই নিস্তব্ধতার কোলে, সেই অন্ধকারের মধ্যে ঠিক তেমনি নিস্তব্ধ হয়ে হরিদ্বারের পথে গঙ্গাতীরে এক সন্ন্যাসিনী বসে। কম্বলের তৈরী একটি আলখাল্লার উপর একখানা গেরুয়া রঙের সাড়ী পরা, হাতে দুগাছি লাল রুলি, মাথার একরাশ খোলা চুল পিঠ ছাপিয়ে মাটিতে পড়ে লুটচ্ছে, সন্ন্যাসিনী গঙ্গার জলে পা দুখানি ডুবিয়ে তীরে বসে আছে।

 নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সন্ন্যাসিনী হঠাৎ গেয়ে উঠল ‘পার কর হে পার কর হে পার কর, এই পারের এই দুখের কথা আর কইতে নারি যে, পার কর।

 গানের সুর অন্ধ কারের বুকের উপর ছড়িয়ে পড়ে তাকে যেন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতে লাগল। নিস্তব্ধতা তখনও অটল মূর্ত্তিতে দাঁড়িয়ে, সুরের স্পর্শ তার বুকের ভিতর কেবল একটু একটু কাঁপন তুলেছে। অন্ধকার ছাপিয়ে, নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে ক্রমেই সুর পর্দ্দায় পর্দ্দায় ওঠা নামা করতে লাগল, সন্ন্যাসিনী গাইছে ‘ভার হর হে ভার হর হে ভার হর, এই পারের এই ভারের ভার আর বইতে নারি যে ভার হর’।

 সন্ন্যাসিনীর গলা চমৎকার। শেখা গলা ছাড়া সুরের এমন খেলা, এমন মূর্চ্ছনা, এমন গতি ভঙ্গী, তাল মান লয়ের এমন সুন্দর সামঞ্জস্য হতেই পারে না। সন্ন্যাসিনী সুগায়িকা। গলার মিষ্টি আওয়াজে সুরের এই আশ্চর্য্য খেলা অন্ধকারের বুকটাকে যেন ভিজিয়ে তুলতে লাগল, অন্ধকার নিজের বুক পেতে তার বুকের ভার নামিয়ে নেবার জন্যে যেন কাছে এসে দাঁড়াল। একটু থেমে, বুক ভাঙ্গা একটা নিশ্বাস ফেলে সন্ন্যাসিনী আবার গাইতে লাগল ‘পাপ তার হে, পাপ তার হে, পাপ তার, এই পারের এই পাপের তাপ আর সইতে নারি যে পাপ তার।’

 গানের এই কলিটি শেষ হতে না হতে পিছন থেকে একজন বলে উঠ্ল‌ “কে তুমি”? সন্ন্যাসিনী মাথা তুলে ফিরে চেয়ে দেখ্ল‌ ঠিক তার পিঠের কাছে তারই মত একজন সন্ন্যাসিনী দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, সে ধীরে ধীরে বলল,

 আমি সন্ন্যাসিনী।

 আগন্তুক। এখানে কেন?

 স। ঠাঁই নাই।

 আ। পৃথিবীতে কোথাও তোমার ঠাঁই নাই?

 স। আছে।

 অ। কোথায়?

 স। “গঙ্গার জলে” এই বলে সে আঙুল দিয়ে গঙ্গার জল দেখিয়ে দিলে।

 আ। ওখানে ঠাঁই পেলে কি হবে?

 স। ঠাণ্ডা হবো।

 আ। কেমন করে?

 স। ডুবে মরে।

 আ। তুমি বুঝি মরতে এসেছ?

 স। হাঁ।

 আ। কেন?

 স। জীবনটা জ্বলে গেছে।

 আ। কিসে?

 স। প্রতারণায়।

 আ। সব গেছে?

 স। সব।

 আ। তবে আবার মরবে কেন? সবই যদি গেল মরবার জন্যে তবে আর থাক্‌ল কি? কিছু কি বাকি আছে?

 স। আছে।

 আ। কি?

 স। জ্বালা, ভীষণ জ্বালা।

 আ। এ জ্বালা জলে ঠাণ্ডা হবে না।

 স। আগুনে পুড়ে ?

 আ। তাতে ও নয়।

 স। তবে কিসে?

 আ। মরণ এর পথ নয়।

 স। পথ তবে কোনদিকে?

 আ। জীবনের দিকে।

 স। সে কি রকম, আমি তো তা জানি না।

 আ। আমি জানি।

 স। জান তো আমাকে দেখিয়ে দাও।

 আ। চল আমার সঙ্গে দেখতে পাবে।

 এই বলে আগন্তুক সন্ন্যাসিনী তার হাত ধরে তুলে দাঁড় করাল। কলের পুতুলের মত পূর্ব্ব সন্ন্যাসিনী পিছু পিছু চলল, আগন্তুক সন্ন্যাসিনী আগে আগে।

 পথে যেতে যেতেই অন্ধকার সরে গিয়ে আলোর আভাস দেখা দিলও। চলতে চলতে আগন্তুক সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞসা করলো, তোমার নাম কি?

 স। মধুমতী।

 আ। বয়স কত?

 স। বাইশ বছর।

 আ। বাড়ী কোথা?

 স। বাংলা দেশে।

 আ। এখানে এসেচ কতদিন?

 স। একমাস।

 আ। কার সঙ্গে?

 স। প্রতারকের সঙ্গে।

 আ। কে সে?

 স। সন্ন্যাসী।

 আ। তার সঙ্গে কতদিনের পরিচয়য়?

 স। ছয় বছরের।

 আ। কোথায় পরিচয় ঘটে?

 স। নিজের দেশে।

 আ। কি সূত্রে?

 স। শিক্ষা সূত্রে, দীক্ষাসূত্রে। তিনি আমার গুরু মন্ত্রগুরু। এখন তিনি আমাকে পথে বসিয়ে পালিয়েছেন। এখানে এনে রেখেই সরে পড়েছেন, আর তার সন্ধান পাচ্ছি নে।

 আ। কোথায় আছ?

 স। ছিলেম এক সন্ন্যাসীর আড্ডায় এখন ঐ গঙ্গাতীর যেখানে দেখেছো।

 আ। কতক্ষণ গঙ্গাতীরে এসেছ?

 স। ঘণ্টা দুই হবে। আড্ডার মধ্যে স্ত্রীলোকের উপর ভীষণ অত্যাচার দেখে যন্ত্রণায় ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছি, নিজের জীবনটা তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে গঙ্গার জলে ডুবে মরতে গেছি, ঠাণ্ডা হবার জন্যে, শুধু কেবল জ্বালা নেবাবার জন্যে। আঃ গঙ্গার জল কি ঠাণ্ডা!

 আ। ভয় নেই ঠাণ্ডা হবে, এ জ্বালা থাকবে না, উপায় আছে।

 স। জানিনা সে কি উপায়।

 আ। জানতে পারবে। দেশ ছেড়েছ কতদিন?

 স। এক বৎসর।

 আ। সন্ন্যাসিনীর বেশ পরেছ কবে থেকে?

 স। যবে থেকে দেশ ছেড়েছি।

 আ। এতদিন ছিলে কোথায়?

 স। কাশী, এলাহাবাদ, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন ঘুরে হরিদ্বারে এসেছি, সন্ন্যাসীদের আড্ডায় আড্ডায় ফিরেছি, মেয়েদের উপর অমানুষিক অত্যাচার দেখেছি; এমন কেউ নাই যে তাদের বাঁচায়, এমন একটা লোকও সেখানে নেই যে তাদের হয়ে দাঁড়ায়। সন্ন্যাস কি পাপ, সন্ন্যাসী কি পাপী, সন্ন্যাসীর বাসস্থান কি ভীষণ পাপের আড্ডা!

 আ। ওকথা বোলো না, সন্ন্যাস পৃথিবীর সব চেয়ে বড় জিনিস। সন্ন্যাসী পৃথিবীর সব চেয়ে বড় মানুষ, তবে আসল হওয়া চাই। জিনিষ যত বেশী ভালো হবে তার নকল তত বেশী খারাপ করবে। ভালোর নামে, সবাই বশ মানে বলেই ভালো কথা দিয়ে, ভালোর নাম নিয়ে ভালোর পোষাক পরে মানুষ মানুষকে ঠকায়। তা না হলে মানুষ ঠকবে না সবাই জানে। মানুষের যা কিছু টান সব ভালোর উপরে। ভালোর নাম শুনলেই মানুষ পাগল হয়ে ছোটে। তুমিই তার সাক্ষী। ভালো জেনেই তো তুমি সন্ন্যাসীর সঙ্গ করেছিলে?”

 স। নিশ্চয়, খুব ভালো জেনে, সাধু মহাত্মা ভেবে।

 আ। “যার নামের পোষাকের এত দর তার আসল জিনিষটার কত দর তাহলে বুঝে দেখ।”

 স। ওঃ সেটা খুব বড় জিনিষই হবে, তার দর ও খুব বেশীই হবে, বোধ-হয় বলা যায় না কত?

 আ। না মোটেই বলা যায় না একেবারেই বলা যায় না সে কেবল অনুভব করে জানতে হয়। তার তো শেষ নেই।”

 স। মানুষ সেটা সহজে পায় না কেন?

 আ। সহজ করে মানুষের কাছে সেটা ধরা হয়নি বলে।

 স। “কেন ধরা হয়নি, ধরলে মানুষ ঠকে ঠকে এতখানি কষ্ট পেত না।

 আ। “অবসর হয়নি, পেতে পেতেই সময় কেটেছে দেবার অবসর হয়নি। আর সাধনাটাও তত পাকা হয়নি। পৃথিবীর মাঝখানে এটাকে অনায়াসে ফেলে দিতে হলে সাধনাটা অনেক খানি পেকে ওঠা চাই।”

 স। “আমি কেমন করে আসল সন্ন্যাসীর দেখা পাব কেমন করে চিনবো।”

 আ। “তোমার নিজের মধ্যেই তো আসল সন্ন্যাসীর রয়েছেন। আর যা ছিল সব তো পুড়ে গেছে, যেটুকু রয়েছে সেটুকু কেবল সন্ন্যাস।”

 স। তাকে কেমন করে ব্যবহার করব বলে দাও?

 আ। “ঐ সব দুষ্টু ভণ্ড সন্ন্যাসীদের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাও। ওদের মেরে দূর করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও।”

 স। কেমন করে তাড়াব তারা যে বলবান।

 আ। আমাদেরও বল আছে যদি সবাই এক সঙ্গে জুটি।

 স। ঠিক বলেছ, তুমি এর জন্যে আমাকে তৈরী করে নাও।

 আ “তাই নেবো।”

 হরিদ্বার জায়গাটির দক্ষিণ পশ্চিম কোণ ঘেঁসে, অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটি আশ্রম। আশ্রমটি বহুকালের পুরণ। পরে পরে কয়েকজন যোগী এইখানে থেকে নাকি যোগ সাধন করে গেছেন এই রকম শোনা যায়। কেউ তাঁদের দেখেনি লোকের মুখে মুখে এই কথা কেবল রটতে শোনা গেছে। একজন সাধু পুরুষকে এইখানে সবাই দেখেছে ও জানে বলে, লোকেরা তাঁকে 'যোগী মহারাজ' বোলে ডাকত। কিছুদিন আগে পর্য্যন্ত তিনি নাকি এ আশ্রমে বাস করেছেন। ইদানিং দু তিন বছর আর তাঁকে দেখা যায় নি, কেউ জানে না তিনি কোথায় গেছেন। 'যোগী মহারাজ' একদিকে যোগের সাধক আর একদিকে অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। বেদ, বেদান্তও, উপনিষদ অ গীতা প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্রগুলিতে তাঁর অসামান্য বুৎপত্তি দেখা যেত। আমাদের আগন্তুক সন্ন্যাসিনী দৈবপ্রভা এঁরই শিষ্য, এঁরই হাতের তৈরী। কেমন করে দৈবপ্রভা এঁর কাছে এসেছিল কেউ জানে না চোদ্দ পনের বছর ‘যোগী মহারাজের’ আশ্রমে সবাই তাকে দেখছে। ‘যোগী মহারাজ’ চলে গেছেন আশ্রমটি এখন দৈবপ্রভারই হাতে। অনেকগুলি সন্ন্যাসিনী নিয়ে দৈবপ্রভা এখানে বাস করে। সন্ন্যাসিনীদের শিক্ষা দীক্ষার সমস্ত ভারই দৈবপ্রভার উপর। সকলকে সে শিখিয়ে তুল্‌ছে।

 দৈবপ্রভার একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে দুরন্ত কাপালিকদের হাত থেকে ভৈরবীদের বাঁচান। কত ভৈরবীকে যে তাদের গ্রাস থেকে সে ছাড়িয়ে এনেছে গুণে শেষ করা যায় না। অনেককে দেশে ফিরে পঠিয়েছে, তারা ঘরের বউ ঝি ঘরে গেছে কেউ জানতে পারেনি এতদিন কোথায় ছিল। অনেককে শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তুলে, তীর্থে তীর্থে আড্ডা তৈরী করে তাদের সেখানে রেখেছে ঐ রকম সব মেয়েদের বাঁচাবার জন্যে। যারা এখনো তৈরী হয়নি তাদেরই কেবল নিজে কাজে রেখে তৈরী করচে।

 এহেন সন্ন্যাসিনী দৈবপ্রভার সঙ্গে আজ গঙ্গাতীরে মধুমতির দেখা হয়েছে।

 দুজনে এসে তারা আশ্রমের মধ্যে ঢুকল। দৈবপ্রভাকে দেখে আশ্রমের সব সন্ন্যাসিনীরা দৌড়ে এসে ঘিরে দাঁড়ালো। নতুন একটি সন্ন্যাসিনীকে দেখে চোখে মুখে তাদের আনন্দ ফুটে উঠল, বুঝল তাদেরই মত একজন।

 কয়েক দিন আশ্রম বাস করেই মধুমতী অনেকটা শান্তি পেয়েছে। তার সে রকম অস্থিরতা সে রকম ছটফটানি আর নেই। শিক্ষা দীক্ষা দৈবপ্রভার কাছে রীতিমতই চল্‌ছে। একদিন দৈবপ্রভা বল্লে "এইবার আমাদের তীর্থে যেতে হবে সময় হয়েছে।" মধুমতী বল্ল "তীর্থে যাবে কেন, দেবতা দেখতে"?

 দৈ। দেবতা তো তীর্থে নেই তাঁকে দেখতে তীর্থে যাব কেন?

 ম। “দেবতা তবে কোথায়?" দৈবপ্রভা নিজের বুকের উপর হাত দিয়ে বল্ল “এই এখানে।”

 ম। “দেবতা কি কেবল বুকেই থাকেন?”

 দৈ। না, বুকে, চোখে, বুদ্ধিতে, মনে, জ্ঞানে, ঘুমের শান্তিতে, জেগে থাকার কাজে, সব জায়গায়ই দেবতা ভরে আছেন।

 ম। মানুষ তবে দেখ্‌তে পায় না কেন?

 দৈ। আগে অনুভব করতে পারলে তবে তো দেখ্‌তে পাবে?

 ম। অনুভব হয় না কেন?

 দৈ। অনুভব শক্তি পরিষ্কার নয় বলে, তাতে ময়লা ধরে আছে বলে।

 ম। কেমন করে তাকে পরিষ্কার করে তোলা যায়?

 দৈ। শরীরকে খাটালে, মনকে কোন নোংরা জিনিষ ছুঁতে না দিলে, জ্ঞান চর্চ্চা করলে, বুদ্ধিকে প্রতি কাজে জাগিয়ে রাখলে, আর পাপ না করে আত্মাকে প্রসন্ন রাখতে পারলে।

 ম। পাপ কি?

 দৈ। আত্মার যাতে কষ্ট তাই পাপ।

 ম। আত্মাকে যদি কেউ বুঝতে না পারে?

 দৈ। পাপকে ও বুঝতে পারবে না।

 ম। তাহলে কি করবে?

 দৈ। পাপ করবে, কষ্ট ও পাবে।

 ম। কে তাদের বাঁচাবে?

 দৈ। যে পারে?

 ম। যদি কেউ না পারে?

 দৈ। বাঁচবে না, মরবে, মরে মাটির সঙ্গে মিশবে, তাদের উপর দিয়ে গাছ-পালা বেরবে, সে সব পৃথিবীর কাজে লাগবে।

 ম। তোমার কথা শুন্‌লে অবাক্‌ হয়ে যেতে হয়।

 দৈ। তোমার ও কথা শুনে পরে মানুষ অবাক্‌ হয়ে যাবে।

 মধুমতী চুপ করে রইল, কথাগুলো, কথার ভাবগুলো মনের মধ্যে যেন থিতিয়ে বসতে চাইছে, একটু নাড়া পেলে যেন গুলিয়ে যাবে।  মধুমতী অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞাসা করল, “তীর্থে কবে যেতে হবে?

 দৈ। কালই।

 দৈবপ্রভার যেমন কথা অমনি কাজ সুরু। তার শরীর মন বুদ্ধির কোনখানে যেন কিছুমাত্র জড়তা নেই। সমস্তটাই নিরলস, আগাগোড়াই যেন ঝরঝর তরতর করছে।

 তখুনি স্থির হয়ে গেল কাল ভোরেই তীর্থের জন্য বেরতে হবে।

 সন্ন্যাসিনীর দল মহা খুসী। নূতন জায়গায় যাবে চারদিক দেখবে, ঘুরে ঘুরে বেড়াবে এতে তাদের বড় আনন্দও। উৎসাহের সঙ্গে তারা আয়োজনের কাজে লেগে গেল। দৈবপ্রভার কথামত একরাশ ছোলা, একরাশ কাঁচা চিঁড়ে, গাওয়া ঘিতে পাক করা, বড় থলের এক থলে সুজির লাড়ু, আশ্রমের গাছের শুকিয়ে রাখা বাদাম থলে ভরে বেঁধে সঙ্গে নিল। এ ছাড়া পথে যেখানে যা যোগাড় হয় বন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে অনেক ফল মূল তুলে নিতে পারবে, নদী আর ঝরণার জল তো আছেই। তারা বাইশ জন, প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে কম্বল আর মোটের উপর গোটা পাঁচ ছয় ঘটি। মোটামুটি এই তাদের পথের সম্বল। লুকন ছোরা দুচার খানা সঙ্গে অবশ্য যাবে।

 আয়োজন সেরে সন্ধ্যা হতেই সন্ন্যাসিনীর দল শুয়ে পড়ল খুব ভোরে উঠতে হবে বলে।

 সবাই ঘুমচ্ছে মধুমতীর চোখে ঘুম নেই। দৈবপ্রভার দিনের কথাগুলো তার বুকের উপর যেন আসন বিছিয়ে বসেছে। তাদিকে সে সরাতে পারছে না। একলাটি উঠে আশ্রমের ভিতরকার প্রকাণ্ড একটা বটগাছের তলায় গিয়ে সে বসলো। পায়ের শব্দে গাছের ঘুমন্ত বাদুড়গুলো একবার ডানা ঝাড়া দিয়ে নড়ে উঠল, তারপর আবার সব চুপ। মধুমতী তখনও অন্যমনস্কও, সে নিজের মনে গাইছে—

আছ যদি কেন আসিছ না কাছে
কেন হয়ে আছ দূর পরবাসী
কেনহে এমনে রয়েছ গোপনে,
প্রাণ মনে কেন উঠিছ না ভাসি

 আজ মধুমতীর মনটা বড় শুন্য সব যেন খালি। একটু থেমে আবার মধুমতী গাইতে লাগল

থাক যদি তবে থাকিওনা দূরে,
মনে এস মম মনোসাধ-পুরে,
শুনি আছ তবু হিয়ায় না ধরে
তোমা লাগি প্রাণ হয়েছে উদাসী।

 মধুমতীর গলার আওয়াজ কি মিষ্টি, গানের সুরে চারদিকটাকে যেন মধুময় করে তুলল, নিজের গানে সে নিজেই বুকের মধ্যে অনেকখানি আরাম পেতে লাগল, আপনার মনে বলে উঠল "আকাশ কি সুন্দর।" পাশ থেকে হঠাৎ দৈবপ্রভা ডাক্‌ল "মধুমতী এখানে"?

 ম। হাঁ।

 দৈ। কি করছ?

 ম। বসে আছি মনটা আজ কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে।

 দৈ। কেন?

 ম। দেবতা নেই।

 দৈ। আছেন বৈকি, না থাকলে তুমি চাইবে কেন?

 ম। চাইছি তো পাচ্ছি কই?

 দৈ। চাও, আরো বেশী করে চাও, দিনরাত চাও, খেতে শুতে, উঠতে বসতে, চল্‌তে ফিরতে, ঘুমিয়ে জেগে যখন মনে পড়ে তখুনি চাও, চাইতে চাইতে পেয়ে যাবে।

 ম। অন্ধকার যেমন করে আমাকে চাওয়ায়, দিন তা পারে না।

 দৈ। অন্ধকারই যে চাওয়া, দিনটা যে পাওয়া। অন্ধকারে একলা বসে চাইতেই দিনের আলোয় পেয়ে যাবে।

 ম। অন্ধকার কি চায়?

 দৈ। পেতে চায়।

 ম। কাকে?

 দৈ। নিজেকে।

 ম। কোথায়?

 দৈ। বাইরে।

 ম। কিসের মধ্যে?

 দৈ। দিনের মধ্যে।

 ম। কেমন করে?

 দৈ। নিজেকে আলোয় ফুটিয়ে তুলে।

 ম। দিনের কি মোটেই চাওয়া নেই?

 দৈ। আছে।

 ম। সে কি চায়?

 দৈ। দিতে।

 ম। কাকে?

 দৈ। নিজেকে।

 ম। কোথায়?

 দৈ। পৃথিবীতে।

 ম। কিসের মধ্যে?

 দৈ। প্রাণের মধ্যে।

 ম। কেমন করে?

 দৈ। পৃথিবীকে প্রাণ দান ক'রে।

 ম। পৃথিবীটা প্রাণ দান পেলে কি হবে?

 দৈ। চারদিকটা জেগে উঠে কাজ চল্‌তে থাকবে। সব কিছুকে পাওয়া যাবে।

 ম। অন্ধকারে কি পাওয়া তবে কিছুই নেই?

 দৈ। আছে বই কি, সবই সেখানে মজুত আছে কেবল অন্ধকারে যেটা খুঁজে পাওয়া যায় না দিনে সেটা স্পষ্ট। অন্ধকারে যেটা থাকে দিনে সেটা কাজ করে তাই মানুষ সেটাকে জলজ্যান্ত দেখতে পায়।

 ম। অন্ধকারের চাওয়াটাকেই বুঝি দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে?

 দৈ। হাঁ অন্ধকারে চেয়ে, আলোর মধ্যে পেয়ে, পৃথিবীকে দিয়েই ছুটি।

 ম। তোমার মধ্যে কি মস্ত বড় প্রাণ রয়েছে, যখনি কাছে এস যেন প্রাণ পাই, বেঁচে উঠি, মনটা জেগে ওঠে, চারদিকটা সচেতন বলে অনুভব হয়, বুদ্ধি যেন জ্বলতে থাকে।

 দৈ। তোমার প্রাণ যে কত স্নিগ্ধ কত গভীর তাকি জান?

 দুজনে উঠে বাড়ীর দিকে চল্‌ল। যেতে যেতে মধুমতী মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়ায়। দৈবপ্রভা বল্‌ল “থাম কেন?”

 ম। আকাশটা মাথার উপর জাগিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে বড় ভালো লাগে।

 দৈ। বেশ, চল বাইরে একটু বেড়িয়ে আসা যাক্‌।

 দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, চলতে চলতে মধুমতী বলল “তোমার কাছে একটা কথা আমার জানবার আছে

 দৈ। কি বল?

 ম। তীর্থ কি?

 দৈ। কবির মনের রূপ যেমন কাব্য, ভক্ত সাধকের আত্মার রূপ তেমনি তীর্থ; কবি রচনা করে মানুষ পড়ে, সাধক মূর্ত্তি গড়ে মানুষ দেখে।

 ম। কাব্য পড়লে কবির মনের রূপগুলো ধরা যায়; তীর্থ দেখলে সাধকের আত্মার রূপগুলো ধরা যায় কি?

 দৈ। চর্চ্চা করলেই জানা যায়। কবি যেমন নিজের অনুভূতি গুলো কাগজের পাতায় কালির অক্ষরে গেঁথে রাখে, সাধক ও তেমনি সাধনায় পাওয়া নিজের আত্মার রূপগুলো কাঠ পাথরে খুদে রেখেছে। খোঁজ করলেই জানা যাবে তাদের আসল অর্থ কি।

 ম। আচ্ছা মূর্ত্তিগুলির আকার ভিন্ন ভিন্ন কেন?

 দৈ। সকল কবির অনুভূতি যেমন এক নয়, সকল সাধকের উপলব্ধি ও তেমনি এক নয়। এক এক কবির অনুভূতি এক এক রকম, এক এক সাধকের উপলব্ধিও এক এক রকমের।

 ম। কবি তো নিজের কাব্যকে ইষ্টদেবতা বলে না সাধকরা মূর্ত্তিকে ইষ্টদেবতা বলে কেন?

 দৈ। যে সত্যিকার কবি নিজের রচনাকে তার ইষ্ট দেবতার মত প্রিয় বলেই বোধ হয়। আত্মা সকলের চেয়ে ভালো, ভক্ত সাধক নিজের আত্মার রূপকে তাই ইষ্টদেবতা অর্থাৎ ‘আমার ভালো’ নাম দিয়েছে।

 ম। আচ্ছা এই মূর্ত্তিগুলি কি চিরকাল থাকবে?

 দৈ। না তা কখনও থাকবে না, কাঠ পাথর কখনই চিরকাল থাকবে না, সময়ে এগুলি লোপ পাবেই, কত কত মূর্ত্তি ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেছে জানই তো, কিন্তু এই মূর্ত্তিগুলির, রূপগুলির ইতিহাস মানুষকে লিখে রাখতে হবে। তা নাহলে মনুষ্য ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

 ম। কেন?

 দৈ। মানুষ তো একই রকম রূপের মধ্যে চিরকাল আত্মাকে উপলব্ধি করে চুপ করে বসে থাকবে না, কালে কালে কত নূতন নূতন রূপের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করতে থাক্‌বে, তার প্রত্যেকটির ইতিহাস অক্ষরে অক্ষরে লিখে রাখতে হবে, তবেই বোঝা যাবে মানুষ সত্যি সত্যি কি জিনিষ?

 ম। মানুষ এককালে সাপ্‌ সাধনা, ব্যাঙ সাধনা, ভূত, প্রেত, পিশাচ সাধনা, রাক্ষস সাধনা কত কি উৎকট বিকট সাধনা করেছে সব কি লিখে রাখতে হবে?

 দৈ। সব, সব,। যেখানে যখন যা কিছু সাধনা যে কোন মানুষ করেছে তার সমস্ত ইতিহাস লেখে রাখতে হবে—যতদূর পাওয়া যায়। মানুষের পূর্ব্বপুরুষ যদি বাঁদর হয় তাও তো মেনে নিয়ে লিখে রাখতে হচ্ছে? কত রকমের প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি মানুষের ছিল ও আছে সব গুলোকে চেয়ে দেখতে হবে, কোনটার সম্বন্ধে চোখ বুজলে চলবে না?

 ম। ক্রমে ক্রমে সাধনার রাজ্য অনেক বদলে যেতে থাকবে?

 দৈ। নিশ্চয়; পৃথিবীর সব জিনিষ যে রকম বেড়ে গিয়ে বড় হয়ে ফুটে উঠেছে, মানুষের আত্মা ও তেমনি বেড়ে গিয়ে বড় হয়ে ফুটে উঠবে। সাধনার রূপ অনেক বদলে যাবে, অনুভূতি উপলব্ধি ধারণা ঢের বেড়ে যাবে,— অনেক বেড়ে যাবে। মানুষের মধ্যে আত্মা কত বড় হয়ে ফুটে উঠবে বলাই যায় না। তখন পৃথিবী মানুষের কাছে আবার নূতন হয়ে দেখা দেবে। এই পৃথিবীই তখন মানুষ থেখবে সম্পূর্ণ আর এক রকম।

 কথা শুনে মধুমতী অবাক্‌ হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল, পরে আস্তে আস্তে বল্‌ল "তুমি তো ঘরে বসেই সব পাচ্ছ দেখ্‌ছি তোমার আবার তীর্থে যাওয়া কেন"?

 দৈ। দুরন্ত কাপালিক ও দুষ্ট সন্ন্যাসীদের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাবার জন্যে। তীর্থে তীর্থে তাদের আড্ডা, তাই তীর্থে তীর্থে ঘুরে আমি তাদের আড্ডা ভাঙ্গতে চেষ্টা করি। এটা আমার ধর্ম্ম। মেয়েদের বাঁচাতে হবে তা যেমন করেই হোক্‌। স্থির হয়ে মধুমতী শুনলো, মনের মধ্যে কত কি আন্দোলন

হতে লাগলো, কোন কথা আর জিজ্ঞাসা করল না।

 কথায় কথায় রাত এদিকে শেষ হয়ে এসেছে তাড়াতাড়ি দুজনে বাড়ীর দিকে ফিরল সে রাত্রে তাদের আর ঘুম হল না। ভোর হতেই দৈবপ্রভা দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়্‌ল। আশ্রমের দুয়ার রইল খোলা যে ইচ্ছা আসুক যার ইচ্ছা থাকুক।

 গয়া জেলার রাজগীর জায়গাটির স্থানে স্থানে ছোট বড় অনেক পাহাড় দেখা যায়। তারই একটা বড় গোছ পাহাড়ের পাশ দিয়ে একদিন সন্ধ্যার সময় একদল সন্ন্যাসিনী চলেছে। নিজেদের মধ্যে তারা খুব গল্প করতে করতে যাচ্ছে; মুখে বা কথাবার্ত্তার ভাব ভঙ্গীতে ভয় ভাবনার চিহ্ন মাত্র দেখা যাচ্ছে না। রাত্রি এসে পড়েছে, বাঘ, ভালুকের ভয়, দুষ্টু মানুষের ভয়, নির্দ্দিষ্ট বাসস্থান না থাকার ভাবনা, খাবার ভাবনা কোন ভাবনাই তাদের নেই। সব কিছুকে মাড়িয়ে, সব কিছুকে ছাড়িয়ে চলবার জন্যেই যেন তারা তৈরী।

 এরাই যে আমাদের পূর্ব্বপরিচিত দৈবপ্রভার দল তা বোধ হয় বলে বোঝাতে হবে না।

 ক্রমে চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। আর পথ চলা যায় না। পাহাড়ের কাছে জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙ্গা পোড়ো বাড়ী দেখে রাতের মত সন্ন্যাসিনীরা সেখানে আশ্রয় নিল। সূর্য্যাস্তের আগেই তাদের খাওয়া দাওয়া চুকে যায় তাই রাতে যে সবের আর কোন হাঙ্গাম নেই।

 খানিকক্ষণ গল্প করে একে একে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ল। মধুমতী ও দৈবপ্রভা জেগে! মধুমতী জিজ্ঞাসা করল “তুমি ঘুমোবে না?”

 দৈ। এখন না।

 ম। তবে কখন?

 দৈ। যখন সময় হবে।

 ম। এখনো সময় হয়নি? রাত যে প্রায় দুপুর পেরিয়ে গেছে।

 দৈ। যতক্ষণ কাজ থাকে ততক্ষণ আমার ঘুম আসে না।

 ম। এখানে আবার কি কাজ, এই জঙ্গলের মধ্যে?

 দৈ। কাজ আছে, যত দুষ্ট দুরদান্ত কাপালিক ভণ্ড-সন্ন্যাসীদের সাধন ভজন পাপাচরণের এই তো সময়। দেখ্‌ছ না সামনেই শ্মশান।

 মধুমতীর চেয়ে দেখ্‌ল খানিকটা দূরে, এক খণ্ড জমির উপরে, এদিক ওদিক দু চারটে শেয়াল কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরই মুখের, দু এক টুক্‌রো কুড়িয়ে পাওয়া হাড় চিবানোর শব্দ থেকে থেকে এক একবার শোনা যাচ্ছে। নিভানো চিতার শেষ আগুনের অস্পষ্ট রাঙা চিহ্ন ছাইয়ের গাদার ভিতর থেকে তখনও উঁকি দিচ্ছে।

 কিছুক্ষণ চেয়ে থাক্‌তে থাক্‌তে দেখা গেল চিতার ছাইগুলো কি সে যেন নাড়ছে উপর থেকে ছাইগুলো সরে যাওয়াতে তলার আগুন স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে পড়ল তখন দেখা গেল একজন মানুষ আগুনের উপর কতকগুলো কাঠ চাপাচ্ছে। খানিকক্ষণ ধুঁইয়ে কাঠ গুলো দপ্‌ করে জ্বলে উঠল। জ্বলন্ত আগুনের সামনে একজন কাপালিক দাঁড়িয়ে, গলায় জবা ফুলের মালা, কপালে মস্ত বড় রক্ত চন্দনের ফোঁটা, তার নীচে তিন সার রক্ত চন্দনের দাঁড়ি টানা; বুকের ঠিক্‌ মাঝখানটিতে সিঁদুর দিয়ে ত্রিকোণ চিহ্ন আঁকা; পরণে হলুদে ছোপান একখানা মোটা ধুতি তার উপর কোমরে লাল রঙের এক গামছা বাঁধা। সাধন ভজনের সরঞ্জামগুলি মাটিতে নামিয়ে রেখে আগুনে কাঠ দিয়ে কাপালিক আগুণটা আগে জ্বালিয়ে তুলছে।

 কাপালিকের বয়স খুব বেশী নয় আন্দাজ ছত্রিশ সায়ত্রিশ হবে। চেহারা দিব্য সুশ্রী, উজ্জ্বল গৌর রঙ, শরীরের গড়ন বলিষ্ঠ ও সুন্দর। কিন্তু উৎকট সাধনায় সমস্ত চেহারায় এখন যে একটি বিকট ভাব দেখা দিয়াছে সেটা ভেদ করে সুন্দর বলে কোন কিছু আর ধরাই যায় না। দেখলেই মনে হয় বিশ্রী ও ভয়ঙ্কর।

 মধুমতী কখনো কাপালিক দেখেনি, বিস্মিত হয়ে সে দৈবপ্রভাকে জিজ্ঞাসা করল, “এ কে?"

 দৈ। “চুপ।"

 মড়ার আসন, মড়ার মাথার খুলিতে মদ মাংস প্রভৃতি শব সাধনার আর সব উপকরণ ছাড়া একটি দশ বার বছরের ছেলে হাত পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে দেখা গেল।

 আলতায় ছোপান লাল রঙের এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখখানি তার ঢাকা। ছেলেটি মরা কি জ্যান্ত বোঝা যায় না। যদি ও বেঁচে থাকে তবে অজ্ঞান হয়ে আছে বল্‌তেই হবে কেন না একেবারেই স্থির, একটুও নড়ছে না।

 মধুমতী ভাবল ছেলেটি মৃত, একেই দাহ করতে লোকটি এনে থাকবে, আগে চিতা জ্বলছে।

 দৈবপ্রভা জানে আসল ব্যাপারটা কি। কাপালিক সম্বন্ধে অনেক খবরই দৈবপ্রভা রাখে দেখা গেছে, কেন তা জানা যায় নি।

 চিতার আগুণ দপ্‌ দপ্‌ করে জ্বলছে। কাপালিক তার উপর মাটির হাঁড়িতে কি একটা সিদ্ধ করতে চাপিয়ে দিল। তার পর এটা ওটা যোগাড় করে মড়ার আসনে জপে বসল। জপের আরম্ভে মড়ার মাথার খুলিতে রাখা খানিকটা মদ ও এক টুকরো মাংস খেয়ে নিল। মাংসটা কিসের জানা গেল না। লোকে সন্দেহ করে কাপালিকরা মানুষের মাংস খায়।

 দশ মিনিট হয়ে গেল কাপালিক জপই করছে, আরো খানিকটা সময় কাটল জপের শেষ নেই। ক্রমেই সে জপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে বোধ হল, বাহ্যজ্ঞান প্রায় নেই বল্লেই হয়।

 ঠিক সেই সময় দৈবপ্রভা উঠে দাঁড়ালো। মধুমতীকে উঠতে ঈসারা করে, সন্ন্যাসিনীদের কানের কাছে ফিস্‌ ফিস্‌ করে, কি বলে, তাদের জাগিয়ে সকলে মিলে সার বেঁধে জঙ্গলের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে গিয়ে একেবারে কাপালিকের পিছনে উপস্থিত হল।

 মিনিট খানেক অপেক্ষা করে, সবাই একসঙ্গে পড়ে, পিছমোড়া করে কাপালিকের হাত দুটো মোটা পুরু একখানা বড় গামছা দিয়ে তার চোখ দুটো চকিতের মধ্যে বেঁধে ফেল্‌ল।

 নেশার ঝোঁকেও জপের তন্ময়তায় ব্যাপারটা ভালো রকম বুঝতে না পেরে কাপালিক গর্জ্জন করে বলে উঠল, কে তুমি?

 দৈ। আমি শক্তি।

 কাপালিক রাগে গর্জ্জন করতে করতে আবার বলে উঠল, কিসের শক্তি?

 দৈ। সাধন শক্তি।

 কা। কার সাধন শক্তি?

 দৈ। তোমার।

 কাপালিক জড়িত গলায় আমতা আমতা করে বল‍্ল। আমার সাধন শক্তি! কবে জাগ্রত হল?

 দৈ। এইবার হয়েছে।

 কা। কি তার রূপ?

 দৈ। উৎকট বিকট ভয়ঙ্কর; দেখতে পাচ্ছে না?

 দৈ। "তবে কিছুদিন অন্ধকারেই থাক। অন্ধকারের মধ্যে নিজের শক্তির রূপটা আগে ভালো করে দেখে নাও তবে চোখ খুলে দেওয়া হবে।" ইতিমধ্যে সন্ন্যাসিনীরা কাপালিকের পা দুটি ও বেঁধে ফেলেছে। দৈবপ্রভার কথা শুনে চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকতে হবে জেনে হাত পা ছোঁড়ার চেষ্টা করে, কাপালিক ভীষণ চীৎকার আরম্ভ করল। বৃথা চেষ্টা, বাঁধন একটুখানিও আলগা করতে পারল না। শেষে নিরুপায় হয়ে চুপ করে পড়ে থাকতে বাধ্য হল।

 সন্ন্যাসিনীরা ধরাধরি করে তাকে ভাঙ্গা বাড়ীটার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রাত পুইয়ে গেল। ছেলেটি সন্ন্যাসিনীদের যত্নে ইতিপূর্ব্বেই বেঁচে গিয়েছিল। সকাল হতেই দৈবপ্রভার কথা মত দুতিনজন সন্ন্যাসিনী গিয়ে তাকে গ্রামের ভিতর ছেড়ে দিয়ে এল। যাদের ছেলে তাদের কাছে ফিরে গেল কোথায় গিয়েছিল কেন গিয়েছিল কেউ জানল না।

 সাতদিন হয়ে গেল ভাঙ্গা বাড়ীর একটা ঘরে চোখ হাত পা বাঁধা অবস্থায় কাপালিক পড়ে আছে। সন্ন্যাসিনীদের ভিতর কেউ একজন দিনের মধ্যে একবার এসে ঘরটা পরিস্কার করে তাকে কিছু খাইয়ে যায় এই পর্য্যন্ত। আজ দৈবপ্রভা কাপালিকের কাছে যাবে বলেছে। মধুমতী বল্ল সেও সঙ্গে যাবে। দুজনে যাচ্ছে মধুমতী জিজ্ঞাসা করল, "একে তুমি অমন করে বেঁধে ফেলে রেখেছ কেন?"

 দৈ। দরকার আছে।

 ম। কি দরকার?

 দৈ। ওর শক্তিকে বদলে দিতে হবে। পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু উৎকট যা কিছু বিকট, যা কিছু ভয়ঙ্কর তার উপর জয় লাভ করাই কাপালিকদের সাহনার লক্ষ্য। এর জন্যই তারা আত্মশক্তি বা আত্ম চৈতন্যকে উৎকটতর, বিকটতর অধিকতর ভয়ঙ্কর করে তুলে এদের উপর জয় লাভ করতে চেষ্টা করে। এতে করে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তাদের আত্মার সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে যায়, আত্মা নিজের স্বাভাবিক অবস্থা হারায়। কিন্তু এর দ্বারা নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ওরা খুব সচেতন হয়ে উঠে নিজের অস্তিত্বকে এক মুহূর্ত্ত ভুলে থাকতে পারে না। এখুনি তার প্রমাণ দেখতে পাবে।”

 বল্‌তে বল্‌তে দৈবপ্রভা ও মধুমতী কাপালিকের ঘরের মধ্যে ঢুক্‌ল।

 দৈবপ্রভা জিজ্ঞাসা করল “কেমন আছ?”

 কা। ভয়ানক কষ্ট।

 দৈ। কিসের কষ্ট?

 কা। চোখ হাত পা বেঁধে পড়ে থাকার একটা ভয়ানক কষ্ট, তাছাড়া বাইরের কিছু দেখতে শুনতে না পাওয়ায় নিজের অস্তিত্বকে খুব বেশী করে অনুভব হয় তার এক ভীষণ যন্ত্রণা।

 দৈ। সাধনার দ্বারা নিজের অস্তিত্বকে যে উৎকট শক্তির মধ্যে এতদিন ধরে জাগিয়ে তুলেছে তার ভীষণতা, উগ্রতা একবার অনুভব কর।

 কা। ভয়ানক, ভয়ানক, অত্যন্ত ভয়ানক কি ভীষণ শক্তি। মৃত্যু হোক আমার মৃত্যু হোক, অস্তিত্বের উগ্রতায় উৎকটতায় আমার আত্মা যেন ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

 দৈ। শান্ত হও, কাপালিক শান্ত হও, নিজের অস্তিত্বকে শান্ত রূপে ভজনা করতে চেষ্টা কর সহজে শান্তি পাবে।" কাপালিক মূর্চ্ছিতের মত মাটিতে পড়ে রইল, দৈবপ্রভা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

এবার একমাস পড়ে দৈবপ্রভা এল, সঙ্গে মধুমতী। ঘরের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে দৈবপ্রভা জিজ্ঞাসা করল, “এখন কেমন আছ?”

 কা। অবশ, মৃত্যুর মত অবশ, অন্ধকারের মত জ্যোতিহীন, মাটির নীচে চাপা পড়া প্রাণীর মত রুদ্ধশ্বাস, ইন্দ্রিয় বোধ শূন্য জড়পিণ্ড, এ ছাড়া আর কিছু নই।”

 দৈ। শীঘ্র বেঁচে উঠবে কাপালিক! শীঘ্র বেঁচে উঠবে, তোমার সাধনার একটি ফল এখন অনেকখানি কাজ দেবে। নিজের অস্তিত্বকে সে কখনো ভুলতে দেবে না। দিনরাত তুমি নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করবে, আর অন্ধকার ক্রমাগত তাকে শান্ত করতে থাকবে। অন্ধকারের নামই শান্তি; সেতো এক মুহূর্ত্ত তোমাকে ছেড়ে নেই।

 কা। আমি তো দেখছি অন্ধকার প্রতিদিন আমাকে একটু একটু করে মেরে ফেলছে; আমার কাছে সে মৃত্যুর মত ঠাণ্ডা, গতিশূন্য জড়।

 দৈ। অল্পদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে সে গতিশূন্য জড় নয় সে শান্তিময় চেতন; কিছু দিন পর তুমি নিজেই বল্‌বে অন্ধকারের মধ্যে আমি শান্তি পেয়েছি।

 কা। এখন কিন্তু সে আমাকে কেবলই মারছে, মৃত্যুর গহ্বরের মধ্যে টেনে নিয়ে ফেল্‌ছে। এ মৃত্যু, এ কখনো জীবন হতে পারে না।

 দৈ। সে তোমার অস্তিত্বের উগ্রশক্তিকে মেরে ফেলছে অস্তিত্বকে নয়; তুমি কি বল্‌তে চাও তোমার অস্তিত্ব মরবে?

 কা। না অস্তিত্ব মরবে না, কিন্তু সে যে এর পর কি ভাবে থাকবে তা আমি বুঝতে পারছি না।

 দৈ। শান্ত ভাবে, অন্ধকারের মত স্থির শান্ত ভাবে। কাপালিক চুপ করে রইল, মনে হল কথাগুলো যেন খুব ভালো করে বুঝতে পারল না।

 ছয় মাস কেটে গেছে! এর মধ্যে একদিনও দৈবপ্রভা কাপালিকের কাছে যায়নি। মধুমতী দৈবপ্রভাকে বল্ল "আর কতদিন তাকে এইভাবে ফেলে রাখবে? এইবার বাইরে নিয়ে এস।"

 দৈ। "এখনো সময় হয়নি।" শান্ত হতে দাও, ভালো করে শান্ত হতে দাও; যখন সহজে সব শান্ত হয়ে আসবে তক্ষণই বেরবার সময় হবে।"

 ম। "তার যে বড় কষ্ট হচ্ছে, এমন করে কি বেশী দিন থাকা যায়? এত কষ্ট দিতে হচ্ছে কেন?"

 দৈ। "উপায় নেই, দিতেই হবে; তাকে কষ্ট দিতে গিয়ে আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি, সহ্য করতে হচ্ছে।"

 ম। তুমি কি ওকে আগে থেকে জানতে?

 দৈ। হাঁ।

 ম। কত আগে?

 দৈ। বিশ বছর আগে।

 ম। কোথায় দেখেছিলে?

 দৈ। নিজের দেশে।

 ম। দেশ তোমার কোথায়?

 দৈ। গোপালপুর।

 ম। কোন জেলা?

 দৈ। বর্দ্ধমান জেলা।

 ম। দেশে কে আছে?

 দৈ। এখন কেউ নেই।

 ম। কে ছিল?

 দৈ। "বাপকে আমার মনে নেই আমি ছোট থাকতেই তিনি মারা যান, মা ছিলেন, স্বামী ছিলেন।"

 ম। তাঁরা এখন কোথায়?

 দৈ। "ষোল বছর হল হরিদ্বারে কলেরা রোগে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।"

 ম। স্বামী?

 দৈ। এই ভাঙ্গা বাড়ীর অন্ধকার ঘরে চোখ হাত পা বাঁধা পড়ে আছেন। কথা শুনে বিস্ময়ে মধুমতী যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল; চোখ দুটো বড় বড় করে মেলে অবাক দৃষ্টিতে দৈবপ্রভার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠল,

 কাপালিক তোমার স্বামী?

 দৈ। হাঁ।

 ম। তবে কেন তাকে এত কষ্ট দিচ্ছ?

 দৈ। সেই জন্যই তো কষ্ট দিচ্ছি, এ না হলে আমি তাঁর সঙ্গে মিলতে পারিনে।

 ম। অদ্ভুত কাণ্ড।

 দৈ। তা ঠিক।

 ম। স্বামীর সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল কেন?

 দৈ। তিনি কাপালিকদের সাথে মিশে শবসাধনা করতেন, মা বা আমি কেউ টের পাইনি; হঠাৎ একদিন জানা গেল নরবলি দেওয়ায় পুলিসের হাতে ধরা পড়ে ফেরার হয়েছেন।

 ম। হরিদ্বারে গিয়াছিলেন কেন?

 দৈ। মনের দুঃখে মা আমাকে নিয়ে তীর্থ করতে বেরলেন, হরিদ্বার পৌঁছে কলেরায় তাঁর মৃত্যু হল, আমি পিতাজীর হাতে পড়ে বেঁচে গেলুম।

 ম। যোগী মহারাজকে তুমি পিতাজী বলতে?

 দৈ। হাঁ, তিনি আমার শিক্ষাদাতা, জ্ঞানদাতা, পিতা, গুরু; আবার আর একদিকে সন্তান তুল্য। তাঁর আশ্চর্য্য স্নেহ ছিল মানুষের উপরে।

 ম। স্নেহের এমন আশ্চর্য্য শক্তি তুমি ও তাই লাভ করেচ, স্বামীকে এখন বাঁচিয়ে তোলো।

 দৈ। চেষ্টা তো করছি।

 ম। তোমাদের আসল নাম কি?

 দৈ। আমার নাম সুব্রতা তাঁর নাম দেবনন্দন। এই বলে দুজনে উঠে কাপালিকের ঘরে দিকে চল্‌ল।

 যেতে যেতে মধুমতী গাইছে—

অন্ধকারে হৃদয়খানা
ভরলে আমার কালো রূপে,
লুকিয়ে এসে দিনের দাহ
জুড়িয়ে দিলে চুপে চুপে।
পেয়ে তোমার অমৃত দান
হারায় না সুর ফুরায় না গান
এমনি করে জ্বালিয়ে তোলো
দিনের আলোয় গন্ধে ধূপে।

 ঘরে ঢুকেই দৈবপ্রভা জিজ্ঞাসা করল "এখন কেমন আছ?"

 কা। শান্তি পেয়েছি। এখানেই থাকি আর যেখানেই যাই কিছু আসে যায় না। এখানে ও বেশ পড়ে আছি। ভগবানের দয়া আমার উপর এসেছে; তুমি কে আমাকে বাঁচিয়েছ বল?

 দৈ। আমি সন্ন্যাসিনী।

 কা। কোথায় থাক?

 দৈ। হরিদ্বারে তা ছাড়া যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াই।

 কা। আমাকে যখন বাঁচিয়েছ তখন আর একটা কথা আমি জানতে চাই। শশ্মানে পাপাচরণ করে, শবসাধনায় মানুষ বলি দিয়ে, শশ্মানের কাছে ও মানুষের কাছে আমার গুরুতর অপরাধ হয়েছে। আমাকে বলে দাও তার বদলে শশ্মানের জন্যে ও মানুষের জন্যে আমি কি করতে পারি?

 দৈ। শ্মশানে পাপাচরণ করে চিরদিন যে শ্মশানকে অপরিস্কার করে এসেছো তার বদলে এখন শ্মশান পরিষ্কার করার ভার নাও। শশ্মানে যারা কাজ করে তারা মুর্দ্দাফরাস, তাদের জ্ঞান নেই, শশ্মান ভাল রকম পরিষ্কার রাখতে তারা জানেনা। তুমি কাজ করলে শ্মশান খুব পরিষ্কার থাকবে, দুর্গন্ধের বদলে শ্মশানের আকাশ সুগন্ধে ভরে উঠবে; আর নরবলি দিয়ে জ্যান্ত মানুষকে মৃতদেহে পরিণত করে যে অপরাধ করেছ তার বদলে এখন অনাথদের মৃতদেহ সৎকারের ভার নাও। যাদের সৎকারের লোক নেই তুমি তাদের সক কর।

 কাপালিক উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, “চমৎকার ব্যবস্থা, কাল থেকেই আমি এ কাজে প্রবৃত্ত হবো এতে আমার বিশেষ আনন্দ আছে।” দৈবপ্রভা বল্‌ল; বেশ ভালো, আমিও একাজে যোগ দেব, তোমার সঙ্গে প্রতি দিন শ্মশান পরিস্কার করব, অনাথ মৃতদের দেহ শ্মশানে বহে নিয়ে আসব।

 কা। কেন, তুমি কেন করবে; তুমি তো কোন পাপ করনি তবে তুমি কেন দণ্ড স্বীকার করবে?

 দৈ। এখুনি তো তুমি বলেছ এতে তোমার বিশেষ আনন্দ আছে, আমি সেই আনন্দের ভাগ নেব।

 কা। অনন্দ কি ভাগ করা যায়?

 দৈ। যায়।

 কা। কি করে?

 দৈ। একসঙ্গে কাজ করে।

 কা। কাজ ছাড়া আর কিছুতে আনন্দ নেই?

 দৈ। আছে, তাতে ছুটি নেই।

 কা। কাজের মধ্যেই কেবল ছুটি?

 দৈ। হাঁ, সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি।

 কা। ছুটির কাজ কেমনতর?

 দৈ। ভার বওয়া, শুধু কেবল ভার বওয়া, পৃথিবীর ভার বুকে তুলে নিয়ে পৃথিবীকে হাল্কা করা, পৃথিবীকে হাল্কা করলেই পৃথিবী তোমাকে হাল্কা করবে।

 কা। পৃথিবী হাল্কা হলে কি হবে?

 দৈ। পৃথিবীর বুকে আনন্দ খেলতে থাকবে।

 কা। ছুটি তাহলে আনন্দেরই, আমার নয়?

 দৈ। আনন্দে তোমাতে তফাৎ কি!

 কাপালিকের বুকের ভিতরটা হঠাৎ জোরে নাড়া দিয়ে উঠল, সে উঁচু গলায় বলে উঠল, “আনন্দ আমি এক?”

 দৈ। হাঁ।

 কা। তাকে পাওয়া যাবে এই পৃথিবীর কাজে?

 দৈ। হাঁ, তুমিই তো এখুনি বলেছ মুর্দ্দাফরাসের কাজে তোমার বিশেষ আনন্দ আছে।

 কাপালিক অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “আনন্দের রূপ কি সন্ন্যাসিনী?”

 স। “আলোক, শান্তির রূপ যেমন অন্ধকার আনন্দের রূপ তেমনি আলোক! পুলকিত হয়ে কাপালিক বলে উঠল “দাও তুমি যোগ দাও আমার কাজে, আমার আনন্দের ভাগ নাও। আমার আনন্দ তোমার হোক, তোমার আনন্দ আমার হোক, আমার সত্তা তোমার সত্তা মিলে এক হয়ে যাক্।

 দৈ। এইটুকুই আমার বাকী ছিল, এর জন্যেই অপেক্ষা।

 কাপালিকের হাত পা চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে দৈবপ্রভা তার হাত ধরে তাকে বাইরে এনে দাঁড় করাল, তার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল “আমাকে কেমন দেখছ?”

 কা। সুন্দর, অতি সুন্দর, আশ্চর্য্য সুন্দর।  দৈ। নিজের অস্তিত্বকে কিরূপে অনুভব করছ?

 কা। শান্ত চিরদিনের মত শান্ত।

 দৈ। পৃথিবীর রূপ কেমন দেখছ কাপালিক?

 কা। আনন্দ কেবলই আনন্দ।

 দৈবপ্রভা কাপালিকের পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করে বলল “আমি সুব্রতা।”

 কাপালিক একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল—

 সৌন্দর্য্যে আকাশ পৃথিবী প্লাবিত হয়ে গেছে।