দুনিয়ার দেনা/সাঁঝের পাড়ি
সাঁঝের পাড়ি
১
তুফান জাগান নদী, তার বুকের উপর দিয়ে প্রতিদিন একখানা খেয়া নৌকা আসা যাওয়া করে। ঝড় বাদল মানে না, ঝাঁ ঝাঁ রোদে ডরায় না, ঘূর্ণায় পড়ে কখনো পাক খায় না; অনায়াসে নৌকাখানা যায় আর আসে।; ভোর, দুপুর, সাঁঝে, দিনে তিনবার তাকে আসতে যেতে দেখা যায়। কালা। বুড়ো মাঝিটি তার হাল ধরে বসেই আছে। দুই পারের মানুষরা চেয়ে চেয়ে দেখে খেয়া বোঝাই লোক নিয়ে সকাল দুপুর সাঁঝে মাঝি পাড়ি দিচ্ছে।
সবাই তাকে কালা-মাঝির খেয়া বলে। নামটি মাঝির কালাচাঁদ কি কানে সে কালা বলে খেয়ার এই নামকরণ বোঝা যায় না। শুধু কালামাঝি আর কালামাঝির খেয়া লোকে এই জানে।
কালামাঝির বাড়ী কোথা কেউ দেখেনি, কে আছে কেউ শোনেনি। পারাপারের লোকেরা আজন্ম যেন তাকে খেয়ার উপরেই দেখেছে। বয়স তার আশী বছর হবে। বেঁটে খাটো কালো চেহারার মানুষটির শরীর এখনো মজবুত কত। এত বয়স কোমর একটু ভাঙ্গেনি, পিঠ একটু বাঁকেনি। কানটা কেমন করে গেছে কে জানে, চোখের দৃষ্টির তেজ এখনো খুব, দূরের জিনিষ মাঝি খুব দেখতে পায়। কানের কাছে চেঁচিয়ে বল্লে শুনতেও কিছু কিছু পায় দেখা গেছে।
খেয়ার পারাণী তার একটি করে পয়সা। ষাট বছর মানুষ পিছু একটি পয়সা নিয়ে মাঝি খেয়া বাইছে।
এই নদীর বুকে কত নূতন নূতন খেয়া দেখা দিল, লোপ পেল, ভাঙ্গলো, গড়ল, কালামাঝির খেয়া অটুট। চিরকাল সে এই খেয়াই বাইছে। বছর অন্তর একবার কেবল ফাটা ফুটো সেরে নেয়, তিন বছরে একবার রঙ দিয়ে এটাকে নূতন করে তোলে।
খেয়াখানা আগে কি কালামাঝি আগে, লোকে ভেবে পায় না। এদের ছাড়াছাড়ি কেউ কখনো দেখেনি! কালামাঝিকে বুকে করে নদীর তলা থেকে হঠাৎ একদিন খেয়াখানা যেন নদীর বুকে ভেসে উঠেছে এমনি মনে হয়।
কতকাল ধরে কত মানুষ যে এই খেয়ায় পারাপার হয়েছে কে তা গুণতে পারে? কালামাঝির মুখ খানা দেশশুদ্ধ লোকের চেনা। তার মুখ ভরা হাসি বুকভরা খুসী না দেখেছে কে, খুসী না কারছে কাকে?
বছরখানেক ধরে একরাশ ফুল বোঝাই একটা ডালা মাথায় নিয়ে কালামাঝির খেয়ায় ছোট্ট একটি মেয়েকে নিত্যি পারাপার হতে দেখা যায়। মেয়েটি দিব্যি ফুটফুটে সুন্দর, বয়স বছর নয়, নাম সুরভি, সবাই তাকে সুরী বলে ডাকে। সে এ পারের চিন্তে মালির মেয়ে।
বাপের বাগানের ফুল ডালি ভরে নিয়ে রোজ সে ওপারে বেচতে যায়; দুপুরের খেয়ায় গিয়ে সাঁঝের খেয়ায় এক টাকা পাঁচসিকে নিয়ে ফেরে।
প্রতিদিন আসতে যেতে সুরীর সঙ্গে কালামাঝি খুব ভাব হয়েছে। মাঝি সুরীকে খুব ভাল বাসে; সুরীও তাকে কম ভালবাসে না। মাঝি কানে শোনে না সুরী তবু চেঁচিয়ে চেঁচিয় তার সঙ্গে কত কথাই কয়! পাড়ার মেয়েদের কত গল্প, পুতুল খেলার, ঘাটে নাইতে যাওয়ার গল্প, বাপের বাগানে কত রকমের ফুল গাছ আছে কত করে সে গাছের যত্ন নিতে হয়, তার বাপ কত নূতন রকমের মালা গাঁথতে জানে, মা কেমন সুন্দর ফুলের পাখা তৈরী করে, ঘরের চালে কটা চড়াইয়ের বাসা আছে এই রকম কত গল্পই সে করে।
কালামাঝি কতক শুন্তে পায় কতক পায় না। নিজের সব মনটা জাগিয়ে সে সুরীর কথা শোনে, বুদ্ধির সবটা দিয়ে তার কথা বুঝতে চেষ্টা করে তাই কথাগুলো পুরোপুরি কানে গিয়ে না পৌঁছলেও প্রাণে গিয়ে যেন পৌঁছয় বলে বোধ হয়।
কিছুদিন থেকে কালামাঝি পারাণীর পয়সটি সুরীর কাছে নেয় না। সুরী বলে কেন মাঝি পয়সা নেবে না, পয়সা না হলে তোমার চলবে কিসে? মাঝি বলে “রোজ আমি কত পয়সা পাই একটা পয়সাতে আমার কি আসে যায়? তোমার কাছে পয়সা নিতে আমার একটুও ভাল লাগে না। পয়সাটি নিয়ে তুমি যা খুসী কোরো, যাকে খুসী দিও, বাবাকে ফিরিয়ে দিতে হবে না।
সুরী বলে কি মজা, একটা করে পয়সা আমার নিজের, এটা নিয়ে আমি যা খুসী করবো।
সাতদিনের পয়সা জড় হলে কোনোবার সে পুতুলের বিয়েতে খরচ করে, কোনোবার চারটে পয়সা জমলেই সঙ্গিনীদের মুড়ি বেগুণী কিনে খাওয়ায়, কোনোবার ছোট ভাইটির জন্যে ওপার থেকে কাগজের ফানুষ, রঙ করা টিনের বাঁশি কিনে আনে, কখনো বা দু একটা পয়সা কানা খোঁড়াকে দেয়।
কালামাঝির দেওয়া পয়সাটির উপর সুরীর বড় দরদ। রোজ রাতে ঘুমবার আগে সুরী ভেবে রাখে পরদিনের পয়সাটি সে কিসে খরচ করবে। সুরীর পয়সা পাওয়ার খবর শুনে চিন্তে মালি বল্ল, “সুরী, তুই মাঝিকে রোজ একটা করে ফুল দিস, শুধুই পয়সা নিবি তার বদলে মাঝিকে তুই কিছু দিবিনে, খুসীতে সুরীর মুখখানা যেন ঝলমলিয়ে উঠল, সে তাড়াতাড়ি বল্ল ঠিক বলেছ বাবা কাল থেকে খুব বড় একটা করে ফুল নিয়ে রোজ আমি মাঝির কানে গুঁজে দেব মাঝিকে বেশ দেখাবে।
পরদিন থেকে দেখা গেল, কালা মাঝি খেয়া বাইছে, তার কানে একটা ফুল গোঁজা।
সুরী একদিন মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল “মাঝি, তোমার কে আছে?”
মা। কেউ নেই।
সু। তোমার ঘর কোথা মাঝি?
মা। এই খেয়াখানার বুকে।
সু। দিন রাত নদীর কোলে এই খেয়ার বুকে তুমি পড়ে থাক মাঝি?
মা। হাঁ।
সু। মাঝি তোমার রাঁধে কে?
মা। কেউ না।
সু। খাও কি?
মা। বাজারে কিনে।
সু। একদিন ও রাঁধা ভাত পাও না?
মা। তিরিশ বছর পাইনি।
সু। তিরিশ বছর অগে কে রাঁধত?
মা! আমার বউ ছিল।
সু। আর কে ছিল?
মা। তোমার মত একটি মেয়ে।
সু। তারা এখন কোথায়?
মা। “স্বর্গে,” এই বলে মঝি আঙ্গুল দিয়ে আকাশ দেখিয়ে দিল।
সু। ওখানে তারা কেমন করে থাকে, ওখানে কিঘর আছে?
মা। এখন কি আর তারা মানুষ আছে যে ঘরে থাকবে, এখন যে তারা দেবতা হয়ে গেছে। দেবতারা আকাশের মধ্যে বেশ থাকতে পারে!
সু। আকাশের দেবতারা হাঁটে কিসের উপর দিয়ে মাঝি?
মা। বাতাসের উপর দিয়ে।
সু। তুমি তাদের দেখ্তে পাও?
মা। হাঁ।
সু। তোমার চোখের দৃষ্টি অতদূর যায় কেমন করে মাঝি? আমিত ওখানে কিছুই দেখ্তে পাইনে।
মা। মনের চোখ না ফুটলে ওখানে কিছু দেখতে পাওয়া যায় না, তুমি ছেলে মানুষ তোমার তো মনের চোখ এখনো ফোটে নি!
সু। কবে ফুটবে মাঝি?
মা। বড় হলে।
সু। আমার মা বড় হয়েছেন তাঁর তাহলে মনের চোখ ফুটেছে?
মা। বলা যায় না, বড় হলেই হয় না, ব্যথা পাওয়া চাই, ব্যথা পেলে মনের চোখ আপনি ফুটে ওঠে।
সু। তুমি বুঝি খুব ব্যথা পেয়েছিলে মাঝি?
মা। হাঁ, আমার খুকী যেদিন আমাকে ছেড়ে আকাশে উড়ে গেল সেদিন ব্যথায় আমার বুকটা একেবারে নুয়ে পড়েছিল, তার পরেই আমার মনের চোখটা ফুটে উঠল, মনটা আমার বাতাসে ছড়িয়ে গিয়ে আকাশের সঙ্গে মিশিয়ে গেল আর আমি সেখানকার সব দেখতে পেতে লাগলুম।
সু। কি দেখতে পেলে মাঝি?
ম। এই আকাশের মধ্যে আমার খুকীর মত মুখ। আকাশটা আমার বুক আর তোমার মুখখানা ঠিক্ যেন আমার খুকীর মুখ।
সু। সত্যি, মাঝি সত্যি, আমার মুখখানা ঠিক তোমার খুকীর মুখের মত?
মা। ঠিক্ অবিকল ঠিক, সেই মুখ যেন তোমার মুখে বসানো।
সুরি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল তার নাম কি ছিল মাঝি?
মা। রুক্মিনী, আমরা তাকে রুনি বলে ডাকতুম।
সুরি ঔৎসুক্যের সঙ্গে মাঝির কোলের কাছে ঠেসে গিয়ে বসল, কোলের উপর হাত দুটি রেখে বল্ল মাঝি কাল তোমার জন্যে আমি ভাত রেঁধে নিয়ে আসব তুমি খাবে ত? মাঝি বলল “হাঁ খাবো বই কি?”
পরদিন সুরী মাঝির জন্যে ভাত তরকারী রেঁধে নিয়ে এল; খেয়ার বুকে বসে বসে কালামাঝি সুরীর দেওয়া ভাত বড় তৃপ্তি করেই খেল।
এ বছর পূজোতে কালামাঝি সুরীকে খুব ভাল এক খানা কাপড় কিনে দিয়েছে।
২
বছর ঘুরে এল একদিন দুপুরে, খেয়ার পার হতে একে সুরী কালামাঝিকে বলল মাঝি কাল রাতে আমাদের গাঁয়ে একজন বাউল এসেছে, সারাক্ষণ সে একতারা বাজিয়ে গান করছে, পাড়া সুদ্ধ লোক গান শোনবার জন্যে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, এখনো গান হচ্ছে, আমি শুনে এলুম; বাউল বলেছে আমাদের গাঁয়ে সে কিছুদিন থাকবে; সকালে এইখানেই গাইবে, দুপুরের খেয়ায় রোজ পারে গিয়ে, গান গেয়ে, সাঁজের খেয়ার আবার ফিরবে। হয়ত বা আমাদের খেয়াতেই সে আসা যাওয়া করবে মাঝি। মাঝি বল্ল, “হুঁ”।
কিছুক্ষণ পরেই দূরে যেন একতারার সুর শোন গেল। ক্রমেই সুর এগিয়ে আসছে, কাছে ক্রমে আরো কাছে এইবার বাউলকে দেখা গেল, ছোঁড়া আলখাল্লা পরা, গৌরবর্ণ, দাড়িওয়ালা লম্বা মানুষটি জোরে জোরে একতারার তারে ঘা দিচ্ছে আর গাইছে—
একটি তারে বারে বারে
ডাকছে আমায় কে,
গানের এই কলিটিই ফিরিয়ে ফিরিয়ে বাউল বিশবার গাইতে লাগল, শেষে ধরল
“দ্বারে দ্বারে ফিরতে যে চায়
তারে ফিরার কে?
বাউল গাইছে
দিনে দিনে কাছে টানে
বাড়ায় না সে দূর,
কালে কালে কোনো জালে
জড়ায় না যে সুর।
একটি কথায় একটি ব্যথায়
সুরটি সাধায় সে।
দেখ্তে দেখ্তে বাউল খেয়ার কাছে এসে পড়ল একটি পয়সা মাঝির হাতে দিয়ে খেয়ার চড়ে বসল; গানটা এখন থেমেছে, বাউলকে বস্তে দেখে সুরী বলে উঠল “গাও না বাউল।
বাউল বল্ল তুমি গান ভাল বাস?
সু। হাঁ।
বা। তুমি গাইতে পার?
না বাউল, আমি মোটেই গাইতে পারিনে, একটি গানও আমি জানিনে, আমাদের পাড়ার মালতীমালা আর মুক্তকেশী গাইতে পারে, তারা রোজ বলে আমাকে শেখাবে কিন্তু আজ পর্য্যন্ত একটাও শেখায়নি। বাউল বল্ল “তুমি গান শিখবে? আমি তোমাকে শেখাব, তুমি রোজ সকালে আমার কাছে যেও”।
সুরী উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল “কাল থেকে রোজ তোমার কাছে ঠিক্ যাবো, ভোরে উঠেই যাব, “তুমি অনেক গান জ্ঞান বাউল, না”?
বা। হাঁ ঢের জানি।
সু। গান তুমি ঢের জান কিন্তু বাজনা বুঝি তোমার এই একটি?
বা। হাঁ, এই একটি বাজনার একটি তারেই আমি সব গান বাজাতে পারি।
সু। কেমন করে বাউল?
বা। তোমাকে শিখিয়ে দেব, তাহলেই তুমি বুঝবে কেমন করে বাজে।
সুরী মহাখুসী, সে গান শিখবে, একতারা বাজাবে, সঙ্গিনীদের শোনাবে, খুব মজা হবে।
খেয়ার যাত্রীরা বাউলকে ঘিরে বস্ল, সুরী একমনে গান শুনছে। বাউল গাইছে—
দ্বারে দ্বারে ফিরতে যে চায়
তারে ফিরায় কে?
একটি কলি বাউল কতবার যে ফিরিয়ে ফিরিয়ে গায়, যেন সুর দিয়ে নিজের বুকের ভিতরটা সে মেজে নিতে চায়, কোন কিছু ছোঁয়ালেই বুকটা যেন বেজে ওঠে, যেন সাড়া দেয়। বাউল গাইছে—
দিনে দিনে কাছে টানে
বাড়ায় সে দূর,
কালে কালে কোন জালে
জড়ায় না যে সুর,
সজোরে তারের উপর ঝঙ্কার দিয়ে বাউল গেয়ে উঠল
একটি কথায় একটি ব্যথায়
সুরটি সাধায় সে।
জোরে জোরে তারের উপর ঘা দিচ্ছে আর বাউল গাইছে
একটি কথায় একটি ব্যথায়
সুরটি সাধায় সে।
খেয়া এসে পারের ঘাটে ভিড়ল। যাত্রীরা নেমে যে যার পথে গেল চলে, যাবার সময় সকলেই দুএকটা করে পয়সা বাউলকে দিয়ে গেল।
সাঁঝের খেয়ায় সুরী দেখল বাউল ও তাদের সঙ্গে ফিরছে। সুরী ভাবল, কি মজা! সে যা ভেবেছে তাই; বাউল ও তাদের সঙ্গে আসা যাওয়া করবে।
রোজ তারা যায়, সাঁঝে ফেরে; সুরীর পল্প, বাউলের গান, কালামাঝির হাসি হাসি মুখ খেয়ার বুকটাকে আজ কাল কেমন জমিয়ে রাখে, পারাপারের লোকেরা বড় খুসীতেই পার হয়।
কালামাঝিব খেয়ায় আজকাল খুব ভীড়। তার খেয়ায় যাবার জন্যে লোকেরা ঘাটে এসে ঠেলাঠেলি করতে থাকে। যারা একটু আগে আসে তারাই গিয়ে খেয়ার চড়ে বসে, বোঝাই হলেই মাঝি খেয়া ছেড়ে দেয়।
কালামাঝি আগের চেয়ে ঢের বেশী লোক এখন খেয়ায় বোঝাই করে তবুও সকলকে ধরাতে পারে না। যারা পড়ে থাকে তীরে দাঁড়িয়ে খেয়াখানার দিকে চেয়ে চেয়ে তারা দেখে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাউলের গান শোনে, মনে ভাবে কাল আমি সকলের আগে এসে খেয়ায় চড়ে বসব।
বাউলের সঙ্গে, সুরীর, কালামাঝির খুব ভাব। খেয়া ছাড়বার একঘণ্টা আগে ওরা দুজনে এসে খেয়ায় বসে থাকে। খেয়ার বুকে ওরা যেন নিজেদের ভাবের ঘর বেঁধেছে। এইখানে বাউলের গান, সুরীর গল্প, কালামাঝির প্রাণের খুসী বুকের ভিতর থেকে যেন উথলে পড়ে—সবাইকে টানতে থাকে।
৩
আকাশে অল্প অল্প মেঘ করেছে, নদীর বুকে বাতাস উঠে খেয়াখানাকে অল্প অল্প দোলাচ্ছে, কালামাঝি হাল ধরে বসে, খেয়ার বুকে বাউল আর সুরী; এখনো পাড়ি দেওয়ার সময় হয়নি,—একঘণ্টা দেরী আছে। বাউল ধীরে ২ একতারাতে ঘা দিচ্ছে আর নিজের মনে গুন্ গুন্ করে গাইছে—
আমার এই একটি তারের
একটি কড়ি দর।
দূর থেকে দেখা গেল তাড়াতাড়ি পা ফেলে একটি লোক যেন খেয়া ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু পরেই সে এসে উপস্থিত হল, পা দুটো ধূলোয় ভরা, মাথার চুল উস্কো খুসকো, মুখখানা শুকিয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি যেন কাকে খুঁজছে; লাল কাপড়ের তৈরী একটা খোলের মধ্যে একটা লম্বা ধরণের জিনিষ ভরা—জিনিষটা বাদ্যযন্ত্র বলে বোধ হয়—সেইটা হাতে নিয়ে লোকটি তীরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল “এদিকে বাউল এসেছেন?”
খেয়ার উপর থেকে বাউল বল্ল, কেন ভাই বাউলকে তোমার কি দরকার?
লো। বড় দরকার, তাঁর একতারার সুরটা আমাকে এতদুর পর্য্যন্ত টেনে এনেছে, ঐ সুরটিতে আমার বড় দরকার।
বা। উঠে এস ভাই উঠে এস, খেয়ার বুকে উঠে এস; খেয়ার বুকে বসে সুর শুনবে এস। সুরের খেলা শোনবার এই তো ঠিক জায়গা; তুমি সুর চেন দেখছি।
লো। সুর নিয়েই যে আমার কারবার, আজীবন সুরের খেলা নিয়েই আমি আছি,— অন্য কাজ নেই। কত বড় বড় ওস্তাদের সঙ্গে ফিরেছি, সুরের কত আশ্চর্য্য খেলা শুনেছি, শেষে সর্ব্বস্ব ব্যয় করে এই বীণাটি কিনেছি নিজে বাজাব বলে,—ঘরে বসে যখন ইচ্ছা সুর শুনবো বলে,—আজ আমার বীণায় সুর নেই।
বা। কেন কি হয়েছে ভাই তোমার বীণার?
লো। জড়িয়ে গেছে, তারে তারে জড়িয়ে গেছে, নতুন বীণাটি কিনে সুর বেঁধে যেমনি বাজাতে যাব, অমনি তারে তারে জড়িয়ে গেল। বীণার আামার দুটি মাত্র তার, সেই দুটিতে এমন করে জড়িয়ে গেছে যে কেউ তাকে খুলতে পারছে না। কত ওস্তাদের কাছে গেলুম, কতজনকে দেখালুম, কেউই খুলতে পারল না। বীণা নিয়ে পথে পথে পথে ফিরছি বাউল, কেউ আমার জড়ান তার খুলে দিতে পারছে না। আজ একতারের সুর শুনে তোমার পিছু পিছু ছুটে আসছি ঐ সুরটা আমার বীণায় একবার বাজিয়ে দাও বাউল।
বী। “একতারের পথ তোমাকে কে দেখিয়ে দিল বীণকর?”
বী। “রাস্তায় এক ফকিরের সঙ্গে দেখা, সে বল্লে বাউলের কাছে যাও, বাউলের একতারের ঝঙ্কার নিজের বীণার তারে লাগিয়ে নাও, পাক খুলে তার আপনি বেজে উঠবে। অনেক ঘুরে এসেছি ভাই বাউল অনেক ঘুরেছি, একতারার সুরটা দয়া করে আমার দুইতারায় লাগিয়ে দাও, বীণা বেজে উঠুক।”
খুসী হয়ে বাউল হাত ধরে বীণ্করকে খেয়ায় তুলে নিল, কাছে বসিয়ে বল্ল, ভাই বীণকর! একতারের সুরটা আগে কানে শুনে, প্রাণে চিনে নাও তবে তাকে দুইতারে বাজাতে পারবে। তুমি তো সুর চেন?”
বী। চিনি বই কি!
বা। “সুরের মাঝে মাঝে ফাঁক আছে জান তো, যেখানে এসে সুর শেষ হয়?”
বী। জানি বই কি!
বা। “লোকে মনে করে সেই ফাঁকটা বুঝি শুধুই ফাঁকা, তার বুঝি আর কোন সুর নেই, কিন্তু সেই ফাঁকের যে মস্ত বড় একটা সুর আছে সেটা সবাই জানে না।”
বী। সে সুর কোথায় কেমন করে বাজছে বাউল?
বা। “জগতের বুকের ঠিক মাঝখানটিতে সে দিনরাত বাজছে; বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই সে বাজছেই বাজছেই বাজছেই। সে ডাক হৃদর হরা বৈরাগ্য ভরা সুর, সে চিরফাঁকের সুর।”
বী। সে সুর ধরে রাখছে কে?
বা। বাউলের একতারা, সেই সুরই বাউলের একতারাতে বাজে, উদাসীর প্রাণকে আরও উদাস করে, আপনি বেজে জগতের সব সুরকে নিজের নিজের জায়গায় বাজবার চির অবকাশ দেয়। এই ফাঁকের সুরটা বাজাতে না জানলেই সুরে সুরে জড়িয়ে যায় হে বীণকর তারে তারে জড়িয়ে যায়। ফকির তোমাকে এই ফাঁকের সুরটাই শিখতে বলেছে।’
বাউলের কথাশুনে বীণকর আনন্দে বলে উঠল, “বাজাও, ভাই বাউল বাজাও, তোমার ‘একতার’ আমার জড়ান বীণার তারে একবার ফাঁকের সুরটা লাগিয়ে নিই।” এই বলে থলের ভিতর থেকে সে নিজের বীণাটা বের করতে লাগল।
এদিকে যাত্রী বোঝাই হয়ে কালা মাঝি খেয়া ছেড়ে দিয়েছে। সুরী এতক্ষণ হাঁ করে বাউলের কথা শুনছিল, খেয়া ছাড়তেই বলে উঠল “এইবার গাও না বাউল।” বাউল গান আগেই ধরেছে—
আমার এই একটি তারের
একটি কড়ি দর,
‘দুনিয়ার সকল সুরের
এই সুরেতে ভর।’
যাত্রীরা বাউলের কথা, বাউলের গান, একতারার ঝঙ্কার মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে শুনছে, বাউল গাইছে—
বাজে সে একটি ফাঁকে,
সাড়া দেয় একটি ডাকে,
বাঁধে সে সকল সুরের
মাঝখানে তার ঘর।’
আকাশে মেঘ জমে উঠেছে, সেদিকে কারো নজর নেই, সকলের মন সুরের দিকে; বীণকর একটি আঙ্গুল দিয়ে জড়ান তারের উপরই কিড়িং কিড়িং করে ঘা দিচ্ছে,—ফাঁকের সুরটা লেগে, পাক খুলে, যদিই বীণা বেজে ওঠে।
হঠাৎ কালা মাঝি বলে উঠল “আজ আকাশের গতিক খারাপ, ঝড় উঠবে হে।” কেউ সে কথায় কান দিল না, একতারার ঝঙ্কারে সকলের মন ডুবে আছে।
তারে ঘা দিতে দিতে বীণকর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল “পাক খুলেছে হে বাউল আমার জড়ান তারের একটা পাক খুলেছে।”
বা। “তা তো খুলবেই; ফাঁকের সুরটা লাগাতে পারলেই পাক্ খুলবে; ফাঁকটা বজায় রেখে সুর খেলাতে শিখলেই স্বর্গ মর্ত্ত্য একসঙ্গে বাজবে। তোমার বীণার সেইটাই কাজ।
তারে বীণকর ঘা দেয় আর পর্দ্দায় পর্দ্দায় পাক্ খোলে। সে ফাঁক বজায় রেখে তার বাজাতে শিখেচে। ক্রমেই তার খুলে আস্ছে—বীণকরের বুকের ভিতরটায় যেন আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল, সে থামে না, ঝনন্ ঝনন্ করে কেবলই তার বাজায়। দেখ্তে দেখ্তে খেয়া এসে পারের ঘাটে ভিড়ল, যাত্রীরা নেমে গেল। বীণকরের বীণার জড়ান তার খুলে গেছে; ফাঁক বজায় রেখে সুর বেঁধে নিয়ে আনন্দে বীণা বাজাতে বাজাতে সে বাউলের সঙ্গে সঙ্গে চল্ল।
বাউল গাইতে গাইতে যাচ্ছে—
একতারাতে ঘা দিয়ে কে
পথ কেটে যায় মধ্যখানে,
পিছিয়ে পড়ে এধার ওধার
এগিয়ে সে যায় সমুখ পানে।
ঐ দেখা যায় বিরাম তাহার
মাঝ পথের ঐ শেষ কিনারে,
একতারাতে বাজছে গো তার
চিরফাঁকের সেই চিনারে।
বীণকর, বাউল, গাইতে, বীণ শোনাতে গাঁয়ের মধ্যে গেল, সুরী গেল ফুল বেচতে, কালামাঝি একলা বসে রইল খেয়ার বুকে। আকাশে খুব মেঘ, মাঝি চেয়ে চেয়ে তাই দেখ্ছে।
8
সাঁঝের পাড়ির সময় এখনো হয়নি, একটু আগেই আজ সবাই এসে জুটল,—আকাশের গতিক দেখে। সুরী, বীণকর, বাউল, সবাই এসেছে—অন্য যাত্রীও ঢের। কালামাঝিও আজ একটু সকাল সকাল খেয়া ছাড়বে—আকাশে মেঘের খুব ঘটা।
হালটি কালামাঝি ফেরালো তঈর থেকে খেয়া খানা ভেসে এল জলের দিকে। মাথা উঁচু করে সবাই একবার আকাশের দিকে তাকাল। মাথার উপর কি কালো মেঘ! একজন যাত্রী বলে উঠল, “ও বাবা মেঘের ঘটা দেখ, খেয়াখানা পেরতে পারলে হয়, মাঝ নদীতে তুফান না জাগে, কে জানে কপালে কি আছে!” লোকটা কালামাঝির খেয়ার আজ নূতন উঠেছে। পুরোণ যাত্রীরা দু একজন বলে উঠল “ভয় নেই হে ভয় নেই, মাঝি বড় পাকা, বড় হুঁসিয়ার, কত ভয়ানক তুফানে সে আমাদের পার করেছে, জান না তো? এ কালামাঝির খেয়া এ খেয়ায় উঠলে কোনো ভয় থাকে না।
কালামাঝির সুখ্যাতি শুনে সুরীর মুখখানা খুসীতে ভরে উঠল। সে কালামাঝির হাঁটু ধরে নাড়া দিয়ে বলল” মাঝি, সবাই বল্ছে কালামাঝির খেয়ায় কোন ভয় নেই, তোমাকে ওরা জানে।”
মা। “তোমার চেয়ে বেশী জানে না।”
সু। “আমি বুঝি তোমাকে খুব বেশী জানি?”
মা। “হাঁ, খুব বেশী, সব চেয়ে বেশী; তুমি আমার সব জান।
সু। বলত কি কি জানি আমি গুণে গুণে দেখি।
এই বলে সুরী আঙ্গুলে এক, দুই, গুণতে লাগল, মাঝি বলে যাচ্ছে— কোথায় থাকি, কোথায় শুই, কি খাই, কখন খাই, কখন শুই, ঘর কোথা, আছে কে, রাঁধে কে, খুকীর খবর, খুকীর মায়ের খবর, তাদের আকাশে থাকার খবর, সব খবরই তুমি জান, এত কি আর কেউ জানে?
সু। “সত্যি মাঝি, আমি তোমার সব জানি, আমার মত কেউ জানে না; তোমার কাছে থাকতে তাই আমি এত ভাল বাসি মাঝি!
“ভালবাস বলেই আমার সবটা নিয়ে আমাকে এমনতর ফাঁকা করে দিয়েছ। আমার ফাঁকা বুকটাতে এখন নদীর জল ‘ছলাৎ’ ‘ছলাৎ’ করে এসে ঢোকে, খেয়াখানা আসতে যেতে আমার বুকের মধ্যে কেমন গান গায়!”
সু। কি বল মাঝি, খেয়া আবার কখনো গান গাইতে পারে?
মা। বাউলকে জিজ্ঞাসা কর সকাল, দুপর, সাঁজে খেয়া গান গায় কি না?
সুরী মাঝিকে ছেড়ে বাউলের দিকে ফিরে বল্ল “বাউল দাদা! মাঝি বলচে খেয়া গান গায়; সত্যি?”
বা। হাঁ দিদি, খেয়া আসতে যেতে দিন রাত গান গায়।
সু। তোমাদের কথা কিছুই বোঝা যায় না, কি যে তোমরা বল!
বাউল বীণকরের দিকে ফিরে বলল কালা মাঝির বুকে সুর বাজে ভাই বীণকর! আসতে যেতে খেয়া তার বুকে সুর বাজায় শুনলে তো?”
বী। “তাই তো শুনছি, অশ্চর্য্য, ব্যাপার, সুরের যে কোথায় শেষ কে জানে?”
বা। “শেষ ঐ ফাঁকের মধ্যে, ফাঁকের সুরটা কানে এখনো ভাল করে বসেনি বলে ওটা ধরছে পারছ না, আরো শুনতে হবে হে আরো শুনতে হবে।”
বী। ভাই বাউল! তোমার একতারাটা একবার বাজাও ভাই, ভালো করে ঐ সুরটা প্রাণের মধ্যে বসিয়ে নিই।
গানে বাউলের শ্রান্তি নেই।
একতারায় ঘা দিয়ে সে তখুনি গান সুরু করল।
ওরে ও ক্ষ্যাপা বাউল
মিছে তুই মরিস্ ঘুরে,
তারে তোর বাজছে যে সুর
সেই সুরে নে পরাণ পুরে।
বীণা রেখে দিয়ে একমনে বীণকর গান শুনছে, সুরটা আজ সে প্রাণে বসিয়ে নেবে।
বাউল গাইছে
‘ওরে ও ক্ষ্যাপা রাউল
মিছে তুই মরিস ঘুরে।’
নদীর বুকে তুফান জেগেছে, ঝড় এসে পড়ল বলে, মেঘে আকাশ ঘেরা।
খেয়াখানা একবার এদিকে কাৎ হয় একবার ওদিকে; উল্টে গেল আর কি! ছোট ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করে ওঠে, বড়রা তাদের ধরে থেকে সামলায়।
কালামাঝি অটল, হাল ধরে সে বসেই আছে, মুখে ভয়ের চিহ্ন মাত্র নেই, এর চেরে কত ভারী তুফানে সে পাড়ি দিয়েছে এতো আর তুলনায় কিছুই নয়। এটুকু তুফান সে গ্রাহ্যই করে না।
সুরী কালামাঝির পায়ের কাছে বসে খেয়া কাৎ হলেই ভয় পেয়ে সে কালামাঝির হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরে। কালামাঝি বলে “ভয় পাচ্ছ?” সুরী বলে না, কই ভয় পাচ্ছি! কালামাঝি হাসতে থাকে।
তুফান ঠেলে মাঝি পাড়ি দিচ্ছে। কি তার পাড়ি দেওয়ার কায়দা। তুফান যতই উঠুক খেয়া ঠিক আছে। ডুফান দেখে বাউলের প্রাণে কি আনন্দ! সে গলা ছেড়ে গান ধরেছে, কোন দিকে চোখ কান নেই, একতার বাজছে বাউল গাইছে—
ওরে ও ক্ষ্যাপা বাউল
মিছে তুই মরিস ঘুরে
“তারে” তোর বাজছে যে সুর
সেই সুরে নে পরাণ পুরে।
বাউলের আনন্দ দেখে কে? তুফানের দিকে সে চেয়ে চেয়ে দেখ্ছে আর গাইছে—
আছে পথ একটি জানা
গেছে সুর একটি শোনা
দেখে নে জগত খানা
বাজছে কোথায় একের সুরে।
বাউলের প্রাণের আনন্দ খেয়া খানার বুকে যেন ছড়িয়ে পড়ল। তুফানের ভয় ভুলে সবাই এখন গানের সুরে ডুবে গেল। গান শুনতে সবাই মন দিয়েছে হঠাৎ একটা শব্দ হল ‘ফোঁস’ তার পরেই ঝপাৎ করে জলে একটা কি পড়ে গেল। সকলে অন্যমনস্ক, সেদিকে কারো কান গেল না। খানিক পরে আবার সেই শব্দ ‘ফোঁস’, ঝপাৎ করে আবার যেন জলে কি একটা পড়ল!
এইবার সকলের চোখ পড়ল সেদিকে। এক চুবড়ি সাপ নিয়ে একজন বেদে খেয়ায় পার হচ্ছিল, ডালা ঠেলে, মাথা উঁচিয়ে দুবার দুটো সাপ চুবড়ির ভিতর থেকে লাফিয়ে জলে পড়ল এ তারই শব্দ।
রাগে গস্গস্ করতে করতে চুবড়ি ধরে বেদে ঝাঁকাচ্ছে আর বক্ছে, “আঃ গেল যা, সাপ গুলোর হয়েছে কি, ভারি যে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে দেখছি, দু দুটে সাপ পালিয়ে গেল, আবার আমাকে কষ্ট করে জঙ্গল থেকে সাপ ধরে পোষ মানাতে হবে; এদের কত করে শিখিয়েছিলুম।”
চুবড়িতে সাপ চারটে ছিল, দুটো পালিয়েছে বাকি দুটোও স্থির থাকছে না, ঝেঁকে ঝেঁকে উঠছে।
বেদের হাতে একটা বাঁশি ছিল, তাই দিয়ে সাপ দুটোর মাথায় ঘা দিতে দিতে সে বল্ল চুপ, থাক বেটা চুপ্ থাক্, নড়বিনে চুপ্ থাক্।
ঘা খেয়ে তখনকার মত সাপ দুটো গুটি সুটি মেয়ে চুবড়ির মধ্যে লুকোলো, সাপুড়ে বাঁশীতে ফুঁদিল।
সাপুড়ের বাঁশির সুরে সাপ মুগ্ধ হয়ে বশ মানে; বাঁশী পোঁ ধরল, বেদে নিশ্চিন্ত হয়ে বাঁশী বাজাতে লাগল আর সাপদের পালাবার যো নেই সে জানে।
বাউলের একতারা বাজছে, গান চলছে তার ভিতরে সাপুড়ের বাঁশীর পোঁ পোঁ আওয়াজটা সকলেরই কানে কেমন বেখাপ ঠেকতে লাগল। বাউল সে দিকে কান দেয়নি, সে নিজের মনে গেয়েই যাচ্ছে—
ওরে ও ক্ষ্যাপা বাউল
মিছে তুই মরিস্ ঘুরে,
‘তারে’ তোর বাজছে যে সুর
সেই সুরে নে পরাণ পুরে,
আছে পথ একটি জানা
গেছে সুর একটি শোনা,
দেখে নে জগৎ খানা
বাজছে কোথায় একের সুরে।
সাপুড়ের বাঁশীর পোঁ পোঁ সুর তখনো রাজছে, সকলে ত্যক্ত হয়ে উঠল। যাত্রীদের মধ্যে একজন বলে উঠল “কি হে বেদে তোমার পোঁ পোঁ থামবে না; দেখছ না একতারা বাজছে।”
বেদে চটে উঠে বল্ল “বলেন কি মশায় দু দুটো সাপ পালিয়ে গেল আমার কি কম ক্ষতি হল, ঐ একতারার সুরটাই তো সাপগুলোকে বিগড়িয়ে দিচ্ছে। সাপেরা অন্য সুর সইতে পারে না। বাঁশীর সুর শুনে তবে একটু চুপ করে আছে”।
কথা কইতে গিয়ে বেদে অন্যমনস্ক হয়েছে সেই তাবসরে ঝপাৎ করে আর একটা সাপ্ লাফিয়ে জলের মধ্যে পড়ল।
বেদে রেগে জ্ঞান শূন্য হয়ে বাউলকে তেড়ে উঠে বল্ল তোমার একতারের সুরের জ্বালায় আমার সব সাপগুলো পলিয়ে গেল, কি তুমি ফড়াং ফড়াং তড়াং তড়াং সুর বের করছ, আমার সর্ব্বনাশ করে ছাড়লে?”
গান থামিয়ে বাউল বল্ল “কি ভাই বেদে কি হয়েছে তোমার?”
বে। আর কি হবে সর্ব্বনাশ হয়েছে।
বা। কেমন করে?
বে। তোমার একতারার সুরের জ্বালায় পোষা সাপগুলো আমার সব পালিয়ে গেছে।
বা। ওরা প্রাণ পেয়েছে ভাই বেদে প্রাণ পেয়েছে, এতে দুঃখ কোর না।
বে। তবে তো বড় কাজই হয়েছে ওরা প্রাণ পেয়েছে, ওরা প্রাণ পেল তো আমার কি, আমার যে এদিকে সর্ব্বনাশ হয়ে গেল তার কি হবে?
বা। যার প্রাণ তাকে তো সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে। নিজের প্রাণ নিজে ফিরে পেলে অন্যের যদি তাতে সর্ব্বনাশ হয় তবে তেমন সর্ব্বনাশ তো ঘটাতেই হবে; তা না তো বাঁচবে কি করে?
বে। রেখে দাও তোমার ওসব ভালো কথা, যেমন আমার সাপ গেছে তেমনি তোমার একতারাটা কেড়ে নিয়ে তবে আমি ছাড়ব।
বা। এই নাও আমার একতারা বাজিয়ে যতপার পয়সা রোজগার কোরো।
বে। তা দেবে না কেন, জানছ ওটা আমার হাতে বাজবে না, তাই তাড়াতাড়ি দিতে এসেছ, সে হবে না, আমার সাপের দাম দিতে হবে তবে ছাড়ব।
বাউলের আলখাল্লার পকেটে সেদিনকার পাওয়া যে কটি পয়সা ছিল পকেট থেকে সেগুলি বেদেকে দিয়ে বাউল তাকে নিজের কাছে বসাল। বাকি সাপটা বেদের চুবড়ি থেকে ইতিমধ্যে কখন লাফ মেরে পালিয়েছে কেউ দেখেইনি। ঝগড়া কর্ত্তে যাবার সময় তাড়াতাড়িতে চুবড়ির ডালাটা বেদে খুলে রেখে গিয়েছিল।
পয়সা পেয়ে বেদে খুসী হয়েছে। গলা সুরটা একটু নরম করে বাউলকে বলল, “ভাই বাউল আবার আমাকে অনেক কষ্ট করে জঙ্গল থেকে সাপ ধরে এনে পোষ মানাতে হবে; সে কম কষ্ট নয়।”
বা। সাপ নিয়ে কি করবে ভাই বেদে?
বে। খেলাব।
বা। মানুষ কি সাপ নিয়ে খেলে, সে যে বিষের খেলা।
বে। আমরা বিষকে ভয় করিনা।
বা। ভয় করনা কিন্তু বিষের হাত থেকে বাঁচতে ও তো পার না।
বে। বেঁচে তো থাকি।
বা। সে সাপ হয়ে, মানুষ হয়ে নয়, সাপের সঙ্গে মিল্তে মিল্তে সাপ হয়ে যাও, মানুষ থাক না।
বে। মানুষ হয়ে বাঁচতে গেলে কি নিয়ে থাকতে হয়?
বা। সুর নিয়ে, সুরের খেলাই মানুষের খেলা; বিষ নিয়ে খেলবে সাপ, মানুষ নয়।
বে। সাপগুলো তাহলে থাকবে কোথায়?
বা। জঙ্গলে, গর্ত্তে, আর এই নদীর জলে; লোকালয়ে নয়।
বাউলের কথায় বেদের মনটা যেন একটু ভিজে গেল। সে বল্ল এটা আমার জাতব্যবসা, এ না হলে আমার চলবে কিসে?
বা। ভুলে যাও এমন ব্যবসা।
বে। জাত যাবে যে।
বা। যেতে দাও।
বে। কি নিয়ে থাকব?
বা। সুর নিয়ে।
বে। সাপ খেলাতেও সুর আছে, আমরা বাঁশী বাজাই তবে সাপ খেলে।
বা। সে বাঁশী বিষের বাঁশী, সে সুর মোহের সুর ও বাঁশী বাজাতে বাজাতে নিজের বুকেও বিষ ঢুকে যায় ও সুর শুনতে শুনতে নিজেকেও মোহে ডুবিয়ে ফেলে।
বে। আমার তবে কি হবে ভাই বাউল, এ ছাড়া আর কোন সুর তো আমি জানিনে, গলায় আমার দুর আসে না, হাতে আমার সুর বাজে না, সুর আমি পাব কোথায় যে তাই নিয়ে থাকব?
বা। খেয়া বাও, সকাল দুপুর সাঁজে খেয়া বাও ভাই বেদে সুর আপনি বেজে উঠবে।
বে। খেয়া বাইলে কি সুর বাজে বাউল?
বা। হাঁ, খুব বাজে, আশ্চর্য্য সুর বাজে।
রে। কি বলছ বাউল! আমরা তো খেয়ার আসা যাওয়ায় কোন সুর শুন্তে পাইনে।
বা। মনের কাণ নেই শুনবে কি করে, মনের কাণ না খুললে এ সুর শোনা যায় না।
বে। “তুমি শুনতে পাও?”
বা। “হাঁ।”
বে। “তোমার মনের কান খুললো কি করে?”
বা। “একতারের সুর শুনতে শুনতে; এ সুর কানের ভিতর দিয়ে প্রাণে গিয়ে পৌঁছলেই মনের কান আপনি খুলে যায় পৃথিবী জুড়ে যেখানে যত সুর বাজছে সব শোনা যেতে থাকে।
বে। “খেয়া বাইলে একটি সুর শোনা যায়, না অনেক?”
বা। “একটি সুরই নানা রকমে অনেক বার শোনা যায়, এর যাওয়ায় সুর, আসায় সুর, ভাসায় সুর, উজানে সুর, তুফানে সুর, খেয়া বাওয়ার আগা গোড়াই সুরের খেলা। কালামাঝির কান নেই তবু এই সুরটা তার প্রাণে গিয়ে বসেছে, তাই তার প্রাণটা এমন খুসীতে ভরা মুখখানা এমন হাসি হাসি।”
বে। “খেয়া বাওয়াতে কড়ি ও আছে ভাই বাউল, এখন থেকে আমি তাহলে খেয়াই বাইবো। তোমার কাছেই থাকতে হবে, আমার জাত যাবে, ঘরে তে আমাকে নেবে না।”
বা। চমৎকার হবে ভাই বেদে চমৎকার হবে। বেদে বাউলের কথা খেয়ার যাত্রীদের এতক্ষণ এমন ভুলিয়ে রেখেছিল যে কখন তুফান কেটে গেছে তারা টেরই পায়নি। আকাশ পরিস্কার, দু একটা তারা দেখা দিয়েছে, কালামাঝির মুখের হাসি এইবার আরো যেন ফুটে উঠেছে, সে হাস্তে হাস্তে সুরীকে বল্ল, “কি খুকী তুফান কোথায় গেল?”
সু। কে জানে,— তুমি এখুনি বলবে আকাশে মিশিয়ে গেছে।
মা। তাই গেছে।
সু। বেশ যাহোক্, সব জিনিষ বুঝি আকাশে মিশিয়ে যায়?
মা। হাঁ, সব।
সু। আর সব জিনিষ আসতে যেতে গান গায়, —তুমি ও বল বাউল দাদাও দাও বলে।
মা। গানের খবর বাউলই বেশী জানে, আমি কেবল একটি সুর বুকের মধ্যে শুনি—খেয়া আসতে যেতে যেটি বাজায়। কানটা যে আমার কালা, আমি কি বেশী সুর শুনতে পাই? প্রতিদিন খেয়া বাই তাই খেয়ার সুরটা কান ডিঙ্গিয়ে কোন রকমে আমার বুকে এসে পৌঁচেছে!
খেয়া এসে এপারে মাটিতে ঠেক্ল, যাত্রীরা আনন্দে চীৎকার করে উঠল—
বেঁচে থাক ভাই কালামাঝি বেঁচে থাক, আজ বড় তুফানেই আমাদের পার করেছ।
মা। আমি কি পার করেছি ভাই দেবতা করেছেন, দেবতার হাতেই সব।
যাত্রীরা নেমে পড়ল, বাউলকে ঘিরে তারা গাঁয়ের পথে এগোতে লাগল, বাউল গাইতে গাইতে যাচ্ছে—
খুলে দে মনের ঠুলি,
রেখে দে দুয়ার খুলি,
কে আসে দেখরে চেয়ে আকাশ বেয়ে
কণ্ঠে সুরের তুফানে তুলি।
বাউলের হাত ধরে সুরী যাচ্ছে। যেতে যেতে সে কালামাঝির দিকে ফিরে ফিরে দেখ্ছে আর ভাবছে রাতটা কালামাঝির কেমন করে খেয়ার বুকে কাটবে!
৫
গত রাতে নদীতে বান এসে অর্দ্ধেক খানা গাঁ প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গরু, বাছুর, ছাগল, ঘরের চাল, গরিবের ছেঁড়া কাথা, গৃহস্থের বাসন পত্র, অনেক দিনের জড় করা ধান চাল কত যে লণ্ডভণ্ড হয়ে, বানের জলে ভেসে চলে গেছে কে তা গুণ্বে?
ভোরের সময় জল সরে গিয়ে নদী আবার ঠিক আগের মত স্থির। রাতে যে অমন প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেছে এখন নদীর চেহারা দেখে তা একটুও বোঝাবার যো নাই। ডাঙ্গার দিকে নির্লজ্জ ভাবে কটাক্ষ করতে করতে নদী এখন হেসে তো চলেছে— যেন সে কিছুই জানে না। যত সব ভাঙ্গা চোরা ছেঁড়া ফাটা নোংরা ময়লা জিনিষ, বুকে নিয়ে ডাঙ্গা খানা যেন কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কেউ তার দিকে চেয়ে না দেখলেই ভাল হয়। কাদা ভেঙ্গে একটি ছোট্ট মেয়ে নদীর তীরে ছুটোছুটি করছে দেখা গেল।
ঘাটের কাছেই, তিন জন মানুষ একখানা খেয়া ধরে টানাটানি করছে, খেয়াখানা কাদার উপর উল্টে পড়ে আছে, সেটাকে টেনে এনে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা।
খানিক টানাটানি করতেই খেয়াখানা কাৎ হল, তার তলায় একটা মানুষ শুয়ে, মানুষটা মরা।
ছোট্ট মেয়েটি দৌড়ে খেয়ার কাছে এসে চেঁচিয়ে উঠল—“কালামাঝি!”