দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/একবিংশ পরিচ্ছেদ
বিমলাকে দেখিয়া জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের কোলাহল?”
বিমলা কহিলেন, “পাঠানের জয়ধ্বনি। শীঘ্র উপায় করুন; শত্রু আর তিলার্দ্ধমাত্রে এ ঘরের মধ্যে আসিবে।”
জগৎসিংহ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ কি করিতেছেন?”
বিমলা কহিলেন, “তিনি শত্রুহস্তে বন্দী হইয়াছেন।”
তিলােত্তমার কণ্ঠ হইতে অস্ফূট চীৎকার নির্গত হইল; তিনি পালঙ্কে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন।
জগৎসিংহ বিশুষ্ক-মুখ হইয়া বিমলাকে কহিলেন, “দেখ দেখ, তিলােত্তমাকে দেখ।”
বিমলা তৎক্ষণাৎ গোলাবপাশ হইতে গােলাব লইয়া তিলােত্তমার মুখে কণ্ঠে কপােলে সিঞ্চন করিলেন, এবং কাতরচিন্তে ব্যজন করিতে লাগিলেন। শত্রু-কোলাহল আরও নিকট হইল; বিমলা প্রায় লােদন করিতে করিতে কহিলেন; “ঐ আসিতেছে!—রাজপুত্র! কি হইবে?”
জগৎসিংহের চক্ষুঃ হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কহিলেন, “একা কি করিতে পারি? তবে তোমার সখীর রক্ষার্থ প্রাণত্যাগ করিব।”
শত্রুর ভীমনাদ আরও নিকটবর্তী হইল। অস্ত্রের ঝঞ্ঝনাও শুনা যাইতে লাগিল। বিমলা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—
“তিলোত্তমা। এ সময়ে কেন তুমি অচেতন হইল? তোমাকে কি প্রকারে রক্ষা করিব?”
তিলোত্তমা চক্ষুরুন্মীলন করিলেন। বিমলা কহিলেন, “তিলোত্তমার জ্ঞান হইতেছে; রাজকুমার! রাজকুমার! এখনও তিলোত্তমাকে বাঁচাও।”
রাজকুমার কহিলেন, “এ ঘরের মধ্যে থাকিলে কার সাধ্য রক্ষা করে। এখনও যদি ঘর হইতে বাহির হইতে পারিতে, তবে আমি তোমাদিগকে দূর্গের বাহিরে লইয়া যাইতে পারিলেও পারিতাম; কিন্তু তিলোত্তমার ত গতিশক্তি নাই। বিমলা! ঐ পাঠান সিঁড়িতে উঠিতেছে। আমি অগ্রে প্রাণ দিবই, কিন্তু পরিতাপ যে, প্রাণ দিয়াও তোমাদের বাঁচাইতে পারিলাম না।”
বিমলা পলকমধ্যে তিলোত্তমাকে ক্রোড়ে তুলিয়া কহিলেন, “তবে চলুন; আমি তিলোত্তমাকে লইয়া যাইতেছি।”
বিমলা আর জগৎসিংহ তিন লম্ফে কক্ষদ্বারে আসিলেন। চারিজন পাঠান-সৈনিকও সেই সময়ে বেগে ধাবমান হইয়া কক্ষদ্বারে আসিয়া পড়িল। জগৎসিংহ কহিলেন, “বিমলা, আর হইল না, আমার পশ্চাৎ আইস।”
পাঠানের শিকার সম্মুখে পাইয়া “আল্লা—লা—হে” চীৎকার করিয়া, পিশাচের ন্যায় লাফাইতে লাগিল। কটিস্থিত অস্ত্রে ঝঞ্ঝনা বাজিয়া উঠিল। সেই চীৎকার শেষ হইতে না হইতেই জগতসিংহের অসি একজন পাঠানের হৃদয়ে আমূল সমারোপিত হইল। ভীম চীৎকার করিতে করিতে পাঠান প্রাণত্যাগ করিল। পাঠানের বক্ষঃ হইতে অসি তুলিবার পুর্ব্বেই আর একজন পাঠানের বর্শাফলক জগৎসিংহের গ্রীবাদেশে আসিয়া পড়িল। বর্ষা পড়িতে না পড়িতেই বিদ্যুদ্বৎ হস্তচালন দ্বারা কুমার সেই বর্শা বাম করে ধৃত করিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ সেই বর্শারই প্রতিঘাতে বর্শা-নিক্ষেপীকে ভূমিশায়ী করিলেন। বাকি দুই জন পাঠান নিমেষমধ্যে এক কালে জগৎসিংহের মস্তক লক্ষা করিয়া আসি প্রহার করিল, জগৎসিংহ পলক ফেলিতে অবকাশ না লইয়া দক্ষিণ হস্তস্থ অসির আঘাতে এক জনের অসি সহিত প্রকোষ্ঠচ্ছেদ করিয়া ভূতলে ফেলিলেন; দ্বিতীয়ের প্রহার নিবারণ করিতে পারিলেন না; আসি মস্তকে লাগিল ন। বটে, কিন্তু স্কন্ধদেশে দারুণ আঘাত পাইলেন। কুমার আঘাত পাইয়া যন্ত্রণায় ব্যাধশরস্পৃষ্ট ব্যাঘ্রের ন্যায় দ্বিগুণ প্রচণ্ড হইলেন; পাঠান অসি তুলিয় পুনরাঘাতের উদ্যম করিতে না করিতেই কুমার, দুই হস্তে দৃঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ভীষণ অসিধারণপূর্বক লাফ দিয়া আঘাতকারী পাঠানের মস্তকে মারিলেন, উষ্ণীষ সহিত পাঠানের মস্তক দুই খণ্ড হইয়া পড়িল। কিন্তু এই অবসরে যে সৈনিকের হস্তচ্ছেদ হইয়াছিল, সে বাম হস্তে কটি হইতে তীক্ষ ছুরিকা নির্গত করিয়া রাজপুত্ত্র-শরীর লক্ষ্য করিল; যেমন রাজপুত্ত্রের উল্লম্ফোথিত শরীর ভূতলে অবতরণ করিতেছিল, অমনি সেই ছুরিকা রাজপুত্ত্রের বিশাল বাহুমধ্যে গভীর বিঁধিয়া গেল। রাজপুত্র সে আঘাত সূচীবেধ মাত্র জ্ঞান করিয়া পাঠানের কটিদেশে পর্ব্বতপাতবৎ পদাঘাত করিলেন, যবন দূরে নিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। রাজপুত্ত্র বেগে ধাবমান হইয় তাহার শিরচ্ছেদ করিতে উদ্যত হইতেছিলেন, এমন সময়ে ভীমনাদে “আল্লা—ল্লা—হো” শব্দ করিয়া অগণিত পাঠানসেনা-স্রোত কমধ্যে প্রবেশ করিল। রাজপুত্ত্র দেখিলেন, যুদ্ধ করা কেবল মরণের কারণ।
রাজপুত্রের অঙ্গ রুধিরে প্লাবিত হইতেছে; রুধিরোৎসর্গে দেহ ক্রমে ক্ষণ হইয়া আসিয়াছে। তিলােত্তমা এখনও বিচেতন হইয়া বিমলার ক্রোড়ে রহিয়াছেন। বিমলা তিলােত্তমাকে ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছেন। তাঁহারও বস্ত্র রাজপুত্রের রক্তে আর্দ্র হইয়াছে।
কক্ষ পাঠান-সেনায় পরিপূর্ণ হইল।
রাজপুত্র এবার অসির উপর ভর করিয়া নিঃশ্বাস ছাড়িলেন। একজন পাঠান কহিল,—“রে নফর! অস্ত্র ত্যাগ কর, তােরে প্রাণে মারিব না!” নির্বাণােন্মুখ অগ্নিতে যেন কেহ ঘৃতাহুতি দিল। অগ্নিশিখাবৎ লম্ফ দিয়া, কুমার দাম্ভিক পাঠানের মস্তকচ্ছেদ করি নিজ চরণতলে পাড়িলেন। অসি ঘুরাইয়া ডাকিয়া কহিলেন,—“যবন! রাজপুতেরা কি প্রকারে প্রাণত্যাগ করে, দেখ্।”
অনন্তর বিদ্যুদ্বৎ কুমারের অসি চমকিতে লাগিল। রাজপুত্ত্র দেখিলেন যে, একাকী আর যুদ্ধ হইতে পারে না; কেবল যত পারেন, শত্রুনিপাত করিয়া প্রাণত্যাগ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য হইল। এই অভিপ্রায়ে শত্রু-তরঙ্গের মধ্যস্থলে পড়িয়া বজ্রমুষ্টিতে দুই হস্তে অসিধারণপূর্ব্বক সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। আর আত্মরক্ষার দিকে কিছুমাত্র মনােযােগ রহিল না; কেবল অজস্র আঘাত করিতে লাগিলেন। এক, দুই, তিন,—প্রতি আঘাতেই হয় কোন পাঠান ধরাশায়ী, নচেৎ কাহারও অঙ্গচ্ছেদ হইতে লাগিল। রাজপুত্ত্রের অঙ্গে চতুর্দ্দিক হইতে বৃষ্টিধারাবৎ অস্ত্রাঘাত হইতে লাগিল। আর হস্ত চলে না, ক্রমে ভূরি ভুরি আঘাতে শরীর হইতে রক্তপ্রবাহ নির্গত হইযা বাহু ক্ষীণ হইয়া আসিল; মস্তক ঘুরিতে লাগিল; চক্ষে ধূমাকার দেখিতে লাগিলেন; কর্ণে অস্পষ্ট কোলাহল মাত্র প্রবেশ করিতে লাগিল।
“রাজপুত্ত্রকে কেহ প্রাণে বধ করিও না, জীবিতাবস্থায় ব্যাঘ্রকে পিঞ্জরাবদ্ধ করিতে হইবে।” এই কথার পর আর কোন কথা রাজপুত্র শুনিতে পাইলেন না; ওস্মান খাঁ এই কথা বলিয়াছেন।
রাজপুত্রের বাহুযুগল শিথিল হইয়া লম্বমান হইয়া পড়িল; বলহীন মুষ্টি হইতে অসি ঝঞ্চনা-সহকারে ভূতলে পড়িয়া গেল; রাজপুত্রও বিচেতন হইয়া স্বকরনিহত এক পাঠানের মৃতদেহের উপর মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। বিংশতি পাঠান রাজপুত্ত্রের উষ্ণীষের রত্ন অপহরণ করিতে ধাবমান হইল। ওস্মান বজ্রগম্ভীরস্বরে কহিলেন,—“কেহ রাজপুত্ত্রকে স্পর্শ করিও না!”
সকলে বিরত হইল। ওস্মান থাঁ ও অপর একজন সৈনিক তাহাকে ধরাধরি করিয়া পালঙ্কের উপর উঠাইয়া শয়ন করাইলেন। জগৎসিংহ চারিদণ্ড পূর্ব্বে তিলব্ধি জন্য আশা করিয়াছিলেন যে, তিলােত্তমাকে বিবাহ করিয়া একদিন সেই পালঙ্কে তিলােত্তমার সহিত বিরাজ করিবেন,—সে পালঙ্ক তাহার মৃত্যু-শয্য়া-প্রায় হইল।
জগৎসিংহকে শয়ন করাইয়া ওস্মান খাঁ সৈনিকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “স্ত্রীলােকেরা কই?”
ওস্মান, বিমলা ও তিলােত্তমাকে দেখিতে পাইলেন না। দ্বিতীয়বার সেনা-প্রবাহ কক্ষ-মধ্যে প্রধাবিত হয়, তখন বিমলা ভবিষ্যৎ বুঝিতে পারিয়াছিলেন; উপায়ান্তরবিরহে পালঙ্কতলে তিলােত্তমাকে লইয়া লুক্কায়িত হইয়াছিলেন, কে তা দেখে নাই। ওস্মান তাহাদিগকে না দেখিতে পাইয়া কহিলেন, “স্ত্রীলােকেরা কোথায়, তােমরা তাবৎ দুর্গ মধ্যে অন্বেষণ কর। বাদী ভয়ানক বুদ্ধিমতী; সে যদি পলায়, তবে আমার মন নিশ্চিন্ত থাকিবেক না। কিন্তু সাবধান; বীরেন্দ্রের কন্যার প্রতি যেন কোন অত্যাচার না হয়।”
সেনাগণ কতক কতক দুর্গের অন্যান্য ভাগ অন্বেষণ করিতে গেল। দুই একজন কক্ষমধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিল। একজন অন্য একদিক দেখিয়া আলো লইয়া পালঙ্ক-তলমধ্যে দৃষ্টিপাত করিল। যাহা সন্ধান করিতেছিল, তাহা দেখিতে পাইয়া কহিল,—“এইখানেই আছে।”
ওস্মানের মুখ হর্ষপ্রফুল্ল হইল। কহিলেন,—“তোমরা বাহিরে আইস, কোন চিন্তা নাই।”
বিমলা অগ্রে বাহির হইয়া তিলোত্তমাকে বাহিরে আনিয়া বসাইছেন। তখন তিলোত্তমার চৈতন্য হইতেছে—বসিতে পারিতেন। ধীরে ধীরে বিমলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“আমরা কোথায় আসিয়াছি?”
বিমলা কাণে-কাণে কহিলেন, “কোন চিন্তা নাই, অবগুণ্ঠন দিয়া বসে।”
যে ব্যক্তি অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছিল, সে ওস্মানকে কহিল, “জুনাব। গোলাম খুঁজিয়া বাহির করিয়াছে।”
ওস্মান কহিলেন, “তুমি পুরস্কার প্রার্থনা করিতেছ? তোমার নাম কি?”
সে কহিল, “গোলামের নাম করিমবক্স, কিন্তু করিমবক্স বলিলে কেহ চেনে না। পূর্ব্বে আমি মোগল-সৈন্য ছিলাম। এজন্য সকলে রহস্যে আমাকে মোগল-সেনাপতি বলিয়া ডাকে।”
বিমলা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। অভিরামস্বামীর জ্যোতির্গণনা তাঁহার স্মরণ হইল।
ওস্মান কহিলেন,—“আচ্ছা স্মরণ থাকিবে।”