দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নবীন সেনাপতি

 শৈলেশ্বর-মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া, জগৎসিংহ পিতৃশিবিরে উপস্থিত হইলে পর, মহারাজ মানসিংহ পুত্ত্রপ্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশৎ সহস্র পাঠান-সেনা, ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির-সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রাম সকল লুঠ করিতেছে এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্ম্মাণ বা অধিকার করিয়া, তদাশ্রয়ে একপ্রকার নির্ব্বিঘ্নে আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুবৃত্তির আশু দমন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু এ কার্য্য অতি দুঃসাধ্য। কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণজন্য সমভিব্যাহারী সেনাপতিগণকে একত্র করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, “দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরগণা, দিল্লীশ্বরের হস্তস্খলিত হইতেছে, এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, কিন্তু কি প্রকারেই বা তাহাদিগের শাসন হয়? তাহারা আমাদিগের অপেক্ষা ও সংখ্যায় বলবান; তাহাতে আবার দুর্গশ্রেণীর আশ্রয়ে থাকিয়া যুদ্ধ করিবে; যুদ্ধে পরাজিত করিলেও তাহাদিগকে বিনষ্ট বা স্থানচ্যুত করিতে পারিব না; সহজেই দুর্গমধ্যে নিরাপদ হইতে পারিবে। কিন্তু সকলে বিবেচনা করিয়া দেখ, যদি রণে আমাদিগকে বিজিত হইতে হয়, তবে শত্রুর অধিকার-মধ্যে নিরাশ্রয়ে একেবারে বিনষ্ট হইতে হইবে। এরূপ অন্যায় সাহসে ভর করিয়া দিল্লীশ্বরের এত অধিক সেনানাশের সম্ভাবনা জন্মান, এবং উড়িষ্যাজয়ের আশা একেবারে লোপ করা, আমার বিবেচনায় অনুচিত হইতেছে; সৈদ খাঁর প্রতীক্ষা করাই উচিত হইতেছে; অথচ বৈরিশাসনের আশু কোন উপায় করা ও আবশ্যক হইতেছে। তোমরা কি পরামর্শ দাও?”

 বৃদ্ধ সেনাপতিগণ সকলে একমত হইয়া এই পরামর্শ স্থির করিলেন যে, আপাততঃ সৈদ খাঁর প্রতীক্ষায় থাকাই কর্ত্তব্য। রাজা মানসিংহ কহিলেন, “আমি অভিপ্রায় করিতেছি যে, সমুদায় সৈন্য-নাশের সম্ভাবনা না রাখিয়া, কেবল অল্পসংখ্যক সেনা কোন দক্ষ সেনাপতির সহিত শত্রুসমক্ষে প্রেরণ করি।”

 একজন প্রাচীন মোগল-সৈনিক কহিলেন, “মহারাজ! যথায় তাবৎ সেনা পাঠাইতেও আশঙ্কা, তথায় অল্পসংখ্যক সেনা দ্বারা কোন কার্য্য সাধন হইবেক?”

 মানসিংহ কহিলেন, “অল্প সেনা সম্মুখ রণে-অগ্রসর হইতে পাঠাইতে চাহিতেছি না। ক্ষুদ্র বল অস্পষ্ট থাকিয়া গ্রামপীড়নাসক্ত পাঠানদিগের সামান্য দল সকল কতক মনে রাখিতে পারিবেক।”

 তখন মোগল কহিল, “মহারাজ! নিশ্চিত কালগ্রাসে কোন্ সেনাপতি যাইবে?”

 মানসিংহ ভ্রুভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “কি? এই রাজপুত ও মোগলসেনামধ্যে মৃত্যুকে ভয় করে না এমন কি কেহই নাই?”

 এই কথা শ্রুতিমাত্র পাঁচ-সাত জন মোগল ও রাজপুত গাত্রোত্থান করিয়া কহিল, “মহারাজ! দাসেরা বাইতে প্রস্তুত আছে।” জগৎসিংহ ও তথায় উপস্থিত ছিলেন; তিনি সর্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ; সকলের পশ্চাতে থাকিয়া কহিলেন, “অনুমতি হইলে, এ দাসও দিল্লীশ্বরের কার্য্যসাধনে যত্ন করে।”

 রাজা মানসিংহ সস্মিত-বদনে কহিলেন, “না হবে কেন? আজ জানিলাম যে, মোগল-রাজপুত-নাম-লোপের বিলম্ব আছে। তোমরা সকলেই এ দুষ্কর কার্য্যে প্রস্তুত, এখন কাহাকে রাখিয়া কাহাকে পাঠাই?”

 একজন পারিষদ সহাস্যে কহিল, “মহারাজ! অনেকে যে এ কার্য্যে উদ্যত হইয়াছেন, সে ভালই হইয়াছে। এই উপলক্ষে সেনাব্যয়ের অল্পতা করিতে পারিবেন। যিনি সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র সেনা লইয়া যাইতে স্বীকৃত হয়েন, তাঁহাকেই রাজ-কার্য্য-সাপনের ভার দিউন।”

 রাজা কহিলেন, “এ উত্তম পরামর্শ।” পরে প্রথম উদ্যমকারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কত সংখাক সেনা লইয়া যাইতে ইচ্ছা কর।”

 সেনাপতি কহিলেন, “পঞ্চদশ সহস্র পদাতিবলে রাজকার্য্য উদ্ধার করিব।”

 রাজা কহিলেন, “এ শিবির হতে পঞ্চদশ সহস্র ভয় করিলে অধিক থাকে না। কোন্ বীর দশ সহস্র লইয়া যুদ্ধে যাত্রা করিতে চাহে?”

 সেনাপতিগণ নীরব রহিলেন। পরিশেষে রাজার প্রিয়পাত্র যশোবন্ত সিংহ নামক রাজপুত যোদ্ধা রাজাদেশ পালন করিতে অনুমতি প্রার্থিত হইলেন। রাজা হৃষ্টচিত্তে সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। কুমার জগৎসিংহ তাঁহার দৃষ্টি-অভিলাষী হইয়া দাঁড়াইলেন, তৎপ্রতি রাজার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র তিনি বিনীতভাবে কহিলেন,—

 “মহারাজ! রাজপ্রসাদ হইলে, এ দাস পঞ্চ-সহস্র-সহায়ে কতলু খাঁকে সুবর্ণরেখা-পারে রাখিয়া আইসে।”

 রাজা মানসিংহ অবাক্ হইবেন। সেনাপতিগণ কানাকানি করিতে লাগিলেন। ক্ষণেক পারে রাজা কহিলন,—“পূত্ত্র! আমি জানি যে, তুমি রাজপুতকূলের গরিমা; কিন্তু তুমি অন্যায় সাহস করিতেছ।”

 জগৎসিংহ বদ্ধাঞ্জলি হইয়া কহিলেন,—“যদি প্রতিজ্ঞাপালন না করি। বাদসাহের সেনাবল অপচয় করি, তবে রাজদণ্ডে দণ্ডনীয় হইব।”

 রাজা মানসিংহ কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমি তোমার রাজপুতকূলধর্ম্ম-প্রতিপালনের ব্যাঘাত করিব না; তুমিই এ কার্যে যাত্রা কর।”

 এই বলিয়া রাজকুমারকে বাষ্পাকুললোচনে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া বিদায় করিলেন। সেনাপতিগণ স্ব স্ব শিবিরে গেলেন।