দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
গড়-মান্দারণ
যে পথে বিষ্ণুপুর প্রদেশ হইতে জগৎসিংহ জাহানাবাদে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, সেই পথের চিহ্ন অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। তাহার কিঞ্চিৎ দক্ষিণে মান্দারণ গ্রাম। মান্দারণ এক্ষণে ক্ষুদ্র গ্রাম, কিন্তু তৎকালে ইহা সৌষ্ঠবশালী নগর ছিল। যে রমণীদিগের সহিত জগৎসিংহের মন্দিরমধ্যে সাক্ষাৎ হয়, তাঁহারা মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া এই গ্রামাভিমুখে গমন করেন।
গড়-মান্দারণে কয়েকটি প্রাচীন দুর্গ ছিল, এই জন্যই তাহার নাম গড়-মান্দারণ হইয়া থাকিবে। নগর-মধ্যে আমোদর নদী প্রবাহিত; এক-স্থানে নদীর গতি এতাদৃশ বক্রতা প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তদ্দ্বারা পার্শ্বস্থ এক খণ্ড ত্রিকোণ ভূমির দুই দিক্ বেষ্টিত হইয়াছিল; তৃতীয় দিকে মানবহস্ত-নিখাত এক গড় ছিল; এই ত্রিকোণ ভূমিখণ্ডের অগ্রদেশে যথায় নদীর বক্রগতি আরম্ভ হইয়াছে, তথায় এক বৃহৎ দুর্গ জল হইতে আকাশ-পথে উত্থান করিয়া বিরাজমান ছিল। অট্টালিকা আমূলশিরঃ কৃষ্ণপ্রস্তর-নির্ম্মিত; দুইদিকে প্রবল নদী-প্রবাহ দুর্গমূল প্রহত করিত। অদ্যাপি পর্য্যাটক গড়-মান্দারণ গ্রামে এই আয়াসলঙ্ঘ্য দুর্গের বিশাল স্তূপ দেখিতে পাইবেন। দুর্গের নিম্নভাগমাত্র এক্ষণে বর্ত্তমান আছে; অট্টালিকা কালের করাল স্পর্শে ধূলিরাশি হইয়া গিয়াছে; তদুপরি তিন্তিড়ী, মাধবী প্রভৃতি বৃক্ষ ও লতা সকল কাননাকারে বহুদূর ভুজঙ্গ-ভল্লুকাদি হিংস্র পশুগণকে আশ্রয় দিতেছে। নদীপারে অপর কয়েকটা দুর্গ ছিল।
বাঙ্গালার পাঠান সম্রাট্দিগের শিরোভূষণ হোসেন সাহার বিখ্যাত সেনাপতি ইস্মাইল গাজি এই দুর্গ নির্ম্মাণ করেন। কিন্তু কালক্রমে জয়ধর সিংহ নামে একজন হিন্দু সৈনিক ইহা জায়গীর পান। এক্ষণে বীরেন্দ্রসিংহনামা জয়ধর সিংহের একজন উত্তরপুরুষ এখানে বসতি করিতেন।
যৌবনকালে বীরেন্দ্রসিংহের পিতার সহিত সম্প্রীতি ছিল না। বীরেন্দ্রসিংহ স্বভাবতঃ দাম্ভিক এবং অধীর ছিলেন, পিতার আদেশ কদাচিৎ প্রতিপালন করিতেন, এজন্য পিতাপুত্ত্রে সর্ব্বদা বিবাদ বচসা হইত। পুত্ত্রের বিবাহার্থ বৃদ্ধ ভূস্বামী নিকটস্থ স্বজাতীয় অপর কোন ভূস্বামি-কন্যার সহিত সম্বন্ধ স্থির করিলেন। কন্যার পিতা পুত্রহীন, এজন্য এই বিবাহে বীরেন্দ্রের সম্পত্তি-বৃদ্ধির সম্ভাবনা; কন্যাও সুন্দরী বটে, সুতরাং এমত সম্বন্ধ বৃদ্ধের বিবেচনায় অতি আদরণীয় বোধ হইল; তিনি বিবাহের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বীরেন্দ্র সে সম্বন্ধে আদর না করিয়া নিজ পল্লীস্থ এক পতিপুত্রহীনা দরিদ্রা রমণীর দুহিতাকে গোপনে বিবাহ করিয়া, আবার বিবাহ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। বৃদ্ধ রোষপরবশ হইয়া পুত্রকে গৃহ-বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন; যুবা পিতৃগৃহ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া যোদ্ধৃবৃত্তি অবলম্বন করণাশয়ে দিল্লী যাত্রা করিলেন। তাঁহার সহধর্ম্মিণী তৎকালে অন্তঃসত্ত্বা, এজন্য তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতে পারিলেন না। তিনি মাতৃকুটীরে রহিলেন।
এদিকে পুত্ত্র দেশান্তরে যাইলে পর, বৃদ্ধ ভূস্বামীর অন্তঃকরণে পুত্ত্রবিচ্ছেদে মনঃপীড়ার সঞ্চার হইতে লাগিল, গতানুশোচনার পরবশ হইয়া পুত্রের সংবাদ আনয়নে যত্নবান্ হইলেন; কিন্তু যত্নে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। পুত্ত্রকে পুনরানয়ন করিতে না পারিয়া, তৎপরিবর্ত্তে পুত্ত্রবধূকে দরিদ্রার গৃহ হইতে সাদরে নিজালয়ে আনিলেন। উপযুক্ত কালে বীরেন্দ্রসিংহের পত্নী এক কন্যা প্রসব করিলেন। কিছুদিন পরে কন্যার প্রসূতির পরলোক-প্রাপ্তি হইল।
বীরেন্দ্র দিল্লীতে উপনীত হইয়া মোগল-সম্রাটের আজ্ঞাকারী রাজপুত সেনামধ্যে যোদ্ধৃত্বে বৃত হইলেন; অল্পকালে নিজগুণে উচ্চপদস্থ হইতে পারিলেন। বীরেন্দ্রসিংহ কয়েক বৎসর ধন ও যশঃসঞ্চয় করিয়া পিতার লোকান্তর-সংবাদ পাইলেন। আর এক্ষণে বিদেশ-পর্য্যটন বা পরাধীন-বৃত্তি নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। বীরেন্দ্রের সহিত দিল্লী হইতে অনেকানেক সহচর আসিয়াছিল। তন্মধ্যে জনৈক পরিচারিকা আর এক পরমহংস ছিলেন। এই আখ্যায়িকায় এই দুই জনের পরিচয় আবশ্যক হইবেক। পরিচারিকার নাম বিমলা, পরমহংসের নাম অভিরাম স্বামী।
বিমলা গৃহমধ্যে গৃহকর্ম্মে, বিশেষতঃ বীরেন্দ্রর কন্যার লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত থাকিতেন, তদ্ব্যতীত দুর্গমধ্যে বিমলার অবস্থিতি করার অন্য কারণ লক্ষিত হইত না; সুতরাং তাঁহাকে দাসী বলিতে বাধ্য হইয়াছি; কিন্তু বিমলাতে দাসীর লক্ষণ কিছুই ছিল না। গৃহিণী যাদৃশী মান্যা, বিমলা পৌরগণের নিকটে প্রায় তাদৃশী মান্যা ছিলেন; পৌরজন সকলেই তাঁহার বাধ্য ছিল। মুখশ্রী দেখিলে, বোধ হইত যে, বিমলা যৌবনে পরমা সুন্দরী ছিলেন। প্রভাতে চন্দ্রাস্তের ন্যায় সে রূপের প্রতিভা এ বয়সেও ছিল। গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ নামে অভিরাম স্বামীর একজন শিষ্য ছিলেন; তাঁহার অলঙ্কার-শাস্ত্রে যত ব্যুৎপত্তি থাকুক বা না থাকুক, রসিকতা প্রকাশ করার তৃষ্ণাটা বড় প্রবল ছিল। তিনি বিমলাকে দেখিয়া বলিতেন, “দাই যেন ভাণ্ডস্থ ঘৃত; মদন-আগুন যত শীতল হইতেছে, দেহখানি ততই জমাট বাধিতেছে।” এইখানে বলা উচিত, যেদিন গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ এইরূপ রসিকতা করিয়া ফেলিলেন, সেই দিন অবধি বিমলা তাঁহার নাম রাখিলেন—‘রসিকরাজ রসোপাধ্যায়।”
আকারেঙ্গিত ব্যতীত বিমলার সভ্যতা ও বাগ্-বৈদগ্ধ্য এমন প্রসিদ্ধ ছিল যে, তাহা সামান্যা পরিচারিকার সম্ভবে না। অনেকে এরূপ বলিতেন যে, বিমলা বহুকাল মোগল-সম্রাটের পুরবাসিনী ছিলেন; একথা সত্য কি মিথ্যা, তাহা বিমলাই জানিতেন, কিন্তু কখন সে বিষয়ের কোন প্রসঙ্গ করিতেন না।
বিমলা, বিধবা কি সধবা? কে জানে? তিনি অলঙ্কার পরিতেন, একাদশী করিতেন না। সধবার ন্যায় আচরণ করিতেন।
দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমাকে বিমলা যে আন্তরিক স্নেহ করিতেন, তাহার পরিচয় মন্দিরমধ্যে দেওয়া গিয়াছে। তিলোত্তমাও বিমলার তদ্রূপ অনুরাগিণী ছিলেন। বীরেন্দ্রসিংহের অপর সমভিব্যাহারী অভিরাম স্বামী সর্ব্বদা দুর্গমধ্যে থাকিতেন না। মধ্যে মধ্যে দেশপর্য্যটনে গমন করিতেন; দুই এক মাস গড়মান্দারণে, দুই একমাস বিদেশ-পরিভ্রমণে যাপন করিতেন। পুরবাসী ও অপরাপর লোকের এইরূপ প্রতীতি ছিল যে, অভিরাম স্বামী বীরেন্দ্রসিংহের দীক্ষাগুরু; বীরেন্দ্রসিংহ তাঁহাকে যেরূপ সম্মান এবং আদর করিতেন, তাহাতে সেইরূপই সম্ভাবনা। এমন কি, সাংসারিক যাবতীয় কার্য্য অভিরাম স্বামীর পরামর্শ ব্যতীত করিতেন না, ও গুরুদত্ত পরামর্শও সতত প্রায় সফল হইত। বস্তুতঃ অভিরাম স্বামী বহুদর্শী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন; আরও নিজ ব্রতধর্ম্মে সাংসারিক অধিকাংশ বিষয়ে রিপুসংযম করা অভ্যাস করিয়াছিলেন; প্রয়োজনমতে রাগক্ষোভাদি দমন করিয়া স্থিরচিত্তে বিষয়ালোচনা করিতে পারিতেন। সে স্থলে যে অধীর দাম্ভিক বীরেন্দ্রসিংহের অভিসন্ধি অপেক্ষা তাঁহার পরামর্শ ফলপ্রদ হইবে, আশ্চর্য্য কি?
বিমলা ও অভিরাম স্বামীর আশ্মানি নাম্নী একজন দাসী বীরেন্দ্রসিংহের সঙ্গে আসিয়াছিল।