দুর্নীতির পথে/বিষয় প্রবেশ
দুর্নীতির পথে
-:.:—
প্রথম অধ্যায়
বিষয় প্রবেশ
কৃত্রিম উপায়ে সন্তানবৃদ্ধি বন্ধ করা সম্বন্ধে যেসব লেখা দেশী সংবাদ পত্রে বাহির হইতেছে, তাহা কাটিয়া সহৃদয় বন্ধুগণ আমার নিকট পাঠাইতেছেন। যুবকদের সহিত তাহাদের চরিত্র সম্বন্ধে অনেক পত্রব্যবহার আমি করিতেছি। পত্রলেখকগণ যেসব প্রশ্ন তুলিয়াছেন, আমি তার অতি অল্প কয়েকটির আলোচনা এখানে করিতে পারিব। আমেরিকার বন্ধুগণ আমার নিকট এ সম্বন্ধীয় সাহিত্য পাঠাইতেছেন এবং কৃত্রিম উপায়ের বিরুদ্ধে মত দিয়াছি বলিয়া কেহ কেহ আমার উপর চটিয়াছেন। তাহারা দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন, আমার ন্যায় নানা বিষয়ে উন্নত সংস্কারকের জন্ম-নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে সেকেলে ধারণা থাকা ঠিক নহে। ইহাও দেখিতেছি যে, কৃত্রিম উপায়ের পক্ষপাতী লোকের ভিতর সব দেশের কতকগুলি চিন্তাশীল নর-নারীও আছেন।
এসব দেখিয়া মনে হইল, কৃত্রিম উপায়ে সন্ততিনিরোধের পক্ষে নিশ্চয়ই কিছু জোরের যুক্তি আছে এবং এ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা অপেক্ষা কিছু বেশী বলিতে হইবে। যখন আমি এই সমস্যার কথা ও এই বিষয় সম্বন্ধীয় পুস্তক পাঠকরার কথা ভাবিতেছিলাম, তখন একখানা ইংরেজী বই আমার হাতে পড়ে। ইহাতে সুন্দররূপে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক ইহাই আলোচিত হইয়াছে। মূল গ্রন্থখানি মুক্ত পালবুরো নামক এক ব্যক্তি ফরাসী ভাষায় লিখিয়াছেন। বইটির নাম ‘ভ্রষ্টাচার'।
এই বই পড়িয়া মনে হইল, গ্রন্থকারের অভিমত সংক্ষেপে প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে, কৃত্রিম উপায় সমর্থন করিয়া যেসব বই প্রকাশিত হইয়াছে তার ভিতর হইতে প্রধান প্রধান বই পড়িতে হইবে। এ জন্য ‘ভারত সেবক সমিতি’র (Servants of India Society) নিকট যে সব বই ছিল তাহা আনিয়া পড়িলাম। কাকা কালেলকর ইহা আলোচনা করিতেছিলেন। তিনি আমাকে হ্যাভলক্ এলিসের একখানা বই দিয়াছেন এবং একজন বন্ধু ‘দি প্রাকটিশনার’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা দিয়াছেন—এই সংখ্যায় বিখ্যাত চিকিৎসকদের অভিমত সংগৃহীত হইয়াছে।
শ্রীযুক্ত বুরোর সিদ্ধান্তের সত্যতা পরীক্ষার জন্য, যাহারা চিকিৎসক নহেন তাহাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, আমি এই বিষয়ের সাহিত্য সংগ্রহ করিতে ততটা চেষ্টা করিয়াছি। বৈজ্ঞানিকদের ভিতর কোনো প্রশ্ন লইয়া আলোচনা হইলে প্রায়ই দেখা যায় যে, ইহার দুটি দিক আছে এবং দু’দিকেই যথেষ্ট বলার আছে। এ জন্য বুরোর গ্রন্থ পাঠকদের নিকট উপস্থিত করার পূর্বে কৃত্রিম উপায়ের পক্ষপাতীদের সমস্ত যুক্তি জানার ইচ্ছা হইয়াছিল। অনেক চিন্তার পর আমি এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌছিয়াছি যে, অন্ততঃ পক্ষে ভারতবর্ষে কৃত্রিম উপায় প্রবর্ত্তনের কোনো প্রয়োজন নাই। যাহারা ভারতে ইহা প্রচার করিতে চাহেন, তাহারা হয় ভারতের প্রকৃত অবস্থা জানেন না, না হয় জানিয়াও তাহা গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু যদি প্রমাণ করা যায় যে, কৃত্রিম উপায় পাশ্চাত্য দেশেরও অনিষ্টকর, তবে ভারত সম্বন্ধে ইহা আলোচনা করা দরকার হইবে না।
দেখা যাক্, বুরো কি বলেন। তিনি ফ্রান্স্, সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু ইহা আমাদের পক্ষে যথেষ্ট, কারণ ফ্রান্সের অর্থ অনেক। ইহা পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ। যদি ফরাসী দেশে এই প্রণালী সফল না হইয়া থাকে, তবে ইহা কোথায় সফল হইবে?
‘অসফলতার’ অর্থ লইয়া মতভেদ হইতে পারে। সে জন্য এখানে যে অর্থে ইহা ব্যবহার করিয়াছি তাহা বলিব। যদি প্রমাণ করা যায় যে, কৃত্রিম উপায় অবলম্বনের ফলে লোকের নীতিজ্ঞান শিথিল হইয়াছে, ব্যভিচার বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং স্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক কারণে গভনিরোধের জন্য ইহার ব্যবহার না করিয়া শুধু পাশববৃত্তি চরিতার্থ করার অন্য লোকে ইহার আশ্রয় লইতেছে, তবে নিশ্চয়ই বুঝান হইবে যে, এই প্রণালী অকৃতকার্য হইয়াছে। কৃত্রিম উপায়ে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ করা মধ্যম পন্থা। উৎকৃষ্ট নৈতিক সিদ্ধান্ত অনুসারে কৃত্রিম উপায়ে সন্তাননিয়ন্ত্রণ করা সর্ব্বাবস্থায় দোষনীয়। যেমন শরীর রক্ষার উদ্দেশ্য ভিন্ন নর-নারীর আহার করা উচিত নহে, তেমনি সন্তান লাভের উদ্দেশ্য ভিন্ন কামেন্দ্রিয় চরিতার্থ করার প্রয়োজন নাই। তৃতীয় আর এক শ্রেণীর লোক আছে। তাহারা বলে, ‘নীতি বলিয়া কোনো কিছু নাই, থাকিলেও ইহার অর্থ সংযম নহে; ইহার অর্থ খুব বিষয়ভোগ করা; ইন্দ্রিয়সেবাই জীবনের উদ্দেশ্য; একটু নজর রাখিতে হইবে ইন্দ্রিয়সেবা করিতে করিতে শরীর নষ্ট না হয়, কারণ ইহাতে ভোগে ব্যাঘাত পড়িবে।’ এইরূপ উৎকট ভোগপন্থী লোকের জন্য বুরো তাহার পুস্তক লেখেন নাই, কারণ বুরো টম্ম্যানের যে কথাটি উদ্ধৃত করিয়া তাহার পুস্তক শেষ করিয়াছেন তাহা এই “যাহারা সংযমী ভবিষ্যৎ সেই সব জাতির হাতে।”
পুস্তকের প্রথম ভাগে শ্রীযুক্ত বুরো যে সব ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা পড়িলে অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠে। মানুষের পাশববৃত্তির খোরাক যোগাইবার জন্য ফরাসী দেশে কিরূপ বিরাট প্রতিষ্ঠান সকল গড়িয়া উঠিয়াছে তাহার কথা ইহাতে আছে। কৃত্রিম উপায় সমর্থনকারীদের সর্ব্বাপেক্ষা বড় যুক্তি এই যে, ইহার দ্বারা গর্ভপাত ও দ্রুণহত্যা বন্ধ হয়। তাহাদের এ কথাও ঠিক নহে। শ্রীযুক্ত বুরো বলেন, ‘গত পচিশ বৎসর ধরিয়া ফরাসী দেশে গর্ভ-নিরোধের জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা সত্ত্বে, সেখানে অপরাধমূলক গর্ভপাতের সংখ্যা কমে নাই, বরং ইহা বাড়িতেছে। ফ্রান্সে বৎসরে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার হইতে ৩ লক্ষ ২৫ হাজার পর্যন্ত গর্ভপাত হইয়া থাকে। দুঃখের বিষয়, পূর্ব্বে সাধারণে ইহাকে যেরূপ ভীতির চোখে দেখিত, এখন তা দেখে না।’