দুর্নীতির পথে/অবিবাহিতদের ভিতর ভ্রষ্টাচার

দ্বিতীয় অধ্যায়

অবিবাহিতদের ভিতর ভ্রষ্টাচার

শ্রীযুক্ত বুরো বলেন, “গর্ভপাতের সহিত শিশু হত্যা, ব্যভিচার এবং এইরূপ আরও অনেক পাপ বাড়িয়াছে। এ সব শুনিলে ছাতি ফাটিয়া যায়। শিশুহত্যা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলিবার নাই, তবু এইটুকু বলিব, অবিবাহিত মাতাদের গর্ভ-নিরোধ ও গর্ভপাতের নানা সুবিধা দেওয়া সত্বে, শিশুহত্যা অপরাধ পূর্ব্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহাতে তথাকথিত সম্মানী লোকদের মনে দণ্ড দেওয়া অথবা ভর্ৎসনা করার কথা জাগে না এবং আদালত হইতে এই সব ব্যাপারে প্রায়ই বেকসুর খালাস রায় দেওয়া হইয়া থাকে।”

 অশ্লীল সাহিত্যের প্রচার কিরূপ বৃদ্ধি পাইয়াছে, বুরো এক অধ্যায়ে শুধু তাহাই আলোচনা করিয়াছেন। সাহিত্য, নাটক ও চিত্রাদি লোকের মানসিক আনন্দ ও স্বাস্থ্য দান করিবে। কিন্তু অশ্লীল সাহিত্য ও চিত্রাদি বিক্রয় করিয়া অর্থশোষণের উদ্দেশ্যেই অনেকগুলি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সর্ব্বত্র এই সাহিত্যের চাহিদা আছে, ইহা বিক্রয় হইতেছে এবং ইহার চর্চ্চা হইতেছে। খুব বুদ্ধিমান লোকে এই সাহিত্য-ব্যবসায় করিতেছে এবং কোটি কোটি টাকা এই কারবারে খাটিতেছে। লোকের মনের উপর এই সাহিত্যের ভয়ানক বিষাক্ত প্রভাব পড়িয়াছে। এই সব পুস্তক পাঠ করার সময় তাহারা মনে মনে এক নূতন ব্যভিচারী দুনিয়া ভোগ করে—এই সাহিত্যই সেই কল্পনারাজ্য সৃষ্টির মূলে আছে।  তারপর বুরো রুইসনের করুণাপূর্ণ এক লেখা উদ্ধৃত করিয়াছেন:—

 “এই সব অশ্লীল সাহিত্য লোকের মহা অনিষ্ট সাধন করে। ইহার বিক্রয়াধিক্য দেখিয়া বলা যায় যে, লক্ষ লক্ষ লোকে এগুলি পড়ে। পাগলাগারদের বাহিরেও কোটি কোটি পাগল বাস করে। পাগল যেরূপ তাহার এক নিরালা দুনিয়ায় বাস করে, এই সব বই পড়ার সময় লোকে সেইরূপ এক নৃতন দুনিয়ায় বাস করে এবং তখন জগতের কথা তাহাদের মনে হয় না। অশ্লীল সাহিত্যের পাঠকগণ কল্পনার সাহায্যে ইন্দ্রিয়-ভোগের স্বপ্ন-রাজ্যে বাস করে এবং নিজেদের কর্তব্য ভুলিয়া যায়।”

 ইহার একমাত্র কারণ লোকের এই ধারণা আছে যে, ইন্দ্রিয়সেবা করা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং বিষয়-ভোগ না করিলে মানুষের পূর্ণ বিকাশ হইতে পারে না। যখন এরূপ ধারণা কোনো লোককে পাইয়া বসে, তখন তাহার সব চিন্তার ধারা উল্টাইয়া যায়। যাহাকে সে এককালে পাপ মনে করিত, তাহাকে সে পুণ্য মনে করে এবং নিজের পাশববৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবন করে।

 কিরূপে দৈনিক সংবাদ-পত্র, মাসিক পত্রিকা, উপন্যাস, চিত্র ও নাট্যশালা প্রভৃতি এই মনুষ্যত্ব-নষ্টকারী রুচির থোরাক ক্রমবর্দ্ধমান ভাবে যোগাইতেছে তাহা তিনি বিশেষ প্রমাণ প্রয়োগে দেখাইয়াছেন।

 অবিবাহিতদের মধ্যে যে নৈতিক অধঃপতন হইয়াছে, তাহা বলার পর শ্রীযুক্ত বুরো বিবাহিত জীবনের ভ্রষ্টাচার সম্বন্ধে লিখিয়াছেন। তিনি বলেন, “সম্ভ্রান্ত শ্রেণী, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও কৃষকদের অধিকাংশ বিবাহের মূলে আছে বৃথা অভিমান, চাকুরী অথবা সম্পত্তির লোভ, বৃদ্ধ বয়সে অথবা অসুখের সময় দেখাশুনার জন্য একজন লোকের বন্দোবস্ত করিয়া রাখা, বাধ্যতামূলক সৈন্যসংগ্রহের সময় নিজের স্থলে আর একজনকে (পুত্রকে) সৈন্যদলে ভর্ত্তি করার সুবিধা পাওয়ার আশা, অথবা এইরূপ অপর কোনো স্বার্থ-চিন্তা। যে পাপ-পথে চলিতে চলিতে তাহারা ক্লান্ত হইয়া পড়ে, তার পরিবর্ত্তে নূতন রকমে ইন্দ্রিয়ভোগ করার জন্যও তাহারা বিবাহ করে।

 শ্রীযুক্ত বুরো তার পর হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, এই সব বিবাহের ফলে ব্যভিচার কমে নাই বরং বাড়িয়াছে। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এই অধঃপতনের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে—এই আবিষ্কারের উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয়পরায়ণতা রোধ করা নহে, ইহার উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তির ফল এড়ান। যে অধ্যায়ে পরস্ত্রীগমন ও তালাকের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা আছে, সে অধ্যায় সম্বন্ধে এখন কিছু বলিব না— গত ২০ বৎসরে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশী বাড়িয়াছে। ‘পুরুষের সমান অধিকার নারীর থাকা চাই’ এই কথা বলিয়া যাহারা নারীকে ইন্দ্রিয়সেবার স্বাধীনতা দিবার পক্ষপাতী, আমি তাহাদিগকে কিছু বলিব। গর্ভ-নিরোধ এবং গর্ভপাত করিবার জন্য যে সব তথাকথিত উন্নত প্রণালী আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা স্ত্রী-পুরুষ সকলকে সব রকম নৈতিক বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়াছে। এ জন্য বিবাহের কথায় লোকে যদি হাসে, তবে ইহাতে বিস্ময়ের কি আছে? বুরো এক জনপ্রিয় লেখকের এই লেখা উদ্ধৃত করিয়াছেন:— “আমার মতে বিবাহপ্রথা বর্ব্বরতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক। যখন মানুষ আরও ন্যায়পরায়ণ ও বুদ্ধিমান হইবে তখন তাহারা এই কুপ্রথা নিশ্চয়ই লোপ করিবে। *** কিন্তু পুরুষ এত মূর্থ এবং নারী এত ভীরু যে কোনো মহান আদর্শের জন্য তাহারা উৎসাহের সহিত কিছু করিতে চায় না।”

 যে সব প্রণালীর কথা বুরো উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার ফল এবং যে যুক্তির দ্বারা এই সব প্রণালী সমর্থন করা হয়, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সে সব পরীক্ষা করার পর বুরো বলিতেছেন:—“এই ভ্রষ্টাচার আমাদিগকে এক নৃতন দিকে লইয়া যাইতেছে। সে কোন্ দিক? আমাদের ভবিষ্যৎ আলোকময়, না অন্ধকারময়? আমরা উন্নত হইব, না অবনত হইব? আমরা আত্মার সৌন্দর্য্য দেখিতে পাইব, না কদর্য্যতা এবং পশুত্বের ভয়ানক মূর্ত্তি দেখিব? বিপ্লব তো ছড়াইয়া পড়িতেছে। যে বিপ্লব দেশ ও জাতির উত্থানের পূর্ব্বে সময় সময় দেখা দেয়, যার ভিতর উন্নতির বীজ নিহিত থাকে, ইহা কি সেই বিপ্লব? ভবিষ্যৎ বংশীয়দের উন্নতির জন্য ইহা যথাকালে সংঘটিত হইয়াছিল বলিয়া কি তাহারা কৃতজ্ঞতার সহিত এই বিপ্লবকে স্মরণ করিবে? না, আদি মানবের সেই পশুভাব আমাদের মধ্যে জাগিয়া উঠিতেছে এবং ইহা দমন করিতে হইলে কঠোর নিয়ম পালন করা দরকার? এরূপে কি আমরা শান্তি নষ্ট ও জীবন বিপন্ন করিতেছি না?”

 বুরো অনেক প্রমাণ প্রয়োগে দেখাইয়াছেন, এই সব মত প্রচারের ফলে আজ পর্য্যন্ত সমাজের মহান অনিষ্ট সাধিত হইয়াছে। এ সব দুরাচার জীবন পর্যন্ত লইয়া টানাটানি আরম্ভ করিয়াছে।