দুর্নীতির পথে/বিবাহিত জীবনে ভ্রষ্টাচার

তৃতীয় অধ্যায়

বিবাহিত জীবনে ভ্রষ্টাচার

আত্ম-সংযম দ্বারা বিবাহিত লোকে সন্তান-নিগ্রহ করে সে এক কথা, আর ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তি করিয়া ইহার ফল এড়াইবার জন্য তাহারা যদি অন্য উপায় অবলম্বন করে, তবে সে স্বতন্ত্র কথা। প্রথমোক্ত উপায়ে লোকে সব রকমে লাভবান হয়; দ্বিতীয়টির দ্বারা তাহাদের ক্ষতি ভিন্ন আর কিছুই হয় না। শ্রীযুক্ত বুরো মানচিত্র এবং অঙ্কের সাহায্যে দেখাইয়াছেন যে, অবাধ ইন্দ্রিয়-সেবা করা এবং ইহার স্বাভাবিক ফল সন্তান-জন্ম বন্ধ করার উদ্দেশ্যে গর্ভনিরোধ-যন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ফলে শুধু পেরিসে নহে, সমগ্র ফরাসী দেশে মৃত্যুহার অপেক্ষা জন্ম হার কমিয়াছে। ফরাসী দেশ ৮৭টী ক্ষুদ্র জেলায় বিভক্ত, ইহার ৬৮টি জেলায় জন্ম অপেক্ষা মৃত্যু-সংখ্যা বেশী। লট জেলায় জন্ম-হার ১০০ স্থলে মৃত্যুহার ১৬৮; টার্নগরী জেলায় জন্ম-সংখ্যা ১০০ শুলে মৃত্যু-সংখ্যা ১৫৬। এমন কি যে উনিশটি জেলায় মৃত্যু-সংখ্যা অপেক্ষা জন্ম সংখ্যা বেশী, সে সব যায়গার অধিকাংশ স্থলের এই বৃদ্ধি ধর্তব্য নহে। শুধু দশটি জেলায় এই বৃদ্ধি সুস্পষ্ট। মোরবিহান ও পাস-ডি-কালে জেলায় মৃত্যুহার সর্বাপেক্ষা কম—১০০ জন্ম স্থলে মৃত্যুহার ৭৭। বুরো দেখাইয়াছেন এইরূপে আত্মহত্যা দ্বারা দেশকে জনশূন্য করা এখনও বন্ধ করা হয় নাই।

বুরো তার পর ফরাসী দেশের প্রত্যেক স্থানের অবস্থার খুঁটিনাটি বিচার করিয়াছেন এবং নর‍্ম্যাণ্ডী সম্বন্ধে ১৯১৪ সালে লেখা এক বই হইতে নীচের অংশটি উদ্ধৃত করিয়াছেন:—‘গত ৫০ বৎসরে নর‍্ম্যাণ্ডীর লোক সংখ্যা তিন লক্ষ কমিয়াছে; ইহার অর্থ এই সমগ্র ওর্ন জেলায় যত লোক আছে, নরম্যাণ্ডীর তত লোক কমিয়াছে। ফরাসী দেশ পাঁচটি সুবায় বিভক্ত, এক সুবায় যত লোক আছে, প্রতি বিশ বৎসরে তত লোক কমিতেছে। মৃত্যুহার এইভাবে থাকিলে ফ্রান্সের উর্ব্বর শস্যশ্যামল ক্ষেত্র এক শত বৎসরে ফরাসীশূন্য হইবে। আমি ইচ্ছা করিয়া ‘ফরাসীশূন্য’ শব্দটি ব্যবহার করিলাম, কারণ নিশ্চয়ই অন্য দেশের লোক আসিয়া সেখানে বসতি করিবে; ইহার অন্যথা হইলে বলিতে হইবে অবস্থা আরও শোচনীয়। কেনের চারি পাশে যে সব লোহার খনি আছে, সেখানে জার্মান শ্রমিকগণ কাজ করে; এবং যেখান হইতে বিজয়ী উইলিয়ম[] জাহাজে চড়িয়া ইংলণ্ড যাত্রা করিয়াছিলেন, গত কল্য ঠিক সেখানে সর্ব্বপ্রথম একদল চীনা মজুর নামিয়াছে।’ বুরো লিথিয়াছেন, অন্যান্য বহু প্রদেশের অবস্থা ইহা অপেক্ষা ভাল নহে।

 তিনি পরে দেখাইয়াছেন জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে ফরাসী জাতির সামরিক শক্তি কমিয়াছে। তাহার বিশ্বাস, একই কারণে ফ্রান্স হইতে কম লোকে বিদেশে বাস করিতে যাইতেছে এবং ফরাসী জাতির উপনিবেশ, ভাষা ও সভ্যতার বিস্তার না হইয়া অবনতি হইতেছে।

 বুরো প্রশ্ন করিয়াছেন, ‘প্রাচীনকালের সংযম অগ্রাহ্য করিয়া ফরাসী জাতি কি বেশী সুখ, পার্থিব সম্পদ, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং কৃষ্টির অধিকারী হইয়াছে?’ উত্তরে তিনি বলিতেছেন, ‘স্বাস্থ্যোন্নতি সম্বন্ধে অল্প কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে। সব রকম আপত্তির বিরুদ্ধে সুন্দর ভাবে উত্তর দিবার ইচ্ছা আমাদের যতই প্রবল হউক না কেন, যখন এ কথা বলা হয় যে, অবাধ ইন্দ্রিয়সেবা শরীরকে সুস্থ ও সবল করে, তখন তাহা বিশ্বাস করা যায় না। চারিদিক হইতে শুনা যাইতেছে যে যুবক ও বয়স্কদের তেজোবীর্য্য কমিয়া যাইতেছে। যুদ্ধের পূর্ব্বে সৈন্য বিভাগের কর্ত্তাদিগকে নূতন সৈন্য সংগ্রহের সময় শারীরিক যোগ্যতার সর্ত্ত কয়েকবার ঢিলা করিতে হইয়াছিল। জাতির সহনশীলতা সাংঘাতিকভাবে কমিয়া গিয়াছে। অবশ্য এ কথা বলিলে অন্যায় হইবে যে, শুধু অসংযমই এই অধঃপতন আনিয়াছে, তবে ইহা সত্য যে অসংযম এজন্য অনেকখানি দায়ী, মদ্যপান ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে বাস করা প্রভৃতি কারণও ইহার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। আমরা যদি স্থিরভাবে একটু চিন্তা করিয়া দেখি, তবে সহজে বুঝিব এই ভ্রষ্টাচার এবং যে মানসিক অবস্থা ইহাকে স্থায়ী করে তাহা অন্যান্য ব্যাধিরও বিশেষ সহায়ক। উপদংশাদি রোগের ভয়ানক বিস্তৃতি জনসাধারণের স্বাস্থ্যের মহা অনিষ্ট করিয়াছে।

 ম্যালথাস-পন্থীগণ বলেন, যে-অনুপাতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ দ্বারা লোক সংখ্যা হ্রাস করা যায়, সেই অনুপাতে লোকের ধনসম্পদ্ বাড়ে। শ্রীযুক্ত বুরো এই কথা মানেন না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সহিত জার্মানির অর্থ সম্পদ কিরূপে বাড়িতেছে এবং জনসংখ্যা হ্রাসের সহিত ফ্রান্সের অর্থ সম্পদ কিরূপে কমিতেছে তাহা তিনি অকাট্যরূপে প্রমাণ করিয়াছেন। শ্রমিকদের স্বার্থ বিসর্জ্জন দিয়া অন্যান্য দেশে যেরূপে বাণিজ্য বিস্তার করা হয়, জার্মানির অসাধারণ বাণিজ্য বিস্তারের জন্য সেখানকার শ্রমিকদের স্বার্থ তাহা অপেক্ষা বেশী বিসর্জ্জন দেওয়া হয় নাই। তিনি রোসিনোলের এই লেখাটি উদ্ধৃত করিয়াছেন:— ‘যখন জার্মানিতে শুধু ৪ কোটি ১০ লক্ষ লোক ছিল, তখন লোকে অনাহারে মরিত; যখন তাহাদের সংখ্যা ৬ কোটী ৮০ লক্ষ হইয়াছে, তখন হইতে জার্মানি দিন দিন অর্থশালী হইতেছে।’ বুরো বলেন, সন্ন্যাসী বা সংযমী না হইয়াও এই সব লোক বৎসর বৎসর সেভিংস্-ব্যাঙ্কে যথেষ্ট টাকা জমাইয়াছে। ১৯১১ সালে এই সঞ্চিত টাকার পরিমাণ ছিল ২২০০ কোটি ফ্রাঙ্ক; ১৮৯৫ সালে ছিল মাত্র ৮০০ কোটি ফ্রাঙ্ক; প্রতি বৎসর তাহারা ৮৫ কোটি ফ্রাঙ্ক জমাইয়াছে।

 জার্মানির যন্ত্রপাতির উন্নতির কথা বর্ণনা করিয়া, সেখানকার সাধারণ বিদ্যাচর্চা বিষয়ে শ্রীযুক্ত বুরো লিখিয়াছেন:— সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানলাভ না করিয়াও সকলে ইহা বুঝিতে পারেন যে, উন্নত শ্রমিক, উচ্চশিক্ষিত পরিদর্শক এবং সুশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার পাওয়া না গেলে, সেখানে এরূপ উন্নতি অসম্ভব হইত। শিল্প বিদ্যালয়গুলি তিন রকমের—পাঁচ শতের বেশী বিদ্যালয়ে পেশাগত শিল্প শিক্ষা দেওয়া হয়—শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০ হাজার; যন্ত্রবিজ্ঞান বিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও অনেক বেশী, ইহার কোনো কোনো বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা হাজারের উপর; সৰ্বশেষে আছে আরও উন্নত শিক্ষাদানের জন্য কলেজ-সমূহ, সেখানকার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০০০, এই সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় ডক্টর উপাধি বিতরণ করিয়া থাকে। *** ৩৬৫টি বাণিজ্য বিদ্যালয়ে ৩১,০০০ ছাত্র আছে এবং অসংখ্য বিদ্যালয়ে ৯০,০০০ ছাত্র কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করে। অর্থ উপার্জ্জনের বিভিন্ন বিভাগের এই ৪০০,০০০ ছাত্রের তুলনায় ফরাসী দেশের পেশাগত শিল্প শিক্ষার্থী ৩৫ হাজার ছাত্রের সংখ্যা কত কম? ফরাসী দেশে ১৭, ৭০,০০০ লোক কৃষিজীবি, ইহাদের ভিতর ৭,৭৯,৭৯৮ জনের বয়স আঠার বৎসরের কম এ অবস্থায় বিশেষ কৃষি-বিদ্যালয়ে মাত্র ৩,২৫৫ জন ছাত্র আছে। বুরো ইহা স্বীকার করিয়াছেন যে, জার্মানির লোকের জন্মসংখ্যা মৃত্যুসংখ্য অপেক্ষা বেশী বলিয়াই যে তাহাদের এ সব আশ্চর্যজনক উন্নতি হইয়াছে তাহা নহে। তিনি ঠিকই বলিয়াছেন, অন্যান্য সুযোগ থাকিলে জন্মহার অনেক বেশী হওয়া রাষ্ট্ৰীয় উন্নতির পক্ষে অবশ্য প্রয়োজনীয়। বাস্তবিক তিনি যাহা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন তাহা এই, জন্মসংখ্যার বৃদ্ধি পার্থিব সম্পদ বৃদ্ধি ও নৈতিক উন্নতির পরিপন্থী নহে। জন্ম-সংখ্যা হিসাবে ভারতবাসী আমাদের অবস্থা ফরাসীদের মত নহে। কিন্তু একথা বলা চলে যে, ভারতের জন্মসংখ্যার অতি বৃদ্ধি, জার্মানির মত আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্নতির সহায়ক নহে। কিন্তু বুরোর অঙ্ক এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারতের অবস্থার বিচার অন্য এক অধ্যায়ে করিব।

 যেখানে মৃত্যুসংখ্যা অপেক্ষা জন্মসংখ্যা বেশী, সেই জার্মানির অবস্থা বর্ণনা করিয়া বুরো বলেন, “সকলেই জানেন ধন-সম্পদে ফরাসী জাতির স্থান ইউরোপে চতুর্থ এবং সে তৃতীয় রাষ্ট্রের অনেক নীচে। টাকা খাটাইয়া ফ্রান্স বৎসরে পায় ২৫•• কোটি ফ্রাঙ্ক, জার্মানি পায় ৫০০০ কোটি ফ্রাঙ্ক। ১৮৭৯ হইতে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ৩৫ বৎসরে ফরাসী দেশের জমির মূল্য ৯,২০০ কোটি হইতে ৫,২০০ কোটি ফ্রাঙ্কে নামিয়াছে অর্থাৎ ৪,০০০ কোটি ফ্রাঙ্ক কমিয়াছে। দেশের প্রত্যেক জেলায় ক্ষেতে কাজ করা কৃষাণের অভাব হইয়াছে এবং এমন অনেক জেলাও আছে যেখানে বৃদ্ধ ভিন্ন কদাচিত অন্য কাহাকেও দেখা যায়।” তিনি লিখিয়াছেন, “ভ্রষ্টাচার এবং সন্তান নিরোধের ফলে সমাজের সকল রকম শক্তি ক্ষীণ হয় এবং সামাজিক জীবনে বৃদ্ধদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপিত হয়। প্রতি হাজার লোকের মধ্যে ফ্রান্সে শিশুর সংখ্যা ১৭০, ইংলণ্ডে ২১০ ও জার্মানিতে ২২০। বৃদ্ধের সংখ্যার অনুপাত স্বভাবত যাহা হওয়া উচিত ফ্রান্সে তাহা অপেক্ষা বেশী। যাহারা বৃদ্ধ নহে তাহারাও ভ্রষ্টাচারের ফলে অকাল বৃদ্ধ হইয়াছে—তাহাদের ভিতর শক্তিহীন জাতির সব রকম দুর্ব্বলতা ও কাপুরুষতা দেখা দিয়াছে।”

 গ্রন্থকার তারপর বলিতেছেন—‘পারিবারিক জীবনে প্রত্যেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন’ নীতির কল্যাণে ফরাসী জাতির অধিকাংশ লোকে তাহাদের শাসকদের এই শিথিল পারিবারিক নীতির প্রতি উদাসীন। তিনি দুঃখের সহিত লিওপোল্ড মোনোর নীচের মন্তব্য উদ্ধৃত করিয়াছেন:—

 “অত্যাচারীকে গালি দেওয়া এবং যাহারা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ তাহাদিগকে উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধে যোগ দেওয়া বেশ। কিন্তু যাহারা বিবেককে প্রলোভন হইতে মুক্ত রাখিতে চেষ্টা করে না, অন্যের আদর অথবা উষ্মার ইঙ্গিত দ্বারা যাহাদের সাহস কম-বৃদ্ধি হয়, যাহারা লজ্জাসরমের মাথা খাইয়া প্রথম যৌবনে স্ত্রীর নিকট পবিত্র মুহর্ত্তে সানন্দে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অম্লানচিত্তে ভঙ্গ করে এবং এই কাজের জন্য গৌরব বোধ করে, যাহারা সম্পূর্ণরূপে আত্মসর্ব্বস্ব হইয়া স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিবারের সকলকে অত্যাচারপিষ্ট করে, তাহারা কিরূপে মুক্তিদাতা হইতে পারে?”

 লেখক পরে বলিতেছেন— “এইরূপে যেদিকে তাকাই না কেন দেখিতে পাইব যে, আমাদের নৈতিক অসংযম ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের মহা অনিষ্ট করিতেছে এবং আমাদের দুঃখ অত্যন্ত বৃদ্ধি করিয়াছে। যুবকদের ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, বেশ্যাবৃত্তি, অশ্লীল পুস্তক ও চিত্রাদি প্রচার, অর্থ লোভে বিবাহ, মিথ্যা অভিমান, বিলাসিতা, ব্যভিচার ও বিবাহবিচ্ছেদ, কৃত্রিম বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভপাত জাতিকে দুৰ্বল এবং লোকসংখ্যা হ্রাস করিয়াছে। মানুষ আপনার শক্তি সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেছে না এবং জন্মসংখ্যা হ্রাসের সহিত শিশুরা ক্ষীণ ও দুর্ব্বল হইতেছে। জন্ম-সংখ্যা কম হইলে, সন্তান ভাল হইবে, কোনো কারণে এই কথা তাহাদের ভাল লাগিয়াছে। ইহারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের স্থুল বিচার করিয়া ভাবিয়াছিল, ঘোড় ও ভেড়ার ন্যায় মানুষ একই ভাবে সন্তান উৎপাদন করিবে। অগস্ত কোঁত তীব্র কটাক্ষ করিয়া বলিয়াছেন, যাহারা এই সব সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসক বলিয়া নিজেদের পরিচয় দেন, তাহারা পশুচিকিৎসক হইলে জগতের মঙ্গল হইত, কারণ ব্যক্তি ও সমাজের জটিল মনোবৃত্তি বুঝিবার মত কোনো শক্তি তাহাদের নাই।

 ব্যাপার এই, বিষয়ভোগের সহিত সংশ্লিষ্ট মনোবৃত্তি ও সিদ্ধান্ত লোকের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যতটা প্রভাব বিস্তার করে, মানুযের অপর কোনো মনোবৃত্তি, সিদ্ধান্ত ও অভ্যাস তাহা করে না। সে ইহাকে বাধা দিক এবং আয়ত্তে রাখুক, অথবা পরাজিত হইয়া ইহার প্রবাহে ভাসিয়া চলুক, তাহার কাজের প্রতিধ্বনি সামাজিক জীবনের বহুদূরবর্ত্তী স্থানেও পৌছিবে; কারণ প্রকৃতির নিয়ম এই যে, অত্যন্ত গুপ্ত কাজও আপনার প্রভাব বিস্তার না করিয়া পারে না।

 “যখন আমরা কোনোপ্রকার নৈতিক বন্ধন ছিন্ন করি, তখন আমরা ভাবি, আমাদের দুষ্কার্য্যে পরিণাম খারাপ হইবে না। প্রথমতঃ, নিজেদের সম্বন্ধে আমরা সন্তুষ্ট থাকি, কারণ আমাদের নিজেদের সুখ অথবা স্বার্থসাধনই আমাদিগকে এ কাজে নিয়োজিত করে; সমাজের সম্বন্ধে আমরা ভাবি, সমাজ এত উচ্চ যে ইহা আমাদের মত সামান্য লোকদের কুকার্য্য লক্ষ্য করিবে না; সর্ব্বোপরি আমরা মনে মনে আশা করি যে, অপর সকলে পবিত্র ও সদাচারী থাকিবে। ইহার সর্ব্বাপেক্ষা শোচনীয় কুফল এই যে, যতদিন এই দোষ অল্প লোকের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকে ততদিন উপরোক্ত কাপুরুষোচিত হিসাব প্রায়ই ঠিক হইয়া থাকে; কিন্তু তাহার ফলে মানুষের এই মনোভাব ক্রমে বদ্ধমূল হইতে থাকে এবং পরিশেষে ইহা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়—এবং ইহাই আমাদের চরম শাস্তি।”

 “কিন্তু এমন দিন আসে যখন এই ভাবে চলার ফলে অন্যান্য কর্তব্যচ্যুতি ঘটে; আমাদের প্রত্যেক দুষ্কার্য্যের ফলে, অন্য লোকের পক্ষে যে ধর্ম্মপথে চলা আমরা সহজ বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম, তাহা আরও দুর্গম ও কঠোর হইয়া উঠে এবং আমাদের প্রতিবাসীরা ধোখা খাইতে খাইতে হয়রাণ হইয়া ব্যস্ততার সহিত আমাদের অনুকরণ করে। ঐ দিন হইতে পতন আরম্ভ হয় এবং প্রত্যেকে আপন আপন দুষ্কার্য্যের ফল এবং তাহার দায়িত্বের পরিমাণ বুঝিতে পারে।

 “যেখানে বন্ধ থাকিবে মনে করিয়াছিলাম, সেই গুপ্তস্থান হইতে গোপন কাজ বাহির হইয়া পড়ে। বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়া যে ভাবে রেডিও চলে, ইহার সেইরূপ অপার্থিব শক্তি আছে; সেই শক্তির বলে ইহা সমাজের সব স্তরে প্রবেশ করে; প্রত্যেকের দোষে প্রত্যেকে দুঃখভোগ করে; কারণ ক্ষুদ্র জলাশয়ে পাথর ফেলিলে, তাহা হইতে ছোট ছোট তরঙ্গ যেরূপে বহুদূরে যায়, তেমনি আমাদের কাজের প্রভাব, সমাজের অতি দূরতম প্রদেশেও অনুভূত হয়।

 “ভ্রষ্টাচার জাতির প্রাণশক্তিকে দ্রুত শুকাইয়া ফেলে, পরিণত বয়স্কদের শরীর ক্ষীণ ও রোগপ্রবণ করিয়া তোলে এবং তাহাদের শরীর ও মনের বল কমাইয়া দেয়।


  1. ইনি ১০৬৬ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ড জয় করেন—অনুবাদক