দুর্নীতির পথে/সংযমের উপকারিতা
চতুর্থ অধ্যায়
সংযমের উপকারিতা
ভ্রষ্টাচার তথা কৃত্রিম উপায়ে দুর্নীতির প্রসার ও তার ভয়ঙ্কর পরিণাম সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া, লেখক তাহা নিবারণ করার উপায় সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। যে অংশে আইন-কানুন, তাহাদের প্রয়োজনীয়তা ও সম্পূর্ণ ব্যর্থতা সম্বন্ধে আলোচনা আছে, আমি তার কথা এখানে কিছু বলিব না। তার পর তিনি লোকমত গঠন করিয়া অবিবাহিতদের সংযম রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, যাহারা সব সময় পাশববৃত্তি দমন করিতে সক্ষম নহে, তাহাদের বিবাহের প্রয়োজনীয়তা, বিবাহের পর স্বামীস্ত্রীর পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং বিবাহিত জীবনে ব্রহ্মচর্যের আবশ্যকতা সম্বন্ধে লিখিয়াছেন। সংযমের বিরুদ্ধে কেহ কেহ এই যুক্তি পেশ করেন যে, ইহা নরনারীর স্বাভাবিক বৃত্তির বিবোধী, স্বাস্থ্যের পক্ষে অনিষ্টকর, ইহা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব্ব করে, প্রত্যেককে ইচ্ছামত জীবনযাপন করার ও সুখী হইবার স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত করে। তিনি এ সব যুক্তি আলোচনা করিয়াছেন।
তিনি স্বীকার করেন না যে, অন্য ইন্দ্রিয়ের ন্যায় জননেন্দ্রিয় আপনার ভোগ চায়। ইহা সত্য হইলে ইহাকে দমনে রাখিবার যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ইচ্ছাশক্তির আছে, তার মূল কিরূপে নির্ণীত হইবে? আধুনিক সভ্যতা অকালে অল্পবয়স্ক বালক-বালিকাদের সামনে অসংখ্য উত্তেজনার কারণ উপস্থিত করে বলিয়া, অসময়ে তাহাদের ইন্দ্রিয়পরায়ণতা জাগ্রত হয়। আবার এই ইন্দ্রিয়সেবাকে কোন কোনো কূট তার্কিক অতি প্রয়োজনীয় মনে করেন।
টুবিগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অষ্টার্লেন বলেন, “কামবাসনা এত প্রবল নহে যে, বিবেক অথবা নৈতিক শক্তির সাহায্যে ইহাকে সংযত করা যায় না। উপযুক্ত সময় পর্যন্ত যুবক যুবতীর নিজেকে সামলাইয়া চলা উচিত। তাহাদের জানা উচিত, এইরূপ স্বেচ্ছাকৃত আত্মত্যাগের পুরস্কারস্বরূপ হৃষ্টপুষ্ট শরীর, অটুট স্বাস্থ্য ও নিত্য নূতন উৎসাহের অধিকারী হওয়া যায়।”
“সংযম ও পূর্ণ পবিত্রতার সহিত শরীরবিজ্ঞান ও নীতিধর্ম্মের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে। নীতি ও ধর্ম্মের অনুশাসনের ন্যায় শরীরবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়সেবার সমর্থন করে না।”
লণ্ডনের রয়াল কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত স্যার লায়ন্স বিলী বলেন, “শ্রেষ্ঠ এবং মহৎ লোকের দৃষ্টান্ত হইতে সব সময় বুঝা যায় যে, সর্ব্বাপেক্ষা শক্তিশালী বিকার ও সহজাত সংস্কারকেও প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে এবং জীবন যাপন প্রণালী ও পেশা নির্ব্বচনে সাবধানতা অবলম্বন করিলে সংযত করা যায়। শুধু বাহ্যিকভাবে নহে, যাহারা দেহমনে ইন্দ্রিয়সেবা হইতে বিরত হইয়াছেন, তাহাদের কোনো অনিষ্ট হইতে পারে না। এক কথায়, মন ভাল হইলে অবিবাহিত থাকা একটুও দুঃসাধ্য নহে। ••• সম্ভোগ-বিরতিই ব্রহ্মচর্য্য নহে। মানসিক পবিত্রতা এবং অটল বিশ্বাসের ফলে যে শক্তিলাভ হয় তাহাই ব্রহ্মচর্য্য।
সুইস মনোবিজ্ঞানবিৎ ফোরেল বলেন, “প্রত্যেক রকম স্নায়বিক কাজ অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি পায় ও শক্তিশালী হয়। অন্যপক্ষে, কোনো বিশেষ স্নায়ুর কাজ বন্ধ রাখিলে, উত্তেজনার কারণ কমিয়া তাহা সংযত থাকে। ইন্দ্রিয়-চাঞ্চল্যের সব কারণই বিষয়-বাসনাকে অত্যন্ত প্রবল করে। এই সব উত্তেজনা এড়াইতে পারিলে, বিষয়-তৃষ্ণা ক্রমে কমিয়া যায়। যুবক-যুবতীদের এই ধারণা আছে যে, ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ অস্বাভাবিক ও অসম্ভব। তথাপি অনেকে সংযত জীবন যাপন করিয়া প্রমাণ করিয়া থাকেন যে, সংযম রক্ষা করিলে স্বাস্থ্যের কোনো অনিষ্ট হয় না।
আর এক বিদ্বান ব্যক্তি বলেন, “যাহারা পূর্ণ সংযম পালন করিয়াছেন, অথবা বিবাহের পূর্ব্ব পর্যন্ত ইহা পালন করিয়াছেন, এরূপ কতকগুলি লোককে আমি জানি—ইহাদের বয়স ২৫।৩০ অথবা তাহা অপেক্ষা বেশী। এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নহে, তবে তাহারা নিজেদের কথা ঢাক-ঢোল পিটাইয়া প্রকাশ করেন না।”
“যাহাদের শরীর ও মন উভয়ই সুস্থ এরূপ ছাত্রদের নিকট হইতে আমি অনেক গোপন চিঠি পাইয়াছি। ইন্দ্রিয়সংযম সুসাধ্য সে কথা আমি বিশেষ জোরের সহিত প্রচার করি নাই বলিয়া তাহারা অভিযোগ করিয়াছেন।
ডাক্তার এক্টন বলেন, ‘বিবাহের পূর্ব্বে যুবকদের পূর্ণ সংযম পালন করা সম্ভব এবং কর্তব্য।' সার জেম্স্ প্যাজেট বলেন, ‘পবিত্রতা আত্মার যেমন কোনো অনিষ্ট করে না, তেমনি শরীরেরও কোনো অনিষ্ট করে না। সংযমের পথে চলা সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’
ডাক্তার পেরিয়র বলেন, ‘পূর্ণ সংযম পালন করিলে অনিষ্ট হয়, এই ধারণা অনেকের আছে। এই ভুল ধারণা নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করা দরকার। কারণ ইহাতে যে শুধু বালক-বালিকাদের মন বিগড়াইয়া দেয় তাহা নহে, তাহাদের পিতামাতার মনও বিগড়াইয়া দেয়। ব্রহ্মচর্য্য যুবকদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নতির সহায়তাকারী।’
সার এণ্ড ক্লার্ক বলেন, “সংযম কোনো ক্ষতি করে না, শরীরগঠন ও পুষ্টির বাধা দেয় না; ইহা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং বুদ্ধিকে প্রখর করে। ইন্দ্রিয়-পরায়ণতা আত্ম-সংযমের শক্তি হ্রাস করে, অলসতা বৃদ্ধি করে, শরীরকে অকর্মণ্য ও ঘৃণ্য করে এবং ইহাকে এমন সব রোগের আকর করে, যেগুলি পরবর্ত্তী অনেক পুরুষ পর্যন্ত সংক্রামিত হয়। যুবকদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ইন্দ্রিয়সেবা দরকার, এ কথা শুধু ভুল নহে, ইহা মিথ্যা ও অনিষ্টকর এবং ভয়ানক নিষ্ঠুরতাপূর্ণ।”
ডাক্তার সারব্লেড লিখিয়াছেন, “অসংযমের ফল যে খারাপ তাহা অবিসংবাদিত এবং সর্ব্বজনবিদিত, পরন্তু সংযমের ফল যে খারাপ তাহা কল্পিত মাত্র। অনেক প্রসিদ্ধ বিদ্বান লোকে প্রথমটি সমর্থন করেন, কিন্তু কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি শেষোক্ত মত সমর্থন করেন না। শেষের দলের লোকে প্রকাশ্যভাবে তাহাদের মত আলোচনা পর্য্যন্ত করিতে চান না।
ডাক্তার মোণ্টেগাজা তাঁহার এক পুস্তকে লিখিয়াছেন, “সংযমের ফলে কাহারও কোনো ব্যাধি হইতে দেখি নাই। সব লোকে বিশেষতঃ যুবকেরা সংযমের টাটকা ফল প্রত্যক্ষ করিতে পারেন।
বিখ্যাত অধ্যাপক ডুবয় বলেন, “যাহারা অধিক ইন্দ্রিয়সেবা করে তাহাদের অপেক্ষা যাহারা কিছু সংযত জীবন যাপন করে, তাহাদের মধ্যে স্নায়বিক দৌর্বল্য কম।” ডাক্তার ফিয়ার বলেন, “যাহারা মানসিক পবিত্রতা রক্ষা করিতে পারে, ভোগ-বিরতি তাহাদের কোনো অনিষ্ট করে না এবং ইন্দ্রিয়-চরিতার্থ করার উপর স্বাস্থ্যরক্ষা নির্ভর করে না।”
অধ্যাপক আলফ্রেড ফোর্ণিয়ার লিখিয়াছেন, “সংযম রক্ষা করিলে যুবকদের অনিষ্ট হয়, এরূপ অযোগ্য ও তরল আলোচনা কোথাও কোথাও হইয়া থাকে জানি। আমি দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিতেছি যে, ইহাতে কোনো অনিষ্ট হয় না। চিকিৎসক হিসাবে আমার এইরূপ ব্যাপার লক্ষ করার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বে, ইহাতে যে কাহারও কোনো অনিষ্ট হইয়াছে, তার কোনো প্রমাণ আমি পাই নাই।”
“ইহা ভিন্ন শরীর-শাস্ত্রবেত্তারূপে আমি বলিব, ২১ বৎসর বা এইরূপ বয়সের পূর্ব্বে প্রকৃত বীর্য্য-পুষ্টি হয় না; এবং বিশেষভাবে কুৎসিৎ উত্তেজনা দ্বারা কু-বাসনা উদ্দীপ্ত না হইলে, তার পূর্ব্বে ইন্দ্রিয়সেবার ইচ্ছা উৎপন্ন হয় না। অকালে ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তির ইচ্ছার মূলে থাকে কৃত্রিম অভাব, এবং অধিকাংশ সময় ইহা কুশিক্ষার ফল।”
“সে যাহা হউক, নিশ্চিত জানিয়া রাখুন, স্বাভাবিক প্রবৃত্তির পথে চলা অপেক্ষা তাহা সংযত করিতে গেলে শরীরের অনিষ্টের সম্ভাবনা কম হইবে।”
এই সব সুবিখ্যাত লোকের মত উদ্ধৃত করার পর, শ্রীযুক্ত বুরো ১৯০২ সালে ব্রসেল্স্ নগরে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও নীতিরক্ষা কংগ্রেসের অধিবেশনে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ১০২ জন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে যে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল, তাহা উদ্ধৃত করিয়াছেন:—“যুবকদিগকে সর্ব্বোপরি এই শিক্ষা দিতে হইবে যে, ব্রহ্মচর্য্য এমন জিনিষ যাহা কাহারও কোনো অনিষ্ট তো করেই না, বরং ইহা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরম আবশ্যকীয়।
বুরো তারপর লিখিতেছেন:— কয়েক বৎসর পূর্ব্বে কোনো খৃষ্টান বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-বিভাগের আচার্যগণ সর্ব্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করিয়াছিলেন, “পবিত্র জীবন যাপন করিলে স্বাস্থ্যের হানি হয়, এইরূপ উক্তির মূলে কোনো ভিত্তি নাই। পবিত্র নৈতিক জীবন যাপন করিয়া, কাহারও কোনো ক্ষতি হইয়াছে এরূপ কিছু আমাদের জানা নাই।”
“এ কথা শুনা গিয়াছে এবং নীতিবিদ ও সমাজ-শাস্ত্র-ধুরন্ধরগণ শ্রীযুক্ত রায়সেনের এই স্পষ্ট সত্যের পুনরাবৃত্তি করেন যে আহার ও ব্যায়ামের ন্যায় বিষয়-ভোগের তৃপ্তির দরকার নাই। এ কথা সত্য, দুই একটি বিশেষ উদাহরণ ব্যতীত, প্রত্যেক নরনারী কোনো অসুবিধায় না পড়িয়া, কোনো প্রকার পীড়াগ্রস্ত না হইয়াই, পবিত্র জীবন যাপন করিতে পারে। বহুবার বলা সত্ত্বে ইহার পুনরুক্তি করিলে দোষের হইবে না যে, সংযম হেতু জনসাধারণের কোনো ব্যধি উৎপন্ন হয় নাই, এবং জনসাধারণই সংখ্যায় সকলের চেয়ে বেশী। ইহাও সত্য যে অনেক সর্ব্বজনবিদিত সংঘাতিক মারাত্মক ব্যাধি অসংযম হইতে উৎপন্ন হয়। প্রকৃতি সর্ব্বাপেক্ষা সরল ও অভ্রান্তভাবে খাদ্য হইতে উৎপন্ন প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তির উচিত ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে—ইহাকে আমরা মাসিক ঋতু অথবা অনায়াস- স্খলিত বীর্য্যরূপে দেখি।
“সুতরাং ডাক্তার ভিরি ঠিকই বলিয়াছেন যে, বাস্তবিক আবশ্যকতা অথবা খাঁটি সহজাত সংস্কারের সহিত এই প্রশ্নের কোনো সম্বন্ধ নাই। সকলেই জানেন, ক্ষুধায় আহার না করিলে, অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বন্ধ করিলে, পরিণাম কিরূপ খারাপ হইতে পারে। কিন্তু সাময়িক অথবা স্থায়ী সংযমের ফলে কোনো সামান্য অথবা সাংঘাতিক ব্যারাম হইয়াছে, এ কথা কেহই লিখেন নাই। আমরা সাধারণতঃ দেখিয়া থাকি, যাহারা ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাহার চরিত্রবলে কাহারও অপেক্ষা ন্যূন নহেন, কম উৎসাহী অথবা কম বলবান নহেন, এবং বিবাহ করিলে সন্তানের জন্ম দিতে কম যোগ্য নহেন। যে প্রয়োজন অবস্থা অনুসারে পরিবর্ত্তিত হয়, যে সহজাত সংস্কার তৃপ্তির অভাবে শান্তভাব ধারণ করে, তাহা প্রয়োজনও নহে সহজাত সংস্কারও নহে।
যে বালক বাড়িতেছে শারীরিক প্রয়োজনে ইন্দ্রিয়সেবা করা তাহার পক্ষে অনাবশ্যক; বরুং তাহার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও দৈহিক গঠনের উন্নতির জন্য পূর্ণ সংযমই বিশেষ দরকার। যাহারা ইহা মানে না, তাহারা স্বাস্থ্যের মহা অনিষ্ট করে। যৌবনপ্রাপ্তির সময় অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়, শরীর ও মনের বিক্ষোভ ও চাঞ্চল্য উপস্থিত হয় এবং সাধারণ উন্নতি হয়। বর্ধিষ্ণু বালকের পক্ষে তাহার সমগ্র জীবনী-শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজন খুব বেশী, কারণ এই সময় বোগ-প্রতিরোধ করার শক্তি প্রায়ই কমিয়া যায়, ব্যাধি এবং মৃত্যুহার পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক বেশী হয়। দীর্ঘকাল-সাপেক্ষ শরীরবৃদ্ধি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রমবিকাশ, সমগ্র শারীরিক ও মানসিক পরিবর্ত্তন, যার পরিণামে বালক মানবত্ব প্রাপ্ত হয়, তাহা প্রকৃতির পক্ষে বহু পরিশ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। এই সময় সব রকম মাত্রাধিক্য বিশেষতঃ ইন্দ্রিয়-সেবা অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল।