দুর্নীতির পথে/ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সংযম
পঞ্চম অধ্যায়
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সংযম
ব্রহ্মচর্য্য পালনের ফলে যে শারীরিক উপকার হয় তাহা আলোচনার পর, বুরো ইহার নৈতিক ও মানসিক উপকার সম্বন্ধে অধ্যাপক মণ্টেগাজার নীচের লেখাটি উদ্ধৃত করিয়াছেন।
“সকল মানুষ বিশেষতঃ যুবকগণ ব্রহ্মচর্য্যের ফল টাটকা পাইতে পারেন। ইহার ফলে স্মরণশক্তি স্থির ও প্রখর, বুদ্ধি উর্ব্বর, ইচ্ছাশক্তি অদম্য হয় এবং সমস্ত জীবনে এমন এক পরিবর্ত্তন সাধিত হয়, যার কল্পনাও স্বেচ্ছাচারীগণ কখনও করিতে পারে না। সংযম আমাদের পারিপার্শ্বিক জিনিষকে এমন স্বর্গীয় আভায় রঞ্জিত করে যাহা আর কিছুতেই পারে না; ইহা বিশ্বের অতি সামান্য দ্রব্যকেও উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত করে এবং আমাদিগকে চিরস্থায়ী সুখের পবিত্রতম আনন্দের ভিতর লইয়া যায়—এ আনন্দ কখনও হ্রাস বা ম্লান হয় না। গ্রন্থকার আরও বলেন, “ব্রহ্মচর্য-ব্রতধারী তেজস্বী যুবকদের প্রফুল্লচিত্ততা ও আনন্দ এবং ইন্দ্রিয়ের দাসগণের অশান্তি ও অস্থিরচিত্ততার মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।” তিনি তার পর কামুকতা ও চরিত্রহীনতার শোচনীয় পরিণামের সহিত সংযমের উপকারিতার তুলনা করিয়াছেন। গ্রন্থকার বলেন, “সংযমের ফলে কাহারও কোনো রোগ হয় না, কিন্তু অসংযমের ফলে যে ভয়ানক ব্যাধি হয় সে কথা কে না জানে? অসংযমের ফলে শরীর পচিয়া যায়, কল্পনাশক্তি, বুদ্ধি এবং অন্তঃকরণ পর্য্যন্ত কলুষিত হয়। ইহার ফলে সর্ব্বত্র চরিত্রের অবনতি, ইন্দ্রিয়ের উদ্দাম প্রবৃত্তি এবং স্বার্থপরতা বৃদ্ধি হয়।”
এ পর্যন্ত বিবাহের পূর্বে্ব ইন্দ্রিয়সেবার তথাকথিত প্রয়োজন এবং তার ফলে যুবক-যুবতীর যথেচ্ছ-বিহারের বা স্বাধীনভাবে চলার কথা বলা হইয়াছে। ইহা সত্ত্বে, যাহারা বীর্য্যনাশ করা আবশ্যক মনে করেন, তাহারা বলেন, ইহাতে বাধা দিয়া তোমরা আমাদের স্বাধীনভাবে শরীর-ব্যবহারের অধিকারে হস্তক্ষেপ করিতেছ। গ্রন্থকার সুন্দর যুক্তিদ্বারা দেখাইয়াছেন যে, সমাজের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় এরূপে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন আছে।
গ্রন্থকার বলেন, “সমাজতত্ত্ববিদের মতে কর্ম্মের পরস্পর ঘাতপ্রতিঘাতের নাম জীবন। এমন কোনো কাজ নাই, যাহাকে আমরা অন্যান্য কাজ হইতে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন কহিতে পারি। প্রত্যেক কাজের প্রভাব সর্ব্বত্র পড়িবে। আমাদের অতি গোপন কাজ, চিন্তা, অথবা সংকল্পের প্রভাব এত দূরে ও গভীরভাবে পড়ে, যার ধারণা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। মানুষ মানুষ বলিয়াই সামাজিক জীব। এই সামাজিক প্রবৃত্তি তাহার মনুষ্যত্বেরই অঙ্গ। ইহা সে বাহির হইতে লাভ করে নাই। মানুষের সব কাজের ভিতরকার এই অখণ্ড সম্বন্ধ বিচার না করিয়া, কখনও কখনও কোনো কোনো সমাজ দুই এক বিষয়ে লোককে স্বাধীন বানাইতে চাহে। এই স্বাধীনতাকে স্বীকার করার ফলে ব্যক্তি আপনাকে ছোট করিয়া ফেলে—আপনার মহত্ত্ব থোয়াইয়া বসে।”
গ্রন্থকার আরও বলেন, “অবস্থাবিশেষে রাস্তায় থুতু ফেলার অধিকার যখন আমাদের নাই, তখন বীর্য্যরূপ মহাশক্তি খরচ করার স্বাধীনতা আমাদের কিরূপে থাকিবে? এ কাজ কি এরূপ যে, উপরে বর্ণিত সমস্ত কাজের পারস্পরিক অখণ্ড সম্বন্ধের সহিত ইহার কোনো সংস্রব নাই। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, গুরুত্ব হেতু ইহার প্রভাব আরও গভীর। যে নব-যুবক এবং বালিকা নিজেদের মধ্যে এখনই এরূপ সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছে, তাহাদের কথা ধরুন। তাহারা মনে করে, এ বিষয়ে তাহারা সম্পূর্ণ স্বাধীন—তাহাদের কাজের জন্য আর কাহারও কিছু আসিয়া যায় না; ইহার ফল শুধু তাহারা দুজনে ভোগ করিবে। স্বাধীনতার ভুল ধারণার বশে তাহারা ভাবে, তাহাদের গোপন কাজের সহিত সমাজের কোনো সম্বন্ধ নাই এবং তাহাদের কাজ সম্পূর্ণরূপে সমাজ-শাসনের বাহিরে। ইহা শিশুর কল্পনা! তাহারা জানে না যে, প্রত্যেকের গুহ্য এবং ব্যক্তিগত কাজের ভয়ানক প্রভাব অত্যন্ত দূরের কাজের উপরও পড়ে। এইরূপে সমাজ বিশৃঙ্খল হইয়া উঠে। যদি তুমি শুধু আনন্দের জন্য অল্পস্থায়ী অথবা অনুৎপাদক যৌনমিলনের অধিকার স্থাপন করিতে অগ্রসর হও, যদি জীবনের সারপদার্থ বীর্য্যকে যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে যাও, তবে তুমি ইচ্ছা কর আর না কর, ইহা দ্বারা সমাজের ভিতর ভেদ ও বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করিবে। আমাদের স্বার্থপরতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিগড়াইয়া গেলেও সমাজ ইহা ধরিয়া লয় যে, লোকে জননবৃত্তি তৃপ্তির সহিত ইহার দায়িত্ব ভালভাবে গ্রহণ করিবে। এই দায়িত্ব লোকে ভুলিয়ে যায় বলিয়া, সমাজে আজ মুলধন এবং শ্রম, মজুরী ও সম্পত্তির অধিকার, করধার্য্য করা এবং সৈন্যদলভুক্ত হওয়া, প্রতিনিধিত্বের অধিকার এবং নাগরিকের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় লইয়া জটিল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে। কেহ এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলে, সে একই আঘাতে সমাজের সময় সংগঠন নষ্ট করিয়া দেয়। এরূপে সে সমাজ-বন্ধনের মূলতত্ব অগ্রাহ্য করে, অপরের বোঝা ভারি করিয়া নিজে হালকা হইতে চায় এবং পরগাছার ন্যায় জীবন যাপন করিতে ইচ্ছা করে; সুতরাং সে লুণ্ঠনকারী, চোর, জুয়াচার অপেক্ষা ভাল নহে। অন্যান্য শক্তির ন্যায় শারীরিক শক্তির সদ্ব্যবহারের জন্য আমরা সমাজের নিকট দায়ী। সমাজ এ বিষয়ে নিরস্ত্র। সমাজের মঙ্গলের জন্য ঐ শক্তি হিসাব করিয়া ব্যবহার করার দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে, সেজন্য এ দায়িত্ব অন্যান্য দায়িত্ব অপেক্ষা গুরুতর।”
‘স্বাধীনতা বাহির হইতে সুখের মনে হয়, পরন্তু ইহা বাস্তবিক এক বোঝা স্বরূপ। ইহার ধারণা প্রথমেই হইতে পারে। মন ও বিবেকের ভিতর ঐক্য আছে তা জানি; এ দুটির ভিতরই আমাদের শক্তি নিহিত আছে; পরন্তু উভয়ের ভিতর বিস্তর পার্থক্যও দেখা যায়। যখন মন ও বিবেক বিপরীত পথে চলিতে বলে, তখন কাহাকে মানিব? আমাদের বিবেক বুদ্ধি হইতে যাহা উৎপন্ন তাহাকে মানিব, না অত্যন্ত হীন ইন্দ্রিয়লালসা হইতে যাহা উৎপন্ন তাহাকে মানিব? যদি বিবেকের জয় হইলে সমাজের উন্নতি হয়, তবে এই দুটির ভিতর একটি রাস্তা বাছিয়া লওয়া কিছু শক্ত নহে। তবে তর্কের খাতিরে এ কথাও বলা চলে যে, শরীর ও আত্মার যুগপৎ বিকাশ চাই। সে বেশ কথা! কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, আত্মার সামান্য বিকাশের জন্যও কিছু না কিছু সংযম পালন করিতে হয়। প্রথমে এই বিলাসের ভাবকে নষ্ট করিয়া দিলে, পরে যাহা ইচ্ছা হওয়া যায়।
গ্যাব্রিয়েল সিলেস লিখিয়াছেন, “আমরা মানুষ হইতে ইচ্ছা করি এ কথা বলা খুব সোজা, কিন্তু ইহা এক কঠোর কর্ত্তব্য এবং ইহা পালনে সকলেই অল্প বিস্তর অক্ষম। ‘আমরা স্বাধীন হইতে চাই’ ইহা ঘোষণা করিয়া লোকের অন্তরে আমরা ত্রাসের সঞ্চার করি। সহজাত সংস্কারের গোলামরূপে ইচ্ছামত কাজ করাকে যদি স্বাধীনতা বলিতে হয়, তবে এ জন্য গর্ব্ব করার কিছু নাই। যদি খাঁটি স্বাধীনতা চাই, তবে যেন কোমর বাঁধিয়া স্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই। একতা, সাম্য এবং স্বাধীনতা সম্বন্ধে কিছু বুলি কপচাইয়া গর্ব্বভরে আমরা ভাবি যে, আমরা ভগবানের অমর সন্তান। কিন্তু এই ‘আমি'কে ধরিতে চেষ্টা করিলে, ‘আমি’র খোঁজ পাই না; ইহা অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রাণীতে পরিণত হইবে—ইহারা একে অপরকে অস্বীকার করে, ইহাদের ইচ্ছাও পরস্পরবিরোধী—এই সব ইচ্ছার সমষ্টি লইয়াই আমি। যে সব কুসংস্কার এবং প্রলোভনের অধীন আমি হইয়া থাকি, আমি তাহাই। আমার এই স্বাধীনতা ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব ভিন্ন আর কিছুই নহে—এই দাসত্বকে অবশ্য আমি দাসত্ব মনে করি না এবং বাধা দেই না।”
রায়সেন বলেন, “সংযম শান্তির এবং অসংযম অশান্তিরূপ মহাশত্রুর উৎস। কামেচ্ছা সব সময় বিপদসঙ্কুল। কিন্তু যৌবনে ইহা ভয়ানক অধঃপতনের কারণ হইতে পারে। ইহা আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে বিলকুল বিগড়াইয়া দিতে পারে। যে যুবক প্রথমবার কোনো স্ত্রীলোকের সহিত মিলিত হয়, সে জানে না যে, এরূপে সে তাহার শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক জীবন লইয়া খেলা করিতেছে; সে ইহাও জানে না যে, এই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির কথা ভবিষ্যতে তাহার স্মৃতিপটে উদিত হইয়া তাহাকে বার বার যাতনা দিবে এবং সে আপনার ইন্দ্রিয়ের হীন দাসরূপে পরিণত হইবে। এমন অনেক লোকের কথা জানি, যাহাদের নিকট লোকে অনেক কিছু আশা করিয়াছিল, কিন্তু যাহারা গোল্লায় গিয়াছে—প্রথম বারের নৈতিক পতন হইতেই তাহাদের অধঃপতন শুরু হইয়াছে।”
কবিও দার্শনিকের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিতেছেন, “মানুষের আত্মা গভীর পাত্রের ন্যায়, একবার যদি ইহার উপর কলুষিত জল ফেলা হয়, তবে সহস্রবার ধুইলেও ইহার কলুষ দূর হয় না।”
ইংলণ্ডের বিখ্যাত শরীর-শাস্ত্রবিদ কেণ্ড্রিক সাহেব বলেন:— যৌবনেন্মেষের সময় অবৈধ ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কেবলমাত্র নৈতিক অপরাধ নহে, ইহা শরীরের পক্ষে মহা অনিষ্টকর। একবার বশ্যতা স্বীকার করিলে, এই নূতন অভাব আরও অত্যাচার করিবে, এবং মন অপরাধী হইলে ইহার কথা শুনিতে ইচ্ছা হইবে এবং ইহার শক্তি আরও বৃদ্ধি পাইবে। প্রত্যেক বারের নৃতন কাজ, গোলামীর জিঞ্জিরে এক নৃতন কড়া লাগাইবে।”
“ইহা ভাঙ্গিবার শক্তি অনেকের থাকে না। এই প্রকারে এক অজ্ঞতা-জনিত অভ্যাসের ফলে জীবন নষ্ট হয়। ইহা হইতে রক্ষা পাইবার শ্রেষ্ঠ উপায় হইল পবিত্র চিন্তা করা এবং সব কাজে সংযতভাবে চলা।”
শ্রীযুক্ত বুরো ডাক্তার এসকাণ্ডির লেখা উদ্ধৃত করিয়াছেন:—“মন ও সংকল্প দ্বারা মিলনের ইচ্ছাকে আয়ত্বাধীন করা যায়। ইন্দ্রিয়ভোগের প্রয়োজনীয়তার পরিবর্ত্তে ইন্দ্রিয়ভোগের ইচ্ছা শব্দ ব্যবহার করা দরকার, কারণ ইহা এমন কোনো অবশ্যকরণীয় কাজ নহে, যাহা ভিন্ন জীবন ধারণ করা অসম্ভব। অনেকে ইহাকে বিশেষ দরকারী ভাবিলেও বাস্তবিক ইহা দরকারী কাজ নহে। আমরা এ কথা বলিতে পারি না যে, প্রাকৃতিক নিয়মের বশীভূত হইয়া অনন্যোপায় হইয়া পরিণত বয়সে আমরা ইহাতে লিপ্ত হই। বরং পূর্ব্ব হইতে সংকল্প করিয়া জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছা করিয়াই আমরা ইন্দ্রিয়সেবায় নিরত হইয়া থাকি।