দেওয়ানা/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ।
জুমেলির মুখে সংবাদ পাইয়াই, আনারউন্নিসা, এক কক্ষ মধ্যে মীর লতিফের জন্য উৎকণ্ঠিত চিত্তে অপেক্ষা করিতেছিল। কক্ষ সন্ধ্য। সমাগমে পূর্ণভাবে দীপোজ্জ্বলিত। আর সেই মৃদুকম্পিত দীপ-শিখার মত তাহার হৃদয়ও দুরু দুরু কাঁপিতেছে। মীর লতিফ কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্রই, আনারউন্নিসা সহর্ষে বলিয়া উঠিল—“মীর লতিফ!”
মীর লতিফও স্নেহপূর্ণ স্বরে ডাকিল—“আনারউন্নিসা!”
বহু দিনের পর দেখা! দুই জনে চোখে চোখে মিলন। উভয়েরই হৃদয় অপূর্ব্ব আনন্দে—ধীরে স্পন্দিত। উভয়েরই বেশী কথা বলিয়া মনোভাব প্রকাশের অবসর কম।
মীরলতিফ দেখিল— আনার উন্নিসা, ভাদ্রের ভরা দরিয়ার মত, কুলে কুলে ভরিয়া উঠিয়াছে। অঙ্গের ঢল ঢল লাবণ্য, রূপের সমুজ্জ্বল প্রভা, মুখের গম্ভীর ভাব, সলজ্জ চাহনি, যৌবনের যাহা কিছু ঐশ্বর্য্য সম্পদ, তাহা সেই দেহবল্লরীতে পূর্ণ সুষমা লইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে।
একখানি চিকণের কাজ করা ফিরোজা—রঙ্গের ওড়নায় আনার উন্নিসার ক্ষীণ দেহযষ্টি আবরিত। সেই চিকণের কাজের উপর, দীপের আলো পড়িয়াছে। সে অপ্সর সৌন্দর্য্যের, অপূর্ব্ব মাধুরী দেখিয়া মীর লতিফ ভাবিল—যেন নীল মেঘে, বিদ্যুৎকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে। চিরচঞ্চলা সৌদামিনী, যেন স্থির মূর্ত্তি ধারণ করিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে।
আনার উন্নিসা বলিল— “তবু ভাল, যে আমাকে মনে পড়িয়াছে। কি অপরাধ করিয়াছি আমি লতিফ্! যে আমার উপর এতটা নিষ্ঠুর হইয়া সকল সম্পর্ক তুলিয়া দিলে?”
এ যে এক অদ্ভূত উল্টা অভিযোগ। কে যে নিষ্ঠুর,—কে যে কাহার সহিত সম্পর্ক লোপ করিল, তাহার উত্তর দিতে সক্ষম কেবল উভয়েরই মন। কিন্তু সে মনের ভিতরের কথা ব্যক্ত করিতে গেলে, শুষ্ক ক্ষতে আবার আঘাত পড়ে। কাজেই মীর লতিফ নিরুত্তরে রহিল।
আনার উন্নিসা, মীর লতিফের হাত খানি ধরিয়া একটী—সোফার উপর বসাইল। বহুদিনের পর সেই বিদ্যুন্ময় স্পর্শে, মীর লতিফের শরীরের সর্ব্বত্রই যেন একটা মৃদু বৈদ্যুতিক উত্তেজনার স্রোত বহিয়া গেল।
আনার, মলিন মুখে লতিফের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল। লতিফ বলিল,—“বসনা তুমি ও খানে আনার।”
আনার উন্নিসা একটী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, — “না বেশ আছি! আগে বল দেখি, তুমি কেমন আছ লভিফ?”
মীর লতিফ মলিন হাস্যের সহিত বলিল,—“মন্দই বা কি? জীবনের দিন গুলি, বিদেশে প্রবাসে কাটিতেছে মন্দ নয়। কিন্তু তোমার মুখ অত মলিন কেন? তুমি কেমন আছ আনারউন্নিসা?”
আনারউন্নিসা একটী মৃত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, — “খুব ভালই আছি আমি লতিফ্। অফুরন্ত ঐশ্বর্য্যের মালিক নবাব সুজাবেগের পত্নী আমি। দাসী বাঁদী আমার অনেক। গা-ভরা অলঙ্কার আমার—এতবড় প্রাসাদতুল্য অট্টালিকার স্বামিনী আমি! আমার মত সুখী কে মীর লতিফ্?”
আনারের উচ্ছ্বাসবদ্ধ কণ্ঠস্বর, ছল ছল নেত্র দেখিয়া, মীর লতিফ বুঝিল —এক সম্ভ্রান্ত ওমরাহের পত্নী হইয়াও, আনারউন্নিসা সুখী হইতে পারে নাই। সুখ ত ঐশ্বর্য্যের দাস নয়। সুখ—মনে।
তাহারই সুখের জন্য, সে যে খুব দূরে সরিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার এতটা আত্মত্যাগের কি এই শোচনীয় পরিণাম?
কি একটা প্রচ্ছন্ন দুঃখ, অবক্তব্য মনের বেদনায়, আনার বড়ই অধীর হইয়া পড়িয়াছে। সেটা যে কি, তা না জানিলে তার প্রতিকার করাও অসম্ভব।
এই জন্য আনারের হস্তধারণ করিয়া স্নেহ-পূর্ণ স্বরে মীর লতিফ্ বলিল,—“আনার উন্নিসা! তোমার এ মন কষ্টের কারণ কি?”
এ অযাচিত সহানুভূতির প্রবল শক্তি, আনারের হৃদয়ের নিভৃতকন্দরে গিয়া খুব জোরে আঘাত করিল। নবাব পত্নী হইবার পর তাহার ও মীর লতিফের মধ্যে যে একটা বিরাট ব্যবধান আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহা সেই মুহূর্ত্তে সরিয়া গেল।
অভাগিনী আনার উন্নিসা তখন ধীরে ধীরে বাহারবানু ঘটিত সমস্ত ব্যাপার, মীর লতিফকে বলিয়া ফেলিল। সে দিন যাহা ঘটিয়াছিল,—তাহাও সে বলিতে ভুলিল না।
মীর লতিফ ধীরভাবে সমস্ত কথাগুলি শুনিয়া বুঝিল,—“এই সর্ব্বনাশিনী বাহারবানু বর্ত্তমান থাকিতে, নবাব সুজাবেগ কখনই তাহার ছলনাপাশ হইতে মুক্ত হইতে পারিবেন না। আর তাহা না হইলে, আনার উন্নিসাও এ জীবনে সুখী হইবে না। লতিফ্ চায় আনারের সুখ। সে চায়—আনারের সদা প্রফুল্ল হাস্যমুখ।
অসম্ভব আত্মত্যাগ করিয়া, আনারকে চিরসুখী দেখিবার জন্য লতিফ যে তাহার সম্মুখ হইতে দূরে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এখন সে বুঝিল, তাহার সে উদ্দেশ্য বিফল হইয়াছে। আনারউন্নিসাকে মনে মনে আরাধ্য দেবীরূপে আরাধনা করিয়া তাহার রূপ চিন্তা করিয়াই যে তাহার সুখ। আনার উন্নিসাকে সুখী দেখিতে পাইলেই যে তাহার জীবনের সার্থকতা। কিন্তু নসীবে না থাকিলে সুখ দেয় কে? তাহা যদি না হইবে, তাহা হইলে আনার উন্নিসা আজ এত অসুখী কেন? নবাব সুজাবেগের পত্নীর এ মর্ম্মভেদী দীর্ঘশ্বাস কেন?
কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া কি ভাবিয়া মীর লতিফ উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, “আনার উন্নিসা! মনে পড়ে এক দিন আমি আমার দেহের শোণিত দিয়া, তোমার বিপন্ন জীবন রক্ষা করিয়াছিলাম! একদিন তোমাকে নদী তরঙ্গের করাল গ্রাস হইতে উদ্ধার করিয়াছিলাম। আজও তোমার স্বার্থের জন্য, তোমার হিতের জন্য—তোমার সুখের পথের কণ্টক এই বাহারবানুকে তোমার পথ হইতে সরাইবার জন্য—যাহা কিছু করা সম্ভব—তাহা আমি করিতে প্রস্তুত।”
মীর লতিফ এই পর্য্যন্ত বলিয়াই থামিয়া গেল। আর আনার ঊন্নিসা বিস্মরবিহ্বল নেত্রে লতিফের সেই উত্তেজিত ক্রুদ্ধ মূর্ত্তি দেখিল। সে মনে মনে বড়ই ভয় পাইল। সে জানিত, এই মীর লতিফ চিরদিনই ঘোর নির্ব্বন্ধবান। তাহার কথার ভাবে সে বুঝিল, এখনও সে তাহার উপর সমানভাবে স্নেহশীল। আর এটুকুও বুঝিল, এই মীর লতিফ তাহার জন্য সবই করিতে পারে।
তাহা হইলেও আনার উন্নিসা লতিফের কথার ভাবে, একটু ভয় পাইয়া তাহার হাতখানি ধরিয়া বলিল, — “তুমি কি বাহারকে হত্যা করিবে না কি?”
বিকট হাস্যের সহিত মীর লতিফ বলিল,— “না—না সে ভয় তোমার নাই। তাহার মত কলুষিতা নারীর শোণিতে হস্ত রঞ্জিত করিবার প্রবৃত্তি আমার নাই। হত্যা ভিন্ন আরও অনেক উপায় আছে, যাহার সহায়তায় আমি বাহারের মুখ বন্ধ করিয়া দিতে পারি। নবাব সুজাবেগের উপর তাহার এতটা আধিপত্য কিসে, ইহার মধ্যে প্রেমের ব্যাপার ছাড়া আরও কোন কিছু আছে কি না, এ গূঢ় রহস্য যে দিন জানিতে পারিব সেই দিনই নবাব সুজা খাঁর ব্যাধির শান্তি হইবে। তুমিও কণ্টকমুক্ত হইবে।”
এই কথা বলিয়া, উত্তেজিত মুখে মীর লতিফ উঠিয়া দাঁড়াইল। আনার উন্নিসা তাহাকে আর একটু অপেক্ষা করিবার জন্য, বার বার অনুবোধ করিলেও, সে তাহা রক্ষা করিল না। যাইবার সময় কেবলমাত্র বলিয়া গেল—“আর তিন দিন পরে, আবার তোমার সঙ্গে দেখা করিব। সেই দিন বলিব, তোমার কাজ কত দূর অগ্রসর হইল।”
মীর লতিফ্ চলিয়া গেলে, আনার উন্নিসা সেই কক্ষমধ্যে দাঁড়াইয়া কত কি ভাবিতে লাগিল। সে এক এক বার মনে মনে ভাবিল —“নবাব সুজাখাঁ যে তাহাকে আজকাল এতটা অগ্রাহ্য করেন, বাহারবানুর প্রেমের মোহই এই তুচ্ছ তাচ্ছল্যের মূল। আর এ কথাটা মীর লতিফের কাছে বলিয়া, সে যেন খুবই একটা হাল্কা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে। যদি দুঃখ ভোগই তাহার ভবিতব্য হয়, তাহা হইলে, বিধাতা রমণীকে যে সহিষ্ণুতা শক্তি দিয়াছেন, তাহা অবলম্বনে এ দুঃখটা নীরবে মনে মনে সহিয়া গেলেই ত ভাল হইত! বিধাতা স্বহস্তে তাহার ললাটফলকে যে দুঃখের ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহার শক্তি লোপ, এ ক্ষুদ্র মানব মীর লতিফ্ কি করিয়া করিবে? যে স্বামী তাহার সকল দুঃখ মোচনের কর্ত্তা— তাহার জ্বালাময় অশ্রুজল মুছাইবার অধিকারী, তিনি যখন তাহা পারিলেন না—তখন এই ক্ষুদ্র শক্তি মীর লতিফ কি করিবে?”
কিন্তু সে জানিত, মীর লতিফ বড়ই হিংস্র প্রকৃতি। রাগ হইলে তাহার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। তাহার মুখ দিয়া একবার যে প্রতিশ্রুতি বাক্য বাহির হয়, তাহা পালনের জন্য সে তাহার জীবনকে বিপন্ন করিতেও কুণ্ঠিত হয় না। তবে কি মীর লতিফ তাহারা সুখের পথের কণ্টক উন্মূলিত করিবার জন্য, বাহারবানুকে হত্যা করিবে?
আনার এই সব চিন্তায় ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি শয্যায় গিয়া মুখ লুকাইল। কি একটা যাতনায় যে তাহার প্রাণ মুছড়াইয়া ধরিতেছে, তাহা সে ঠিক বুঝিতে পারিল না। চারিদিক হইতে যেন একটা প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক, ছায়াময় বিভীষিকা, তাহাকে ভয় দেখাইতে লাগিল। সে এই সব ভাবিতে ভাবিতে, সে অবসন্ন চিত্তে শয্যা আশ্রয় করিল।
জুমেলি আজকাল নীচে থাকিত। কেননা আনার-এদানীং বড়ই নির্জ্জনতা প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল।
সে দিন আবার ঘটনাবশে আকাশটা খুব মেঘাচ্ছন্ন। আকাশের গায়ে বিদ্যুৎ চমকিতেছে। সেই কক্ষ মধ্যে বিনিদ্র নেত্রে আনার একা। বাহিরে প্রকৃতির অন্ধকার, আর বায়ুর প্রবল সনসনানি, বিদ্যুতের ঝলকানি দেখিয়া সে বড়ই ভয় পাইল। নবাব সুজাখাঁর জন্য সে বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠিল।
আবার বিদ্যুৎ! আবার মেঘ গর্জ্জন! আবার বজ্রনাদ! আনার উন্নিসা ভয়ে চমকিয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল—“কোথায় তুমি জীবিতেশ্বর! কোথায় তুমি নবাব সুজা খাঁ! এস আমার হৃদয়ের ধন! আমার ঘরে ফিরিয়া এস। আমি বড়ই ভয় পাইতেছি।”