দেওয়ানা/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।
বহুদিন আমরা মীর লতিফের কোন সংবাদ পাই নাই। একবার তাহার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ করিতে হইবে।
সাধু ফকির জুম্মাশার উপদেশে, বহুদিনের সুখময় স্মৃতিকে বিস্মৃতির অনলগর্ভে নিক্ষেপ করিয়া, সে অতি দূর দেশে চলিয়া গিয়াছিল।
আনারকে দেখিবার জন্য, তাহার মনে খুবই একটা উৎসুক্য জাগিয়া উঠিল। সে ঔৎসুক্য—সে কোন মতেই দমন করিতে পারিল না। সেই আনার উন্নিসা—এখন না জানি দেখিতে কেমন সুন্দর হইয়াছে, তাহার রূপপ্রভা দশদিক আলো করিয়া, প্রভাত সূর্য্যকিরণের মত চারিদিকে কতই না জ্যোতি ছড়াইতেছে, একটা বৃহৎ সংসারের গৃহিণীরূপে সে কি ভাবে সংসার চালাইতেছে, তাহা দেখিবার জন্য তাহার বড়ই একটা ঔৎসুক্য জন্মিল। এই জন্য সে এক সপ্তাহের অবসর লইয়া চুপি চুপি আগরায় আসিয়াছে।
জামাল খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, মীর লতিফ্ আনারউন্নিসার সম্বন্ধে সকল সংবাদই পাইল। নবাব-পত্নী হইবার একমাস মধ্যেই, আনার নবাব সুজাবেগের প্রাসাদতুল্য ভবনে চলিয়া গিয়াছে। তাহার চেষ্টায় যত্নে, পত্নীর কর্ত্তব্যে, নবাব সুজা বেগ এখন কলুষিত স্বভাব ত্যাগ করিয়াছেন। দুষ্ট লোকের সাহচর্য্য বিসর্জ্জন করিয়াছেন। আর আনারের শৃঙ্খলায় ও সুব্যবস্থায়, নবাবের সংসারে একটা নূতন সৌন্দর্য্য ফুটিয়া উঠিয়াছে।
কথাগুলি শুনিয়া, মীর লতিফের বুকটী যেন দশ হাত স্ফীত হইয়া উঠিল। সে মনে মনে বলিল—“আনার! তোমাকে আজও আমি ভালবাসি। স্বার্থত্যাগেই ভালবাসার মহত্ত্ব। তুমি সুখে আছ, ইহা শুনিয়া যে আমার সুখ! তুমি চিরদিন এইরূপ সুখে থাক, ইহাই আমার কামনা। আমি জানি খোদা তোমাকে অপূর্ব্ব স্পর্শমণিরূপে সৃজন করিয়াছেন। যে তোমার সাহচর্য্যে আসিবে, সে পিতল হইলেও সোনা হইবে।
সে মোটে সাতটী দিন আগরায় থাকিবে। কিন্তু এর মধ্যে একবার আনারের সঙ্গে তাহাকে সাক্ষাৎ করিতেই হইবে। এই ইচ্ছাটা সে কোন মতেই দমন করিতে পারিল না।
জামাল খাঁর নিকট বিদায় লইয়া সে মনে ভাবিল—“নবাব সুজাখাঁর প্রাসাদ ত বেশী দূরে নয়। একবার দেখিয়া গেলে হয় না কি?”
তাহার মনে বড়ই একটা সংকোচময় লজ্জার ভাব উপস্থিত হইল। কিন্তু আনারকে দেখিবার একটা অতি প্রবল বাসনা, এই সংকোচকে মাঘের কুয়াসার মত তখনই উড়াইয়া দিল।
সে নবাব সুজাখাঁর ভবনের উদ্দেশে চলিল। বাড়ীর নিকটস্থ হইবামাত্রই, ভবিতব্য প্রেরণায়—জুমেলির সহিত তাহার দেখা হইল। জুমেলি তখন সংসারের একটী ফরমায়েস লইয়া বাহিরে যাইতেছে।
মীর লতিফ প্রথমতঃ অর্দ্ধাবগুণ্ঠিতা এই জুমেলিকে চিনিতে পারেন নাই। কিন্তু জুমেলি তাহাকে দেখিবামাত্রই স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া, অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া বলিল—“বন্দেগি! জনাব মীর লতিফ সাহেব! লাহোর হইতে আপনি কবে ফিরিলেন?” মীর লতিফ জুমেলিকে দেখিয়া খুব সুখী হইল। সে মনে মনে ভাবিল—খোদা তাহার সহায়। তাহা না হইলে এই জুমেলি সহসা তাহার সম্মুখে আসিয়া পড়িবে কেন?
মীর লতিফ সহাস্য মুখে বলিল— “ভাল আছ ত জুমেলি? তোমার বিবি ভাল আছেন ত? বোধ হয় তোমরা আমার কথা একবারে ভুলিয়া গিয়াছ।”
জুমেলি সহাস্য মুখে বলিল— “না—সাহেব! তা নয়! আপনার মত লোককে ভুলিয়া যাওয়া সহজ কাজ নয়। কালই নবাব বেগম আপনার কথা বলিতেছিলেন। বাস্তবিক আপনি বড় নিষ্ঠুর!
মীর লতিফ। কেন? আমার অপরাধ?
জুমেলি। চিঠি পত্রের আদান প্রদান বন্ধ করিলেন কেন? কুশল সংবাদের আদান প্রদানে দোষ কি?
মীর লতিফ একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল “তা বটে—কিন্তু এখন আর এরূপ পত্র ব্যবহারটা সঙ্গত নয়।”
চতুরা জুমেলি, মীর লতিফের মনের কথা বুঝিয়া ও সম্বন্ধে আর কোন কিছু বলিল না। কেবল মাত্র বলিল—“আপনি এখন আগরাতেই থাকবেন ত?”
মীর লতিফ। না— সরকারের জরুরি পত্রবাহক রূপে একখানি গোপনীয় পত্র আমাকে সুলতান দারার নিকট আনিতে হইয়াছে। পত্রের জবাব বোধ হয় এক সপ্তাহের মধ্যে পাইব। জবাব পাইলেই আমাকে লাহোরে চলিয়া যাইতে হইবে।”
জুমেলি মুহুর্ত্ত মাত্র কি ভাবিয়া বলিল—“বেগমের সহিত একবার দেখা করিবেন না?”
মীর লতিফের মুখমণ্ডল আরক্ত ভাব ধারণ করিল। আনারউন্নিসার সহিত দেখা করিতে তাহার সাহস হইল না। বাল্যের—কিশোরের— যৌবনের সকল কথাই যেন প্রত্যক্ষ স্বপ্নের স্মৃতির মত, তাহার মনে ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিল।
মীর লতিফ কম্পিত স্বরে বলিল— “সেটা কি ভাল? নবাব সুজা বেগ কি মনে করিবেন?”
জুমেলি। নবাব এখানে নাই। তিনি আজমীরে গিয়াছেন। বোধ হয় দুই দিন ফিরিবেন না। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। মীর লতিফ মনে মনে অনেক কথাই ভাবিতে লাগিল।
অনেক দিনের কথা! সেই আনারউন্নিসা, সেই বাল্য ক্রীড়া, সেই দিবারাত্রব্যাপী সাহচর্য্যও আসক্তি—সেই আসক্তিতে প্রেমের মধুর বিকাশ। তার পর দারুণ নিরাশাময় যবনিকার পতনে, মিলনের পরিবর্ত্তে চিরদিনের বিরহ। হায়! সেই রূপসম্পদময়ী, স্নেহময়ী, সহাস্যমুখী, আনারউন্নিসাকে যে কত দিন দেখি নাই! দুঃখের দিনে যাহার দুঃখ কষ্টে দুঃখ ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আজ তাহার সুখের দিনে—একটু আনন্দিত হইব না কেন? দেখায় একবার দোষ কি?
সন্দেহে দোলায়মান চিত্ত, স্থির ভাব ধারণ করিল। প্রবৃত্তি দমনের শক্তি, দর্শনাকাঙ্ক্ষার প্রবল টানে শিথিল হইয়া গেল।
মীর লতিফ একটী মর্ম্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল “ভাল তাহাই হউক। তোমার বেগমকে গিয়া সংবাদ দাও।”