দেওয়ানা/চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ।

 প্রভাতের পূর্ব্বে নবাব সুজা বেগের চৈতন্য হইল। দেহের তাপ যেন অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। বোধ হয় জ্বর ছাড়িয়া আসিতেছে।

 নবাব ক্ষীণ স্বরে বলিলেন,— “আমি কোথায়?”

 আনারউন্নিসা তাঁহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল,“তুমি নিজের কুঠিতে আছ।”

 সুজাখাঁ। আনার উন্নিসাকে একবার ডাকিয়া দাও।

 আনার। আমিই ত তোমার সঙ্গে কথা কহিতেছি। কি কষ্ট হইতেছে নবাব?

 সুজাখাঁ। আনার! আমি বোধ হয় এ যাত্রা রক্ষা পাইব না।

 আনার। ছিঃ! ও কথা বলিও না। তুমি এখন অনেক ভাল আছ। চেতনা ছিল না — চেতনা হইয়াছে। জ্বরও কমিয়া আসিতেছে।

 সুজাখাঁ একটু মলিন হাস্য করিয়া, আনারের মুখের দিকে চাহিলেন। তার পর সহসা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ওঃ—বড় যাতনা। আনার উন্নিসা! আমি চলিলাম। বিদায় দাও—আমার আনারউন্নিসা। তোমাকে লইয়া সোনার সংসার পাতিয়াছিলাম। শয়তানী বাহারবানু তাহাতে আগুণ ধরাইয়া দিল।”

 সুজা এই টুকু বলিয়া বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। আনার তখনই তাঁহাকে উত্তেজক পানীয় দিল। তিনি আবার প্রকৃতিস্থ হইলেন। ক্লান্তিবশে চোখ বুজিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ এই ভাবে থাকিবার পর, নবাব সুজাখাঁ চক্ষু চাহিয়া দেয়ালের দিকে ভীতিপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—“ঐ— ঐ—সে আসিতেছে!”

 আনার শশব্যস্তে, চকিতনেত্রে, সেই কক্ষের চারিদিকে চাহিয়া বলিল—“কৈ—কেউ তো এখানে নাই প্রিয়তম!”

 সুজা খাঁ আবার ভয়ে চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন “ঐ—ঐ—বাহারবানু! সে প্রথম চেষ্টায় আমায় হত্যা করিতে পারে নাই বলিয়া, আবার ছুরি লইয়া মারিতে আসিতেছে! ঐ—সে! ঐ আবার আমার বুকে ছুরি বসাইয়া দিল! আনার! আনার! রক্ষা কর। বাঁচাও—আমাকে! প্রতিশোধ লওয়া হলোনা!”

 এই উত্তেজনার বিরামে নবাবের আর বাক্য স্ফুর্ত্তি হইল না। সমস্ত দেহ সহসা হিমাঙ্গ হইয়া পড়িল। নবাব সুজা খাঁ, শয্যায় ঢলিয়া পড়িয়া, জন্মের মত নীরব হইলেন। সব ফুরাইল! সেই স্নিগ্ধ প্রভাত বায়ুতে—তাঁহার জ্বালাময় শেষ নিঃশ্বাস মিশিল!

 ঠিক এই সময়ে, কে একজন সেই কক্ষের দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে আসিয়া বলিল— “নবাব! তোমার শেষ ইচ্ছা আমি পূর্ণ করিয়াছি। আনার! আনার! এই নাও সেই শোণিতাক্ত ছুরিকা! এই ছুরিকায় যে উজ্জল শোণিত কলঙ্ক দেখিতেছ, তাহা নবারের আর সেই শয়তানী বাহারবানুর! এই নাও তোমার রত্নহার! তোমার পথের কণ্টক সরাইবার জন্য তোমারই কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিলাম। কাল সন্ধ্যার সময়, যখন তোমার কাছে আসি—তখন তুমিই কাঁদিতে কাঁদিতে আমার হাতে ধরিয়া অনুরোধ করিয়াছিলে, নবাব একাকী আরামবাগে গিয়াছেন। যে উপায়ে পার, নবাবকে বাঁচাও। কিন্তু নবাবকে ত বাঁচাইতে পারিলাম না! হায়! আনার! এক মুহুর্ত্ত আগে যদি পৌঁছিতাম। তাই নিরাশার মনস্তাপে, বাহারবানুকে হত্যা করিয়া, নবাব সুজাখাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ লইয়াছি!”

 মীরলতিফ আনারের দিকে উন্মাদের মত বিকট দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া, সেই ছুরিকাখানি কক্ষ মধ্যে সজোরে নিক্ষেপ করিল। আর সেই রত্নহার আনারের দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, দ্রুতপদে সেই কক্ষ হইতে বাহির লইয়া গেল। নবাবের মৃত্যুর সহিত সকল ঘটনার শেষ যবনিকা পড়িল।

 * * * *

 পারিবারিক মসৌলিয়ামে বা সমাধিক্ষেত্রে— নবাব সুজা বেগের বিনা আড়ম্বরে সমাধি হইয়া গিয়াছে। তাহার পর দুই মাস কাটিয়াছে। শোকের দিনই হৌক, আর সুখের দিনই হৌক, সমান ভাবেই সেগুলি চলিয়া যায়।

 সুলতান দারা, নবাব সুজা বেগের মৃত্যু সংবাদে বড়ই ব্যথিত চিত্ত হইলেন। তাঁহার অকাল মৃত্যুতে তিনি একজন অনুরাগী সুহৃৎ হারাইলেন। বাহারবানুর দ্বারাই যে এ হত্যা কাণ্ড ঘটিয়াছিল—সহরে তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল। সুলতান বাহারবানুকে ধরিবার জন্য, অনেক চেষ্টা করিলেন। পরিশেষে তাহার নিজের গৃহ হইতেই তাহার গলিত মৃতদেহ বাহির হইল। সকলে বুঝিল, বাহার রাজদণ্ডের ভয়ে, লাঞ্ছনার ভয়ে, আত্মহত্যা করিয়াছে।

 এই এক মাসে আনারউন্নিসারও সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন হইয়াছে। সুখ, বিলাস, স্বচ্ছন্দ সবই সে ত্যাগ করিয়াছে। তাঁহার মুখের সে কান্তিলাবণ্য নাই—দেহে যত্ন নাই —বেশে আনুরক্তি নাই— সংসারে স্পৃহা নাই। একখানি নীলবসনে তাহার দেহ আবরিত। সর্ব্বদেহ অলঙ্কার শূন্য। মার্জ্জনার অভাবে, চুলে জট পড়িয়া যাইতেছে। আহারে স্পৃহা নাই—লোকের সহিত মিশিতে বাসনা নাই। দিনরাত মর্ম্মভেদী আকুল নিশ্বাস, তীব্রশোক জনিত অস্ফুট ক্রন্দন— গণ্ডবাহী মলিন অশ্রুধারা।

 প্রতিদিন গভীর রাত্রে, আনার অসংখ্য সুগন্ধি দীপ ও সুগন্ধ পুষ্প লইয়া, স্বামীর মসৌলিয়ামের মধ্যে যায়। সুস্নিগ্ধ গোলাপ বারিতে, সেই সমাধিতল মার্জ্জনা করে। সেই মর্ম্মর কক্ষের মধ্যে অগুরু ও লোবানের দীপ জালিয়া দেয়। তারপর প্রেমস্মৃতি সুগন্ধিত অশ্রুধারায়, সেই সমাধিতল সিক্ত করিয়া ঘরে ফিরিয়া আসে।

 জুমলা সাহেব, এখন বিষয় কার্য্য দেখিতেছেন। আনারের অভিলাষ অনুসারে, তাহার রত্নালঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া, ধর্ম্মশালায় দরিদ্র পালনের জন্য দেওয়া হইয়াছে। মীরলতিফের ও এই দুই মাস কোন সংবাদ নাই।

 জুমলা সাহেব কন্যাকে প্রকৃতিস্থ করিবার জন্য মিষ্ট কথায় নিত্যই বুঝান। তিনি একদিন বলিলেন,—“আনার উন্নিসা! দেখিতেছি স্মৃতি তোমার বড়ই যন্ত্রণা দিতেছে। চল তোমাকে লইয়া আমি দিন কতক তীর্থ ভ্রমণ করিয়া আসি!”

 আনারউন্নিসা কাঁদিতে বলিল— “ঐ যে পবিত্র মসৌলিয়াম, যাহাতে আমার স্বামীর দেহ চির বিশ্রাম লাভ করিতেছে, তাহাই যে আমার মহাতীর্থ! জীবনে তাঁর পরিচর্য্যা করিতে পারি নাই, কিন্তু তাঁর মরণে সে অবসর ঘটিয়াছে। এ সুযোগ ছাড়িব কেন? পিতা আমি—দেওয়ানা! সংসারের সহিত কোন সম্পর্কই আমার নাই। পিতা আমি—“দেওয়ানা।”

 ইহার পর জুমলা সাহেব তাঁহার কন্যাকে আর কোনরূপে বুঝাইবার চেষ্টা করেন নাই। মরুতাপবিদগ্ধ মলিন বনকুসুমের মত, দিনে দিনে শুখাইয়া, আনার উন্নিসা, এক দিন নিরাশাময় ভগ্নহৃদয়ে, স্বামীর পার্শ্বে চিরনিদ্রিতা হইল।

 এক দিন খুব মেঘ বৃষ্টি। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার! মধ্যে মধ্যে দামিনী স্ফুরণ, সে অন্ধকারকে আরও ভীষণ করিয়া তুলিতেছে।

 এই দুর্য্যোগময়ী রজনীতে, এক ছিন্ন মলিনবাস পরিহিত যুবা পূরুষ, বৃষ্টি ধারাসিক্ত দেহে, আনার ও নবাব সুজাবেগের সমাধিপার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল।

 তাহার হাতে এক রাশ ফুল। বিকট দৃষ্টিতে বহুক্ষণ সেই সমাধি দুটীর দিকে চাহিয়া থাকিয়া, সেই উন্মাদ, সেই শীতল সমাধির উপর সেই ফুলগুলি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বলিল— “মৃত্যুই—শান্তি! মৃত্যুর পর—অবিচ্ছিন্ন প্রেম! আঃ! কি সুখ তোমাদের! জ্বালাময় জীব আমি, চিরদিন জ্বলিতেই আসিয়াছিলাম।”

 সে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বিকট হাস্যের সহিত আবার অন্ধকারে মিশাইল। সে— মীরলতিফ।

সমাপ্ত।