দেওয়ানা/ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ।
সেই গভীর নিশুতি রাত্রে, এই ভয়াবহ কাণ্ডের পর, শয়তানী বাহারবানু বাটীতে ফিরিল। পথিমধ্যে শকটওয়ালাকে বিদায় করিয়া দিয়া, সে তাহার আবাস বাটীর পশ্চাতের এক ক্ষুদ্র দ্বার দিয়া —প্রেতিনীর ন্যায় নিঃশব্দে নিজের কক্ষে প্রবেশ করিল।
বাঁদী দুইজন রাত্রে বাটী চলিয়া যায়। কেবল মাত্র দ্বার রক্ষক একজন বান্দা, তাহার রক্ষকরূপে পুরীতে থাকে।
বাহারের কক্ষটী দীপোজ্জলিত। সে কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়াই, দ্বার ভেজাইয়া দিল। সেই রক্তাপ্লুত ভীষণ ছুরিকা খানি, তখনও তাহার হাতে। সে তাহার বস্ত্রমধ্য হইতে হীরক হারের পেটিকাটী বাহির করিয়া দীপালোকের সম্মুখে রাখিল। সেই বাস্কটী খুলিবামাত্রই, সে ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। সবিস্ময়ে দেখিল, যে সেই সমুজ্জল হীরক গাত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শোণিত বিন্দু!
আর সেই সুশাণিত ইস্পাহানী ছুরিকাখানি, তখনও রক্তমাথা। সে রক্তের দাগ মুছিবার যেন কোন উপায় নাই।
চিত্তের এই বিপ্লবময় অবস্থার প্রতিকারের জন্য, সে প্রচুর পরিমাণে সেরাজী পান করিল। খুব একটা ভীষণ যন্ত্রণায় অধীরা হইয়া, সে অস্ফুটস্বরে কাতরভাবে বলিয়া উঠিল— “হায়! করিলাম কি?”
তার পর—দন্তে দন্তে নিষ্পেষিত করিয়া—সেই শোণিতাক্ত ছুরিকাখানি হাতে লইয়া বলিল— “বেশ করিয়াছি! ভালই করিয়াছি! ইরাণীর উষ্ণ রক্ত, অপমানের তাপে ফুটিয়া উঠিলে, তাহাতে এমন একটা কেন—দশটা নরহত্যা করিতেও আমি কুণ্ঠিত| হই না। এত অপমান! এত লাঞ্ছনা! এত প্রতারণা! এতটা নেমকহারামী!”
সহসা সে দেয়ালের গায়ে যেন কাহারও ছায়া মূর্ত্তি দেখিল। সে মূর্ত্তি দেখিয়া সে ভয় পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মদিরার উত্তেজনা, আর নরহত্যার একটা ভীষণ স্মৃতি, তাহার মস্তিষ্কটাকে খুবই গরম করিয়া তুলিয়াছে। সে সভয়ে সবিস্ময়ে, চীৎকার করিয়া বলিল,—“কে—কে তুমি? নবাব সুজা খাঁ? তোমার হস্তে শাণিত ছুরিকা কেন? তুমি কি আমাকে হত্যা করিতে আসিয়াছ?”
দেওয়ালের নিকটস্থ সেই ছায়ামূর্ত্তি, যেন তাহার সম্মুখে সরিয়া আসিয়া বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলিল, “না—আমি নবাব সুজা খাঁ নই। আমি তোর যম!”
সেই মূর্ত্তির আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত। জড়িতস্বরে, কম্পিত হৃদয়ে বাহারবানু বলিল,—“সত্যই তুমি কি আমায় হত্যা করিতে আসিয়াছ?”
আগন্তুক। হাঁ—
বাহার। আমি তোমার কি করিয়াছি?
আগন্তুক। তাহা বলিতে আমি বাধ্য নই। শয়তানী! মৃত্যু—তোর সম্মুখে! নবাব সুজাখাঁর হত্যাকারীকে শাস্তি দিবার জন্য খোদা আমাকে এখানে পাঠাইয়াছেন।
বাহার। কে বলিল —যে আমি নবাব সুজাখাঁকে হত্যা করিয়াছি? মিথ্যা কথা তোমার! তুমি দস্যু! এই বহু মূল্য রত্নহারের লোভে তুমি আমার অনুসরণ করিয়াছ।
আগন্তুক তখনই বাহারের সম্মুখে রক্ষিত, শোণিতাক্ত ছুরিকা খানি তুলিয়া বলিল—“শয়তানী! মৃত্যু তোর সম্মুখে! তবুও মিথ্যা কথা বলিতেছিস্ তুই! এই ছুরিকার গাত্রলিপ্ত শোণিত কলঙ্ক, যে নবাব সুজা খাঁর হৃদয়ের শোণিত! অই সমুজ্জ্বল হীরক-হারের উপর অতি ক্ষুদ্র লোহিত শোণিত বিন্দু, যে নবাব সুজাখাঁর হৃদয়ের শোণিত! তোকে আর বেশী বাঁচিয়া থাকিতে দিলে খোদার রাজত্বে একটী ভীষণ বিপ্লব ঘটিবে। তোর জীবনের শেষ মুহুর্তে একবার সেই করুণাময় খোদাকে স্মরণ কর।”
বাহারবাহু বুঝিল,—ব্যাপার সহজ নয়। সে তখনই নতজানু হইয়া, আগন্তুকের চরণতলে বসিয়া পড়িয়া, যুক্ত করে অশ্রুপূর্ণনেত্রে, তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল “বড় অভাগিনী আমি। আমায় হত্যা করিও না। আমার জীবন ভিক্ষা দাও! এই বহুমূল্য হীরকহার, আর আমার যাহা কিছু অর্থ অলঙ্কার আছে—সবই তোমার। এ ভরা যৌবনে আমার অনেক সাধ! তাহার একটাও পূর্ণ হয় নাই। আমায় ছাড়িয়া দাও। আজ রাত্রেই আমি এই অভিশপ্ত আগরা হইতে চলিয়া যাইতেছি।”
আগন্তুক বলিল,—“না — না, কোন মার্জ্জনাই তোর জন্য নাই। তোর মত এক পাপিষ্ঠার জন্য, আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিতে চাহি না। আনার উন্নিসার সর্ব্বনাশ যে করিয়াছে, তাহার সর্ব্বনাশ আমি করিব।”
বাহারবানু তখন বুঝিল, এ হত্যাকারী দস্যু নয়,—তস্কর নয়,—অর্থ লোভে তাহার গৃহে প্রবেশ করে নাই। সে আসিয়াছে, আনারউন্নিসার পথের কণ্টক মুক্ত করিতে। আনার উন্নিসা নিজে যে প্রতিশোধ লইতে অসমর্থ, তাহা করিবার ভার দিয়াছে, এই নিষ্ঠুর প্রাণহীন আগন্তুকের উপর। বাহার তখন বিস্মিত চিত্তে বলিল,— “তাহা হইলে মরিবার পূর্ব্বে আমায় জানিতে দাও—কে তুমি?”
আগন্তুক সরোষে গর্জ্জন করিয়া বলিল,— “আমি মীর লতিফ! আনারের পিতার অন্নে পুষ্ট ক্রীতদাস আমি!”
বাহার বিদ্রূপ পূর্ণ স্বরে বলিল,— “ওঃ! তুমি মীর লতিফ! আনারউন্নিসার জার! লতিফ! কেন তুমি আমায় হত্যা করিবে? আমি নবাব সুজাখাঁকে হত্যা করিয়া ত তোমার প্রেমের পথের কণ্টক মুক্ত করিয়া দিয়াছি। আমার এই কর্ম্মের ফলে এখনত সেই দর্পিত আনার উন্নিসা তোমার।”
“আনারের জার” এ অপবাদ মীর লতিফ সহ্য করিতে পারিল না। সে তখনই উন্মাদের মত বিকট দৃষ্টিতে বাহারের সম্মুখস্থ সেই বিষাক্ত ছুরিকাখানি তুলিয়া লইয়া, তাহার বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিল!
আঘাত অতি সাংঘাতিক। সেই আঘাতেই বাহারবানু মরিল। তাহার মুখের শেষ কথা—“খো—দা—পা—পে—র প্রা—য়—শ্চি—ত্ত। চ—র—ণে—স্থা—ন—”
এ ভীষণ মৃত্যু দেখিয়া, মীর লতিফ একটুও কাঁপিল না। টলিল না। সেই মৃতদেহ টানিয়া লইয়া পার্শ্বের এক ক্ষুদ্র কক্ষে ফেলিয়া দিয়া তাহার দ্বারে চাবি দিল। তার পর বাহারের সেই হৃদয়শোণিতে কলঙ্কিত ছুরিকা ও হীরকহার লইয়া, পুরীর বাহিরে চলিয়া গেল।