দেওয়ানা/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ।
বলা বাহুল্য—সেই গভীর নিশীথে আনারের পিতা জুমলা খাঁ কোন এক অপরিচিতের মুখে সংবাদ পাইলেন—যে তাঁহার জামাতা, আহত অবস্থায় আরামবাগে পড়িয়া আছেন।
সংবাদ পাইবামাত্র, জুমলা খাঁ সর্ব্বপ্রথমে হাকিমের সন্ধানে লোক পাঠাইলেন। তৎপরে লোকজন সঙ্গে লইয়া, পালকী সহায়তায় নবাবের আহত শোণিতাক্ত দেহ তাঁহার প্রাসাদে লইয়া আসিলেন। ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে শয্যায় শোয়াইয়া দিলেন। নবাব সুজাখাঁ সম্পূর্ণরূপে চেতনাহীন—স্পন্দহীন।
হতভাগিনী আনার, তত রাত্রি পর্য্যন্ত উপরের কক্ষে নবাবের প্রত্যাগমন প্রতীক্ষায় জাগিয়াছিল। এমন সময়ে জুমেলি দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া তাঁহাকে সংবাদ দিল —“আমাদের সর্ব্বনাশ হইয়াছে! নবাব সাহেব কোন গুপ্ত শত্রুর হস্তে আহত হইয়াছেন। তিনি চেতনা শূন্য। তাঁহার সর্ব্বশরীর শোণিত সিক্ত। শীঘ্র নামিয়া এস। তোমার পিতা তাঁহাকে লইয়া আসিয়াছেন।”
বজ্রাহতা লতিকার ন্যায় কাঁপিতে কাঁপিতে, আনারউন্নিস। নীচে নামিয়া আসিয়া, যে শোচনীয় দৃশ্য দেখিল—তাহাতে সে ভয়ে আতঙ্কে মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িল। বাঁদীরা তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া, পার্শ্বের কক্ষে লইয়া গেল। জুমেলি, মূর্চ্ছিতা আনারের শুশ্রুষায় নিযুক্ত হইল।
জুমলা সাহেব—হাকিমকে নবাবের কুঠীতেই আসিবার জন্য উপদেশ দিয়াছিলেন। বান্দাদের সহায়তায়, জুমলা আহত স্থানটী পরিস্কার করিয়া, সুজাখাঁকে অপেক্ষাকৃত সুস্থ অবস্থায় রাখিয়াছিলেন। তখনও মৃদু ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস বহিতেছে। কিন্তু নেত্রদ্বয় নিমীলিত। প্রবল জ্বর আসিয়া দেহাধিকার করিয়াছে।
হকিম আসিয়া রোগীর অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করিয়া বলিলেন, “এই জ্বরটা ছাড়িবার সময় একটা বিভ্রাট ঘটিতে পারে। আঘাত যে খুব গুরুতর তা নয়। তবে বোধ হয়, ছুরিকা খানি বিষাক্ত! সুতরাং জীবন খুবই সঙ্কটাপন্ন।”
হকিম ব্যবস্থা করিয়া চলিয়া যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, “প্রভাতে কোনরূপ খারাপ লক্ষণ দেখিলেই, আমায় সংবাদ দিবেন।”
আনার উন্নিসার তখন পূর্ণ চেতনা হইয়াছে। সে তখনই আসিয়া স্বামীর শয্যাপার্শ্বে বসিল। জুমলা সাহেবের পুনঃপুনঃ নিষেধ স্বত্বেও, সে শয্যাপার্শ্ব হইতে নড়িল না।
সমস্ত রাত্রিটা একই অবস্থা। সেই কান্তিময় দেহ নিস্পন্দে শয্যায় পড়িয়া আছে। হৃদয়ের স্পন্দন অতি মৃদু। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত। আনার, একদৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া আছে। সে ক্রমাগতই ভাবিতেছিল—কে এ সর্ব্বনাশ করিল? কে তাহাকে বলিয়া দিবে, কিসে নবাবের জীবন রক্ষা হয়।
স্বামীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া অশ্রুপূর্ণনেত্রে উর্দ্ধে চাহিয়া আনার যুক্তকরে বলিল—“বিধাতা! দয়াময়! পথের ভিখারিণী হইতেও আমি প্রস্তুত। আমার স্বর্ধ্বম্মের বিনিময়ে আমার স্বামীকে ফিরাইয়া দাও। যাহা একদিন তুমি করুণার দান রূপে স্বেচ্ছায় আমায় দিয়াছিলে, তাহা আজ নিষ্ঠুরের মত কাড়িয়া লইও না।”
এই সময়ে জুমলা সাহেব কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন “ছিঃ—মা! একি কান্নার সময়? সাহসে বুক বাঁধ—সেবা কর। খোদার কৃপায় না হয় কি?”
আনার উন্নিসা অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বলিল—“কে আমার এ সর্ব্বনাশ করিল পিতা? আমিত কাহার কোন অনিষ্ট করি নাই।”
“যে করিয়াছে সে খোদার নিকট শাস্তি পাইবে। খোদাকে ডাক। এ বিপদে তিনিই আমাদের সহায় ও সান্ত্বনা।” এই কথা বলিয়া জুমলা সাহেব কক্ষান্তরে চলিয়া গেলেন।