দেওয়ানা/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।
এখন নবাব সুজা বেগ কোথায়, তাহা একবার আমাদের দেখিতে হইবে।
আগরা প্রাসাদের “হিরণমহলের” এক নিভৃত কক্ষমধ্যে বসিয়া চারিজন ওমরাহ গোপনে কি একটা জরুর ব্যাপারের আলোচনা করিতেছেন। এ কক্ষটী উপরের নয়, ভুগর্ভের মধ্যস্থ একটী গুপ্ত গৃহ। অবশ্য তাহার সাজসজ্জা ও উজ্জ্বল আলোকমালা দেখিলে, কেহ সহসা ধরিতে পারে না, যে সেটী “তয়খানা বা ভুগর্ভস্থ কক্ষ।”
এক সুন্দর স্বর্ণখচিত মখমলমণ্ডিত আসনে বসিয়া, এক দিব্যকান্তি পুরুষ। তাঁহার দক্ষিণে ও বামে এক একটি সোফা অধিকার করিয়া, আরও তিনজন লোক সেই কক্ষমধ্যে, উপবিষ্ট। তাঁহাদের পোষাক পরিচ্ছদ দেখিলে, বোধ হয় তাঁহারা কোন উচ্চশ্রেণীর ওমরাহ।
প্রথমোক্ত দিব্যকান্তি সম্পন্ন ব্যক্তিই সমাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজাদা দারা। আর তাঁহার নিকটে উপবিষ্ট এই তিনজন ওমরাহ, তাঁহার নিতান্ত বিশ্বাসভাজন ও অন্তরঙ্গ।
এই কয়জনের মধ্যে একজন হইতেছেন, নবাব সুজা বেগ। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই সুজা বেগ বাদশাহী মুকিম বা রত্নবণিক। উত্তরাধিকারানুসারে পিতামহ ও পিতার পর, নবাব সুজা বেগই এখন এই গৌরবময় পদ পাইয়াছেন। মোগল রাজত্বের সনাতন বিধানানুসারে, জ্যেষ্ঠ রাজকুমার দারাই সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী। কিন্তু তাঁহার অপর তিন ভ্রাতা, তাঁহার সিংহাসন লাভের পথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। প্রকাশ্যে না হইলেও, গোপনে গোপনে তাঁহারা স্ব স্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য দল বাঁধিয়াছেন ৷
এই তিন জনের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান কুমার ঔরঙ্গজেব। তিনি তাঁহার সহোদর, সম্রাটের অন্যতম পুত্র সুলতান মোরাদকে কলে কৌশলে তাঁহার আয়ত্ত্বাধীন করিয়া লইয়াছেন।
মধ্যম শাহজাদা শাহসুজা, এই সময়ে বাঙ্গালা বিহার উড়িষ্যার মালেক। সরকারী শালতামামী কিত্তি বাদ, এই তিন মুলুকের সকল আয়ের উপস্বত্ত্বের ও নজরাণার মালেক হইতেছেন তিনি।
সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ রাজপুত্র দারা শেকো, বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহানের অতি প্রিয়। তিনি জ্যেষ্ঠ—সুতরাং চাঘ্টাই মোগলদিগের কুলপ্রথানুসারে, তিনিই সিংহাসনাধিকারী। সম্রাট শাহজাহান বুঝিতে পারিয়াছিলেন, যে তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্ব হইতেই, তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে সিংহাসন লইয়া একটা মহা বিবাদ বাধিবে। এই জন্য তিনি ঔরঙ্গজেব ও মুরাদকে দাক্ষিণাত্যে ও গুজরাটে, আর শাহ সুজাকে বাঙ্গলা মুলুকের আধিপত্য দিয়া কৌশলে দূরে পাঠাইয়া তাঁহার প্রিয়তম পুত্র দারার সিংহাসন লাভের পথ অনেকটা পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিলেন।
কিন্তু হইলে কি হয়—চতুর ঔরঙ্গজেব, নিজের ধর্ম্মময় জীবনকে পুরোবর্ত্তী করিয়া,পিছন হইতে এমন কুট চাল চালিতে ছিলেন—যাহাতে দিল্লীর রাজনৈতিক আকাশ দিনে দিনে আরও ঘন ঘটাচ্ছন্ন হইয়া উঠিতেছিল।
সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র সুলতান দারা, শাহজাহানের প্রতিনিধিরূপে হিন্দুস্থান শাসন করিলেও রাজকোষ আর দৌলতখানার চাবি, বৃদ্ধ,সম্রাট শাহজাহান নিজের হেফাজতে রাখিয়াছিলেন। সুতরাং দারার খাস রাজকোষের উপর কোন আধিপত্যই ছিল না। তিনি সম্রাটের তহবিলের রক্ষক মাত্র।
সম্রাটের শরীর এদানীং বড় ভাল যাইতেছিল না। দারুণ মুত্রকৃচ্ছ রোগে, তিনি বড়ই ভুগিতেছিলেন। আর নিজে সকল সময় রাজকার্য্য দেখিতে পারিতেন না বলিয়াই, জ্যেষ্ঠ রাজকুমার দারাকে একটা সর্ব্বময় কর্তৃত্ব দিয়াছিলেন।
লাহোরে অবস্থানকালে, গুপ্ত প্রণিধিমুখে কোন জরুর গূহ্যসংবাদ পাইয়াই, রাজকুমার দারা আগরায় চলিয়া আসিয়াছেন। সে সংবাদের সারকথা এই, তাঁহার ভ্রাতৃগণ সম্রাটের পীড়ার কথা শুনিয়া, রাজধানীর দিকে সসৈন্যে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিতেছেন। দারা বুঝিলেন, তাঁহার সহোদরগণের কার্য্যে বাধা দিতে হইলে, প্রচুর সেনাবল ও অর্থের প্রয়োজন।
প্রচুর অর্থ থাকিলে, সেনার অভাব হয় না। দারার মনের বিশ্বাস, তাঁহার নিকট যাহা আছে—তাহা প্রচুর নহে। আরও বার লক্ষ টাকা তাঁহার প্রয়োজন। এই জন্যই জ্যেষ্ঠ শাহজাদা দারা, বিশেষ ব্যতিব্যস্ত হইয়া এই গুপ্ত মন্ত্রণা-সভা আহ্বান করিয়াছেন। আর এই সভায় আহুত তিনজন ওমরাহই, তাঁহার অতি বিশ্বাসভাজন ও অন্তরঙ্গ সুহৃৎ।
তয়খানার সেই গুপ্ত মন্ত্রণা-কক্ষটার দেওয়ালগুলি, লোহিত বর্ণে চিত্রিত। ইহার আসবাব—অর্থাৎ সোফা কৌচ ইত্যাদি যাহা কিছু, সবই লোহিতবর্ণের মখমল মোড়া। সেই লোহিতবর্ণের গৃহ আর গৃহসজ্জার উপর, লালরঙ্গের ফানুসের লাল আলো পড়ায় বোধ হইতেছিল কক্ষটী যেন—শোণিতরঞ্জিত।
সম্মুখে স্বর্ণখচিত বহুমূল্য সেরাজি পাত্র। কক্ষ মধ্যস্থ দীপাবলীর লাল আলো, এই রত্নমণ্ডিত পানপাত্রের গায়ে পড়ায় বোধ হইতেছিল, তাহার গাত্র বহিয়া যেন শোণিত ধারা পড়িতেছে।
কঞ্চস্থ সকলে এক চতুরস্ত্র আকারের লোহিত মখমলমণ্ডিত উচ্চ টেবিলের চারিদিকে বসিয়াছেন। এই টেবিলের উপর কোষমুক্ত স্বর্ণখচিত একখানি ক্ষুদ্র তরবারি। তাহার শাণিত ফলকের উপর লোহিতবর্ণের আলোকছটা পতিত হওয়ায়,তাহাও যেন রুধিরধারারঞ্জিত বলিয়া বোধ হইতেছিল।
সেই তয়খানা মধ্যস্থ গুপ্তকক্ষের অবস্থা, সত্যই মনে একটা বিভীষিকাময় অবস্থা আনিয়া দিতে ছিল। তাহার দীপালোক লোহিতবর্ণের। কক্ষ গাত্রও লোহিতবর্ণের। আস্তরণ, মছলন্দ সোফা, দিবান, সবই রক্তবর্ণ মখমলের তৈয়ারি। আর যাঁহারা সেই কক্ষে বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলের গম্ভীর মুখমণ্ডলে, দীপের লোহিতাভা পড়ায়, সেই চিন্তাগম্ভীর মুখগুলি আরও বিভীষিকাময়। রাজকুমার দারাই সেই কক্ষের নিস্তদ্ধতা ভঙ্গ করিয়া বলিলেন “বড়ই এক সাংঘাতিক ব্যাপারের মন্ত্রণার জন্য, আমরা আজ এই কক্ষে সমবেত। এখানে যে তিনজন উপস্থিত আছেন, তাঁহার। সকলেই আমার অন্তরঙ্গ মিত্র। সকলেই আমার জন্য জীবন বিসর্জ্জন করিতে প্রতিশ্রুত। কিন্তু আজ হইতেই আমাদের কার্য্য আরম্ভ করিতে হইবে। দিল্লীর “ময়ুর-সিংহাসন” উত্তরাধিকার সূত্রে আমার। আমি সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমার অন্য ভ্রাতারা যাহাতে সেনাবলে বলীয়ান হইতে না পারেন, তাহার বন্দোবস্ত আজই আমাদের করিতে হইবে। এই রক্তবর্ণ কক্ষের মধ্যে বসিয়া আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইতে হইবে,প্রয়োজন হইলে রক্তস্রোতে সাঁতার দিয়া আমরা বাদশাহী “তক্ত-তাউস” অধিকার করিব।”
“এ শোণিতোৎসবের মূল শক্তি প্রচুর অর্থ। আজ আমি আপনাদের প্রাণের দোস্ত বলিয়া সম্বোধন করিতেছি। আপনারা এখনই এই তরবারি, আর আমার মস্তকের এই রত্নময় উষ্ণীস্, স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করুন—“সর্ব্বস্ব পণে আপনারা আমার সহায়তা করিবেন। আপনাদের জীবনধনসম্পত্তি, আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হওয়া পর্য্যন্ত, আমার দখলে থাকিবে।”
কথাগুলি শেষ করিয়া, সুলতান দারা তাঁহার মস্তক হইতে বহুমূল্য রত্নখচিত শিরস্ত্রাণ খুলিয়া সেই মখমলমণ্ডিত চতুষ্কোণ কাষ্ঠাধারের উপর রাখিলেন।
শাহজাদার কথা শেষ হইবামাত্রই, উপস্থিত তিনজন তখনই ভূমির উপর নত জানু হইয়া বসিয়া, সেই তরবারির ও শিরস্ত্রাণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিলেন। তৎপরে তাঁহারা উঠিয়া দাড়াইয়া, সসম্ভ্রমে সেই তরবারি ও মুকুটটী স্পর্শ করিয়া বলিলেন “আজ হইতে আমরা আমাদের সর্ব্বস্ব পণ করিয়া এই তরবারি ও শিরস্ত্রাণ যাঁহার—সেই শাহজাদা মালকেমুলুক সুলতান মহম্মদ দারা শেকোর অধীনতা স্বীকার করিলাম। আজ হইতে আমাদের সমস্ত সঞ্চিত ঐশ্বর্য, তাঁহার কার্য্যে নিয়োগ করিতে প্রতিশ্রুত হইলাম।”
দারাও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এই প্রতিশ্রুতি বাক্য শেষ হইবামাত্রই, তাঁহার মুখমণ্ডল হর্ষপ্রফুল্ল হইয়া উঠিল ৷
সুগন্ধি সেরাজি পূর্ণ একটী পান পাত্র তুলিয়া লইয়া, দারা সম্মুখের দিকে একটু উঁচু করিয়া ধরিয়া বলিলেন—“আজ আপনারা সর্ব্বস্ব বিনিময়ে আমার অন্তরঙ্গ মিত্র। এই মুকুট আর তরবারি, আমার গৌরবান্বিত পিতা সম্রাট শাহজাহান আমাকে জ্যেষ্ঠত্বের সম্মান চিহ্নরূপে, সম্প্রতি উপহার দিয়াছেন। আপনাদের তিন জনের প্রদত্ত,এই দ্বাদশ লক্ষ মুদ্রা আমার আরছ কার্য্যপথ খুবই প্রসারিত করিয়া দিবে। এক মহা বিপদ, মহা বিগ্রহ, আমাদের সম্মুখে। জীবন মরণ পণে, আমাকে বিজয়শ্রী লাভ করিতেই হইবে। যদি এ বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাই— যদি মোগলের “তক্ত-তাউস” আমার দখলে আসে—তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবেন, মোগল সাম্রাজ্যের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পদ আপনাদের। আর এই দ্বাদশ লক্ষ টাকা দ্বিগুণ করিয়া আমি আপনাদের প্রত্যর্পণ করিব। আর যদি তা না হয়—”
মির্জ্জা আস্কারী খাঁ, যিনি একজন মহাধনী ওমরাহ, এই সময়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—“শাহজাদা! খোদা আপনার মঙ্গল করুন। ও সব অমঙ্গলের কথা ভাবিবেন না। আমরা দিব্য চক্ষে দেখিতেছি—এ তক্ত-তাউস আপনার। এ হিন্দুস্থান আপনার। সম্রাটের প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ পুত্র আপনি। খোদা আপনার সহায়। অতি ভাগ্যবান না হইলে, সম্রাটের জোষ্ঠ পুত্ররূপে কেহ এই দুনিয়ায় আসে না।”
সুলতান দারা এ কথায় বিশেষ একটা আনন্দ ও তৃপ্তি উপভোগ করিয়া বলিলেন—“তোমাদের মত হিতকামী, একান্ত সুহৃদের প্রার্থনা, নিশ্চয়ই সেই মহিমাময় বিধাতার চরণে পৌছিবে। এস—এই রত্নময় পানপাত্র আজ আমাদের এই বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করিয়া দিক্। ভুলিয়া যাও তোমরা, যে আমি দিল্লীশ্বর শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ভুলিয়া যাও তোমরা, যে খোদার ও মানুষের বিধানে আমি এই হিন্দুস্থানের ভবিষ্যৎ মালেক! আজ হইতে মনে ভাবিও, তোমরা আমার দোস্ত আমিও তোমাদের একজন বই আর কিছুই নয়। সুখে দুঃখে সম্পদে বিপদে, তোমরা আমার—আমিও তোমাদের।”
এই কথা বলিয়া সুলতান দারা, সেই পান পাত্র নিঃশেষ করিয়া—আবার তিনটী স্বর্ণ পাত্র স্বহস্তে সেরাজি পূর্ণ করিলেন। উপস্থিত সকলেই, বাদশাহ পুত্রের প্রসাদরূপে আবার এক এক পাত্র গ্রহণ করিলেন।
এই ওমরাহ তিনজনের মধ্যে, একজন সরকারী খাজনা খানার অধ্যক্ষ। তাঁর নাম মির্জ্জা আস্কারী বেগ। দ্বিতীয় ব্যক্তি নবাব সুজা বেগ—ইনি বাদশাহী মুকিম। তৃতীয় ব্যক্তি সম্রাটের খাস তোষাখানার হেপাজতকার মির্জ্জা হবীব। তিন জনেই প্রচুর অর্থবান— গননীয় ধনীশ্রেষ্ঠ ওমরাহ। তিনজনেই দারার অন্তরঙ্গ মিত্র। আর এই তিন জনেই তাঁহাদের সঞ্চিত সমস্ত ধন, এমন কি জীবন পর্য্যন্ত দারার অভীষ্ট সাধনে নিয়োগ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর মির্জ্জা আস্কারীই এ ক্ষেত্রে সকলের মুখপাত্র হইয়া, কথা কহিবার ভার পাইয়াছেন।
বার বার তিনবার সেই সুরা পাত্র পূর্ণ হইল। সেদিন পাত্র পূর্ণ করিবার জন্য বান্দা নাই, বাঁদী নাই, সাকিও নাই। কেননা ভুগর্ভস্থ এ গুপ্ত মন্ত্রণা গৃহে, মক্ষিকাটীর পর্য্যন্ত প্রবেশ নিষেধ।
ক্রমশঃ রাত্রি অধিক হইয়া পড়িতেছে দেখিয়া, সুলতান দারা বলিলেন—“এই মন্ত্রণা সভায় এইমাত্র শপথ অঙ্গীকারে তোমরা যে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইলে, তাহাই পর্য্যাপ্ত। আজ হইতে সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের প্রতিশ্রুতি মত সমস্ত ধনরত্নাদি আমার নিকট আসা চাই। আর একটা কথা অতি কষ্টের সহিত বিদায়ের পূর্ব্বে আমাকে বলিতে হইতেছে। আমার সহোদরগণের উপর আমার তিলমাত্র বিশ্বাস নাই। যদি তোমাদের তিনজনের মধ্যে, কেহ তাহাদের কাহারও প্রলোভন ও ছলনায় ভুলিয়া, আমার পক্ষ ত্যাগ কর, বা কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা কর, তাহা হইলে—তোমরা আমার অতি সাংঘাতিক দুষমনের মধ্যে গণ্য হইবে।”
এই বলিয়া সুলতান দারা, রৌপ্যনির্মিত একটী আধারের মধ্য হইতে লোহিতবর্ণের রেশমী রজ্জু ও একখানি রত্নখচিত শাণিত ছুরিকা বাহির করিয়া বলিলেন—“এই রজ্জু —এই শাণিত ছুরিকা, বিশ্বাসঘাতকের চরম দণ্ড। আমার নিযুক্ত গুপ্ত ঘাতকগণের অসাধ্য কার্য্য কিছুই নাই! আমার বন্ধুগণ এই কথাটা মনে রাখিয়া তাঁহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবেন ইহাই আমার শেষ অনুরোধ!”
সেই লোহিতবর্ণের রেশমী রজ্জু ও ছোরাখানি দেখিয়া সেই তিনজন ওমরাহ মনে মনে ভয়ে শিহরিয়া উঠিলেন।
তারপর তাঁহারা যুবরাজ দারার বস্ত্রপ্রান্ত চুম্বন করিলেন। তাঁহাদের মুখপাত্ররূপে আস্কারী খা ঁবলিলেন—“খোদা আমাদের নিমকহারামীর পাপ হইতে চিরদিনই রক্ষা করুন। শয়তানের ছলনায়, আমাদের চিত্ত যেন কখনও বিষাক্ত না হয়। কর্ত্তব্যপথ ভ্রষ্ট না হয়। স্থির মনে জানিবেন— শাহজাদা! যদি আপনার অভীষ্ট সাধনের জন্য আমাদের পথের ভিখারী হইতেও হয়, তাহাতেও আমরা প্রস্তুত। আপনার দৌলত, আমাদের দৌলত। আপনার বিজয়শ্রী, আমাদের বিজয়লাভ! আপনার পরাজয়ে আমাদের সমূহ সর্ব্বনাশ ও অধঃপতন। আপনার অনেক নিমক আমরা খাইয়াছি। আমাদের এ পদ ঐশ্বর্য্য সবই ত আপনার মেহেরবানে জনাবালি! আমরা আবার আপনার গৌরবান্বিত মুকুট ও তরবারি স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি—দেহে প্রাণ থাকিতে, আমাদের সঞ্চিত বিত্তের একটী কপর্দক থাকিতেও, আমরা আপনার সহায়তা করিতে বিমূখ হইব না। “আল্লা-হো আকবর!” সেই ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ। আর হজরতই তাঁর প্রতিনিধি। আমরা তাঁহাদের নাম লইয়া জনাবের কার্য্যে জীবন সমর্পণের জন্য, বার বার তিনবার প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হইলাম।”
বাদশাহী নহবতখানা হইতে এই সময়ে দ্বিতীয় প্রহরের নহবৎ বাজিয়া উঠিল। সেই চন্দ্রালোকিত নিথর—মধু যামিনীতে, মধুর বেহাগের মর্ম্মস্পর্শী আলাপ শুনিতে শুনিতে, সকলেই শাহজাদার নিকট হইতে বিদায় লইয়া প্রাসাদের বাহিরে আসিলেন। সকলেরই যান-বাহন সেখানে অপেক্ষা করিতেছিল।
নবাব সুজা বেগ বাটীতে ফিরিয়া আসিয়া, সরাসর অন্তঃপুরে গেলেন। তাঁহার কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিতে যাইতেছেন—এমন সময়ে জুমেলি কুর্ণীস করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
সুজা বেগ, ততরাত্রি পর্য্যন্ত জুমেলিকে জাগিয়া থাকিতে দেখিয়া,বিস্মিতচিত্তে বলিলেন “এত রাত হইয়াছে— তবু তোমরা জাগিয়া আছ—জুমেলি! বেগমও তাহা হইলে আমার আশাপ্রতীক্ষায় জাগিয়া আছেন?”
জুমেলি বলিল— “তাঁর তবিয়ৎটা আজ বড় ভাল নয়, এজন্য একটু সকাল সকাল শয্যা আশ্রয় করিয়াছেন। আপনি ফিরিয়া আসিলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়ার ভারটা আমার উপর দিয়াছেন বলিয়াই, আমি এখনও জাগিয়া আছি।”
নবাব সুজা বেগ, কি একটা ভাবিয়া লইয়া বলিলেন— “যখন বেগমের তবিয়ৎ ভাল নয়, তখন তাঁহাকে জাগাইবার কোন প্রয়োজন নাই। আজ আমারও বড় ক্লান্তি বোধ হইতেছে এজন্য আমিও একটু নির্জ্জনে থাকিতে চাই। যাও—তুমি শয়ন করগে। রাত প্রায় একটা বাজে।”
জুমেলি কোন কিছু বলিবার পূর্ব্বেই, নবাব সুজা বেগ চিন্তাকাতর হৃদয়ে, নিজের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া, দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। তাঁহার মনে একটা দারুণ অশান্তি জাগিয়া উঠিয়াছে।
নবাব সুজা বেগ,নিদ্রাহীন নেত্রে, চঞ্চলহৃদয়ে সেই কক্ষমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন। সবুজ বর্ণের সামাদানের মধ্যে কয়েকটী স্নিগ্ধ সুগন্ধি বর্ত্তিকা কাঁপিয়া কাঁপিয়া জ্বলিতেছিল ঐ কম্পন, ঠিক যেন তাঁহার হৃৎপিণ্ডের তৎসাময়িক দ্রুত স্পন্দনের অনুরূপ। কি একটা দারুণ দুশ্চিন্তায় তাঁহার মুখ অতি মলিন। বাদশাহী বিলাসভোগ, উৎকষ্ট ও দুষ্প্রাপ্য ইস্পাহানী সেরাজি, তাঁহার চিত্তে যে একটা প্রসন্ন ভাব আনিয়া দিয়াছিল, দারুণ দুশ্চিন্তার ফলে তাহাতে একটা অবসন্নভাব আসিল। তিনি চঞ্চল হৃদয়ে শয্যাশ্রয় করিলেন।
কিন্তু সে শয্যা যেন অনলকণাময়। ইস্তাম্বুলের সুগন্ধ সেই শয্যার উপাধানে ও আস্তরণে। কিন্তু তাহা হইতে যেন নরকের তীব্র পূতিগন্ধ বাহির হইতেছিল। রাশিকৃত গুলাবগুচ্ছ এক স্ফাটিকময় ফুলদানীর উপরে ছিল। সে গুলাবের গন্ধও যেন অতি উগ্র।
সুজা বেগ—ব্যাকুল হৃদয়ে—অস্ফুট স্বরে সহসা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—“হায়! আজ আমি আমার সর্বস্ব হারাইয়া, পথের ভিখারী হইলাম। আজ হইতেই আমার নবাবী লীলা শেষ হইল।”