দেওয়ানা/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
পরদিন প্রভাতে উঠিয়াই, আনার বেগম তাঁহার প্রিয়সঙ্গিনী জুমেলিকে প্রশ্ন করিলেন—“নবাব সাহেব কাল বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছেন কি?”
জুমেলি বলিল—“হাঁ।— তখন রাত্রি বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছে।
আনার। বড়ই বেয়াদব তুই। আমায় ডাকিস্ নি কেন? আমি ত তোকে বলেছিলুম—যত রাত্রেই তিনি আসুন না কেন, আমায় জাগিয়ে দিবি!
জুমেলি। তার অবসর পেলুম কই বেগম?
আনার। অবসর না পাবার কারণ?
জুমেলি। খোদ নবাব সাহেবের নিষেধ!
আনার। নিষেধ? কেন আমি তাঁর কাছে কি অপরাধ করেছি?
জুমেলি। অপরাধ করা—করি নয়। সংসারে অনেক কাজ এমন ভাবে ঘটে যায়, যে তাতে অনেকে মনে ভাবে, তারাই অপরাধী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অপরাধ কারুরই নয়।
আনার। তোর ও সব বাঁকানো জ্ঞানের কথা, এখন তুলে রেখে দে। সত্য বল ব্যাপার কি?
জুমেলি। ব্যাপার কিছুই নয়। আমি বললুম—বেগমের তবিয়ৎ ভাল নয়, এজন্য তিনি একটু সকাল সকাল শয্যা আশ্রয় করেছেন। তাই শুনে তিনিও বল্লেন—যে তা হলে আর এতরাত্রে তোর বেগমকে জাগাবার কোন প্রয়োজন নেই—আমারও দেহ মন ভাল নয়!
আনার। কেন? কেন তাঁর মন ভাল নয় কেন?
জুমেলি। তা কেমন করে জান্বো বল? তবে—
আনার। তবে বলে থেমে গেলি যে?
জুমেলি। না, সে বাজে কথাটা তোমার শুনে কাজ নাই বিবি সাহেব! আমার জিভ টা বড়ই অসামাল। সকল সময়ে ঠিক করে লাগাম দিয়ে রাখ্তে পারিনি। এজন্য অনেক বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ে। অনেক সময় তোমার কাছে এজন্য বকুনিও খেয়েছি।
জুমেলির মুখে সেই ভাবের কথা শুনিয়া, কি একটা অব্যক্ত সন্দেহের পীড়নে, আনারের প্রফুল্লমুখ খানি যেন একটু মলিনাভ হইয়া পড়িল। সে তখনই আত্মসংবরণ করিয়া লইয়া বলিল, “তবে—বলে থেমে গেলি যে? তোর এই “তবের” শেষটা আমাকে শুনতেই হবে।”
বিধাতার বিধানে, নারীর পেটে কখনই কোন কথা বেশীক্ষণ লুকোনো থাকে না। কি একটা কথা বলিবার জন্য, জুমেলি খুবই ব্যাকুল। অথচ তার মনে একটা ভয়ও ছিল, যে পাছে আনারউন্নিসা সে কথা শুনিলে মনে কষ্ট পান। জিহ্বাকে সংযত করিতে না পারায়, সে যে একটা মহা ভুল করিয়া বসিয়াছে, আনারের মুখের মলিন ও গম্ভীর ভাব দেখিয়াই সে তাহা বুঝিয়া লইল। এজন্য সে কথাটা উড়াইয়া দিবার জন্য বলিল—“তোমার কেমন একটা একগুঁয়ে স্বভাব—যে খুব একটা ছোট কথা,তোমার কাণে উঠলে সেটা আর সহজে ভুলতে চাও না। বলি যে কথাটা শুনলে তোমার কোন লাভ নেই, তার জন্য এত পীড়াপীড়ি কেন?”
আনারউন্নিসা কোনমতেই তাহার নির্ব্বন্ধ ত্যাগ করিল না দেখিয়া, জুমেলি প্রকারান্তরে বলিয়া ফেলিল—সে যেন নবাব সাহেবের মুখে গতরাত্রে সেরাজির গন্ধ পাইয়াছিল!
কথাটা শুনিবামাত্রই, আনারউন্নিসার হৃদয়ে কাল মেঘের সঞ্চার হইল। সন্দেহের বাতাসে খুব জোরে পরিচালিত হইয়া, সেই খণ্ড মেঘগুলি একত্র জমায়েৎ হইয়া, যেন একটা মহাঝড়ের সূচনা করিল।
স্বামীর চেয়ে রমণীর পক্ষে বিশ্বাসের পাত্র এ দুনিয়ায় আর কেউ তো নাই। কিন্তু স্বামীর প্রতি, তাঁহার কার্য্যের প্রতি, যেখানে একবার সন্দেহ আসিয়া জুটে, সে সন্দেহের কঠিন পাশ ছিন্ন করা, অনেক রমণীর পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়ে। সে দিন মধ্যাহ্নে বাহারবানুর যে ঘটনাটা আনারের চোখের উপর ঘটিয়া গেল—তাহার কষ্টকর স্মৃতি, এখনও তাহার চিত্তপট হইতে অপসারিত হয় নাই। এখন সুযোগ পাইয়া, পূর্ব্ব সঞ্চিত সেই সন্দেহান্ধকারটা আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিল।
সুতরাং আনারউন্নিসা মনে মনে একটা সহজ সিদ্ধান্ত করিয়া লইল,যে শাহজাদার সহিত কাজ থাকার অছিলাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা! নবাবের আদরিণী বাহারবানু, কাল আমার কাছে খুবই অপমানিত হইয়াছিল। তাহার মান ভাঙ্গিবার জন্য, তিনি নিশ্চয়ই আরামবাগে গিয়াছিলেন। আর সেইখানেই আনন্দে উল্লাসে আর সেরাজি পানে, নবাব সাহেবের অর্দ্ধেক রাত্রি কাটিয়া গিয়াছে যে সেরাজি ব্যবহার করিব না বলিয়া, তিনি তাহার অঙ্গস্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন— তাঁহার সে প্রতিজ্ঞা, গত রজনীতে এই স্বৈরিণীর মোহকরী ছলনার শক্তিতে খুবই শিথিল হইয়া পড়িয়াছে।
এইরূপ একটা বিকৃত সিদ্ধান্ত করিয়া, অভিমানিনী আনারউন্নিসা, স্বামীর উপর বড়ই ক্রুদ্ধা হইল। একটী রাত্রের অদর্শনজনিত একটা আকুল দর্শনাকাঙ্ক্ষা, তাহার হৃদয়ে পোষণ করিয়া সে নবারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। কিন্তু জুমেলির মুখে এই সব কথা শুনিয়া, সে নিজের কক্ষে ফিরিয়া গেল।
আর জুমেলি? সে আনারউন্নিসার মুখে একটা অতি অপ্রসন্ন ও মহাবিরক্তির ভাব দেখিয়া বুঝিল, তাহার অসাবধানতার ফলে নবাব-বেগম আনারউন্নিসা, মনে বড়ই একটা কষ্ট অনুভব করিয়াছেন! সে ভাবিল—কথাটা বলিয়া সে খুবই অন্যায় করিয়াছে।
সে আনারের স্বভাব জানিত। সুতরাং এ সময়ে তাহাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা বলিয়া ঠাণ্ডা করার চেষ্টা নিস্ফল হইবে ভাবিয়া, সে আপনার কাজে চলিয়া গেল।
নির্জ্জন কক্ষ মধ্যে বসিয়া, আনারউন্নিসা নিজের চিন্তায় বিভোরা। সে মনে মনে ভাবিতেছিল—“দাস দাসী, বাদা বান্দা, এল্বাব পোষাক, হীরা মতি ও জড়োয়ার অলঙ্কারই কি রমণী জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ? হীনচরিত্র কলুষিত স্বভাব স্বামীর পত্নী হওয়ার কি এত বেশী মর্ম্ম জ্বালা?”
“নবাব সুজা খাঁর গুপ্ত জীবনের সব কথাই তো সে শুনিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার সহিত বিবাহের পর হইতে সে যে তাঁহার কলঙ্ক মাখা অতীত জীবনের সকল কথাই ভুলিয়া আসিতেছিল! সুখ সৌভাগ্যের উজ্জ্বল রশ্মি-গ্লাবিত, বর্ত্তমানকে লইয়াই যে সে এই বিশাল প্রাসাদতুল্য অট্টালিকার মধ্যে, এক নূতন বেহেস্তের সৃষ্টি করিবার চেষ্টা করিতেছিল! সে যে ভাবিয়াছিল,—তাহার জীবনের নিশিদিন গুলি, সুখ স্বপ্নমাখা সঙ্গীতে বিভোর হইয়া থাকিবে। হায়! তবে কেন তাহার সুখময় জীবন স্রোতে এ শোচনীয় পরিবর্ত্তন ঘটিল?”
আনার যখন এইরূপ হৃদয় বিপ্লবকারী চিন্তায় মূহ্যমানা, সেই সময়ে নবাব সুজা বেগ, তাঁহার পত্নীর কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন—“আনারউন্নিসা! তুমি এখন কেমন আছ?”
অবনতমুখে আনার নিজের চিন্তাতেই বিভোরা ছিল। সহসা স্বামীর কণ্ঠস্বরে তাহার অর্দ্ধলুপ্ত চেতনা, যেন জাগরণের সীমায় ফিরিয়া আসিল। নবাব সুজা বেগ, যে তাহাকে এইমাত্র একটা কি প্রশ্ন করিলেন— তাহা সে ভালরূপ বুঝিতে পারে নাই। এইজন্য বিস্ময় বিহ্বল চিত্তে একবার মাত্র স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া, সে আবার মুখ অবনত করিল।
নবাব সুজা বেগ, আনার চরিত্রের বৈচিত্রতা কি—এই কয় মাস ব্যাপী দাম্পত্য— জীবনেই ভালরূপ বুঝিয়া লইয়াছিলেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত দ্বারা তিনি বুঝিলেন—“কাল রাত্রে আনারের সহিত দেখা না করায়, সে দারুণ অভিমানিনী হইয়াছে। তাই কথা কহিতেছে না।”
তিনি পার্শ্বে বসিয়া, পত্নীর এলায়িত কুঞ্চিত কেশগুলি লইয়া নাড়া চাড়া করিতে লাগিলেন। আনার বলিল,— “আমার এমন কি হইয়াছে—যাহার জন্য তুমি এতটা ব্যাকুলভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া আছ?”
সুজা খঁ। বলিলেন—“কাল রাত্রে জুমেলির মুখে শুনিয়াছিলাম তোমার তবিয়ৎ ভাল ছিল না। তাই জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম।”
আনার। যদি আমার উপর তোমার এতই টান, তাহা লে অসুখের কথাটা শুনিবার পর একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া আমার কক্ষে প্রবেশ করিলেই, হয়তো অসুখের সংবাদটা কাল রাত্রেই পাইতে।
নবাব সুজা বেগ বুঝিলেন—কথাগুলিতে দারুণ অভিমান ফুটিয়া উঠিয়াছে। এজন্য আনারের হাতখানি তাঁহার কোলের উপর তুলিয়া লইয়া, তাহার উপর মৃদুভাবে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন—“অবশ্য সেটা করা আমার উচিত ছিল বটে। কিন্তু আমার মনের অবস্থা নানা কারণে কাল একটুও ভাল ছিল না। আর বড়ই শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম বলিয়া, তোমায় আর ত্যক্ত করি নাই।
আনার। কেন? সহসা তোমার এ মনের অসুখের কারণ কি? আমার বলিতে কোন বাধা আছে কি?
সুজা। তুমি এখন তাহা নাই বা শুনিলে আনারউন্নিসা?
আনার। আমি তোমার ধর্ম্ম-পরিণীতা পত্নী। তোমার সুখ দুঃখের সমান অংশভাগিনী। তোমার যাহাতে মনের অসুখ ঘটিয়াছে, তাহা শুনিলে হয়তঃ আমার সাধ্যমতে তাহার প্রতিকারের কোন না কোন চেষ্টা করিতে পারি।
সুজা। না—আমার এ আগন্তুক মহাদুঃখের প্রতিকারের কোন ক্ষমতাই তোমার নাই। এ দুঃখ—বিধাতা প্রেরিত। এক খোদা ভিন্ন, এ সময়ে কেহই আমার প্রাণে শান্তি দিতে পারেন না। কি বিপদে যে আমি পড়িয়াছি,তাহা যদি কখনও তোমাকে বলিবার প্রয়োজন হয়, জানিও স্বেচ্ছায় আমি তাহা করিব। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যাহা অনেক সময় কোমল হৃদয়া পত্নীর নিকট ব্যক্ত করাও সুবুদ্ধির কাজ নয়।”
সত্য সত্যই অতীত রজনীর সেই ব্যাপারটা, সেই রক্তবর্ণ গুপ্ত কক্ষের স্মৃতি,সুজাবেগের মনে বড়ই একটা দুর্ন্নিমিত্তের ছায়া আনিয়াছিল। যাহা কিছু সেখানে হইয়া গেল, সবই যেন স্বপ্নের মত। তিনি সুলতান দারার তরবারি ও মুকুট স্পর্শ করিয়া এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিয়াছেন। ষে উপায়ে হৌক, এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁহাকে চারি লক্ষ টাকা শাহজাদার হাতে তুলিয়া দিতেই হইবে। দিলে—ঘোর দারিদ্র, আর না দিলে অপমান—লাঞ্ছনা কিম্বা দারার গুপ্ত ঘাতকের হস্তে শোচনীয় মৃত্যু! অথচ এ ভয়ানক গুপ্ত কথা কাহারও নিকট মুখ ফুটিয়া বলিবার বা কোন পরামর্শ জিজ্ঞাসার উপায় নাই! বিশ্বাসভাজন অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু, কিম্বা একাত্মহৃদয়া স্নেহময়ী পত্নী, কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া এই ভয়ানক কথা বলিতে সাহসে কুলায় না। এ সাংঘাতিক ব্যাপারের কথা বাহিরে ব্যক্ত হইলেই, যাহা দ্বারা হইয়াছে, তাহার শোচনীয় মৃত্যু ভীষণ নির্য্যাতন, অতি নিশ্চিত—অব্যর্থ।
ধরিতে গেলে, নবাব সুজা খাঁ প্রকারান্তরে তাঁহার পত্নীর নিকট সত্য কথাই বলিয়াছিলেন। কিন্তু সন্দেহ জিনিষটা বড়ই ভয়ানক। বাহারবানুর ব্যাপারে, আনারের মনে একটা দারুণ সন্দেহ জাগিয়া উঠিয়াছে। এই সন্দেহ বশেই অভাগিনী আনারউন্নিসা মনে মনে ভাবিয়া লইল—এটা বাহারবানু সম্পর্কীয় ব্যাপার না হইয়াই যায় না। নবাব ইচ্ছা করিয়াই তাহার নিকট প্রকৃত কথা গোপন করিতেছেন।
নবাব সুজা বেগ কিয়ৎক্ষণ নির্ব্বাক অবস্থায় পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন—“আনার! আজ হইতে দুই চারি দিন তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে না। আমি সরকারী প্রয়োজনে, এখনই আজমীর যাইতেছি। ফিরিতে দুই চারি দিন বিলম্ব হইতে পারে। খুব সাবধানে থাকিবে তুমি—এই কথা জানাইয়া তোমার নিকট বিদায় লইতেই আমি আসিয়াছিলাম।” আর কোন কিছু না বলিয়া, বা তাঁহার পত্নীকে কোন প্রশ্ন করিবার অবসর না দিয়াই, নবাব সুজা বেগ সহসা সেই কক্ষ ত্যাগ করিলেন।
দুষ্টবুদ্ধিচালিতা আনারউন্নিসা ভাবিল—“পাছে জেরার মুখে প্রকৃত কথা বাহির হইয়া পড়ে, এইজন্যই নবাব সাহেব একটা অছিলা করিয়া, তাঁহার নিকট হইতে তাড়াতাড়ি চলিয়া গেলেন।”
সে অস্ফুট স্বরে কেবলমাত্র বলিল—“হায়! এই কি জীবনের সুখ! পতির অনুরাগিণী পত্নী হইয়াও যখন তাঁহার একান্ত বিশ্বাসের পাত্রী হইতে পারিলাম না, তখন আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ।”