দেওয়ানা/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম পরিচ্ছেদ
আগরা সহরের এক রাজপ্রাসাদ তুল্য ভবনের কক্ষগুলি, আজ খুবই আলোকমালা সমুজ্জ্বল। এই প্রাসাদের অধিকারী, নবাব উল্মুলুক সুজা আলি বেগ। নবাব সুজা আলি বেগ, সম্রাট শাহজাহানের খাস মুকিম বা রত্নবণিক। অনেক টাকার মালিক তিনি। লোকে অনুমান করে, তিনি ক্রোরপতি। তাঁহার বাড়ী ঘরের সাজ সজ্জা, চাকর বাকর, বান্দা বাঁদীর সংখ্যাধিক্য ও যান বাহন দেখিলে, এই ঐশ্বর্য্যের কথা সত্য বলিয়াই বোধ হয়। “নবাব উল্ মুলুক” উপাধিটা সুজা আলি বেগের বংশগত। তিন পুরুষে তাঁহারা এই বাদশাহী উপাধি ভোগ করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার পিতামহ আকবর শাহের অতি সংকট সময়ে, প্রচুর ধনরত্নাদি দ্বারা তাঁহার সাহায্য করায়, তিনি সুজা আলির পিতামহকে “নবাব” উপাধি, জায়গীর ও শিরোপা দান করেন।
তাঁহার পিতা নিজাম মালি বেগ, বাদশাহ জাগঙ্গীরের মুর্কিন বা বাদশাহী রত্নবণিক ছিলেন। এরূপ শোনা যায়, নুরজাহান বেগম তাঁহার বহুমূল্য রাজমুকুটের শোভা স্বরূপ অতি সমুজ্জ্বল যে হীরকখানি ব্যবহার করিতেন— তাহা এই মুকিম নিজাম আলির প্রদত্ত উপহার।
বৎসর দুই হইল · নিজাম আলির দেহ কবরস্থ হইয়াছে। সুজা আলিই এখন তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তি, কারবার ও উপাধির মালেক। বাদশাহের তিনি বড়ই পেয়ারের মুকিম।
এই উৎসবালোক সুজা আলির জন্ম দিনের। তাঁহার জননী এখন জীবিতা। সুতগং তাঁহার স্বামীর আমল হইতে যে উৎসবটা চলিয়া আসিতেছে. সুজার জননী রুকিনা বেগম, তাহা বন্ধ না করিয়া পূর্ব্বের মত সবই বজায় রাখিয়াছিলেন। কেন না—এই সুজাই তাঁহার একমাত্র পুত্র।
নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক নিকটস্থ আত্মীয় প্রতিবাসীগণই, এই উৎসব ব্যাপারে আমন্ত্রিত হইতেন। এই উৎসবের একটা বিশেষত্ব এই-—খানা পিনা, আমোদ, অংহ্লাদ, আদব আপ্যায়ন ছাড়া, প্রত্যেক সমাগত আত্মীয়কে, গৃহস্বামী এক একটী জহরত উপহার দিতেন। এই ব্যাপারটাই এই উৎসবের বৈচিত্রতা। হয়তঃ এই ব্যাপারে পঞ্চাশ ষাট ঘর আত্মীয় আমন্ত্রিত হইতেন। আর প্রত্যেক আমন্ত্রিত ব্যক্তিই—হয় একখানি নীলা, নয় পান্না, নয় পোখ্রাজ, নয় মোতি, না হয় হীরা, উপহার রূপে পাইতেন।
‘এ উপহার কাহারও অগ্রাহ্য করিবার যো ছিল না। কেন না -নিজাম আলির সময় হইতেই এই ভাবে উপহার দিবার প্রথা প্রচলিত। বাহাদুরীর মধ্যে এই— বিতরিত রত্নগুলির নামের ও বর্ণের পার্থক্য থাকিলেও, রতি হিসাবে তাহাদের ওজন আর মূল্য একই ছিল বলিয়া, আমন্ত্রিত বন্ধুগণের মধ্যে কাহারও মনক্ষোভ হইত না।
এইরূপ একটা উপহারের প্রথা প্রচলিত থাকায়, আত্মীরেরা নিমন্ত্রণে আসিবার পূর্ব্বেই, নিমন্ত্রণকারী নবাব গৃহে নানারূপ সওগাত পাঠাইয়া দিতেন। মোটের উপর ইহা একটা কৌলিক প্রথা বই আর কিছু নয়। আর লোকেও জানিত—সরকারী রত্নবণিক এই আলি সুজা বেগের রত্ন ভাণ্ডারে অগণ্য মণি মুক্তা সঞ্চিত। তাঁহাদের অবস্থা বুঝিয়া, তাঁহারা এরূপ দান করিতে কোন কষ্টই অনুভব করেন না।
রাত্রি দশটা বাজিবার পূর্ব্বে —বাড়ী প্রায় খালি হইয়া পড়িল। তখনও থাকিবার মধ্যে রহিলেন— দুই চারি জন আত্মীয়, যাঁহারা রক্তসম্পর্কে খুব অন্তরঙ্গ।
কিন্তু ইহাদের মধ্যে এক সুরূপা যুবতীর দিকে আমাদের একটু দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কেন না, তাঁহার সঙ্গেই এই গল্পের সম্বন্ধ খুব বেশী।
এই নিমন্ত্রিতা নবীনা যুবতীর নাম আনারউন্নিসা। আনার পরমা রূপবতী। সুজা আলিবেগের বহু দিনের প্রতিবাসী। আর তাঁহার মাতা রুকিনা বেগমের সহিত এই যুবতীর পিতা জামাল খাঁর কি একটা আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। কাজেই উভয় পরিবারের মধ্যে মাখামাখি ভাবটা একটু জমাট ছিল।
সেই প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকার একটী নির্জ্জন কক্ষে বসিয়া আনার উন্নিসা ও সুজা আলি বেগ নির্জ্জনে কথোপকথন করিতেছিলেন।
কক্ষটী সুগন্ধি দীপে আলোকিত। তীব্র আলোকছটা সুরূপা আনারের মুখের উপর পড়িয়াছে। তাহার সাঁচ্চা কাজ করা ফিরোজা রঙ্গের সুন্দর ওড়না খানির উপর দীপচ্ছটা পড়ায় স্বভাব সুন্দরী এই আনারকে যে সৌন্দর্য্য দিয়া সাজাইয়াছেন, তাহা যেন আরও সমুজ্জ্বল হইয়াছে।
সুজা বেগ সহাস্য মুখে বলিল— “আনার উন্নিসা! আজ তোমাদের অনর্থক কষ্ট দিলাম।”
আনার সহাস্য মুখে বলল—“এত আপ্যায়ন ও যত্নে যদি কষ্ট হয়, এত তরিবতী খাওয়া দাওয়ানতে যদি অসুখের কারণ উপস্থিত হয়, তাহা হইলে সুজা সাহেব! এরূপ কষ্ট আমি কেন— অনেকেই স্বেচ্ছায় উপভোগ করিতে চাহিবে। যাক্—আজ আমরা বিদায় হই। আমার পিতা বোধ হয় রাত বেশী হইতেছে দেখিয়া, একটু উৎকণ্ঠিত হইতেছেন। কারণ সকাল সকাল শয্যা আশ্রয় করাই তাঁর নিয়ম”
সুজা বেগ একটু অপ্রতিভ ভাবে বলিলেন—“হয়তো তাই! যাই হক আনার! এতক্ষণ যখন অপেক্ষা করিয়াছ, তখন আরও একটু অপেক্ষা কর।”
আনারের কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই, সুজা বেগ তখনই সেই কক্ষ ত্যাগ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মখমলমণ্ডিত কারুকার্যময় একটী সুন্দর বাক্স আনিয়া, তাহার উপরের ডালাটী খুলিয়া স্মিতমুখে আনারের সম্মুখে ধরিলেন।
কক্ষ মধ্যস্থ দীপাবলির উজ্জ্বল আলো সেই বাক্সের ভিতরের জিনিসটীর উপর পড়ায়, সেটা আরও চকচক্ করিতে লাগিল। আনার সবিস্ময়ে বলিল—“বা! বেশ সুন্দর জড়োয়া হার ত? আমার বোধ হয় এর হীরাগুলি খুবই দামী।”
সুজাবেগ সহাস্য মুখে বলিলেন—“এই হারের মূল্য দশ হাজার টাকা।”
“দ—শ-হা—জা—র-টা-কা!!” এই বলিয়া বিস্মিত নেত্রে সেই হার ছড়াটী তুলিয়া লইয়া তাহা দুই একবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া, একটা তৃপ্তির সহিত আনার বলিল—“বেশ কিম্মতিয়া হার ছড়াটী ত! যে পরবে, সে যদি খুব সুন্দরী হয়, তাহা হইলে এই হার ছড়াটী তাহাকে বড়ই মানাইবে।”
সুজা আলি বেগ রহস্য করিয়া সহাস্য মুখে বলিলেন—“আচ্ছা সে যদি তোমার মত অতুলনীয়া রূপসী হয়, তবে এই হারের জ্যোতিঃ হয় তো তাহার উজ্জ্বল রূপের কাছে খুবই মলিন হইয়া পড়িবে।”
আত্মরূপের এইরূপ প্রশংসায় আনারের সুন্দর মুখখানি লাল হইয়া উঠিল। সে—এ মন্তব্যের কোন উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। কেবল মাত্র—একটু মৃদু হাসিয়া সুজা বেগের কথায় একটা নীরব উত্তর দিল মাত্র।
হার ছড়াটী সুজা বেগের হাতে দিয়া আনার বলিল, “তাহা হইলে আজ বিদায় দিন। রাত অনেক হইয়াছে।”
সুজা বেগ হাস্য মুখে বলিলেন—“তোমাকে আর দেরী করিতে বলিতে পারি না। কিন্তু আনার! যাইবার পূর্ব্বে আমার একটা অনুরোধ রক্ষা করিতে হইবে।”
আনার প্রফুল্ল মুখে বলিল— “কি অনুরোধ নবাবজাদা? এক পেয়ালা আঙ্গুরের মিঠি সরবৎ?”
সুজাবেগ বলিল—“সেটা ত বিদায়ী অভিবাদন! আমার অতি স্পৃহনীয় অনুরোধ হইতেছে এই—যে এই হার ছড়াটা আমি তোমাকে পরাইয়া দিব।”
হাস্যমুখী আনারের মুখ খানা এই কথা শুনিয়া, সহসা যেন মেঘ ঢাকা চাঁদের মত মলিন হইয়া গেল। কিন্তু সে তখনই সপ্রতিভ ভাবে বলিল— “আমি এ রত্নহারের যোগ্যা নেই ত নবাব সাহেব! আর ইহা গ্রহণ করিবার কোন দাবিই—বোধ হয় আমার নাই নবাবজাদা!”
সহসা এই সময়ে এক প্রৌঢ়া রমণী, সেই কঙ্ক মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন—“আছে বই কি মা! তোমার খুবই অধিকার আছে। এ হারটী আমি তোমাকে আমার সুজার জন্মদিনের উপহার রূপে দিব বলিয়া, নিজেই নির্ব্বাচিত করিয়াছি। ইহা তোমাকে লইতেই হইবে। নচেৎ আমি খুবই দুঃখিত হইব।”
এই প্রৌঢ়া রমণী রুকিনা বেগম। হুজা আলির গর্ভধারিণী।
কথাটা বলিবার সময রুকিনা বিবির মুখে এমন একটা নির্ব্বন্ধের ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছিল— যাহা সুচতুরা আনার অতি সহজেই পড়িয়া লইল। এতটা স্নেহ মিশ্রিত স্বরে, রুকিনা বিবি এ কথাগুলি বলিয়াছিলেন—যে আনার উন্নিসা তাহার কোন প্রতিবাদই করিতে পারিল না। তবুও সে অতি কোমল স্বরে বলিল—“আমি কি এ বহুমূল্য হারের যোগ্য মা!”
রুকিনা সহাস্য মুখে বলিলেন—“তুমি এই অপূর্ব্ব উপহারের যোগ্যা কি না, সে কথা বিচার করিবার তুমি কে আনার উন্নিসা? আমার ইচ্ছা হইয়াছিল— কাজেই আমি বহুমূল্য রত্নহার ছড়াটী তোমার জন্য বাছিয়া রাখিয়া আমার সুজার নিকট দিয়াছিলাম। আজ তুমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আমার বাটীতে আসিয়াছ—কিন্তু সত্য বলিতে কি, তোমার রূপের জ্যোতিঃতে আমার ঘর যেন আলো হইয়া উঠিয়াছে। আরও ত অনেক সুন্দরী রূপসী আসিয়াছিল— আনার উন্নিসা! কিন্তু তোমার মত এমন অতুলনীয় রূপসী ত তাদের মধ্যে কেহই ছিল না। আমি তোমার মা! মায়ের দান গ্রহণ কর। এ দান—এ স্মৃতি চিহ্ণ—সুজার প্রদত্ত নয়— আমারই স্নেহের উপহার।”
এতটা সরল ভাবে, প্রাণের উচ্ছ্বাসের সহিত রুকিনা বিবি এই কথা গুলি বলিলেন— যে আনার উন্নিসা তখনই তাঁহার নিকটে অবনত মস্তকে দাঁড়াইল। আর রুকিনা বেগম সেই বহুমূল্য হারছড়াটা আনারের গলায় পরাইয়া দিয়া বলিলেন, “তোমার পিতা পার্শ্বের কক্ষে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। এখন তুমি যাইতে পার।”
রুকিনা বেগম, আনারের চিবুকখানি ধরিয়া আদর করিয়া বলিলেন—“যদি আমার সুজার বৌ করিতে হয়, তোমার মতই সুন্দরী বৌ করিব।” এই কথা বলিয়া হাসিভরা মুখে—রুকিনা বিবি, অপর কক্ষ মধ্যেস্থিত তাঁহার অন্যান্য আত্মীয়াদের নিকট চলিয়া গেলেন।
বলা বাহুল্য—সুজা বেগ্ আনারকে তাহার পিতার নিকট পৌছাইয়া দিলেন। এমন কি দ্বার পর্য্যন্ত আসিয়া, তাহাকে ও তাহার পিতাকে আপ্যায়িত করিয়া, গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া গেলেন।
আনারের পিতা—দেখিলেন চিরদর্পিত, ঐশ্বর্য্যাতিমানী নূতন নবাব এবার যেন তাঁহাকে একটু বেশী খাতির যত্ন দেখাইতেছেন। আরও দুই তিনবার তিনি এই নবাব পরিবারের এই প্রকার বাৎসরিক নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলেন। খাতির যত্ন হইয়াছিল খুব। কিন্তু এবার যেন—আপ্যায়নের মাত্রাটী ষোলোর উপর আঠারো আনায় আসিয়া পৌছিয়াছে।
বলা বাহুলা-আনার তাহার কণ্ঠের সেই রত্নহার ছড়াটী তাহার ওড়না দিয়া ঢাকিয়া ফেলাতেই, আনারের পিতা জামাল খাঁ, এ রত্নহার সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারেন নাই। জানিলে বোধ হয় তিনিও তাঁর কন্যার ন্যায় আরও বিস্মিত হইতেন।