দেওয়ানা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 এই হার ছড়াটী যার দাম দশ হাজার টাকা, আর যাহা সুজা বেগের জন্মতিথির উপহার রূপে আনারউন্নিসা স্বপ্নে প্রাপ্ত দুর্ল্লভ রত্নের মত লাভ করিয়াছিল, তাহা সংসার জ্ঞান অনভিজ্ঞা সরলা আনারের মনে, আনন্দের পরিবর্ত্তে কতকগুলা দুশ্চিন্তার সঞ্চার করিয়া দিল। কেন তাহা সেই বলিতে পারে।

 তাহাদের অবস্থা তখন তত ভাল নয়। এখন অবশ্য তাহারা ভাগ্য পরিবর্ত্তনের স্রোতে ভাসিতেছে। কিন্তু তাহা হইলেও এক সময়ে তাহাদের অবস্থা খুবই উন্নত ছিল। অবশ্য সুজা বেগের ঐশ্বর্যের সহিত প্রতিদ্বন্দিতা করিবার মত, তাহার পৈত্রিক ঐশ্বর্য্য ছিল না বটে, কিন্তু যাহা ছিল— তাহা তাহার কতকটা কাছাকাছি ছিল বটে।

 অন্যান্য নিমন্ত্রিতগণ, এই নবাব সুজাবেগের কৌলিক প্রথামত এ বারেও এক একটী রত্নাঙ্গুরীয় লাভ করিয়াছেন। কিন্তু তাহার বেলায় কেন যে এই রাজরাণির ভোগ্য, বহুমূল্য রত্নহারের ব্যবস্থা হইল, তাহা অনেক দিক দিয়া ভাবিয়াও আনার উন্নিসা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিল না।

 পূর্ব্বরাত্রে তাহার পিতাকে সে এই বহুমূল্য রত্নহারের কথা কিছুই বলে নাই। কেন—তাহা সেই জানে। কিন্তু সমস্ত রজনী ব্যাপী চিন্তার পর সে বুঝিয়াছে, এ সংবাদটী তাহার পিতাকে জানানো—খুবই প্রয়োজন।

 প্রভাতে উঠিয়া সে সেই সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিল। এমন সময়ে তাহার পিতা আসিয়া তাহার কক্ষে দেখা দিলেন।

 আনারকে সম্বোধন করিয়া তাঁহার পিতা বলিলেন—“তোমার মুখ অত শুখ‍্নো কেন মা? তোমার কাল রাত্রে কি ভাল নিদ্রা হয় নাই?”

 আনারউন্নিসা একটু মলিন হাস্যের সহিত বলিল—“সত্যই বাবা তাই! কাল আমার নিদ্রার বড়ই ব্যাঘাত হইয়াছিল।”

 “কেন?”

 “এক রত্নহারের জন্য?”

 “রত্নহারের জন্য! আমাদের বাড়ীতে এক সময়ে রত্নহার দু দশ ছ’ড়া ছিল বটে! তখন ভাবনাও ছিল বটে। কিন্তু এখন ত সে গুলি নাই! তবে কি তুমি স্বপ্নে রত্নহার দেখিলে নাকি?

 “স্বপ্ন নয় বাবা! প্রত্যক্ষ সত্য! সে রত্নহার আপনাকে এখনই আনিয়া দেখাইতেছি!”

 “আগে বল—কোথায় পাইলে তুমি সেই হার?”

 “নবাব সুজা খাঁ দিয়াছেন।”

 “তেমাকে?”

 “হাঁ—আমাকে?”

 কথাটা শুনিয়া বয়োবৃদ্ধ জামাল খাঁ, ভ্রুকুটী ভঙ্গী করিযা সন্দিগ্ধস্বরে বলিলেন—“কারণ?”

 আনারউন্নিসা গম্ভীর মুখে বলিল “কারণ—কিছুই জানি না। তবে সুজার জননী রুকিনা বিবি বলিলেন— আমার পুত্রের জন্মোৎসবের স্মৃতিচিহ্ণ স্বরূপ, তিনি আমায় এই বহুমূল্য উপহার দিয়াছেন।”

 জামাল খাঁ—বিস্মিত চিত্তে বলিলেন—“কোথায় সে রত্নহার?”

 আনার উন্নিসা তাহার পেটিকা মধ্য হইতে সেই হার বাহির করিয়া, তাহার পিতার সম্মুখে ধরিল।

 রত্ন বিচারে বৃদ্ধ জামাল খাঁর একটা পূর্ব্ব সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি দুই চারি বার সেই হার ছড়াটী নাড়াচাড়া করিবার পর বুঝিলেন—সত্যই সে হারের খুব কিম্মত আছে।

 কন্যার মত, জামাল খাঁও এই বহুমূল্য উপহারের ভিতরের রহস্যটী বুঝিতে না পারিয়া, একটু চিন্তান্বিত হইলেন। কিন্তু তখন তাঁহার সে চিন্তা চাপিয়া রাখিয়া তিনি বলিলেন—“ভালই হইয়াছে! কখন যে কাহার উপর খোদার সুনজর পড়ে, তাহা বোঝা বড়ই কঠিন! তাহা না হইলে, অন্যান্য নিমন্ত্রিতেরা যে উৎসব স্থলে একটী করিয়া অঙ্গুরীয় উপহার পাইয়াছে, সে স্থলে তোমার সম্বন্ধেই বা এরূপ স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ঘটিল কেন? এ দান অবশ্য রুকিনা বিবির হাত দিয়া আসিয়াছে। কিন্তু প্রকৃত দাতা—সেই মহিমময় বিধাতা।”

 আনার, স্থিরচিত্তে তাহার পিতার এই কথাগুলি শুনিল। সেও তাহার পিতার মত এই রত্নহারের কথাই তখন মনেমনে আলোচনা করিতেছিল। আনার তাহার পিতাকে সহসা সেই কক্ষ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত দেখিয়া বলিল—“বাবা! আমি একটা কথা মনে মনে এতক্ষণ ভাবিতেছিলাম। যদি কন্যার বেয়াদবী বলিয়া না ভাবেন, তাহা হইলে সেটি আপনাকে গুনাইতে ইচ্ছা করি। মা—মরিবার পর হইতে কোন কথাই আমি আপনার কাছে গোপন করি না। মনে যখন যা উদয় হয়, আপনাকেই বলি।”

 কন্যার মুখে এইরূপ লম্বা ভূমিকা শুনিয়া, বৃদ্ধ জামাল খাঁ তাঁহার হেনারঞ্জিত পীতবর্ণের পক্ক শ্মশ্রু রাজির মধ্যে অঙ্গুলি প্রবেশ করাইয়া দিয়া—তাহা চিত্তাপূর্ণ ভাবে মোচড়াইতে মোচ্ড়াইতে বলিলেন—“কি কথা তুমি আমাকে বলিতে চাও আনার? তোমার স্নেহময়ী মাতার মৃত্যুর পর হইতে, আমার নিকট তোমার মনোভাব প্রকাশ করার সম্বন্ধে আমি যে তোমায় পূর্ণ স্বাধীনতাই দিয়াছি। কখনও ত তোমার এ অধিকারের সংকোচ করি নাই— ও ভবিষ্যতেও করিবও না।”

 পিতার কথায় একটু সাহস পাইয়া, আনার উন্নিসা মেঝের দিকে তাহার দৃষ্টিসংযত করিয়া বলিল—“আমি বলি কি,এই হার নবাবজাদাকে ফিরাইয়া দিই। যে রত্নহার আমাদের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া আপনার ও আমার মনে দারুণ দুশ্চিন্তা সঞ্চার করাইয়া দিয়াছে, তাহা আলোয় আলোয় বিদায় করাই ভাল।”

 জামাল খাঁ কন্যার কথা শুনিয়া, একটু বিরক্তির সহিত বলিলেন—“ছিঃ। ও কাজ করিতে আছে মা! ইহাতে রুকিনা বিবির মনে খুবই একটা কষ্ট বোধ হইবে। খালি কষ্ট নয় আনারউন্নিসা, তিনি ইহাতে নিশ্চয়ই অপমানিতা বোধ করিবেন। তার চেয়ে এক কাজ কর তুমি। চিরদিন অবশ্য আমাদের এ অবস্থা থাকিবে না। একদিন এর পর যদি ভাল অবস্থা আসে, তখন এইরূপ একটা কিম্মতিয়া উপহার নবাব সুজা বেগকে পাঠাইয়া দিলেই, হয়ত আমার ও তোমার মনটা এ রহস্যময় দানের সম্বন্ধে খুবই হাল্কা হইয়া যাইবে।”

 জামাল খাঁ আর কিছু না বলিয়া, সেই কক্ষ ত্যাগ করিলেন। সেই কক্ষ মধ্যে রহিল কেবল আনারউন্নিসা।