দেওয়ানা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
আনার উন্নিসার এক পেয়ারের বাঁদী ছিল। সে যুবতী, সদা প্রফুল্লমুখী ও আনারের সমবয়সী। আবাল্য তাহার সহিত একত্রে প্রতিপালিতা, তাহার সুখে দুখে সমবেদনা পরিপূর্ণা। তাহার নাম জুমেলি।
জামাল খাঁ কক্ষ ত্যাগ করিলে, জুমেলি হাস্যমুখে সেই মধ্যে প্রবেশ করিয়া আনারের হাতে একখানি পত্র দিয়া বলিল—“আবার বোধ হয় নবাব বাড়ীতে নিমন্ত্রণ! আবার বোধ হয় আর একছড়া রত্নহার।”
এই জুমেলি, আনারের সঙ্গে এক কক্ষে এক শয্যায় শয়ন করিত। জুমেলির মা—আনারের বাল্যকালের দাই। এজন্য মার মৃত্যুর পর জুমেলি এ সংসারের একরূপ কর্ত্রী হইয়া উঠিয়াছে। আনারউন্নিসা তাহার সঙ্গিনী ও সখী। এই জুমেলীকে ষোল ছাপাইয়া বোধ হয় আঠারো আনা বিশ্বাস এই আনারউন্নিসা করিত।
আনার উন্নিসা জুমেলিয়ার এই রহস্যময় কথায় একটু কৃত্রিম বিরক্তির সহিত বলিল, —“আ মর্! ছুঁড়ি রঙ্গ রাখ্। কার— এ পত্র? কে তোকে এ পত্র দিল?”
জুমেলি গালি খাইয়া হঠিল না। বলিল—“নসীব তোমাকে যে খানে একদিন টানিয়া লইয়া গিয়া, রাণীর সিংহাসনে বসাইবে,—এ পত্রখানি হয়ত সেখান হইতেই আসিয়াছে।”
আনার উন্নিসা জুমেলির দিকে চাহিয়া কোমল স্বরে বলিল “হেঁয়ালি ছাড়িয়া দে। সোজা কথায় বল —কোথায় এ পত্র পাইলি?”
জুমেলি এবার বলিল— “সুজাবেগের খাস বাঁদী এ পত্র আনিয়াছে। পড়িয়াই দেখনা কেন। সব জানিতে পারিবে।”
একটু বিস্মিতভাবে আনার সেই পত্রখানি খুলিয়া পড়িল। তাহাতে লেখা ছিল,—“আনার উন্নিসা! এ জগতে মানুষের সকল কামনা তো পূর্ণ হয় না। বিধাতা আমায় প্রচুর ঐশ্বর্য্য দিয়াছেন —সমাজে যথেষ্ট সম্মান দিয়াছেন। বন্ধু বান্ধবেরও অংমার কোন অভাব নাই। রাজ-দরবারেও আমার খুব খাতির। এক অভাবে কিন্তু আমার সকল সুখ নষ্ট হইতেছে। আমি চাই তোমার মত এক রূপবতী, গুণবতী সহধর্ম্মিণী। আমার মাতাও তোমাকে তাঁহার পুত্র বধূ রূপে গ্রহণ করিতে খুবই উৎসুক। আমার বহু দিনের সুখস্বপ্ন এই, যে তুমি আমার অঙ্ক লক্ষ্মী হইবে। বড়ই সাধে ভরা, আশার মোড়া, এই সোনার স্বপনচী আমার। এ স্বপন তুমি চূর্ণ করিয়া দিও না। তোমার সম্মতি পাইলে প্রত্যক্ষভাবে তোমার পিতার নিকট তোমার হস্ত প্রার্থনা করিব। এই পত্রের অনুকুল উত্তর আমার হাতে আসিলে আমার মাতা নিজে তোমাদের বাড়ীতে গিয়া সমস্ত কথা ঠিক করিয়া আসিবেন।—“সুজাবেগ।”
জুমেলি অনুমানে কতকটা বুঝিয়াছিল, নবাব সুজা বেগের এই পত্রে সম্ভবতঃ কি লেখা থাকিতে পারে।
আর সে একথাও ভাবিতেছিল, হয়ত পত্রখানা পড়িয়া আনরের মুখটা খুবই প্রফুল্ল হইয়া উঠিবে। কেন না, সে কাণাঘুষায় একটা খবর শুনিয়াছিল, যে সুজাবেগের মাতা রুকিনা বিবি আনারকে তাঁহার গৃহলক্ষ্মী করিতে খুবই উৎসুক।
নবাব সুজা বেগের অতুল ঐশ্বর্যা। দেখিতেও তিনি কান্তিময়। মোগল রাজসরকারে তাহার খুবই প্রতিপত্তি। এই সুজা বেগের পত্নী হইলে, আনার রাজরাণীর মত আদরে থাকিবে, অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারিণী হইবে, তাহার নারী জন্মের সকল সাধ মিটিবে, এইরূপ সুখস্বপ্ন এক এক সময়ে তাহার অবসন্ন মনটাকে খুবই আলোকময় করিয়া তুলিত।
পূর্ব্বরাত্রে সুজা বেগ আনারকে যে বহুমূল্য কণ্ঠার উপহার দিয়াছিলেন, তাহা যে এই মিলনের পূর্ব্বরাগ—সুন্দরীশ্রেষ্ঠা আনারের হস্ত প্রার্থনার প্রথম অভিজ্ঞান, তাহাও সে ধরিয়া লইয়াছিল। কিন্তু যখন দেখিল, যে তাহার প্রিয় সখীর মুখখানা সুজা বেগের পত্র পড়িয়া হর্ষোৎফুল্ল না হইয়া, খুবই মলিন হইয়া গেল—তখন সে বড়ই ভাবিত হইল।
জুমেলি কিয়ৎক্ষণ তাহার সখীর মুখের দিকে স্থির ভাবে চাহিয়া থাকিয়া, সন্দিগ্ধ স্বরে বলিল— “তোমার মুখখানা অত মলিন হইয়া গেল কেন? তাহা হইলে পত্রে কি কোন দুঃসংবাদ আছে না কি?”
আনার বলিল— “অন্ততঃ অন্যের পক্ষে দুঃসংবাদ না হইতে পারে। কিন্তু আমার পক্ষে এই চিঠি খানা খুবই কুসংবাদ বহন করিয়া আনিয়াছে। পত্রখানা পড়িয়া দেখ না তুমি জুমেলি! তাহা হইলেই হয়ত সব কথা বুঝিতে পারিবে।”
জুমেলী পত্রখানি পড়িয়া বুঝিল—তাহাতে এমন কোন সাংঘাতিক বা অশুভ ঘটনার সংবাদ নাই, যাহা পড়িয়া আনারের মুখখানা মলিন হইয়া পড়িতে পারে। কিংবা একটা দুশ্চিন্তা আসিয়া, তাহার হৃদয়কে অন্ধকারময় করিয়া দিতে পারে।
পত্রখানি পড়িয়া ভালমন্দ কিছুই না বলিয়া, জুমেলি কেবল মাত্র বলিল,—“বিবাহ হইলে পিতার স্নেহময় ক্রোড় হইতে দূরে যাইতে হইবে, সেই জন্যই বোধ হয় তোমার মনটা খুবই চঞ্চল হইয়াছে। এ বিষয়ের সম্বন্ধে চুড়ান্ত মীমাংসা তোমার পিতার হাতে। তিনি যে হুকুম করিবেন, তাহা তোমাকে নিশ্চয়ই মানিয়া চলিতে হইবে।” আর বেশী কিছু না বলিয়া জুমেলি অন্য কাজে চলিয়া গেল।
আনার উন্নিসা বিষণ্ণমুখে তাহার পিতার কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার পিতা জামাল খাঁ তখন ব্যবসায় সম্বন্ধীয় কাগজ পত্র লইয়া খুবই অভিনিবিষ্ট চিত্ত।
জামাল খাঁ, কন্যাকে মলিন মুখে তাঁহার কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া, তাহাকে পাশে বসাইয়া বলিলেন,—“একি! তোমার মুখথানা অত শুক্নো কেন আনারউন্নিসা? কোন অসুখ করেছে কি তোমার?”
আনার প্রথমে নিজের ভিতরের চঞ্চল অবস্থাটা গোপন করিবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করিল। কিন্তু তাহা বোধ হয় পারিল না। তাহার প্রাণের মধ্যে যে একটা প্রবল ঝট্কা উঠিতেছিল, তাহা পিতার সহিত সাক্ষাতে যেন একটু বেশী জোর সঞ্চয় করিল। আর এটুকুও সে ভাবিল, হয়ত সে ধরা পড়িয়াছে। তবুও তাহার সেই অবস্থাটা সাধ্যমত গোপন করিবার জন্য, সে তাহার পিতার হাতে সুজা বেগের সেই পত্রখানি দিল।
জামাল খাঁ, মুহূর্ত্ত মধ্যে পত্রখানি পড়িয়া লইয়া, চিন্তিত মুখে বলিলেন—“আমিও এই মাত্র নবাব সুজাবেগের নিকট হইতে আর একখানা পত্র পাইয়া বুঝিতেছি, তোমাকে বিবাহ করিবার জন্য, সে খুবই বাগ্র। তোমায় লিখিয়াছে, যে তোমার সম্মতি পাইলে সে পরে আমার অভিমত প্রার্থনা করিবে। কিন্তু সে বিলম্বটুকুও বোধ হয় সহ্য করিতে না পারিয়া, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও এক পত্র লিখিয়াছে। এখন করা যায় কি আনার?
এ ভাবে তাহার নিকট সম্মতি প্রার্থনা করায়, পিতার উদ্দেশ্য কি তাহা বুঝিতে না পারিয়া আনারউন্নিসা বলিল, আপনি পিতা, আমি কন্যা। মা যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন,তাহা হইলে,অবশ্য এ বিষয়ে প্রকৃত পরামর্শ দিবার লোকের অভাব বোধ হয় আপনাকে ভোগ করিতে হইত না। আপনি আমাকে যে পাত্রে সমর্পণ করিবেন, তাঁহাকে আমি সমাজ ও ধর্ম্ম মতে স্বামীরূপে গ্রহণ করিব। কিন্তু—”
জামাল খাঁ বিস্ফারিত লোচনে আনারউন্নিসার মুখের দিকে চাহিয়া উৎসাহিত ভাবে বলিলেন,— “বল—বল—কি বলিতেছিলে? “কিন্তু” বলিয়া থামিয়া গেলে কেন মা?”
পিতার এই কথায় সাহস পাইয়া, আনার দৃঢ়স্বরে বলিল,“কিন্তু বাবা! মীর লতিফের কথাটা এত শীঘ্র ভুলিলেন কি করিয়া? যে তাহার বহুমূল্য শোণিতধারা দান করিয়া, একদিন আপনার জীবনাশা-বিহীন রুগ্ন কন্যাকে বাচাইয়াছিল, যে একদিন আপনার জলনিমজ্জিতা কন্যাকে আসন্নমৃত্যু হইতে রক্ষা করিয়া জীবনের সীমায় ফিরাইয়া আনিয়া দিয়াছিল,—যাহার কৃতপোকারে বাধ্য হইয়া, কৃতজ্ঞচিত্তে আপনি যাহাকে একদিন বলিয়াছিলেন—“এই আনারের উপর তোমার ষোল আনা অধিকার—কেন না দুই দুইবার তুমি এর জীবন বাঁচাইয়াছ।” আজ তাহার হাত হইতে সে অধিকার কাড়িয়া লইবেন কিরূপে পিতা? যে মীর-লতিফ্কে আপনি বাল্যকাল হইতে মানুষ করিয়াছেন, যে আপনার সন্তান তুল্য, তাহাকে ত্যাগ করিবেন কিরূপে?
কথাগুলি সম্পূর্ণ সত্য। একবার এই আনার উন্নিসার অতি কঠিন পীড়া হইয়াছিল। তাহার শরীরে তিলমাত্র রক্তকণা ছিল না। হকিম যখন বলিলেন,—“অন্য সুস্থদেহ হইতে শোণিত লইয়া এই রোগীর দেহে প্রবেশ না করাইলে এ বাঁচিবে না,— তখন এই মীর লতিফই যে প্রফুল্লমুখে, নির্ভীক হৃদয়ে, তাহার দক্ষিণ বাহু খানি প্রসারিত করিয়া দিয়া আসন্ন মৃত্যুকবলগত আনারের জীবন রক্ষা করিয়াছিল। আর ইহার অনেক পূর্ব্বে একদিন স্থানান্তরে কোন আত্মীয়গৃহে নিমন্ত্রণ যাইবার সময়ে, সহসা ঝড় উঠায় যমুনার স্রোেত যখন নৌকা উল্টাইয়া দিয়াছিল, তখন এই মীর লতিফই নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া আনারকে বুকে করিয়া তুলিয়া লইয়া, নদীর পর পারে পৌঁছিয়া দিয়া তাহার জীবন রক্ষা করে। অথচ তিনি পিতা হইয়াও আনারকে ত্যাগ করিয়া নিজের বিপন্ন জীবন রক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। আর এই ভীষণ ঘটনার ফলে এই লতিফ্ যখন একমাস কাল কঠিন রোগে শয্যায় আবদ্ধ হইয়াছিল, তখন তিনি নিজে ও তাঁহার কন্যা আনার উন্নিসা, দিন রাত খাটিয়া রোগীর সেবা শুশ্রূষা করিয়া, কত কষ্টে এই রোগীকে বাঁচান, তাঁহাও তাহার চোখের সম্মুখে যেন পূর্ব্ব দিবসের কোন ঘটনার মত ফুটিয়া উঠিল।
কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া কি ভাবিয়া, জামাল খাঁ তাঁহার কন্যা আনার উন্নিসাকে বলিলেন, “ভাল তোমার ও আমার পত্রের উত্তর আমিই দিব। এই বিবাহ প্রস্তাবের একটা সূক্ষ্ম মীমাংসার জন্য কিছুদিন সময় প্রার্থনা করিয়া আমিই আজ্কে সুজাবেগকে পত্র লিখিতেছি।”
পিতার কথায় আনার উন্নিসার প্রাণটা যেন খুব হাল্কা হইয়া গেল। নিজের কক্ষে প্রবেশ করিয়া, একটা অপরিমেয় আনন্দে সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, —“খোদা! বিশ্বপাতা! তোমার অপার মহিমা। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক প্রভু!”